বিদ্বেষ দিয়েই শেষ মোদীর প্রথম দফার ভোটপ্রচার


  • April 18, 2024
  • (0 Comments)
  • 304 Views

বাংলার বুকের উপর দাঁড়িয়ে তাই রামদাঙ্গাকে একরকম সমর্থন জানিয়ে, “শোভাযাত্রায় পাথর ছোড়ার অনুমোদন তৃণমূল সরকার দিয়ে রেখেছে”, মুসলিমদের নিশানা করে, এমন চূড়ান্ত মিথ্যা, সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক বাক্য উচ্চারণ করতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। দলমত নির্বিশেষে এই বিষবাক্যের যুতসই  জবাব কবে দেব আমরা? আর কত নীলকণ্ঠ হব? লিখলেন দেবাশিস আইচ

 

সন্দেশখালি গণবিক্ষোভে সাম্প্রদায়িক রং লেপে ভোটপ্রচার শুরু করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। প্রথম দফার প্রচার শেষও করলেন একই সাম্প্রদায়িক সুরে। যদি বলা হয়, একথা জেনেবুঝেই যে, রামনবমী উদ্‌যাপন মোদীর রাজত্বে মুসলিম বিরোধী ‘রামদাঙ্গা’য় পরিণত হয়েছে— তা হলে ভুল কিছু বলা হবে না। অন্তত তথ্যপ্রমাণ সে কথাই বলে। ২০১৭ সাল থেকে সারা দেশের মতো— বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে— এ রাজ্যেও রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী উদ্‌যাপন আসলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার নামান্তর। রামনবমী ও মুসলিম নির্যাতন এ দিন সমার্থক। বিজেপি, বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএস-এর মদতে গজিয়ে ওঠা হরেক রকমের রামদাঙ্গার দল এই দিনটিকে বেছে নেয় লাগামছাড়া ঘৃণা ছড়ানোর জন্য; শাণিত ও আগ্নেয়াস্ত্র-সহ মুসলিম মহল্লায় ঢুকে গুন্ডামি ও দাঙ্গার চরম প্ররোচনা দেওয়ার জন্য; ডিজে-সহযোগে ঘৃণ্যভাষায় চূড়ান্ত বিদ্বেষমূলক গান বাজিয়ে দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য। কী সেই গান? মুসলিম মহল্লায় মসজিদ ঘিরে তারস্বরে বাজতে থাকে, “ইনসান নেহি হো সালো, হো তুম কাসায়ি; বহুত হো চুকা হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই।” উত্তরপ্রদেশের প্রেম রাজবংশীর এই গান গলায় নিয়েই উন্মত্তের মতো আচরণ করতে দেখা যায় ‘দ্বেষপ্রেমী’ রামভক্তদের। এখানেই শেষ নয়, লক্ষ্মী দুবে, কবি সিং-দের গলাতেও ভিন্ন ভিন্ন গানে উগরে দেওয়া হয় ঘৃণাভজন। আর ন্যূনতম প্রতিবাদ, পুলিশি ঘেরাটোপে লাঠিসোঁটা, তরবারি, আগ্নেয়াস্ত্রের আস্ফালন, আক্রমণের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধ হলে সর্বশক্তি নিয়ে নামবে রাষ্ট্র। সরকারের নির্দেশে তার পুরবাহিনী, তার সশস্ত্র বাহিনী বুলডোজার নিয়ে ধেয়ে আসবে মহল্লায় মহল্লায়। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে মুসলিম জনপদ, তাঁদের মাথা গোঁজার শেষ ঠাঁই, রুজিরোজগারের একমাত্র সম্বল। আর গণহারে গ্রেফতার করা হবে মুসলিম যুবকদের। ফি-বছর, রমজান মাসে, নিয়ম করে চলে আসছে এই আসুরিক আক্রমণ। এই মিছিলকে সংযত করতে, দাঙ্গার সম্ভাবনাকে যতদূর সম্ভব প্রতিরোধ করতে আইন-আদালতের দ্বারস্থ হলে নির্বাচনি সভা থেকে ভেসে আসবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কটাক্ষ। যাঁর রাজত্বে মুসলিম গণহত্যা ঘটে, অনুতাপহীন তিনি তো চাইবেনই আরও গণহত্যা ঘটুক।

 

প্রধানমন্ত্রী, তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সব ঘটনার সমস্ত খোঁজখবর রাখে। এর পরও নির্বাচনি প্রচারে নরেন্দ্র মোদী বলবেন, “রামনবমীর শোভাযাত্রা অনুমতি পায় না। কোর্টে যেতে হয়। কিন্তু…শোভাযাত্রায় পাথর ছোড়ার অনুমোদন তৃণমূল সরকার দিয়ে রেখেছে।” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জুলাই ২০২৪)।

 

বুকের ভিতরে কতটা বিষ থাকলে, চোয়ালে বিষের থলি থাকলে, বিষদাঁত থাকলে এমন উস্কানিমূলক, সাম্প্রদায়িক, দাঙ্গামুখী ছোবল মারতে পারা যায়, তা আজ নতুন করে হিসাবের প্রয়োজন নেই। যে শহরে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন, “আজ মহাষ্টমীর শুভদিন। কাল (বুধবার) নবরাত্রির পবিত্র উৎসব হবে। তার আগে বোল্লা কালীমাকে (দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ কালীমন্দির) প্রণাম জানাই। কাল সারা দেশ রামনবমী পালন করবে” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ এপ্রিল ২০২৪), সে শহর বালুরঘাটে, আত্রেয়ী নদীর ধারে রঘুনাথপুরে রামনবমী মেলার আয়োজন তখন সম্পূর্ণ। রঘুনাথের মেলা বলেও যা ইতিহাস প্রসিদ্ধ। রঘুনাথপুরের সে মন্দিরে আরও অনেক দেবতার সঙ্গে পূজিত হন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, হনুমান। সে মেলার কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে বোধহয় কেউ তুলে দেননি। রামনবমী থেকে টানা তিন দিন যে মেলায় লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। হাজার লোক হাজার ‘মানসিক’ রাখতে আসেন মেলায়। তরোয়াল উঁচিয়ে কেউ আসে না। ডিজে-সহযোগে বাজে না পরধর্ম বিদ্বেষী কোনও এইচ-পপ (হিন্দুত্বপপ) সঙ্গীত। কোনওদিন কখনও এই রামনবমী/ রঘুনাথের মেলার বিরুদ্ধে কেউ কোনও আইনশৃঙ্খলার দোহাই পাড়েননি। দাঙ্গা বাঁধায়নি রঘুনাথ বাবার কাছে ‘মানসিক’ করতে আসা ভক্তরা। জাতপাত, ধর্মের হিসাব কষতে বসেননি কেউ।

 

তাঁরা দলে দলে আসেন, আত্রেয়ী নদীতে পুণ্যস্নান সেরে, যাঁর যা মানত, পাঁচ কেজি মসুর ডাল কিংবা হাফ কেজি আলু নিবেদন করেন। এর পর মেলার দোকান থেকে চিঁড়ে, মুড়কি, দই, খাজা বাতাসা একসঙ্গে মেখে, খেয়ে ভক্তি নিবেদন করেন। রঘুনাথের কাছে হয়তো তাঁরা প্রার্থনা করেছিলেন, এবার গাছে ডাব ধরাস রঘুনাথবাবা, সামনের বছর এক কাঁদি ডাব দেব। কিংবা দুরারোগ্য অসুখ বা সামান্য আঁচিলের জন্য পাঁচ কেজি মসুর ডাল বা হাফ কেজি আলু মানত করেন। চোখের অসুখে মানত করেন চাঁদির (রূপো) চোখ। যাঁর যা সামর্থ্য।

 

এমন রামনবমী, মেলা তো দিব্যি পালিত হয় এ রাজ্যে। শহর কলকাতাতেও তাঁর এক ঐতিহ্য রয়েছে। উত্তর কলকাতার রামমন্দির, কিংবা হাওড়ার রামরাজাতলার রামমন্দিরে পূজা, অর্চনা ঘিরে তো কখনও দাঙ্গা বাঁধেনি। ২০১৭ সাল থেকে এ রাজ্যের মানুষ দেখছেন রামের নামে, রামনবমীর নামে— এক বিজাতীয়, বিকৃত, সশস্ত্র, হিংস্র, পরধর্ম বিদ্বেষী ইতরের অভিযান। এই হিংস্রযাত্রা থেকেই বার বার এ রাজ্যে হিংসা ছড়ানো হয়েছে। এ রাজ্যের সরকার যদি দৃঢ়চেতা হত; আইন, সংবিধানের প্রতি যদি সরকারের বিশ্বাস থাকত; সর্বোপরি বিশ্বাস থাকত বাংলার, বাঙালির সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক চেতনার উপর— তবে, ধর্মের নামে এই হিংসা তারা রুখে দিতে পারত। সে পথে না হেঁটে এই রামের নামে, ধর্মের নামে বজ্জাতির সহজ রাস্তা বেছে নিল সরকারি দল তৃণমূল কংগ্রেস। অধর্মের মোকাবিলা করতে, সেই অধর্মের লেজুড়বৃত্তি করে বসল। তারাও ভোট হারানোর ভয়ে, বিশেষ করে অবাঙালি এলাকায় ও শিল্পাঞ্চলে এই ভণ্ডামিতে শুধু অংশগ্রহণ নয়, রীতিমতো আয়োজক হয়ে উঠল। আর বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির দৌড় তো সেই রাজাবাজার থেকে মৌলালি কিংবা মৌলালি থেকে পার্কসার্কাস কিংবা ধর্মতলায় মিছিল, মিটিং।

 

বাংলার বুকের উপর দাঁড়িয়ে তাই রামদাঙ্গাকে একরকম সমর্থন জানিয়ে, “শোভাযাত্রায় পাথর ছোড়ার অনুমোদন তৃণমূল সরকার দিয়ে রেখেছে”, মুসলিমদের নিশানা করে, এমন চূড়ান্ত মিথ্যা, সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক বাক্য উচ্চারণ করতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। দলমত নির্বিশেষে এই বিষবাক্যের যুতসই  জবাব কবে দেব আমরা? আর কত নীলকণ্ঠ হব?

 

Share this
Leave a Comment