শিশুদের আরও পুষ্টিকর খাদ্য, রাঁধুনিদের সরকারি স্বীকৃতি: আন্দোলন জোরালো করতে মঞ্চ গড়ল রাঁধুনিদের পাঁচ সংগঠন


  • December 20, 2023
  • (0 Comments)
  • 676 Views

সুদর্শনা চক্রবর্তীর রিপোর্ট।

২০/ ১২/ ২০২৩

 

“আমরা তো মা। এই বাচ্চারাও আমাদের কাছে নিজেদের সন্তানের মতো। তাদের খাবার দিতে না পারলে আমাদের কতটা কষ্ট হয়…। নিজেদের দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার দাবি আমরা আগে রাখছি,” কলকাতা প্রেস ক্লাবে মিড-ডে মিল কর্মী ঐক্য মঞ্চের সাংবাদিক সম্মেলনে কথাগুলি বলছিলেন আমেনা বেগম, অ্যাসোসিয়েশন অফ মিড-ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস (আম্মা)-র উত্তর ২৪ পরগনা জেলা, বসিরহাটের সভানেত্রী।

 

১৯ ডিসেম্বর সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করল ‘মিড-ডে মিল কর্মী ঐক্যমঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ’— যা পশ্চিমবঙ্গের মিড-ডে মিল কর্মীদের পাঁচটি সংগঠন নিয়ে গড়ে ওঠা একটি যৌথ মঞ্চ। সংগঠনগুলি হল— পশ্চিমবঙ্গ মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন, পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী ইউনিয়ন, সারা বাংলা মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন, অ্যাসোসিয়েশন অফ মিড-ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস, পশ্চিমবঙ্গ স্বরোজগারী ও রাঁধুনি ইউনিয়ন।

 

গত ১০ বছরে মিড-ডে মিল কর্মীদের সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি, মজুরি বৃদ্ধি, সবেতন ছুটি, শিশুদের নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্যের সরবরাহের মতো দাবিগুলি নিয়ে এই সংগঠনগুলি পৃথকভাবে লাগাতার আন্দোলন করলেও অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গের সরকার কোনও সাড়া দেয়নি। দেশের অন্যান্য রাজ্যের বেশ কয়েকটিতেই মিড-ডে মিল কর্মীদের দাবি-দাওয়া আংশিক বা পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে এই পরিষেবার মানোন্নয়নও ঘটেছে বলে দাবি ঐক্যমঞ্চের।

 

পশ্চিমবঙ্গে মিড-ডে মিল কর্মীদের লড়াইয়ের সঙ্গে জুড়ে গেছে উপভোক্তা (এক্ষেত্রে যারা নিতান্তই শিশু) তাদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের দাবিও। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ন্যায্য দাবি না-মানার অনড় অবস্থানের জন্য এই পরিষেবা যখন ক্ষতিগ্রস্ত এবং নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তার দায় এসে পড়ছে মিড-ডে মিল কর্মীদের উপরেই। অস্বাস্থ্যকর খাবার, খাবারের গুণগত মান বা পরিমাণে হেরফেরের মতো ত্রুটি ঘটলে, অভিভাবকদের যাবতীয় রোষের শিকার হচ্ছেন মিড-ডে মিল প্রকল্পের কর্মীরা, যাঁরা এই প্রকল্পের মুখ।

 

রাঁধুনি দিদিরা আক্ষেপ করে জানালেন, বাস্তব চিত্রটি হল শিশুদের খাদ্যপরিষেবা ঠিক রাখার জন্য মাত্র ১৫০০ টাকা মাসিক মজুরিতে শ্রম দেন তাঁরা। এবং খাতায়-কলমে তাঁদের পরিচয় ‘স্বেচ্ছাসেবক’। ১২ মাস কাজ করে মজুরি পান ১০ মাসের। এই ১৫০০ টাকাও একজন কর্মী নন, অনেক ক্ষেত্রেই ভাগ হয়ে যায় দায়িত্বে থাকা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে, ফলে প্রত্যেক কর্মী পান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাসে ২৫০-৩০০ টাকা। এই সামান্য টাকাটুকুও বেতন নয়, কারণ তাঁদের সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি নেই। নেই মাতৃত্বকালীন ছুটি।

 

এর পাশাপাশি বহুমূল্য বেসরকারি স্কুলের রমরমা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি স্কুলগুলি হয় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে নতুবা সেখানে শিক্ষক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো এতটাই অপ্রতুল করে দেওয়া হচ্ছে যে স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমছে ক্রমশই। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী পরিবারের শিশুদের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে নষ্ট করে দেওয়ার এই সরকারি নীতির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন রাজ্যের মিড-ডে মিল কর্মীরা।

 

মিড-ডে মিল কর্মীদের সংগঠনগুলির গুরুতর অভিযোগ, মাঝে এ রাজ্যে বরাদ্দ বাড়িয়ে তারপর ফের তা বন্ধ করে দেওয়া এবং এই প্রকল্পে সরকারের নানা অনিয়মের জন্য ‘উদ্বৃত্ত অর্থ যে চুরি হচ্ছে’ তাবোঝা যাচ্ছে। তাঁদের দাবি, এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

ঐক্যমঞ্চের নেতৃত্ব জানান, পশ্চিমবঙ্গে মিড-ডে মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মীদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান ও ছাত্রছাত্রীদের সঠিক পুষ্টি প্রদানের উদ্দ্যেশ্যে বরাদ্দ বৃদ্ধি করার জন্য দীর্ঘ ১০ বছরের আন্দোলনের পর বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য একটি যৌথ মঞ্চের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কেন্দ্র ও রাজ্য কোনও সরকারই এই প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না। সেক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই যেখানে এই প্রকল্পের প্রতি দায়বদ্ধ, সেখানে আগামী বছর, ২০২৪-এ আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে এই ঐক্যমঞ্চের আত্মপ্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ।

 

যে বিষয়গুলি সামগ্রিকভাবে বারেবারেই মিড-ডে মিল কর্মীদের আন্দোলনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে:

 

  • পশ্চিমবঙ্গে মিড-ডে মিল প্রকল্পের অধীনে প্রায় ২ লক্ষ ৩৩ হাজার পদ থাকলেও প্রতিটি পদের পেছনে এক বা একাধিক স্বনির্ভর গোষ্ঠী কাজ করে। ফলে সরকার অনুমোদিত স্কুলগুলিতে ৭-৮ লক্ষ রন্ধনকর্মী কাজ করছেন। তাঁদের মজুরি অত্যন্ত কম।

 

  • এটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প। কিন্তু এটি চালানো হয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ আর্থিক দায়িত্বে। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে প্রথম দফায় ক্ষমতা দখলের পর মিড-ডে প্রকল্পের বরাদ্দ ৭৫% থেকে কমিয়ে ৬০% করে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশের মিড-ডে মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মীদের মজুরি ১০ মাসের জন্য মাসিক ১০০০ টাকা নির্দিষ্ট করে দেয়। গত কেন্দ্রীয় বাজেটে মিড-ডে মিল প্রকল্পের বরাদ্দ ১৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

  • ২০১৩ সাল থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে ৬০০ টাকা কেন্দ্র ও ৪০০ টাকা রাজ্য সরকারের দেয়, সেইসঙ্গে ৫০০ টাকা অতিরিক্ত দিয়ে মোট ১৫০০ টাকা পশ্চিমবঙ্গের মিড-ডে মিল কর্মীদের জন্য মজুরি হিসাবে ধার্য করা হয়েছে।

 

  • মূল্যবৃদ্ধি যেখানে আকাশছোঁয়া সেখানে মিড-ডে মিল-এ প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির জন্য বরাদ্দ ৫.৪৭ টাকা এবং পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য বরাদ্দ ৮.১৪ টাকা। এই বরাদ্দে প্রকল্পের যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ‘শিশুদের পুষ্টি’ তা পূরণ করা অসম্ভব।

 

  • মিড-ডে মিল কর্মীদের ১২ মাস কাজের বিনিময়ে ১০ মাসের মজুরি দেওয়ার ঘটনায় ২০২০-এর ডিসেম্বরে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে মিড-ডে মিল কর্মীদের এই মজুরিতে কাজ করানোকে ‘বেগার খাটানো’ বলে উল্লেখ করে সরকার নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি দেওয়া ও একইসঙ্গে ন্যূনতম মজুরি হিসাবে প্রাপ্য বিগত ১৫ বছরের বকেয়া মিটিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছে। এমন একটি রায় থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিক্ষা নিতে পারত বলে এ রাজ্যের কর্মী ইউনিয়নগুলির মত।

 

দেশের কয়েকটি রাজ্য যেখানে রাজ্য সরকার রাজ্য তহবিল থেকে রন্ধনকর্মীদের অতিরিক্ত মজুরি ও ছাত্র-ছাত্রীদের মিড ডে মিল বাবদ অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ ও করেছে —

 

  • হরিয়ানায় রন্ধনকর্মীদের ৭০০০ টাকা মজুরি ও পোশাক বাবদ বছরে ৬০০ টাকা;
  • কেরালায় দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি ও ১৩০০-২০০০ টাকা উৎসব ভাতা;
  • পচেরিতে ১২০০০ টাকা মজুরি;
  • হিমাচল প্রদেশে ৪০০০ টাকা মজুরি;
  • কর্নাটকে ৪০০০ টাকা মজুরি,১০০০০০ টাকা দুর্ঘটনায় মৃত্যুকালীন ক্ষতিপূরণ এবং আহত হলে ক্ষতিপূরণ ৩০০০০-৫০০০০ টাকা;
  • ওড়িশায় ৩০০০ টাকা মজুরি;
  • উত্তরাখণ্ডে ১০০০ টাকা উৎসব ভাতা এবং পোশাক বাবদ ১০০০ টাকা;
  • বিহারে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ ৫০০০০০ টাকা;
  • অন্ধ্রপ্রদেশে সরকার নির্দেশিত বরাদ্দ ছাড়াও অতিরিক্ত অর্থ রাজ্য সরকারের তহবিল থেকে যোগ করে ছাত্রছাত্রীদের ৫ দিন ডিম এবং প্রতিদিন মিষ্টি দেওয়া হয়;
  • একইভাবে কর্নাটকে ছাত্রছাত্রীদের ৪ দিন ডিম ও যারা ডিম খায় না তাদের কলা ও প্রতিদিন মিষ্টি দেওয়া হয়।

 

মিড-ডে মিল কর্মী ঐক্য মঞ্চের দাবি—

 

  • অবিলম্বে মিড-ডে মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মীদের ২৬০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে, যতদিন তা না-দেওয়া হচ্ছে ততদিন রাজ্য সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি দেওয়া;
  • ১০ মাসের বদলে ১২ মাসের মজুরি দেওয়া;
  • রন্ধনকর্মীদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি ও পরিচয়পত্র দেওয়া;
  • স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য রান্না করা পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো;
  • ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে রন্ধনকর্মীদের মজুরি দেওয়া (তাঁদের মতে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা মানে স্বীকৃতি, তা না থাকায় যখন-তখন কর্মীদের কাজ থেকে ছাঁটাইও করা হয়);
  • উৎসবকালীন ভাতা ও সরকারি বিধিবদ্ধ ছুটি দেওয়া;
  • রন্ধনকর্মীদের মিড-ডে মিল খাওয়ার আইনি অধিকার দেওয়া;
  • মিড-ডে মিল কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা;
  • মিড-ডে মিল প্রকল্পের বেসরকারিকরণ করা কিংবা এনজিও-দের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা বন্ধ করা।

 

“নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলির ম্যানিফেস্টোতে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে যে কর্মীরা কাজ করছেন তাঁদের দাবি, তাঁদের কথা রাখার অনুরোধ আমরা নিশ্চয়ই করব। আগামী দিনে যাঁরা সরকার গড়বেন তারা যাতে এই ম্যানিফেস্টো কার্যকর করেন তাও আমাদের দাবি। নির্বাচনের আগে আমরা কনভেনশন করছি, সেখান থেকে আরেক দফা দাবি তোলা হবে। তাছাড়া সব জায়গায় স্মারকলিপি দেওয়া হবে। আমরা সরকারকে ভাবার সময় দেব, সরকার যদি না-মানে আমাদের আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে।” জানালেন পশ্চিমবঙ্গে মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়নের তরফে মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

 

উল্লেখযোগ্য যে, নাম বদলে সুপ্রিম কোর্টের খাদ্যসুরক্ষা মামলার নির্দেশ অনুযায়ী বিগত সরকারের প্রকল্প ‘আত্মসাৎ’ করার তাড়নায়, মিড-ডে মিল প্রকল্পের নাম বদলে কেন্দ্রীয় সরকার তার নতুন নামকরণ করেছে ‘পিএম পোষণ যোজনা’। মিড-ডে মিল কর্মীদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভোজনমাতা’। অভাব-অভিযোগ থেকে স্পষ্ট, নাম বদল হলেও বদলায়নি মিড-ডে মিল কর্মীদের শোষণ ও বঞ্চনা।

 

Share this
Leave a Comment