লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বিরুদ্ধে আন্দোলনে, সমীক্ষায় বাদ পড়ে যান প্রতিবন্ধকতাযুক্ত নারীরা


  • December 27, 2023
  • (0 Comments)
  • 347 Views

প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সঙ্গে ঘটতে থাকা লিঙ্গভিত্তিক হিংসার চিত্রটি বাস্তব। অথচ তাঁরা যেন চোখের সামনে থেকেও দৃশ্যমান নন। তাঁদের কথাগুলো বৃহত্তর পরিসরে অকথিত, অশ্রুত রয়ে যায়। সেই হিংসার কথা আরও বেশি বলার দায়িত্ব, সামনে আনার দায় আমাদেরও রয়ে যায়। লিখলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

 

সিনেমাটি যখন দেখানো শেষ হল শ্রদ্ধা খাটোর তাঁর কমিউনিকেশন বোর্ড ব্যবহার করে জানালেন, সিনেমায় দেখানো হিংসার ঘটনাটি তার নিজের জীবনের। শর্ট ফিল্মটিতে দেখানো হয়েছিল কীভাবে ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে জটিল চাহিদা রয়েছে এমন একজন মেয়ের উপরে তার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা মানুষটি হিংসাত্মক আচরণ করছেন, তাকে মারধোর, তার চাহিদা-প্রয়োজন না বুঝে তাকে শারীরিক অত্যাচার করা ইত্যাদি চলে দিনের পর দিন। তার মা, বাবাকে কাওকেই মেয়েটি নিজের উপরে ঘটা অত্যাচারের কথা বোঝাতে পারেন না। এই হিংসা তাকে সহ্য করতে হয় দীর্ঘ সময়। শেষ পর্যন্ত মেয়েটির মা বুঝতে পারেন ও এই হিংসা বন্ধ হয়। শ্রদ্ধা নিজের উপর ঘটা হিংসার কথা সকলের সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু সকলে পারেন না। বেশিরভাগ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাই পারেন না। বিশেষত যাদের ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে জটিল চাহিদা থাকে। তারা যেভাবে নিজেদের সঙ্গে ঘটা হিংসা, অত্যাচার, বৈষম্যের কথা বোঝাতে পারেন, সেই অগমেন্টেটিভ ও অল্টারনেটিভ কমিউনিকেশন শেখার বা জানার পরিকাঠামো, ইচ্ছে কোনওটাই সামাজিকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেই বা থাকলেও সীমিত। ফলে এই মহিলাদের সঙ্গে ঘটতে থাকা হিংসা সামগ্রিকভাবে মেয়েদের সঙ্গে ঘটা লিঙ্গভিত্তিক হিংসাকে কেন্দ্র করে যে আলোচনা তার বাইরে রয়ে যায়।

 

বর্ষা ভট্টাচার্যরও ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে জটিল চাহিদা রয়েছে। তিনি এই ধরনের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সঙ্গে ঘটতে থাকা হিংসার বিষয়ে তাঁর তৈরি করা অডিও সহ (এক্ষেত্রে অডিও-র ভয়েস ওভার অপর একজন ব্যক্তি দিয়েছেন কমিউনিকেশন বোর্ড ব্যবহার করে বর্ষা যে লেখা তৈরি করেছেন তার ভিত্তিতে) পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন-এ ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে জটিল চাহিদা রয়েছে – এই বিষয়টিকে স্পষ্ট করতে লিখেছেন – “এই টার্মটি ব্যবহার করা হয় তাদের জন্য যাদের স্পিচ, ল্যাংগুয়েজ ও কমিউনিকেশন নিয়ে সমস্যা আছে। যারা যে কোনও কারণেই হোক কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না বা সঠিকভাবে ভাষা ব্যবহার করতে পারে না।“

 

বর্ষা নিজের প্রেজেন্টেশন-এ জানান এই ধরনের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারা কীভাবে মনের ভাব প্রকাশ করেন। তাঁরা কখনও ইশারা, কখনও মুখের ভাবভঙ্গি, সাইনিং, কখনও ছবির সাহায্যে, কখনও বা হাইটেক সফটওয়্যার, অ্যাপ, ডিভাইস ইত্যাদির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করেন। এই সব মাধ্যমগুলিকে একত্রে বলা হয় অগমেন্টেটিভ অ্যান্ড অল্টারনেটিভ কমিউনিকেশন (এসিসি)।

 

বর্ষা জানান, ২০১৩ সালে কলকাতায় ঘটে যাওয়া ভাব বিনিময়ে জটিল চাহিদা রয়েছে এমন এক তরুণীর সঙ্গে ঘটা যৌন হেনস্থার কথা। সেই তরুণী দুই নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে থিয়েটার দেখে ফেরার সময় অন্ধকার পথে তাকে যৌন নিগ্রহ করা হয়। মেয়েটি কাঁদতে থাকেন, বাড়িতে এসে ইশারায় মা-কে ঘটনার কথা জানান। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও পরে তাঁর শরীরে কালশিটে ও আঁচড়ের দাগ থাকায় ও তিনি ক্রমাগত কাঁদতে থাকায় বাবা-মা থানায় নিয়ে যান। এই ঘটনায় মেয়েটির জবানবন্দী নথিবদ্ধ করার সময় আইন অনুসারে একজন স্পেশাল এডুকেটর-এর সাহায্যে তা হওয়ার কথা, কিন্তু পুলিশ তা করতে অস্বীকার করে। সেই তরুণী যা বলেন, পুলিশ তা বুঝতে পারে না এবং কেসটি এমনভাবে সাজানো হয় যে অভিযুক্তরা ছাড়া পেয়ে যায়।

 

আরও একটি ঘটনার কথা বর্ষা তুলে ধরেন, যা কলকাতায় ঘটেছিল ২০১৮ সালে। একটি ১১ বছরের কিশোরীকে প্রতিবেশী এক যুবক নিয়মিত ফুঁসলিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করে ও নিয়মিত নির্যাতন করতে থাকে। কিশোরী মেয়েটি কথা বলতে পারে না। বিষয়টি বাড়িতে জানালে তাকেই বকাবকি করা হয়। স্কুলে শিক্ষিকাদের সন্দেহ হলেও বাবা-মা স্বীকার করতে চাননি। অবশেষে মেয়েটির রক্তপাত শুরু হয় ও জরায়ু বাইরে বেরিয়ে এলে বাবা-মা ভয় পেয়ে পুলিশে রিপোর্ট করেন। ততদিন অভিযুক্ত পালিয়ে গেছে। কেসটি এখনও চলছে।

 

শ্রদ্ধা খাটোর, বর্ষা ভট্টাচার্য – দু’জনেই এসিসি অ্যাক্টিভিস্ট, প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলন কর্মী। তাঁরা দু’জনে শুধু নিজেদের নয়, নিজেদের মতো আরও অনেক প্রতিবন্ধী মহিলার সঙ্গে ঘটতে থাকা হিংসা, যৌন হিংসার বিষয়টি তুলে ধরেন সম্প্রতি কলকাতা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি পাব্লিক মিটিং-এ। শ্রুতি ডিসএবিলিটি রাইটস সেন্টার ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পলসি-র যৌথ উদ্যোগে এই মিটিংটি আয়োজিত হয়।

 

মহিলাদের প্রতি হওয়া বৈষম্য, হিংসা, যৌন নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে যখনই আলোচনা হয়, তখনই তার থেকে মুখ্যত বাদই পড়ে যান প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারা। কারণ পরিবার, সমাজ, প্রশাসন – কেউই মনে করে না যে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সঙ্গে হিংসার ঘটনা ঘটতে পারে। তাঁদের মহিলা হিসাবে, মানুষ হিসাবে গন্য করা এবং তাঁদের সঙ্গে ঘটতে থাকা লিঙ্গভিত্তিক হিংসার ঘটনাগুলি তাই আড়ালে রয়ে যায়।

 

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে বৃহত্তর মহিলা আন্দোলনেও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত নারীদের সঙ্গে ঘটতে থাকা বহুস্তরীয় লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বিষয়টি আমাদের দেশে বাইরে রয়ে যায়। আবার এ কথাও সত্যি সামগ্রিকভাবে প্রতিবন্ধী আন্দোলনের পরিসরের মধ্যেও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের দাবি-দাওয়া, বৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক হিংসা, যৌন নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ইত্যাদি বিষয়গুলি সামনের সারিতে আসে না। লিঙ্গ সংবেদনশীলতা (জেন্ডার সেনসিটিভিটি) বিষয়টি এক্ষেত্রে কিছুটা যেন অনুপস্থিত বলেই মনে হয়।

 

লিঙ্গভিত্তিক হিংসা প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সঙ্গে হওয়া সহিংসতার মধ্যে অন্যতম। যারা এই ধরনের ঘটনা ঘটান তারা আসলে ধরেই নেন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারা অভিযোগ করলে তা গ্রাহ্য হবে না, তাঁরা এতটাই প্রান্তিক ও পরনির্ভরশীল যে নিজেদের সঙ্গে হওয়া হিংসা-হেনস্থার কথা জানাতে সাহস পাবেন না। ফলে প্রতিবন্ধকতাকে দুর্বলতা ভেবে নিয়ে তাঁদের উপর হিংসা চলতে থাকে।

 

অন্যদিকে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে যেহেতু মনে করা হয় যে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারা, ‘অন্য মহিলাদের মতো নন’ – তাই তাঁদের উপর কোনওরকম লিঙ্গভিত্তিক হিংসা ঘটতেই পারে না। এই ধরনের নির্যাতনের কথা তাই তাঁরা জানালেও, শারীরিক নিগ্রহের প্রমাণ দেখালে, বোঝানোর চেষ্টা করলেও তাই তাঁদের উপেক্ষা করার, মেনে না নেওয়ার মানসিকতাই বেশি চোখে পড়ে।

 

কলকাতা শহরে মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বিভিন্ন বয়সের মহিলাদের উপরে কখনও প্রতিবেশি, কখনও অপরিচিত পুরুষদের দ্বারা যৌন নিগ্রহ, ধর্ষণের ঘটনা বহুবার খবরে উঠে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেও এরকম বহু ঘটনা রয়েছে। পরিবারের পাশাপাশি প্রশাসনও এই বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারাও একইভাবে বহু ক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ, শারীরিক হেনস্থার শিকার হন, এবং তাঁদের অভিযোগ দায়ের হয় না। তথ্য সামনে না আসায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার উদাহরণও তৈরি হয় না।

 

প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের বহুস্তরীয় প্রান্তিকতা এভাবেই তাঁদের উপর লিঙ্গভিত্তিক হিংসা একদিকে যেমন বাড়াতে থাকে, তেমনি এই নিয়ে তাঁদের অভিযোগকেও অদেখা করে দেয়। লিঙ্গভিত্তিক হিংসার মধ্যে ঋতুস্রাব, প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মহিলাদের যেভাবে অত্যাচারিত হতে হয় তা সামনে আসে না। যাতে গর্ভধারণ করতে না পারে তারজন্য বিনা অনুমতিতে, তাঁকে না জানিয়েই জরায়ু বাদ দিয়ে দেওয়া, ঋতুকালীন সময়ের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে তাঁকে অস্বাস্থ্যকর ভাবেই রেখে দেওয়া ইত্যাদি এ দেশের প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের জীবনের বাস্তব।

 

মেয়ে, প্রতিবন্ধী মেয়ে, তার উপরে নির্দিষ্ট ধর্ম পরিচয়, পিছিয়ে পড়া শ্রেণী, সুবিধাবঞ্চিত আর্থ-সামাজিক অবস্থান – এইসবই তাঁদের উপরে ঘটতে থাকা লিঙ্গভিত্তিক হিংসার কথা আড়ালে রেখে দেয়। পরিবারের মানুষেরা এগুলিকে সামাজিক লজ্জা, প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদেরই সমস্যা ইত্যাদি ভেবে গোপন রাখেন।

 

ভারতের আইনে আইনি সহায়তার উল্লেখ থাকলেও ঘটনাগুলি যেহেতু পুলিশ-প্রশাসন পর্যন্তই পৌঁছায় না, অভিযোগ দায়ের হয় না, ফলে আইনি পরিসরেও আসে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আইন, ২০১৬ তো রয়েইছে। পুলিশ, আদালত সর্বত্র আলাদা আলাদা প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার জন্য, আইনি প্রক্রিয়া চালানোর জন্য স্পেশাল এডুকেটর, সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রেটার, প্রতিবন্ধী-বান্ধব পরিকাঠামো থাকার কথা। এ কথা তো ঠিক, এই সমস্ত কিছু রাখার দাবি তখনই তোলা সম্ভব যখন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের দৃশ্যমানতা বাড়বে। অভিযোগই যেখানে গোপন রাখা, দাবিয়ে রাখা হয়, সেখানে থানা বা আদালতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারাও নিজেদের সঙ্গে ঘটা হিংসার কথা জানাতে পৌঁছাতে পারেন না, পারলেও নানাবিধ বাধায় তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যায় পান না।

 

ভারতীয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো সদ্য তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে মহিলাদের সঙ্গে ঘটা বিভিন্ন ধরনের হিংসার রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। অথচ সেখানে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি, অ্যাডভোকেসি সত্ত্বেও আলাদাভাবে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সঙ্গে ঘটা হিংসা, বিভিন্ন ধরনের হিংসার কোনও পরিসংখ্যান এবারেও দেওয়া হয়নি।

 

প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলাদের সঙ্গে ঘটতে থাকা লিঙ্গভিত্তিক হিংসার চিত্রটি বাস্তব। অথচ তাঁরা যেন চোখের সামনে থেকেও দৃশ্যমান নন। তাঁদের কথাগুলো বৃহত্তর পরিসরে অকথিত, অশ্রুত রয়ে যায়। সেই হিংসার কথা আরও বেশি বলার দায়িত্ব, সামনে আনার দায় আমাদেরও রয়ে যায়।

 

Share this
Leave a Comment