“মুখ খুললে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেব, ভারতে বুলডোজার অবিচার” —  একটি অ্যামনেস্টি রিপোর্ট


  • March 6, 2024
  • (0 Comments)
  • 609 Views

২০২৪ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্টে — “ইফ ইউ স্পিক আপ, ইয়োর হাউজ উইল বি ডিমলিশড, বুলডোজার ইনজাস্টিস ইন ইন্ডিয়া” —  ঘৃণার বাস্তুতন্ত্র, বুলডোজার-রাজ, শাস্তিমূলক উচ্ছেদ, রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের ভূমিকার এক ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অ্যামনেস্টি এই রিপোর্ট-এর উপর ভিত্তি করে দেবাশিস আইচ-এর প্রতিবেদন।


১।

ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া বেশ সোজা। বোমা মেরে, আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়াও সহজ। ফিলিস্তিন কিংবা কাশ্মীরে সেই কোন আদ্যিকাল থেকেই চলে আসছে। আরও কত শত দেশে। না হয় ধরেই নেওয়া গেল যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমনটা হয়ে থাকে। যুদ্ধবাজরা যাকে বলেন “কোল্যাটারাল ড্যামেজ”। কিন্তু, সাধারণ পরিস্থিতিতে অহরহ নেমে আসছে বুলডোজার। শুধু একটিই সম্প্রদায়ের গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর, দোকান-পাট, ধর্মস্থান— কেন প্রশ্ন করলে উত্তর আসছে, “বেআইনি নির্মাণ, সরকারি জমি জবরদখল।” মিডিয়ার এক বড় অংশ শাসকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে এই ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডকে বলছে—“বুলডোজার জাস্টিস।” এই দানবীয় কর্মকাণ্ডের হোতাদের বাহবা জানিয়ে নামকরণ করছে, “বুলডোজার বাবা”, “বুলডোজার মামা”। আর অন্যদিকে, বিনা নোটিশে, কোনও কারণ না-দেখিয়ে বুলডোজার চালিয়ে যাঁদের মাথার ছাদ কেড়ে নেওয়া হল, মহিলা-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে পড়লেন, রুজিরোজগার হারিয়ে যাঁরা ভিখারি বনে গেলেন, যে শিশুরা শৈশব হারাল, শিক্ষা হারাল আর নিজেদের জীবন দিয়ে জানল হিংসা কাকে বলে— শাসকের কথায় কথা মিলিয়ে মিডিয়া তাঁদের “ক্রিমিনাল”, “জবরদখলকারী” বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। বাংলা ভাষায় কথা বললে, তাঁদের “ঘুষপেটিয়া” কিংবা “বাংলাদেশি” অনুপ্রবেশকারী বলেও চিহ্নিত করা হচ্ছে।

 

এমনটা যে ঘটছে, ঘটে চলেছে আমাদের দেশে, এই ভারতে— বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে এর কোনও তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফিলিস্তিনে যা ঘটে চলেছে তা জেনোসাইড, হিটলারের জার্মানিতে যা ঘটেছিল তা জেনোসাইড। এই জেনোসাইড বা এমন জেনোসাইডগুলির এক পূর্ব প্রস্তুতি থাকে, থাকে এক নির্দিষ্ট লক্ষে অধিকাংশের এক মত, এক পথ গড়ে তোলা। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা, কোনও একটি জাতি, সম্প্রদায়কে ‘অপর’ প্রতিপন্ন করা। “সব নষ্টের মূল” বলে প্রচার করা, ক্রমে ক্রমে তাঁদের হেয় করা, কথায় কথায় ছোট করা— এ সবই ঘৃণা-বিদ্বেষের নির্মাণ। এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া সমাজে। তাঁদের একঘরে, ঘেটোবন্দি করে ফেলা; শুধু সামাজিক দিক দিয়ে নয়, আর্থিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে ফেলা; ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক অধিকারগুলি থেকে সুপরিকল্পিত ভাবে বঞ্চিত করা; আর যা কিছু খারাপ তার জন্য এঁদের দায়ী করা— আর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে, গলা তুললে হিংসা নামিয়ে আনা। আবার সেই হিংসায় ক্ষতিগ্রস্তদের, আক্রান্তদের, যাঁদের মহল্লায় ঢুকে পায়ে পা বাঁধিয়ে, ডিজের সাহায্যে ঘৃণ্য, অশ্লীল গান, স্লোগান দিয়ে হিংসা ছড়ানো হল, দাঙ্গা বাঁধানো হল— সেই দাঙ্গাবাজরা সরে যেতেই তাদের জায়গা নিল রাষ্ট্রযন্ত্র। রাষ্ট্রের যন্ত্র— আমলা, পুলিশ, পুরসভা, বুলডোজার। রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট এই সব হিংস্র কর্মকাণ্ড, তার উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি, আক্রমণকারীদের প্রতি পক্ষপাত এবং আক্রান্তদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাক্ষেত্র ভেঙে তছনছ করে দেওয়া— রাষ্ট্রের ভাষায় “বুলডোজার জাস্টিস”— যা আইনি ন্যায়নীতির সঙ্গে সঙ্গতিহীন এক শাস্তিমূলক বিনাশ প্রকল্প। এই সবকিছুই আসলে এক ভাবী জেনোসাইডেরই মতাদর্শগত নির্মাণ।

 

বছর দুই আগে, দিল্লির “সিটিজেন্স অ্যান্ড ল’ইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ” ২০২২ সালের এপ্রিলে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী পালনকে উপলক্ষ্য করে দেশের নানা রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা বাঁধিয়ে তোলার ঘটনা নিয়ে— যা, ২০১৭ সাল থেকে এক রুটিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে— “রুটস অব রথ/ ওয়েপনাইজিং রিলিজিয়াস প্রশেসন” শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টটিতে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে রাষ্ট্রীয় মদতে হিন্দুত্ববাদী নানা ধর্মীয় সংগঠনগুলি ধর্মীয় মিছিলের নামে কীভাবে মুসলিম মহল্লায় মহল্লায় “লো স্কেল” নিয়ন্ত্রিত হিংসা ছড়ানোর পর সরকারি বাহিনীর “বুলডোজার বিধান” নেমে আসে, তার বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ছিল পর্যালোচনা ও আইনি ব্যাখাও।

 

“লো স্কেল” অর্থে আমরা বোঝাতে চাইছি, মিরাট, ভাগলপুর, মুম্বাই, গুজরাত, মুজফফরনগর, দিল্লির মতো গণহত্যা না ঘটিয়ে, মুসলিমদের থানায় তুলে নিয়ে যাওয়ার নাম করে পথের মাঝে গুলি করে খুন করে খালে ভাসিয়ে না দিয়ে (মুজফ্ফরনগর, ২০১৩) ধর্মীয় মিছিল থেকে ঘৃণার ফোয়ারা ছুটিয়ে, মসজিদে  ইটপাথর ছুঁড়ে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলেই উদ্দেশ্য সাধন হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে হয়তো মৃত্যু হল এক জনের, কিছু দোকান-পাট বাড়ি লুঠ হল, আগুন লাগানো হল; মুসলিমরা স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবাদ জানালে, বাধা দিলে, আক্রমণের মুখে ইটপাটকেল ছোঁড়ার পর পরই এলাকায় নেমে আসবে পুরসভার বুলডোজার বাহিনী। দাঙ্গা করার দায়ে গণগ্রেফতার এবং “বেআইনি নির্মাণ”-এর অভিযোগ তুলে নির্বিচারে বেছে বেছে মুসলিমদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাবাণিজ্য ভেঙেচুরে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। হাতে ততটা না-মেরে ভাতে মারাই এখন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির দাঙ্গা-কৌশল। বাসস্থান কেড়ে নেওয়া, ব্যবসাবাণিজ্য ধ্বংস করে দেওয়ার শুধুমাত্র বাসস্থানের অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়, বৃহত্তর অর্থে জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া। ২০২০ সালে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের বদলা নিতে উত্তর-পূর্ব দিল্লির মুসলিম গণহত্যা অবশ্যই এই পর্যায়ে পড়ে না। আসলে তা ২০০২-এর গুজরাত গণহত্যাকে মনে করিয়ে দেয়।

 

২০২৪ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর দু’টি রিপোর্টে— “ইফ ইউ স্পিক আপ, ইয়োর হাউজ উইল বি ডিমলিশড, বুলডোজার ইনজাস্টিস ইন ইন্ডিয়া”, এবং “আনআর্থদিং অ্যাকাউনটিবিলিটি, জেসিবি’জ রোল অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি ইন বুলডোজার ইন জাস্টিস ইন ইন্ডিয়া”—  ঘৃণার এই বাস্তুতন্ত্র, এই বুলডোজার-রাজ, এই শাস্তিমূলক উচ্ছেদ, রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের ভূমিকার এক ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০২২ সালের অগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩১ অগস্ট পর্যন্ত এক গবেষণা চালিয়ে অ্যামনেস্টি দেখেছে, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে নিশানা করে মুসলিমদের ১২৮টি সম্পত্তি— বাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় স্থান— ধ্বংস করা হয়েছে। বিজেপি শাসিত চার রাজ্য আসাম (৮টি), গুজরাত (খাম্বাতে ২১টি ও হিম্মতনগরে ১৩টি), মধ্যপ্রদেশ (খারগোনে ৪৫টি ও সেন্ধাওয়ায় ১১টি), উত্তরপ্রদেশ (একটি প্রয়াগরাজে ও দু’টি সাহারানপুর) ও আপ শাসিত দিল্লিতে (২৫টি) এই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানো হয়েছে (মনে রাখতে হবে, দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন)। এই ঘটনাগুলিতে ৬১৭ জন পুরুষ, মহিলা, শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। হয় তাঁরা মাথার উপর ছাদ হারিয়েছেন, না হয় রুজিরোজগারের একমাত্র সংস্থান হারিয়েছেন।

 

এর মধ্যে গুজরাত, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশে রমজান মাসে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী পালনকে উপলক্ষ করে হিংসা ছড়ান হয়। খুশির ইদের প্রাক্কালে সম্পূর্ণ পরিকল্পিত উপায়ে একের পর এক শহরে কেড়ে নেওয়া হয় মুসলিমদের জীবন-জীবিকা। এই তিন রাজ্যের ছ’টি শহরের মুসলিম প্রধান এলাকার উপর দিয়ে বজরঙ্গ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি সংগঠনগুলি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষে মিছিল নিয়ে গিয়েছে। জঙ্গি আস্ফালন, ডিজেতে তীব্র শব্দে বিদ্বেষে ভরা গানের সঙ্গে শাণিত অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র, লাঠিসোঁটা নিয়ে উদ্দাম নাচ এই মিছিলগুলির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

 

অন্য দু’টি ঘটনায় আসামের নগাঁওয়ে পুলিশ হেফাজতে এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার ও প্রতিবেশীরা প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামার “অপরাধে’ তাঁদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় আসাম সরকার। কথায় কথায় বুলডোজার নামিয়ে দেওয়া, ভুয়ো এনকাউন্টারে হত্যা উত্তরপ্রদেশের যোগী জমানার শাসন ব্যবস্থারই অঙ্গ করে তোলা হয়েছে। পয়গম্বরের উদ্দেশে বিজেপির তৎকালীন মুখপাত্র নূপুর শর্মার অশালীন মন্তব্যের জেরে প্রয়াগরাজে মুসলিম নাগরিকদের প্রতিবাদ বিক্ষোভের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই শহরের বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মী জাভেদ আহমদের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়। অ্যামনেস্টি “বুলডোজার-রাজ”-এর উপর এক গবেষণা করতে গিয়ে এই পাঁচটি রাজ্যে তিন ধরণের ঘটনাকে বেছে নিয়েছিল। ২০২২ সালে “সিটিজেন্স অ্যান্ড ল’ইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ”-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ও বাকুড়া-সহ ১৩টি রাজ্যে অন্তত ২৪টি স্থানে এই ধর্মীয় মিছিল থেকে হিংসা ছড়ান হয়।

 

২। 

মধ্যপ্রদেশ 

আমরা রমজানের উপোস করে ছিলাম। আমি ওঁদের বললাম এ বাড়ি ছাড়তে পারব না। জিজ্ঞাসা করলাম, “আমি গরিব মানুষ, কোথায় যাব?” পুলিশ লাঠিপেটা করতে করতে চীৎকার করতে শুরু করল, “বেরিয়ে যা, এখান থেকে। “আমি নড়িনি। বললাম, “এই বুলডোজার দিয়ে আমাকেও গুঁড়িয়ে দাও। আমার মৃতদেহ নিয়ে যাও তোমাদের সঙ্গে। এত গরিব আমি কোথায় যাব? আমার ছেলে এসে মিনতি করে বলল, “আম্মি, ওরা তোমাকে মেরে ফেলতে দু’বার ভাববে না। “আমার সারা জীবনের রোজগার, স্মৃতি সবই ওই বাড়িতে। ওরা আমাদের কোনও কিছুই বার করে আনতে দিল না। সব মাটিতে মিশিয়ে দিল।”

 

চল্লিশ বছরের হাসিনা বাই মধ্যপ্রদেশের খারগোন শহরের এই বাড়িতে স্বামী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করতেন। এই বাড়িটা আদতে ছিল একটা মাটির ঘর। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়িটা পাকা হয়। বাড়ির পাকা দলিলও রয়েছে। তবুও, ১১ এপ্রিল ২০২২, বেআইনি ভাবে “শাস্তিমূলক উচ্ছেদ চালানো হয়।“  কোনও আগাম আইনি নোটিস, কোনও কারণ না-দেখিয়ে, এমনকি কোনও কিছুই ঘর থেকে বার করতে না-দিয়ে জেসিবি ব্র্যান্ডের বুলডোজার দিয়ে ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ঘরবাড়ি। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা  নয়। না মধ্যপ্রদেশে, না ২০২২ সালে। এই হিংস্রতাই তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানকে “বুলডোজার মামা” উপাধি এনে দিয়েছে।

 

কী ঘটেছিল মধ্যপ্রদেশে? যার জন্য সরকারকে মুসলিমদের উপর, হাসিনা বাঈদের উপর এভাবে বুলডোজার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল? সবকটি ঘটনাই একটি আরেকটির কার্বন কপি যেন। অ্যামনেস্টির রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালের ১০ ও ১৫ এপ্রিল, মধ্যপ্রদেশের খারগোন ও সেন্ধাওয়া, গুজরাতের হিম্মতনগর ও খাম্বাত, দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরিতে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীর মিছিল ঘিরে সংঘর্ষ বাঁধে। রমজান মাসের এই সংঘর্ষে এই শহরের মুসলিম এলাকাগুলিতে যথেচ্ছ আগুন লাগানো, মসজিদ ভাঙচুর, বাড়ি ও দোকান ও অন্যান্য ব্যবসয়িক প্রতিষ্ঠানগুলিতে ব্যাপক লুঠতরাজ চালানো হয়। সংবাদমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে মধ্যপ্রদেশে ১০ এপ্রিলের সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধর্মীয় মিছিল থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে “বৈষম্যসূচক” মন্তব্য থেকেই দাঙ্গা বাঁধে। “হিন্দু জাতীয়তাবাদের নির্দিষ্ট গেরুয়া পোশাক পরা জনতা  তরোয়াল ও পিস্তল উঁচিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্ররোচনামূলক স্লোগান দিচ্ছিল।“ এই সাম্প্রদায়িক হিংসায়, ২৮ বছর বয়সি এক মুসলিম যুবকের মৃত্যু হয়। এক জন পুলিশ সুপার-সহ আহত হন কম করে ২০ জন। ৩০টি বাড়ি দাঙ্গাকারীরা জ্বালিয়ে দেয়।

 

এই ঘটনার যাবতীয় দায় চাপানো হয় আক্রান্ত মুসলিমদের ঘাড়েই। মধ্যপ্রদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরোত্তম মিশ্র সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “মুসলিমরা যদি এমন আক্রমণ করে, তবে তারা কোনও সুবিচারের আশা করতে পারে না।“ওই অঞ্চলের বসবাসকারী সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে এই ঘটনার জন্য দায়ী করে  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুমকির সুরেই বলেন, “কেউ যদি মধ্যপ্রদেশে দাঙ্গা বাঁধাতে চায় তবে তাদের গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।“স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বার্তার পরই ১১ এপ্রিল ওই দুই শহরের পুর কর্তৃপক্ষ ব্যাপক অভিযান চালায়। এই গণধ্বংসলীলায় মুসলিমদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও বাসস্থান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। খারগোনয়ে খাসখাসবাদি, তালাও চক, ওল্ড বাস স্ট্যান্ড, ওরাংপুরা ও ছোটিমোহন টকিজ এবং সেন্ধাওয়ায় জোগওয়ারা রোডের উপর  মুসলিমদের যত সম্পত্তি ছিল সব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই তথাকথিত বেআইনি নির্মাণ ভাঙার আওতায় রয়েছেন দিনমজুর, মসজিদের সামনে থাকা ছোট ছোট দোকানদার থেকে হোটেল, লজ, রেস্তোরাঁর মালিক।  অনেকের ব্যবসা ও বাড়ি— দুই-ই ভেঙে ফেলা হয়েছে।

 

১২ এপ্রিল ইন্দোরে উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক এক সংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “দাঙ্গাকারীদের [পড়ুন মুসলিমদের] বেআইনি ও জবরদখল করা সম্পত্তির উপর ‘বুলডোজিং’ শুরু হয়েছে… অন্যান্য অঞ্চলেও এ জাতীয় সম্পত্তি/ জবরদখলি জমি শনাক্ত করা হয়েছে, সামনের দিনে সেগুলির বিরুদ্ধেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। দাঙ্গাকারী ও ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।”

 

সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন সূত্র উদ্ধৃত করে অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানকে “বুলডোজার মামা” শিরোপা-সহ প্রশংসা করা হয়েছে। এবং “সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে খুবই কড়া মনোভাবের” নেতা বলে সমাদরও জানানো হয়। রিপোর্ট আরও বলছে, যাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হল, সংবাদমাধ্যম তাঁদের “সমাজবিরোধী”, “দাঙ্গাকারী” এমন নেতিবাচক চরিত্রে চিত্রিত করেছে। আমরা এই সূত্রগুলিতেও একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারি।

 

# “Khargone clashes: MP starts bulldozing ‘illegal’ assets of rioters and political bickering”, The New Indian Express, 12 April 2022

 

# “Buldozer Mama: Bhopal বিধায়ক Rameshwar Sharma নে অপনে ঘর কে সামনে লগা দিয়ে Bulldozer”, News 18 India, 23 March 2022, “CM Yogi ‘Bulldozer Baba’ তো মুখ্যমন্ত্রী Shivraj Singh Chouhan ‘Buldozer Mama’: BJP বিধায়ক,” NDTV India, 22 March 2022

 

# “Buldozer Baba Scare? Over 50 criminals surrendered since Yogi Adityanath’s return to power, Zee News, 28 March 2022

 

# Sravani Sarkar, “Shivraj on Yogi Way again, becomes ‘bulldozer mama’ as MP governments complete 2 years”, The Week, 23 March 2022

 

# “Khargone: MP Govt demolishes house of those involved in pelting stones; 77 arrested, curfew imposed”, News 18 India, 11 April 2022

 

এ শুধু মধ্যপ্রদেশের সংবাদমাধ্যমের চিত্র নয়। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে এই রিপোর্টের অন্যত্র মন্তব্য করতে গিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, “পরিস্থিতি আরও বাড়িয়ে তুলতে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সম্পত্তি ধ্বংস করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না-করাকে বৈধতা দিয়ে, ক্ষতিকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এর ফলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ঘরবাড়ি ভাঙা নিয়ে দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত ও আসামের ১৬টি স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদমাধ্যম— খবরের কাগজ, ডিজিটাল নিউজ ম্যাগাজিন ও টিভি— রিপোর্ট বিশ্লেষণ করেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে, বেআইনি জবরদখল মুক্ত করতে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, এর সঙ্গে দাঙ্গার কোনও সম্পর্ক নেই। যদিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেখেছে, স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় মিডিয়া চ্যানেলগুলি অন্যরকম বয়ান উপস্থাপিত করেছে এবং পরবর্তীতে ব্যাপক হারে, কোনও পর্যালোচনা ছাড়াই দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের উচ্ছেদের খবর করেছে। এই ঘটনাগুলিকে “বুলডোজার জাস্টিস” আখ্যা দিয়ে মিডিয়া চ্যানেল, খবরের কাগজ, ডিজিটাল নিউজ ম্যগাজিন রাজ্য নেতাদের প্রশংসা করে “সাকসেসফুল অ্যাকশনস”, “মডেল অব গভর্ননেস” শীর্ষক খবর করেছে। এই উচ্ছেদ আইনানুযায়ী হচ্ছে কি না সে বিষয়ে যৎসামান্য বা কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি।

 

গুজরাত

গুজরাত ও দিল্লির কাহিনি যেন মধ্যপ্রদেশের কার্বন কপি। আসলে কর্মপন্থা সর্বত্রই এক। গুজরাতের খাম্বাত ও হিম্মতনগরে ১০ এপ্রিল মুসলিম প্রধান এলাকায় রামনবমীর মিছিল থেকেই হিংসার সূত্রপাত। ৬৫ বছরের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। দোকান-পাট, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে আগুন লাগানো হয়। এর পাঁচ দিন পর ১৫ এপ্রিল এবং ফের ২৬ ও ২৮ এপ্রিল বিজেপি শাসিত পুরসভার বুলডোজার মুসলিমদের ঘরবাড়ি, দোকান-পাট গুঁড়িয়ে দেয়। ১১ এপ্রিল এক বিজেপি বিধায়ককে হিম্মতনগরে দাঁড়িয়ে টাইমস নাউ চ্যানলে বলতে শোনা যায়, মুসলিমরা ‘দেশদ্রোহী’, ‘বিদ্রোহী’।

 

দিল্লি

উত্তর দিল্লির সদাব্যস্ত ব্যবসায়িক এলাকা জাহাঙ্গিরণপুরিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটে ১৬ এপ্রিল। ওইদিন ছিল হনুমান জয়ন্তী। এই ঘটনায় আট জন পুলিশ কর্মী এবং এক জন সাধারণ মানুষ আহত হন। ১৯ এপ্রিল দিল্লি বিজেপির সভাপতি আধেশ গুপ্তা উত্তর ও দক্ষিণ দিল্লি পুরসভাকে “সরকারি জমি দখলকারী  বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা ও সমাজবিরোধীদের” উচ্ছেদ করতে চিঠি লেখেন। এই চিঠি পাওয়ার পরই উত্তর দিল্লি মিউনিসিপ্যাল করপোরেশেন উচ্ছেদ অভিযান চালানোর জন্য দিল্লি পুলিশের কাছ থেকে ৪০০ পুলিশ কর্মী চায়। উত্তর দিল্লি পুরসভার এই বিজ্ঞপ্তিকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানালে, শীর্ষ আদালত ২১ এপ্রিল উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করে দেয়।

 

এই নির্দেশের পরও উত্তর দিল্লির পুরসভা পুলিশ নিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে নেমে পড়ে। এবং সি ব্লক এলাকায় কম করে ২৫টি দোকান ও ঠেলাগাড়ি ভেঙে দেয়। উচ্ছেদ অভিযান চলাকালীনই সিপিআই (এম) নেত্রী বৃন্দা কারাত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কপি হাতে বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। এর পরই উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়। রায় অমান্য করার পরও সুপ্রিম কোর্ট উত্তর দিল্লি পুরসভার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করেনি।

 

অ্যামেনেস্টির পর্যবেক্ষণ,দিল্লির এই ঘটনাতেও মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলিও হিংসার ও বুলডোজার-বলিদের “অমানুষ” প্রতিপন্ন করে। এবং সরকারি জমি থেকে জবরদখলকারীদের এই উচ্ছেদ যে ঠিকপথেই এগোচ্ছে, সেই আখ্যানের উপরই জোর দেয়। এও দেখা যায়, আজ তক চ্যানেলের অ্যাঙ্কার অঞ্জনা ওম কাশ্যপ একটি বুলডোজারে চেপে খবর সম্প্রচার করছেন।

 

আসাম    

২০ মে ২০২২, নগাঁওর বটদ্ররা থানায় শফিকুল ইসলাম নামে এক বাঙালি মৎস্যজীবীর মৃত্যু হয়। অ্যামেনেস্টি তদন্ত করে দেখেছে ভারতীয় ফৌজদারি আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতারির সময় যে যে সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তার কোনওটাই পালন করেনি নগাঁও পুলিশ। এমনকি শফিকুলের বিরুদ্ধে কোনও এফআইআরও ছিল না। অভিযোগ, শফিকুল পুলিশের দাবি মতো ১০,০০০ টাকা ও একটি হাঁস ঘুষ হিসাবে দিতে পারেনি।

 

২১ মে এই ঘটনার প্রতিবাদে শফিকুলের পরিবার এবং কয়েকজন প্রতিবেশী থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায়। এই বিক্ষোভ ক্রমে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে এবং অভিযোগ থানার একটি পুরনো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এর পর নগাঁও পুলিশ মহিলা, শিশু-সহ শফিকুলের পরিবারের সবাইকে ও প্রতিবেশী-সহ ২১ জনকে গ্রেফতার করে। পুলিশের দাবি, জেহাদিরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ২১ জন মিলে যাঁদের মধ্যে ১৪ জন মহিলা, কীভাবে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আগুন লাগাল, সেও এক রহস্য বটে।

 

এই ঘটনার পর পরই আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা ট্যুইট করে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন, “হয় উচ্ছেদ, না হয় যারা এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।“২২ মে, ধিং এলাকার আটটি পাকা ও কাঁচা বাড়ি বুলডোজারের সাহায্যে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সবকটি বাড়িই মৃত শফিকুল কিংবা তাঁর নিকট আত্মীয়দের। এক জনকে মেরে ফেলা হয়েছে, বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকরা সকলেই লকআপে, অথচ বাড়ির শিশুরা ভাঙা বাড়ির সামনে রাস্তায় পড়ে আছে। তাদের যাতে কেউ আশ্রয় না দেয় তার জন্য হুমকি দিয়ে গিয়েছে পুলিশ।

 

উত্তরপ্রদেশ  

১০ জুন ২০২২, উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে (পূর্বতন এলাহাবাদ) বিজেপির মুখপাত্রর (নূপুর শর্মা) গ্রেফতারের দাবিতে মুসলিমরা বিক্ষোভ দেখায়। প্রাইম টাইম টিভি বিতর্কে ওই মুখপাত্র পয়গম্বর মহম্মদ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। ১১ জুন উত্তরপ্রদেশ পুলিশ মানবাধিকার কর্মী জাভেদ মহম্মদ, তাঁর স্ত্রী ও এক মেয়েকে প্রয়াগরাজের কারেলি অঞ্চলে তাঁদের বাড়ি থেকে আটক করে। জাভেদ ও তাঁর বড় মেয়ে আফরিন ফতেমা, সরকারের নীতির কঠোর সমালোচক ছিলেন। বিশেষ ভাবে দিল্লিতে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে আফরিন সক্রিয় ছাত্রী কর্মী ছিলেন।

 

১২ জুন, সরকারি কর্তৃপক্ষ জাভেদ মহম্মদের পারিবারিক বাড়ি ভেঙে দেয়। পুলিশের অভিযোগ, জাভেদ ওই প্রতিবাদ সভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বুলডোজার দিয়ে ভাঙার সেই দৃশ্য টিভিতে লাইভ কভারেজ করা হয় এবং সাংবাদিকরা সরকারি বয়ানকেই সমর্থন জানাতে থাকেন। অ্যামনেস্টি প্রিন্ট ও টিভি মিডিয়া পর্যালোচনা করে দেখে যে, সংবাদমাধ্যমে বাড়ি ভাঙার আইনি বৈধতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, যথাসময়ে নোটিস দেওয়া হয়েছে কি না, এ বিষয়ে কোনও কথা নেই। তার বদলে, “যোগী (মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ) বুলডোজার” কীভাবে জাভেদ মহম্মদকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, তারই চিত্র ও বর্ণনা প্রচার করা হয়েছে। যদিও জাভেদ মহম্মদ তখন জেলে। ১১ জুন, জাভেদ মহম্মদের বাড়ি ভেঙে ফেলার একদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এক সভায় মন্তব্য করেন, “ক্রিমিনাল ও মাফিয়া”দের গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য বুলডোজার চলতেই থাকবে।

 

বৈষম্যমূলক এবং তাগ করে ভাঙা

 

বেছে বেছে, তাগ করে করে মুসলিমদের বাড়ি-দোকানপাট ভাঙার বেশ কয়েকটি চিত্র তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এই রিপোর্ট। সাহায্য নেওয়া হয়েছে স্যাটালাইট মানচিত্রেরও। যেমন, একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে মধপ্রদেশের খারগোনের একটি চার তলা বাড়িতে উপরের অংশে ছিল আমিন শেখের লাজিজ লজ ও হোটেল। অথচ তার সামনের অংশে হিন্দুদের দোকানে ভর্তি। হোটেলটি বেআইনি ভাবে নির্মিত, এই অভিযোগে, হিন্দুদের দোকানগুলি ও বাড়িটিতে একটিও আঁচড় না-কেটে হোটেলটি ভেতরের অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেন্ধওয়াতেও বাছাই করে করে মুসলিমদের ১৩টি বাড়ি ভাঙা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সমর খানদের বাড়িও। তিনি অ্যামেনেস্টির প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন, “ভিডিও সাক্ষ্য থেকে ইট ছোঁড়া হয়েছে এমন কয়েকটি বাড়িকে চিহ্নিত করা হয়। ভাঙতে গিয়ে যখন পুরসভা জানতে পারে বাড়িগুলি হিন্দুদের তখন আর ভাঙা হয়নি।”

 

হিংসাত্মক ঘটনা যেখানে ঘটেনি কিংবা আঁচও যেখানে পড়েনি এবং মূল ঘটনাস্থল থেকে দু’কিলোমিটার দূরের খারগোনের সেই তালাও চকেও ঘরবাড়ি, দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্রেফ মুসলিম প্রধান অঞ্চল বলে। তালাও চকের মসজিদের গায়ে থাকা ১২টি ছোট ছোট দোকান ভেঙে দেওয়া হয়। মসজিদের ট্রাস্টি মহম্মদ হাফিজ মহসিন মনসুরি অ্যামনেস্টিকে অভিযোগ করেন, “যদিও সবকটি দোকানই ভাঙা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র হিন্দুদের দোকানেরই মালপত্র সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। মুসলিমদের দোকানদারদের ওই একই রকম সম্মান বা মর্যাদা রক্ষা করা হয়নি। মালপত্র-সহই দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বুলডোজার যা করেছে তা বৈষম্যমূলক।”

 

গুজরাত কিংবা দিল্লির ছবিও ভিন্ন কিছু নয়। যেমন,গুজরাতের হিম্মতনগরের আসরফনগর অঞ্চলে রামনবমীতে হিংসার পর পরই সংশ্লিষ্ট পুরসভা রাস্তা চওড়া করার অজুহাতে শুধুমাত্র মুসলিমদের কয়েকটি বাড়ি ভেঙে দেয়। এই ঘটনার সরজমিনে তদন্ত করা ছাড়াও ঘটনার আগে ও পরে ওই অঞ্চলের অবস্থার স্যাটেলাইট ইমেজ তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি। এই ঘটনার অন্যতম ভুক্তভোগী মহম্মদ ইমরোজ অ্যামেনেস্টিকে জানায়, “২০২২ সালে রমজানের সময় রাস্তা চওড়া করার কাজ শুরু হয়। রামনবমীতে হিংসার পর তাড়াহুড়ো করে ৭টি মুসলিম দোকান ভেঙে দেয়। কিন্তু, এখন আর রাস্তা চওড়ার কাজে কোনও গরজ দেখা যাচ্ছে না। ২০২৩ সালের রমজানও চলে গেল। কিন্তু, কাজ শেষ হওয়ার কোনও লক্ষ্মণ নেই।”

 

অ্যামনেস্টির তদন্তে উঠে এসেছে, দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরিতে ফেরিওয়ালা, সব্জিওয়ালার ঠেলাগাড়ি-সহ কম করে ২৫টি ব্যবসায়িক কেন্দ্র ভেঙে দেওয়া হয়। এছাড়াও কুশল রোডে মসজিদ ও মন্দির দুই রয়েছে, এবং সেখানে মুসলিম দোকানদারই বেশি। অ্যামনেস্টি লক্ষ করেছে, মসজিদ ও মুসলিম দোকানগুলির রাস্তার উপরের অংশ ভেঙে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু মন্দিরটির কোনও ক্ষতি করা হয়নি। এই ২৫টি দোকানের মধ্যে দুটি হিন্দুদের। একটি দোকানের মালিক গণেশ কুমার গুপ্তা অ্যামনেস্টিকে বলেন, “…প্রথমে মুসলিমদের নিশানা করছে বলে ওদের সমালোচনা করা হত। এখন ওরা সমালোচনার জবাবে বলছে হিন্দুদের দোকানও ভাঙা হচ্ছে। এখানে ন্যায্য কাজটা কী? বেআইনি নির্মাণ ভাঙা ওদের কাছে বৈধ হতেই পারে। অথচ সমস্ত নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও…ওরা ভাঙাভাঙি চালিয়ে গেল।”

 

নির্দিষ্টভাবে মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু করে তোলা, বাড়ি, ব্যবসাকেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেওয়া যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের বিপ্রতীপ সে কথা স্মরণ করিয়ে অ্যামনেস্টির পর্যবেক্ষণ, “তথাকথিত অবৈধ জবরদখল হটানো কিংবা মুসলিমদের প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে বিরত করতে, পাঁচ রাজ্যেই কর্তৃপক্ষের বেছে বেছে মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তু করে তোলা, সুস্পষ্টভাবে সুসংগতা ও যুক্তিযুক্ততার মানদণ্ডে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টে, এ সবই ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত বৈষম্যের সূচক।”

 

গুজরাতের খাম্বাতের মহসিন ইউনুসভাই বোহরার কথায় কেন এই বৈষম্য, সে প্রশ্নের একটা উত্তর মেলে। খাম্বাটে মুসলিম ব্যবসায়ীদের ১৯টি গুদাম ভেঙে দেওয়া হয়েছে। একটি গুদামের মালিক ইউনুসভাই অ্যামনেস্টিকে বলেন, “আমাদের ব্যবসা যদি সত্যিই বেআইনি হয়, তাহলে আমাদের পাশেই থাকা হিন্দুদের ব্যবসায়ীদেরগুলো ভাঙা হল না? এরা [সরকার] আমাদের, মুসলিমদের দাঁড়াতে দিতে চায় না। ভাল ব্যবসা করতে, উন্নতি করতে দিতে চায় না। ওরা আমাদের মানসিক শক্তিকে ভেঙে ফেলতে চায়।”

 

গ্রেফতারেও ভেদ-বিভেদ 

 

সাম্প্রদায়িক হিংসার পর শুধু বুলডোজার নামে না, গ্রেফতার করা হয় তাঁদেরই যাঁরা মিছিলকারীদের হাতে আক্রান্ত হলেন, যাঁদের দোকান-পাট, বাড়ি, ধর্মীয় স্থানে লুঠ ও ভাঙচুর করা হল। গুজরাতের হিম্মতনগরে ধর্মীয় মিছিল থেকে হিংসা ছড়ানোর পর ৩০ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ২৯ জনই মুসলিম। খাম্বাটে ৬১ জনের নাম ধরে ধরে এবং দাঙ্গাকারী হিসাবে এবং অন্যান্য আরও ১০০ জনের বিরুদ্ধে নাম না-করে “জিরো” এফআইআর করা হয়। ওই ৬১ জনই মুসলিম। দু’টি ক্ষেত্রেই এফআইআরই করে হিন্দুরা।

 

মধ্যপ্রদেশের খারগোনের নাগরিক সমাজের এক কর্মী ফারুক খান জানান, “৪০টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে ২২টি মুসলিমদের বিরুদ্ধে, ১৮টি হিন্দুদের বিরুদ্ধে। ওই ১৮টির মধ্যে তিনটির ক্ষেত্রে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। ফলে বাকি ক্ষেত্রগুলিতে হিন্দুদের গ্রেফতার করা হয়নি। অন্যদিকে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা, অগ্নিসংযোগ, বিস্ফোরক আইনের মতো ধারা দেওয়া হয়েছে। মোট ২২৫ জন মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয়, তাঁদের মধ্যে ১২৫ জন জামিন পান, বাকি ১০০ জন জেলেই রয়েছেন।”

 

অ্যামনেস্টি মনে করে, মুসলিমবিরোধী ধারাবাহিক এইসব কার্যক্রমের পরেও যে দায়মুক্ত থাকা যাচ্ছে, তা ভারতে ক্রমবর্ধমান ইসলামোফোবিয়া, হেট ক্রাইম, মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও হিংসার প্ররোচনা, মুসলিমদের অপমান ও দানবীয় করে দেখানো এবং তাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ঘটনাগুলির স্বাভাবিকীকরণের লক্ষণ। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বৈষম্যমুলক আইন এবং মুসলিমদের দেখার যে নেতিবাচক “স্টেরিওটাইপ” সামাজিকভাবে গড়ে তুলেছে ও তার অধীনে মুসলিম ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করে চলেছে, তা দেশের অভ্যন্তরে পদ্ধতিগত বৈষম্যের প্রেক্ষাপট গড়ে তুলেছে। ভারতবর্ষে  মুসলমানরা বৈষম্যের শিকার হয় তাদের চেহারা, আচার-আচরণ, সাংস্কৃতিক চর্চা, ধর্মীয় চিহ্ন, প্রতীক এবং অনুমান করা স্টেরিওটাইপের উপর ভিত্তি করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি এবং স্টেরিওটাইপ ধারণার ফলে ভারতবর্ষে মুসলমানরা চিহ্নিত হন  “অপর” হিসাবে, যার ফলে তাঁরা বাধ্য হন আধিপত্য ও অধস্তনতার জীবনযাপন মেনে নিতে। এইসব কিছুর  ভিতর দিয়ে তৈরি হয় একধরনের মুসলিম-বিমানবীকরণের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক পরিমণ্ডল। বৃদ্ধি পায় ধর্মীয়, জাতিগত, লিঙ্গ সহ অন্যান্য বৈষম্যমূলক বাস্তবতাসমূহও।

 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর রিপোর্টে— “ইফ ইউ স্পিক আপ, ইয়োর হাউজ উইল বি ডিমলিশড, বুলডোজার ইনজাস্টিস ইন ইন্ডিয়া”

 

Amnesty_Bulldozer Justice (1)

 

Share this
Leave a Comment