“গভর্নমেন্ট ফান্ডিং-এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে গ্রুপ থিয়েটারের উপরে”: লাকিজী গুপ্তা


  • March 5, 2024
  • (1 Comments)
  • 1835 Views

নাট্য পরিচালক লাকিজী গুপ্তা গত ১২ বছর ধরে তাঁর নাটক ‘মা মুঝে টেগোর বনা দে’ নিয়ে ঘুরে চলেছেন সারা দেশ। ভারতের এমন কোনও রাজ্য বোধহয় বাকি নেই, যেখানে তিনি পারফর্ম করেননি। মুখ্যত স্কুলের পড়ুয়াদের কাছে তাঁর এই নাটকটি নিয়ে পৌঁছে যাওয়া উদ্দেশ্য হলেও, সাধারণ দর্শক, থিয়েটার কর্মীরাও একাধিকবার এই পারফরম্যান্স দেখেছেন। গত ১২ বছরেও এই একক অভিনয়ের আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং এর সামাজিক-রাজনৈতিক আবেদন সময়ের সঙ্গে আরও শানিত হয়েছে। স্কুলছুট এক পরিযায়ী শ্রমিকের আত্মকথন এই পারফরম্যান্স।  

 

২০২৪-এর ১০ জানুয়ারি কলকাতায় এই নাটকটি প্রথমবার দেখেন গ্রাউন্ডজিরো-র প্রতিবেদক সুদর্শনা চক্রবর্তী। জম্মুরর নাট্যকার, অভিনেতা লাকিজী গুপ্তা-র  সঙ্গে আলাপচারিতায় সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

 

জিএক্স: আপনি গত ১২ বছর ধরে একটিমাত্র নাটক ‘মা মুঝে টেগোর বানা দে’ নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এক দশকের মধ্যে বহু কিছু বদলে গেছে চারপাশে। আপনার কাছে গত ১২ বছরে সবচেয়ে বড় বদল কী?

 

লাকিজী: এই প্রশ্নটা বেশ কঠিন। তবে আমি বলব, আমি আমার দর্শকদের মধ্যেই অনেক বদল দেখতে পাই। ১০, ১২ বছর তো অনেক লম্বা সময়। গত ২/৩ বছর, কোভিডের সময়ে বেশ বড় বদল এসেছে। আগের ১০ বছরের যে পর্যায়টা ছিল, সে সময়ে প্রতিটি দিনের সঙ্গে কিছু না কিছু পরিবর্তন সারা পৃথিবী জুড়ে হত, সারা পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে, কোথাও ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর সমস্যা দেখা দিয়েছে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু রয়েছে – যেখানে যেমন বদল এসেছে মানুষের ভাবনাতেও সেভাবেই বদল এসেছে। আর আমি যে ধরনের দর্শকদের জন্য পারফর্ম করি, যাদের নিয়ে কাজ করি, তাদের মধ্যেও আমি এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারছি।

 

১০/১২ বছরে যে বদলটা দেখেছি, তা হল এই ভার্চুয়াল দুনিয়াটা ভীষণ শক্তিশালী হয়ে ওঠায় মানুষের আবেগ, পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ সবই ১৫ বছর আগের তুলনায় এখন অনেক কম হয়ে গেছে। মানুষের ধৈর্য্য, সহনশীলতা কমে গেছে। বিশেষ করে সমাজের সঙ্গে মানুষের যে এক ধরনের আবেগের সম্পর্ক তা অনেক কমে গেছে।

 

আমার পারফর্মেন্স-ও আমি সেই হিসাবে আপডেট করার চেষ্টা করতে থাকি। মানুষের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, তাঁরা কি অনুভব করছেন, সেই হিসাবে আমি নিজেকে আপডেট করার চেষ্টা করি।

 

জিএক্স: ১২ বছর আগে আপনি প্রথম যখন এই নাটকটির কথা ভেবেছিলেন, তখন কেন এরকম একটা নাটকের ভাবনা মাথায় এসেছিল?

 

লাকিজী: এটা আসলে আমি ভেবেছিলাম, কারণ যে ধরনের প্র্যাক্টিসে আমরা থিয়েটার করি এখনও, ১৯৬০-৭০-এর দশক থেকে যে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের প্র্যাক্টিস আমরা গ্রুপ থিয়েটারে করছি গত ২০/৩০ বছর ধরে, সেখানে অভিনেতাদের জন্য শেখার অনেক কিছু রয়েছে, কিন্তু যে অভিনেতারা অভিনয়কে নিজেদের পেশা (প্রফেশন) বানাতে চান, তাদের জন্য এখানে কোনও মোটিভেশন নেই।

 

কারণ যবে থেকে থিয়েটারে গভর্নমেন্ট ফান্ডিং আসা শুরু হল… গভর্নমেন্ট ফান্ডিং-এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে গ্রুপ থিয়েটারের উপরে। ১৯৬০-৭০-এর দর্শকে যেরকম শক্তিশালী (পাওয়ারফুল) পারফরম্যান্স হত, তার ইনটেনসিটি অনেক কম হয়ে গেল। অনেক সহজে অনেক টাকা অনেক গ্রুপ-এর কাছে আসতে লাগল। তাদের ফোকাসও সেই ফান্ডিং পাওয়ার উপরেই বেশি করে থাকতে শুরু করল। ফলে অভিনেতাদের উপর আর মনোযোগ দিল না।

 

আমি যে রাজ্যে, যে শহরে থিয়েটার করা শুরু করি সেখানে আমার কাছে করার জন্য খুব বেশি কিছু ছিল না। অনেক চেষ্টা করার পরেও, অনেক ফ্রিল্যান্স কাজ করার পরেও, আমি এমন কিছু পাইনি যাতে মনে হয়েছে আমি থিয়েটারকে নিজের প্রফেশন করতে পারি। সেই যে একটা ক্রাইসিস ছিল, এই ফিল্ডে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, তাই আমাকে প্রাণিত করেছিল অন্য রকম কিছু করার জন্য। আমি ভাবছিলাম কি করব, কীভাবে করব?

 

তখন আমি ভাবলাম, যদি বাচ্চাদের সঙ্গে এরকম কাজ করা যায়, তাহলে দর্শক, মঞ্চ সবই তো অলরেডি রয়েইছে। সেই স্পেস-এ গিয়ে কাজ করা যায়, কারণ এই বাচ্চাদের যে সমস্যাগুলি আছে, যদি আমি তার মধ্যে একটা সমস্যা নিয়েও কাজ করে তাদের কাছে যাই, তাহলেও আমার কাছে একটা অনেক বড় অডিয়েন্স রয়েছে। একদম প্রাথমিক স্তরে যখন আমার ভাবনাটি ছিল, তখন আমার মাথায় একটাই কথা ছিল যে, আমাকে এমন কিছু বানাতে হবে যার দর্শকের কোনও লিমিট না থাকে, যা আমি যেখানে হোক করতে পারি।

 

২০০৭-২০০৮ থেকে আমি ভাবতে শুরু করি, ২০১০-এ পৌঁছে আমি কিছু গল্প র‍্যান্ডমলি বেছে নিয়ে, সেগুলো বাচ্চাদের শোনাতাম। তারপর এক/দেড় বছর ধরে ১০-১৫ মিনিটের একটা পারফরম্যান্স তৈরি করে বিভিন্ন স্কুলে, গলি-মহল্লায়, চৌরাস্তার মোড়ে এই গল্পগুলো শোনাতাম। তার থেকেই আমার এই পারফরম্যান্স-এর একটা ড্রাফট, একটা আইডিয়া তৈরি হয়েছিল। ২০১০-এ আমি প্রথম ‘মা মুঝে টেগোর বানা দে’ পারফর্ম করি, তারপর থেকে প্রসেস শুরু হয়, এখনও প্রসেস চলছে।

 

জিএক্স: এই যে বলছেন প্রসেস – যখন ১০/১৫ মিনিটের ছোট পারফরম্যান্স করতেন, তখন সেখান থেকে কী কী নিয়ে এই নাটকে পরবর্তীতে যুক্ত করেছেন?

 

লাকিজী: আসলে আমি থিয়েটারের এই স্টাইলটা জানতাম না। আমি যে জায়গার মানুষ সেখানে পুরো শহরে একটাই অডিটোরিয়াম আছে আর, হাতে গুনে ৩টে গ্রুপ আছে যারা বছরে ২ থেকে ৩টে নাটক করে, ২/৩টে প্রডাকশন করে। রেজিস্টার্ড গ্রুপ অনেক আছে, কিন্তু কেউ কাজ করে না। যখন গভর্নমেন্ট থেকে টাকা পায়, তখনই কাজ করে। যে ২,৩টেগ্রুপ ছিল তাদের সঙ্গে কাজ করে প্রসেনিয়াম শিখেছিলাম, অভিনয়, পরিচালনা করেছিলাম।

 

এই ফর্মটা জানতাম না। আমাদের ওখানে কোনও লিটারেচারো ছিল না। আমি অনেক লাইব্রেরিতেও যেতাম, কিন্তু থিয়েটারের কোনও বই পেতাম না। আমি কীভাবে খুঁজব, কীভাবে পারফর্ম করব এটা জানতাম না। ফর্ম, স্টাইল, এলিমেন্ট কী হবে জানতাম না। আমি এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেঁসে গেলাম, যেখানে আমি যা করছি, সেখান থেকেই আমাকে শিখতে হবে। পারফর্ম করতে করতেই আমার যা অভিজ্ঞতা হতে থাকল, সেগুলোকেই রাখতে শুরু করলাম।

 

যেমন আমি বাচ্চাদের বসিয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করি, প্রশ্নোত্তর চালাই। বাচ্চাদের তাতে খুব ইন্টারেস্ট থাকত। তারপর আমি কিছুক্ষণের জন্য কোনও একটা চরিত্র হয়ে তাদের সামনে চলে আসি, কিছু প্রপস নিয়ে, কস্ট্যিউম বদলে। নাটক সাধারণত আমরা স্টেজের উপরে দেখি, একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমে দেখি। এই যে আমার ইন্টিমেট স্টাইল তাতে প্রথমেই নাটকের এই ধারণাটাই ভেঙে যায়, মানুষদের মনে হয়, এটা নাটক নয়, অন্য কিছু। সত্যি না কি নাটক? – এই ভাবনাতেই অনেকটা সময় চলে যায়। আমার কাছে এই নতুন ফর্মটা শেখা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল।

 

২০১১-১২ সালে আমি শো করার জন্য বাইরে বেরোলাম। ২০১২ সালে প্রথমবার আমি কলকাতায় পারফর্ম করেছিলাম। তারপর আমার বাইরেও আরও নতুন কিছু আবিষ্কার করার সুযোগ হল, আমি অনেক ফোক থিয়েটার দেখলাম, সারা দেশের নানা প্রোডাকশন দেখলাম, এগুলো দেখতে দেখতেই অনেক কিছু শিখেছি, এখনও শিখছি।

 

জিএক্স: প্রথম থেকেই একক অভিনয়ের ঝুঁকিটা কেন নিলেন? শুধুই ‘প্যাশন ফর থিয়েটার’ না কি মাথায় অন্য কিছু ঘুরছিল? আর এই যে আপনি অনেক বেশি করে ফোক থিয়েটার ও অন্যান্য পারফরম্যান্স দেখতে শুরু করলেন, কোনও একটা বা দু’টো ফর্মের কি আপনার উপর বেশি প্রভাব পড়েছিল?

 

লাকিজী: আমি যখন এটা প্রথম শুরু করেছিলাম, আমার একটাই লক্ষ্য ছিল যেকোনও ভাবেই হোক আমাকে আমার পারফরম্যান্স, আমার আর্টকে বাঁচাতে হবে। আমাকে কোনওভাবে শিখতে হবে। ২০০০-২০১০ – ১০ বছর প্রসেনিয়াম থিয়েটার করার পর, আমি যখন তা ছেড়ে পুরোপুরি বেরিয়ে এলাম, আমি সম্পূর্ণ ফাঁকা, ব্ল্যাঙ্ক ছিলাম যে আমি কোথায় যাব, কার কাছে শিখব। জীবনেও তো এমন হয়, যখন আমাদের সঙ্গে কেউ দাঁড়ায় না, আমরা জানি না আমাদের কী করতে হবে। আমি অনেক ফর্ম, অনেক ফোক ফর্ম দেখেছি। এমনও বেশ কিছু ফর্ম আছে, যেগুলির কোনও নাম নেই। যেমন – মাদারি খেলা। আমার সেটা দেখে মনে হয়েছিল এক ধরনের ফোক স্টাইল।

 

ইন্টারঅ্যাকশন, পার্টিসিপেশন আমাদের ফোক ট্র্যাডিশন-এ অনেক আগে থেকেই আছে। অনেকে আমাকে বলেন, “আপনি ব্রেখট-কে ফলো করেন, ব্রেখট-এর অ্যালিনিয়েশন-কে ফলো করেন।” ব্রেখট তো ১৫০ বছরের পুরনো। আমাদের নাট্যশাস্ত্রতে অ্যালিনিয়েশন আছে। অ্যালিনিয়েশন মানে আপনি পারফর্ম করতে করতে তার থেকে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এক সময়ে আপনি পারফর্ম করছেন, আপনি অভিনেতা, তারপর আপনি নিজের পারফরম্যান্স থেকে বেরিয়ে দর্শকদের ভেতরে চলে যাচ্ছেন। ফোরাম থিয়েটার ফর্ম-এ দর্শককেই পারফরম্যান্স-এর অংশ করে নেওয়া হয়, তাদের কথা শোনা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়। এই সবকিছু একে অন্যের সঙ্গে মিলে গেছে। আমাকে দর্শকেরা বলেছেন, এটা সবটা মিলে একটা নতুন ফর্ম তৈরি হয়েছে। আমি এই ফর্মটার মধ্যে এখনও আরও নতুন কিছু আবিষ্কার করে চলেছি। আমার মনে হয় অরিজিনালি আমার এই ফর্মটা কোনও না কোনওভাবে ফোক এলিমেন্ট, ফোক ফর্ম দ্বারাই অনুপ্রাণীত।

 

জিএক্স:আপনি যেমন বলছিলেন, মানুষের অ্যাটেনশন স্প্যান কমে আসছে, সবাই যেন দৌড়চ্ছে। গত ১২ বছরে আপনার কখনও মনে হয়েছে, নতুন কোনও নাটক করি? না কি একটাই নানাভাবে উপস্থাপনা করতেই চেয়েছেন?

 

লাকিজী: আমি নতুন কিছু নাটকও করেছি। ২০১৫, ২০১৭, ২০১৮ সালে একটা করে নতুন প্রোডাকশন করেছি। কিন্তু আমি সেগুলো কন্টিনিউ করিনি। কিছু কিছু শো করেছি, তারপর বন্ধ করে দিয়েছি। সেগুলো চাইলে আমি পরে আবার করতেও পারি। ২০২৪ সালের জুন মাসে আমি আরেকটা নতুন প্রোডাকশন করছি। এই যে পারফরম্যান্সটা এটা আমি আর মেইনস্ট্রিম দর্শকের জন্য করব না। এটা সারা ভারতের যে মেইনস্ট্রিম দর্শক, থিয়েটারের দর্শক প্রায় সকলের দেখা হয়ে গেছে।

 

এই প্রোডাকশনটা তো চলতেই থাকবে, এটা তো বাচ্চাদের জন্য কাজ করি। আমাদের দেশে তো কয়েক লাখ স্কুল আছে। আমি তো মাত্র কয়েক হাজার স্কুলে পৌঁছাতে পেরেছি। এখনও একটা বিশাল বড় সংখ্যক মানুষ আছেন, যাদের কাছে আমি পৌঁছাতে পারি। আর আমার পারফরম্যান্সটা এমন যে আজ থেকে ২০ বছর পরেও মনে হবে না যে এটা পুরনো হয়ে গেছে, এটা প্রাসঙ্গিকই থাকবে। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে সব বাচ্চাদের জন্য স্কুল হয়ে গেল, তাহলেও আমার পারফরম্যান্স-এর চরিত্রটি তাদের ইন্সপায়ার করবে। এটা আমার কাছে শুধু পারফরম্যান্স নয়, একটা জার্নি। বাচ্চাদের জন্য আমি এটা করতে থাকব।

 

জিএক্স: গত ১২ বছরে আমি প্রথম বার এই পারফরম্যান্সটি দেখলাম। আমি একটা জায়গায় বিশেষভাবে যেন কানেক্ট করতে পারলাম, কোভিড পরবর্তী ভারতে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়টিকে জুড়তে পেরে। আপনি যখন কোভিড পরবর্তী সময়ে এই পারফরম্যান্সটি নিয়ে বেরোলেন, আপনার উপর সেই সময়টার কোনও প্রভাব পড়েছিল? কিছু ঘুরছিল মাথার ভেতরে?

 

লাকিজী: কোভিড পরবর্তী সময়ে জীবনে তো তার প্রভাব পড়েছেই। কিন্তু জীবন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার মতো প্রভাবও আবার পড়েনি। কারণ, এত কিছুর পরেও যখনই বিধি-নিষেধ উঠে গেল, জীবন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমরা অসংখ্য মানুষকে হারিয়েছি, কিন্তু জীবন তো একই রকমভাবে চলতে থেকেছে। আমি আলাদাভাবে এটার উপরে ফোকাস করিনি। আমার যে অরিজিনাল ভাবনা সেটার সঙ্গেই আমি চলেছি। অনেক মানুষ অনেক রকম সাজেশন দেন, কিন্তু আমি যেটা আমার পারফরম্যান্স-এর জন্য সঠিক মনে হয়, সেটাই গ্রহণ করি, ইমপ্লিমেন্ট করি।

 

আমার দর্শকেরাও ভিন্ন হন আর তার উপর নির্ভর করে আমার পারফরম্যান্স-ও ভিন্ন হয়। কিন্তু স্টোরি আর তার পেছনে আমার ভাবনা একই থাকে। তার কারণ, প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা স্ট্রাগল আছে। আমি চেষ্টা করি আমার পারফরম্যান্স-এ বাচ্চাটির যে স্ট্রাগল তা দর্শকদের জীবনের স্ট্রাগলের সঙ্গে যাতে কানেক্ট করে।

 

আপনি যেমন বললেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে দেখে আপনি একভাবে কানেক্ট করেছেন, প্রত্যেক দর্শকই সেভাবে নিজেদের মতো করে কোনও না কোনওভাবে কানেক্ট করেন। প্রত্যেকের একটা আলাদা ভাবনা থাকে। আমি সেভাবেই তাদের সামনে বিষয়টিকে রাখি এবং তাদের ভাবনার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করি।

 

জিএক্স: এই যে বিভিন্ন দর্শকদের সামনে পারফর্ম করেন, বিশেষত বড়দের সামনে আর ছোটদের সামনে, সবচেয়ে বড় পার্থক্য কী চোখে পড়ে?

 

লাকিজী: আমার পারফরম্যান্স-এর যে প্রসেস, সেখানে বাচ্চাদের সঙ্গে তো আমার কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু যারা বড়, পরিণত দর্শক তারা নিজেদের একটা শেল-এ আটকে রাখেন। তারা প্রথম থেকেই নিজেদের বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে, নিজেদের একটা আলাদা পৃথিবী তৈরি করে নেন। সেক্ষেত্রে একটা চ্যালেঞ্জ হল, আমাকে তাদের সেই শেল থেকে বের করে আনতে হয়। যে ঘর তারা নিজেদের জন্য বানিয়ে তোলেন, নিজেদের বিচার-বিবেচনা কেন্দ্র করে, সেই ঘর থেকে কীভাবে তাদের বের করে আনব সেটা আমার জন্য খুব ইন্টারেস্টিং, চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বড় মানুষদের সঙ্গে আমার ভালো অভিজ্ঞতা হয়। আর বাচ্চাদের সঙ্গে তো আমার খুবই ভালো অভিজ্ঞতা হয়, কারণ তারা খোলা মনের হয়। কোনও ভাবনাকে নিজেদের ভাবনার প্রেক্ষিতে দেখে না। সামনে যা দেখে, তা সেই রঙেই দেখে। সেখানে আমাকে অতিরিক্ত কিছু করতে হয় না। কিন্তু বড়রা যারা থিয়েটার, সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সঙ্গে আমাকে একটু আলাদাভাবে পারফর্ম করতে হয়, তাদের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য।

 

জিএক্স: এই যে এনগেজ করার আপনার প্রক্রিয়া, কখনও আপনার কোনও অসুবিধা হয়নি বা হয় না?

 

লাকিজী: শুরুর দিকে আমার বেশ অসুবিধা হত। দ্বিধা হত অনেক সময়। বেশ কয়েক বার এরকম হয়েছে যে আমি তাদের ইনভল্ভ করার জন্য গেছি, কিন্তু তাঁরা হননি, তখন আমি যেন আটকে যেতাম। কিন্তু গত ৮,৯ বছরে আমার মনে পড়ছে না এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, আমি প্রসেসটা করতে পারিনি বা ব্যর্থ হয়েছি। হ্যাঁ, অবশ্যই এরকম হয় যে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া অন্য রকম হয়। তাঁরা হয়তো এক রকম কিছু একটা দেখবেন বলে বসেছেন, কিন্তু অন্য কিছু যখন দেখেন, তখন হয়তো সেটা ঠিকভাবে বুঝতে পারেন না বা ঠিক রিসিভ করতে পারেন না। কিন্তু এগুলোই আমার লার্নিং এক্সপেরিয়েন্স। প্রত্যেক জায়গায়, প্রত্যেক পরিস্থিতিতে, প্রত্যেক দর্শকের সামনে আমাকে সেই মাত্রায়, সেই এনার্জিতে, সেই ইন্টেনসিটি নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছতে হয়। একজন অভিনেতা হয়ে, একজন ওপেন এয়ার পারফর্মার হয়ে এটা আমার কাছে একটা খুবই শক্তিশালী ফরম্যাট।

 

আমাদের দেশে গত ১৫-২০ বছরে স্ট্রিট থিয়েটার (পথ নাটিকা আন্দোলন)মুভমেন্ট-ও খুব দুর্বল হয়ে গেছে। বিশেষত সফদর হাশমির মৃত্যুর পর (যদিও তাঁর নাটক সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ছিল)। যত বড় তাঁর আন্দোলন ছিল, তাঁর চলে যাওয়ার পর স্ট্রিট থিয়েটার যেন অনেক মন্থর হয়ে গেল।

 

বাদল সরকারের যে ফর্ম তা নিয়ে বাংলাতেও কোনও এক্সপেরিমেন্ট হয়নি। আমাকে অনেকে বলেন আপনি এই ফর্মটা, স্টাইলটা লিখুন। আমি তখন বলি, এর গ্রোথ বন্ধ হয়ে যায়। আমি করতেই থাকব। আমার তো কোনও লেখা স্ক্রিপ্ট নেই এর হিন্দিতে। কিন্তু কন্নড়, পাঞ্জাবীতে অ্যাডপ্ট হয়েছে, বাংলায় এখন হচ্ছে – যেগুলোর লেখা স্ক্রিপ্ট আছে। সারা বাংলাতেই যারা থার্ড থিয়েটার করছেন, তাঁদের আরও অনেক বেশি এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। যাতে মানুষ আরও বেশি কানেক্ট করতে পারেন।

 

১৯৯০-এর পর সিনেমার গতি অনেক বেড়ে গেল, আর গত ১০, ১২, ১৫ বছরে এই যে সেলফোনের দৌলতে যে ‘ক্রান্তি’ এসেছে তাতে থিয়েটারের অভিনেতারা যেন অনেক ছড়িয়ে গেছেন, তাঁদের মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হয়েছে। একজন অভিনেতার ২০ বছর আগে যে এনার্জি থাকত, এখনকার অভিনেতার তা নেই। অভিনেতার মনে হয়, যত এনার্জি তাঁকে এখানে দিতে হয়, তার চেয়ে কম এনার্জি ক্যামেরার সামনে দিলে তিনি স্টার হয়ে যাবেন। আমাদের যাঁরা শেখাতেন, তাঁরাও যেন খানিক দুর্বল হয়ে গেলেন, তাঁরা ততটা ক্ষমতা দিয়ে শেখাতে পারেননি, ফলে অনেক বেশি সংখ্যায় অভিনেতা বেরিয়ে আসতে পারেননি।

 

থিয়েটার থেকে তো কিছু পাওয়া যায় না। আজকের কোনও তরুণ যদি তুলনা করে, বলবে, “দেখুন উনি ২০ বছর ক্যামেরার সামনে কাজ করে কত বড় নাম হয়ে গেছেন, আপনি ২০ বছর থিয়েটারে দিয়ে কী হয়েছেন?” কিন্তু যা আমি শিখেছি, যা এক্সপ্লোর করেছি, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমার জীবনের গত ১২, ১৫ বছরে আমি কত কিছুই যে শিখেছি। আজকের অভিনেতারা দুর্বল হয়ে গেছেন, কারণ তাদের সামনে আজকের দিনে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক কিছু, তাঁদের ফোকাস কমে গেছে।

 

জিএক্স: আপনি যে কাজ করছেন, আপনার লেগাসি তৈরি করা নিয়ে কী ভাবেন? শেখানোর কথা, পরবর্তী প্রজন্ম তৈরির কথা ভাবেন?

 

লাকিজী: আমি তো ইতিমধ্যেই করছি। কোভিডের আগে থেকেই, গত ৪-৫ বছর ধরে। আমার মতো অনেক শিল্পী আছেন, যাঁরা এরকম কিছু করার ভাবছিলেন, কেউ আগের থেকেই করছিলেন, কিন্তু অতটা সাফল্য পাচ্ছিলেন না – আমার এই প্রোডাকশনের সাফল্যের পর অনেকেই ইনস্পায়ার্ড হয়েছেন। কেউ কেউ ছোট ছোট গ্রুপে এরকম মুভেবল পারফরম্যান্স করতে শুরু করেছেন। আগেও হত, কিন্তু এতটা ভরসা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে আমি যবে থেকে করছি, আমাকে দেখে অনেকেই এরকম প্রোডাকশন বানিয়েছেন আর সফলও হয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।

 

এই যে থিয়েটারের একটা ফ্রেম আছে যে থিয়েটার নির্দিষ্ট রকমের ও নির্দিষ্ট ভাবেই হতে হবে – বিশেষত বাংলা থিয়েটার, মারাঠি থিয়েটার – তাদের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পুরনো ধারা শেষ হয়ে গেছে, এবার নতুন ধারা খুঁজতে হবে। এখন ৫০ জন লোক নিয়ে ২ লাখ টাকার সেট বানিয়ে থিয়েটার করার সময় নয়। মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গে মানুষ এখনও ভাবেন যে সত্তরের দশক চলছে, কিন্তু সেই সময়টা তো আর নেই।

 

থিয়েটারকে এখন নতুনভাবে খুঁজতে হবে। কারণ যাঁদের আপনি থিয়েটার দেখাতে চান, ১৯৮০ সালে যাঁরা ছিলেন, ২০২৪ সালে তাঁরা নেই। আজ বিনোদনের হাজারটা মাধ্যম আছে, তখন কোনও মাধ্যম ছিল না, সেইজন্য দর্শকদের ফোকাস অন্যরকম ছিল। অভিনেতা, দর্শক – উভয়ের মধ্যেই আমরা এই ফোকাস নষ্ট হওয়াটা দেখছি। মানুষকে চমকে দেওয়ার জন্য আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনও নতুন ফর্ম খুঁজে বের করছি, মানুষ যতক্ষণ না বুঝছেন যে এটা একটা অন্য রকম জিনিষ, ততক্ষণ থিয়েটার দেখবেন না। আপনার থিয়েটারে বাকিদের থেকে আলাদা রকম কিছু থাকতে হবে।

 

থিয়েটারের ভিন্ন এক পরিভাষা থাকার যে শক্তি সেটা আমরা হারিয়ে ফেলছি। তার একটা কারণ, বর্তমানে ভারতের থিয়েটারের যে পরিস্থিতি, সেখানে দেশের সমস্ত থিয়েটার ইনস্টিটিউশন, থিয়েটার দলে যাঁরা নাটক শিখছেন, তাঁদের অধিকাংশের মূল লক্ষ্য হল, কিছু বছর পরে মুম্বই যাওয়া। তাহলে থিয়েটারকে কে ইন্সপায়ার করবে? কে বোঝাবে নতুনদের যে থিয়েটার একটা নতুন ফর্ম। আমি আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে একটা ওয়ার্কশপ করব। ১৫, ২০ জন অভিনেতা মিলে প্ল্যান করব, যাতে নতুন কিছু এই ধরনের ইনিশিয়েটিভ নেওয়া যায়।

 

জিএক্স: এই থিয়েটার, এই যে জার্নি এটা কি আপনার রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট-ও?

 

লাকিজী: থিয়েটারের নিজস্ব একটা রাজনীতি আছেই। আমার নিজের আলাদা কোনও রাজনৈতিক ভিউ নেই। আমার এই কাজটা ভালো লাগে, তাই আমি করি। কিছু ধারণা তো আছেই, কিন্তু আমি কোনও নির্দিষ্ট ধারণায় আটকে যাই না। হতে পারে, ৫ বছর পর অন্য কোনও ধারা আসলে, আমার চিন্তাও বদলে যাবে। আমি বলব না যে আমি চিরকাল এরকমই রয়ে যাব। ৫ বছর পর আমি হয়তো অন্য কোনও রকমের থিয়েটার করব। কিন্তু থিয়েটার একটা কমিটমেন্ট, একটা লক্ষ্যের সঙ্গে হওয়া প্রয়োজন। আমার মতে, থিয়েটার শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়। তার অনেক ভিন্ন ধরনের ডাইমেনশন আছে। থিয়েটার কারওর জীবন বদলে দিতে পারে, থিয়েটার কোনও খারাপ মানুষকে ভালো করে দিতে পারে। সেগুলোই খুঁজে চলেছি।

 

একটা কথা আপনাকে অবশ্যই বলতে চাইব, পশ্চিমবঙ্গে আসলে আমি এত বড় সব ব্যক্তিত্বদের দেখি, যাঁদের সারা পৃথিবী অনুসরণ করে। কিন্তু এখন যেন এখানকার তরুণ থিয়েটার কর্মীদের মধ্যে সেই এনার্জিটা হারিয়ে যাচ্ছে। তার অনেক কারণ থাকতে পারে। আমি চেষ্টা করব, তাদের সঙ্গে যখন কাজ করব, সেই এনার্জিটা আবার খুঁজে বের করার।

 

জিএক্স: আপনার নাটকে যেমন বেশ কিছু সামাজিক ইস্যু উঠে এসেছে, তেমনি মানবিক ইমোশন/আবেগও জুড়ে রয়েছে। এই ভারসাম্য তৈরি করাটা সহজ নয়। এটা কি করে করেন?

 

লাকিজী: আপনি একটা প্রশ্ন করেছিলেন, কী বদল আসছে – যেরকম চেঞ্জ আসছে, আমি তারসঙ্গে নিজেকে আপডেট করছি। এতটা ইমোশন ৫ বছর আগে ছিল না, এখন এসেছে। ৫ বছর আগে একবার যদি এই সংলাপটা বলতাম, “একবার জাকে আপনি মাম্মি-পাপাকা চেহেরা দেখনা” –  তাহলেই বাচ্চারা ইমোশনাল হয়ে যেত। এখন একটা খুব ইনটেন্স সিন চললেও, যেমন বাবার মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্যটি, সেখানে বাচ্চারা হাসে। এটা মৃত্যু দৃশ্য জানা সত্ত্বেও হাসে। এখন সত্যিই মানুষের ইমোশনে বদল আসছে। এখন রাস্তায় কাওকে মরে যেতে দেখলেও আমরা এগিয়ে না গিয়ে, পাশ কাটিয়ে চলে যাই।

 

যেভাবে সব মানুষের মধ্যে ইমোশন কমে আসছে, আমি সেইভাবেই নিজের পারফরম্যান্সেও বদল আনছি। সেইজন্যই আপনার বলা দু’টো জিনিসের মধ্যে আমাকে ব্যালান্স করে চলতে হবে। কেউ হয়তো ইমোশন দিয়ে জুড়তে পারছেন না, তিনি ভাবনা দিয়ে কানেক্ট করছেন, কিংবা এর উল্টোটা। বাচ্চাদের জন্য ইমোশন খুব জরুরি। আমি পারফরম্যান্সের সময় চাই বাচ্চারা ইমোশনাল হয়ে পড়ুক, কাঁদুক। আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের সেই জোন-এ নিয়ে যাই, যেখানে তারা কাঁদে। অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চারা কাঁদেও। একটি বাচ্চা কিছু দিন আগে আমাকে বলল, “স্যার, আজকে পাঁচ বছর পর আমার চোখ দিয়ে জল বেরিয়েছে।” আর এখনকার মা-বাবারা বাচ্চাদের কী শেখান? “কাঁদবে না, কাঁদা দুর্বলতার লক্ষণ”, “মেয়েদের মতো কেঁদো না”, ছেলেদের বিশেষ করে মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যে তারা ছেলে আর তাদের এমন তৈরি করে দেওয়া হয়, যেন তারা পাথর। বাচ্চাদের শেখানো হয়, তোমরা শুধু হাসো-খেলো, কেঁদো না। বাড়িতে দেখা যায়, মায়েরা কাঁদছেন আর ছেলেমেয়েরা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এটা তো তাদের ইমোশনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেওয়া। যদি আপনার হৃদয় দুঃখ পাওয়ার মতো কোনও ঘটনায় দুঃখ না পায়, তাহলে আপনি আর মানুষ কী থাকলেন? এটা তো বিপজ্জনক। এই যে এতো অপরাধ বেড়ে গেছে, অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, যাঁরা এগুলো ঘটাচ্ছেন তাঁদের ইমোশন কোথায়? ছোটবেলা থেকে তাদের মধ্যে যা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এগুলো তারই ফল।

 

জিএক্স:ভারতের বর্তমান যে পরিস্থিতি, কী মনে হয় আপনার জার্নি কোথাও বদলাবে? এই নাটকে কোনও পরিবর্তন আনবেন?

 

লাকিজী: দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগেও ছিল, এখনও আছে, সময় বিশেষে কিছু কিছু বদলাতে থাকে। এটা একজন মানুষের লড়াই নয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে একজন মানুষ লড়াই করে কিছু অ্যাচিভ করতে পারবেন না। আমি ধীরে ধীরে চেষ্টা করছি।

 

আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে একটা বদল এসেছে, যে আমরা খুব দ্রুত খুব ছোট জিনিসের জন্য বিক্রি হয়ে যাই। আমাদের কোনও আত্মসম্মান নেই। কেউ খুব ছোট কোনও লোভ দেখালেই আমরা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচিতি ছেড়ে দিই। আমার পরবর্তী নাটকেও আমি এমনই কিছু বিষয় নিয়ে আসার চেষ্টা করব। আমাদের থিয়েটারের লোকেরা সবাই আলাদা আলাদাভাবে লড়াই করছেন। সবাই একই রাস্তায় হয়তো যেতে চান, কিন্তু তাদের ট্র্যাক আলাদা, চিন্তাভাবনা আলাদা, কেউ একসঙ্গে দাঁড়াচ্ছেন না।

 

জিএক্স: আপনি কি নিশ্চিত, সবাই একই দিকে যেতে চান?

 

লাকিজী: আমার মনে হয়, সবার যাওয়া উচিত। কিন্তু তাঁরা চাইছেন কি না সেটা অবশ্যই আলাদা কথা। আপনাকে মানুষকে বিনোদনও দিতে হবে, শেখাতেও হবে। দু’টো জিনিস একসঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। এটা চলছে গত কিছু বছর ধরে। আমি নিজে যতটা পারব, চেষ্টা করে যাব। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গেই কাজ করব।

 

আর একটা কথা, আপনি কলকাতায় বসে লিখবেন, কলকাতার মানুষদের এটা জানাতে চাই, আমি তো সব মঞ্চেই এই কথাটা বলি, কললকাতা, দিল্লি, মহারাষ্ট্রে – থিয়েটারের দর্শকেরা সব জায়গাতেই ৪০ বা তার বেশি বয়সীরা, ৪০-৬০-এর মধ্যে। আমি কলকাতায় বেশ কয়েকটি ন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল দেখলাম, সেখানে ৯৫%-৯৬% দর্শকের বয়সই ৪০-এর উপরে। ১%-২% কলেজ পড়ুয়াদের দেখি, একটা হয়তো স্কুল পড়ুয়া দেখলাম। এই যে ৪০+ বয়সীরা, তাঁরা আগামী ২০ বছরে থাকবেন না, কেউ অসুস্থ হবেন, কেউ মারা যাবেন, কেউ আসতে পারবেন না। ২০ বছর পর কে নাটক দেখবেন?

 

আজ থেকে ২০ বছর আগে থিয়েটার নির্দেশকেরা যে দর্শক তৈরি করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই আজকের নির্দেশকেরা কাজ করছেন। এটা থিয়েটারের সামনে একটা বড় থ্রেট। এখন আমরা রয়েছি ফাইভ জি-র সময়ে। এখন বিনোদনও দ্রুত গতির হয়ে গেছে। আপনাকে বলতেও হবে না, আপনি ভাববেন আর তা আপনার সামনে চলে আসবে। কিছু বছর আ্গেও কলকাতায় আড়াই-তিন ঘন্টার নাটক হত, এখন দেড়-দু’ঘন্টার উপরে নাটক হলে মানুষ চলে যায়। দিল্লি-মুম্বইয়ের মতো মেট্রো শহরে এখন ১০-১৫ মিনিট, আধ ঘন্টার নাটক হয়। কারণ, এরচেয়ে বেশি সময় আপনি দর্শকদের আটকে রাখতে পারবেন না।

 

যারা নতুন নাটক করছেন, তাদের দায়িত্ব হল, যদি বছরে ১০টা এমন নাটক করেন, তাহলে অন্তত দু’টি নাটক এমন করুন যেগুলো বাচ্চারা দেখতে পারে। আমি যে থিয়েটার ওয়ার্কারদের সঙ্গে কাজ করছি, তাদের সকলকেই বলছি – আপনারা বড়দের জন্য থিয়েটার করা ছেড়ে দিন। আপনারা ছোটদের জন্য থিয়েটার করধন, বাচ্চাদের থিয়েটার দেখান, স্কুল-কলেজ থিয়েটার দেখান। তাহলে যে এখন ক্লাস সিক্সে পড়ছে, ছ’বছর পর যখন সে ক্লাস টুয়েলভে পড়বে, যদি সে নাটক নাও করে, শুধু দেখেও, তাহলে যখন সে কলেজে উঠবে, তখন তার মধ্যে নাটক দেখার একটা সেন্স কাজ করবে, বুঝতে পারবে নাটক কী। তাদেরই মধ্যে থেকে অনেক অভিনেতাও তৈরি হবেন। সেভাবেই দর্শকও তৈরি হবে। দুঃখজনক হল, ভারতে এখন খুবই কম সংখ্যক থিয়েটার নির্দেশক আছেন, যারা বাচ্চাদের জন্য কাজ করছেন, তাঁরাই কাজ করছেন যাঁরা টাকা পাচ্ছেন।

 

আমি বলছি, যেকোনও শিল্পী যদি আমার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে চান, আমি তাঁর শহরে গিয়ে তাঁর বাড়িতে থেকে তাঁর সঙ্গে কাজ করব। যদি তিনি থিয়েটারের জন্য কিছু করতে চান, তাহলে আমি তাঁকে ট্রেনিং দিতে, আমি কীভাবে থিয়েটার করি, আমার প্রসেস কী, আমি কীভাবে শো করি, কীভাবে ট্র্যাভেল করি, সবটুকু তাঁর সঙ্গে শেয়ার করব। থিয়েটারের প্রতি কমিটমেন্ট থাকা কেউ হতে হবে। আমার চেষ্টা জারি আছে।

 

জিএক্স: আপনার কখনও মনে হয়েছে, এই যে একক নাট্যকর্মী হিসাবে ভারত জুড়ে আপনার যে পরিচিতি তৈরি হয়েছে তা ‘গ্রান্ট’ পাওয়া নাট্যদলগুলি ‘থ্রেট’ হিসাবে দেখে?

 

লাকিজী: থ্রেট তো তৈরি করেইছে। এখন অনেক গ্রান্ট পাওয়া নাটকের দলে আমাকে আর ডাকে না। তারা ভাবে, “এ এসে নাটক করবে, আমাদের ছেলেমেয়েরা ইন্সপায়ার্ড হয়ে যাবে। বলবে স্যার এ তো একা নাটক করছে, আমরাও করব,” – এরকম অনেক জায়গায় হয়েছে। আমি কোথাও শো করতে গেছি, দু’মাস পরে নির্দেশক আমাকে ফোন করে বলছেন, “আপনি আমাদের সব শিল্পী ভাগিয়ে দিয়েছেন!” আমি তো অবাক! তাঁরা বলে, “কোনও মেয়ে সোলো করছে, কেউ স্কুলে গিয়ে সোলো করছে।” এটা তাঁদের জন্য থ্রেট, আমার জন্য ভালো। আমি বলছি না, সবাই সোলো করবেন, বা সবাইকে করতে হবে।

 

কিন্তু পুরনোরাও তো পুরনো ফরম্যাট ভেঙে নতুনদের নতুন কিছু শেখাচ্ছেন না। মানে তারা স্বার্থপর। তারা শুধু গ্রান্টের কথা ভাবেন। যদি গ্রুপ থিয়েটারের কথা ধরা যায়, ১০,০০০ টাকা একজন অভিনেতাকে দেয় ভারত সরকার, ১৫,০০০ টাকা একজন টিচারকে দেয়। প্রায় অধিকাংশ দলেই এই টাকা পাওয়ার পর তা দেওয়া হয় না। অভিনেতাদেরও দেয় না। তাদের বলে, ৫০০০ টাকা রেখে ৫০০০ টাকা গ্রুপে দাও। ধরা যাক, তাঁর দলে অসুবিধা আছে। এবার, ৫-৭ বছর নতুনদের নাটক শেখানোর পর যখন তাঁরা বলে, “স্যার আমরা নাটক করব না,” তখন তাঁরা বলে, “আরে ঠিক আছে, নাটক আর কী, তোমরা কোনও কাজ খুঁজে নাও পাশাপাশি।” আপনারা তাদের জন্য রোজগার তৈরি করতে পারেন না, তাহলে তাদের কেন ভুল পথে চালিত করেন, যে – নাটক শেখো, অথচ রোজগারের জন্য কাজ অন্য কিছু করো! যদি তাদের জন্য রোজগার তৈরি করতে পারেন, তাহলেই তাদের নাটক শেখান।

 

আমার সমসাময়িক এমন অনেক অভিনেতাকে আমি চিনি, যাঁরা আমার চেয়ে বেশি ট্যালেন্টেড হয়েও অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ একটা সময়ে পৌঁছে তাঁরা ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গেছেন, কাজ পাননি, পয়সা পাননি, বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা এখন চাকরি করেন। এটা তো থিয়েটারেরই ক্ষতি। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-য় প্রতি বছর ২০ জন পাশ করে বেরোন। তাহলে গত ২০-২৪ বছরে ৬০০-র বেশি অভিনেতা পাশ করে বেরিয়েছেন। আমার মনে হয় না, তাঁদের মধ্যে ৫০-৬০ জনও নিজের গ্রামে গিয়ে নাটক করছেন। প্রায় সবাই মুম্বাইতে আছেন। থিয়েটারের নামে তাহলে কী শেখানো হচ্ছে?

 

এটা তো একভাবে থিয়েটারকেই দুর্বল করে দেওয়া, তাকে ভেঙে দেওয়ার উপক্রম। আমার মনে তরুণ প্রজন্মকে একটা লড়াই শেখাতে হবে। এনার্জি জোগাতে হবে। এমন নয় যে থিয়েটারে পয়সা নেই। কাজ খুঁজে নিতে হবে। গত ১২ বছর ধরে কাজ করার পর, আগামী ছ’মাসে আমার কাছে মাসে গড়ে ৩০-৩৫টা শো রয়েছে। কিন্তু সব আমি করতে পারব না, ৩০% আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। এখানে পৌঁছানোর জন্য তো আমাকে শিখতে হয়েছে। এরকম তো নয় যে একজন করলেই সারা দেশ জুড়ে নাটক ছড়িয়ে পড়বে। আমি তো প্রায় সারা দেশ ঘুরে ফেলেছি, রোজই ফোন আসে, বিভিন্ন স্কুল-কলেজে যাওয়ার জন্য। আমি এখন বলি, আমি সব জায়গায় যেতে পারব না, যে শহরে যাই, সেখানে থিয়েটার কর্মীদের বলি, আপনারা শিখুন। কিন্তু শিখতে বললেই তো হয় না, তার জন্য নিজস্ব বোধ, সংস্কার থাকতে হবে। একটা প্রসেসের মধ্যে দিয়ে গেলে, একটা পরিবেশ পেলে তবেই তো তাঁরা শিখতেও পারবেন। কিন্তু আমি চেষ্টা করে যাব, সারা জীবনে আমার মতো আর একজনকেও তৈরি করতে পারলে তা আমার জন্য অনেক হবে।

 

জিএক্স: যদি এক লাইনে এখনও পর্যন্ত আপনার জার্নিকে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়, আপনি কী বলবেন?

 

লাকিজী: এক লাইনে? তাহলে বলতে হয়, এ আমার কল্পনারও অতীত, আমি জীবনে ভাবিনি এরকম কিছু আমি করে উঠতে পারব। যা আমি দেখেছি, যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তা অদ্ভুত। জীবনে নিয়ে আমার যা ভাবনা, তাকে এই জার্নি আরও সম্মৃদ্ধ করেছে। হৃদয় ছুঁয়ে ষাওয়া এমন সব অভিজ্ঞতা হয় আমার প্রতিদিন, যা আমাকে আরও অনুপ্রেরণা দেয়। অনেকে জানতে চান, আপনি ক্লান্ত হন না কেন? কারণ আমি জানি, এই কাজটা থেকে কী হতে পারে, মানুষের মধ্যে এর মাধ্যমে কী বদল আসতে পারে। তাই আমাকে প্রেরণা দেয়।

 

জিএক্স: আপনার কী মনে হয়, যিনি যেখান থেকে আসেন তার একটা প্রভাব থাকে? আপনি যে জায়গা থেকে এসেছেন, সেখানকার মানুষদের প্রতিদিন যা কিছু সহ্য করতে হয়, তার প্রভাব আপনার উপরেও আছে?

 

লাকিজী: নিশ্চিতভাবেই তার প্রভাব থাকে। উত্তর ভারতে শুরু থেকেই নানা ধরনের ডির্স্টাবেন্স ছিল। জীবনকে কেন্দ্র করে এরফলে এক ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। দক্ষিণ ভারত বা উত্তর-পূর্ব ভারতে ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি। উত্তর-পূর্ব ভারতের থিয়েটার দেখুন, তা কত শক্তিশালী। শক্তিশালী কারণ তাঁরা প্রতিনিয়ত বহু কিছু সহ্য করে চলেছেন।

 

 

Share this
Recent Comments
1
Leave a Comment