নির্লজ্জ সরকার, তাই পথে মেয়েরা


  • January 1, 2024
  • (1 Comments)
  • 620 Views

২৯ ডিসেম্বর কলেজ স্কোয়ারের ঐতিহ্যপূর্ণ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে মিড-ডে মিল রন্ধনকর্মীদের পাঁচটি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ ‘মিড-ডে মিল কর্মী ঐক্য মঞ্চ’ তাদের আটটি দাবি তুলল। রন্ধনকর্মী মেয়েদের দাবি, তাঁদের অধিকার আদায়ের লড়াই—রাষ্ট্রের মুখ ও রাজনীতির রূপকে কেমন করে চিনিয়ে দিচ্ছে তারই ছবি মেলে ধরলেন স্বাতী ভট্টাচার্য

 

অনেক কণ্ঠে স্লোগান, অনেক হাতে পতাকা, অনেক পায়ের মিছিল দেখলে ফাঙ্গাস-পড়া মনও আলোর দিকে মুখ ঘোরায়। মুখ যার বন্ধ, তারও কণ্ঠনালী কেঁপে কেঁপে ওঠে — ‘জবাব চাই, জবাব দাও।’ কিন্তু অতি-গরিব, অতি-অসহায় মেয়েগুলো এমন এক একটা কথা লিখে আনে পোস্টারে, যে কণ্ঠনালীও অসাড় হয়ে যায়। কলেজ স্কোয়ারের ঐতিহ্যপূর্ণ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিউট হল-এর মঞ্চের নীচে পোস্টার সাঁটা, “রন্ধনকর্মীদের মিড ডে মিল খাওয়ার আইনি অধিকার দিতে হবে।” এ-ও কি দাবি করার জিনিস নাকি, অ্যাঁ? সকাল আটটায় মেয়েরা ইস্কুলের রান্নাঘরে ঢোকে। তারপর জল তুলে, উনুন ধরিয়ে, তরকারি কুটে, মস্ত হাঁড়ি-ডেকচিতে রান্না করে, পাঁচটা কি আটটা ক্লাসের ছেলেমেয়েকে পরিবেশন করে খাইয়ে, বাসনপত্তর মেজে, রান্নাঘর আর খাবারের জায়গা মুছে যখন ওঠে, তখন বেলা আড়াইটে। তখন তারা নিজেদের রান্না-করা দু’টি ভাত-তরকারি মুখে দেবে না? সব ইস্কুলেই তো তা-ই হয়। এর জন্য দাবি তোলা কেন?

 

প্রশ্ন করতে পশ্চিমবঙ্গ মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়নের নেত্রী মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আমাদের অনেক সদস্যের হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে ফেলে দিয়েছে লোকাল কিছু লোক। বলেছে, ‘কোথায় লেখা আছে তোমরা খাবার খেতে পারো, দেখাও।’ তাই আমরা আইনি স্বীকৃতি চাইছি।” এই ‘লোকাল’-রা নিঃসন্দেহে রাজনীতির লেঠেল। যাঁরা খাদ্যনিরাপত্তার অধিকারের সুরক্ষাকর্মী, দলীয় রাজনীতির সামনে তাঁরা সম্পূর্ণ অসুরক্ষিত। তাই ২৯ ডিসেম্বর ধ্বনিভোটে যে প্রস্তাব পাশ হল, তার আটটি দাবির একটি হল মিড-ডে কর্মীদের মিড-ডে মিল খাওয়ার আইনি অধিকারের দাবি।

 

মনে পড়ল, বছর দুয়েক আগে এ ভাবেই সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে আশাকর্মীদের জমায়েতে প্ল্যাকার্ড চোখে পড়েছিল, “আশাকর্মীদের মাতৃত্বের ছুটি চাই।” রাজ্যের সব গর্ভবতী মেয়েদের মাতৃত্বের নিরাপত্তায় যে মেয়েরা নিয়োজিত, চব্বিশ ঘণ্টার যে কোনও সময়ে যাদের ডাক পড়তে পারে, সেই আশাকর্মীদের মাতৃত্বের ছুটির জন্য দাবি তুলতে হয়।

 

তেমনই নির্লজ্জ শ্রেণি রাজনীতি। উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুর থেকে আসা হালিমা বিবি (নাম পরিবর্তিত) সভায় দাঁড়িয়ে বললেন, “ইস্কুলের স্যারেরা আমাদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।” অর্থাৎ মাসিক দেড় হাজার টাকা বেতনে যজ্ঞিবাড়ির ভাত-তরকারি রাঁধলেই হবে না, তার সঙ্গে মাস্টারমশাইদের নির্দেশমতো ঝাড়ু-ঝাড়নও ধরতে হবে। এই অন্যায় দাবির চাইতেও যা পীড়া দেয়, তা হল উচ্চশিক্ষিতের নিচু দৃষ্টি। সরকারি প্রকল্পে নিযুক্ত কর্মীকে গৃহপরিচারিকা, কিংবা আরও সত্যি বললে, বাড়ির কাজে বেগার-খাটা মেয়ে-বউয়ের সমান করে দেখার অভ্যাস। সকলেই তো মেয়ে। মেয়েদের আবার অধিকার!!

 

“আমরা যে পনেরোশো টাকার চাকরি করি, তা বলতে আমাদের লজ্জা হয়, কিন্তু সরকারের লজ্জা হয় না,” সভামঞ্চে বললেন চায়না শেখ। ২০১৩ সালে ওই মজুরি ধার্য হয়েছিল, আজও এক পয়সা বাড়েনি। বরং ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে আসার পরে মিড-ডে মিল প্রকল্পে কেন্দ্র নিজের বরাদ্দের অনুপাত ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬০ শতাংশ করেছে। কেন্দ্রের হিসাবে রন্ধনকর্মীর ন্যায্য মজুরি হাজার টাকা, যার ৬০০ টাকা দিয়ে দায় সারে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যের সরকারগুলি, সম্ভবত ব্যবস্থা চালু রাখার দায়ে পড়ে, তাদের প্রদেয় চারশো টাকার উপর আরও কিছু দেয়। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মজুরির অঙ্ক ১৫০০ টাকা। অথচ কেরালা দেয় ৬০০ টাকা দৈনিক মজুরি, হরিয়ানা ৭০০০ টাকা, পুদুচেরি ১২০০০ টাকা, ওড়িশা ৩০০০ টাকা দেয়। এ ছাড়া নানা ধরনের ভাতা, অবসরকালীন টাকা, দুর্ঘটনা বিমা প্রভৃতি নানা রকম সুবিধে নানা রাজ্যের সরকার দেয়। কেন্দ্রীয় প্রকল্প হলেও, কর্মীদের প্রাপ্য সুবিধায় কোনও সমতা নেই। পশ্চিমবঙ্গে কেবল কম মজুরিতে কাজ করছেন মিড-ডে মিল কর্মীরা, তা-ই নয়। তাঁদের মাত্র দশ মাসের মজুরি দেওয়া হয়। সঙ্গত ভাবেই তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষকরা যদি সারা বছরের বেতন পান, তাঁরা পাবেন না কেন? সারা কর্মজীবন স্কুলে রান্না করলেও মেয়েদের সামাজিক সুরক্ষা জোটে না, বিধিবদ্ধ ছুটি নেই।

 

এ রাজ্যে যদিও ২ লক্ষ ৩৩ হাজার মিড-ডে মিল রন্ধনকারীর পদ আছে, কিন্তু স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের এই কাজ দেওয়া হয় বলে, গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় সাত-আট লক্ষ মেয়ে এই কাজ করেন। মাসের শেষে তাঁরা যা হাতে পান, তাতে কারও দৈনিক আয় দাঁড়ায় দু’শো টাকা, আবার কারও দশ-বিশ টাকা। নিজেদের দাবি নিয়ে মিছিল-মিটিং করলে চাপ আসে, “অন্য ব্যবস্থা করে নেব।” অর্থাৎ একটি গোষ্ঠীকে সরিয়ে অন্য গোষ্ঠীকে রান্নার কাজে লাগানো হবে। গরিবের অর্থাভাব এমন তীব্র, যে এত সামান্য টাকার জন্যেও মেয়েদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে থাকে। সহজেই তার ফায়দা ওঠায় দলীয় রাজনীতি। “অনেক ভয় দেখিয়েছে, তবু আমরা বারো জন আজ সভায় এসেছি,” বললেন হালিমা।

 

সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি আদায় করার লড়াইয়ে মিড-ডে মিল কর্মীদের পাশে রয়েছেন আশা, অঙ্গনওয়াড়ি-সহ নানা সরকারি প্রকল্পে কর্মরত মেয়েরা। এ বার মিড-ডে মিল কর্মীদের পাঁচটি সংগঠন ‘মিড ডে মিল কর্মী ঐক্য মঞ্চ’ নাম নিল। এই সংগঠনগুলি হল — সারা বাংলা মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন (এআইইউটিইউসি), পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড-ডে মিল) ইউনিয়ন (এআইসিসিটিইউ), পশ্চিমবঙ্গ স্বরোজগারী ও রাঁধুনি ইউনিয়ন (এসএমএস), অ্যাসোসিয়েশন অব মিড ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস (আম্মা) এবং পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন (সিটু)। তাঁদের সদস্যরা সভায় যে প্রস্তাবটি ধ্বনিভোটে পাশ করলেন, তার আটটি দাবির মধ্যে রয়েছে, রন্ধনকর্মীদের ন্যূনতম ২৬,০০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। যত দিন তা না-দেওয়া হয়, তত দিন রাজ্য সরকারের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে। দশ মাসের বদলে বারো মাসের মজুরি দিতে হবে, উৎসবকালীন ভাতা ও সরকারি বিধিবদ্ধ ছুটি দিতে হবে। শিশুদের মিড-ডে মিলে বরাদ্দ টাকা বাড়ানোর দাবিও তাঁরা করেন।

 

এই ভাবে এক মঞ্চে এসে একত্র দাবি তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বললেন সাংবাদিক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। এ দিন সভায় তাঁর বক্তৃতায় তিনি বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার মিড-ডে মিল কর্মীদের যে মজুরি দিচ্ছে, তা কার্যত তঞ্চকতা। শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত রাখা সরকারের কর্তব্য। রাষ্ট্র যদি মুখে সে দায়িত্ব স্বীকার করেও কাজে তা পালন না-করে, এবং আদালতও যদি রাষ্ট্রের কর্তব্যবিমুখতার প্রতিকার নাকরতে পারে, তা হলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে লাগাতার চাপ তৈরি করে যেতে হবে, যাতে অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করা যায়। শ্রমিক মেয়েদের দাবিগুলিকে কী করে নির্বাচনী দাবি-দাওয়ার মধ্যে তুলে আনা যায়, তা চিন্তা করতে বলেন তিনি।

 

বেলা আড়াইটেয় সভা শেষ। মেয়েরা বাড়ির পথে ফিরবেন। কেউ ভাড়া-করা বাসে, কেউ ট্রেনে। অনেকেই ভোর পাঁচটায় বেরিয়েছেন। ফিরেই রাতের রান্না বসাবেন। এঁরা বাসের ভাড়া দিয়ে, ট্রেনের টিকিট কেটে এসেছেন, হাতের পতাকাটা পেতেও চাঁদা দিতে হয়েছে। আন্দোলন যে কত কঠিন কাজ, অধিকার আদায়ের যুদ্ধ কী মূল্য দাবি করে যোদ্ধার থেকে, তা এই মেয়েদের দেখে শিখতে হয়। রাষ্ট্রের মুখ, রাজনীতির রূপ এই মেয়েরা যেমন করে চিনিয়ে দেন, তেমন আর কে?

 

ছবি: আম্মা সংগঠনের সূত্রে প্রাপ্ত।

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Ina Mitra on January 17, 2024

    মানুষ রূপী আমরা অমানুষরা বেশিরভাগ মানুষকে মনুষ্যেতর করে রেখেছি।। নানা ক্ষেত্রে এই বঞ্চনা জেনেও আমাদের গা-সয়া হয়ে গেছে।

Leave a Comment