৪১ জন শ্রমিক নেহাতই ‘স্পেকটাকেল’, আসলে আমরা ভুলেই যাব


  • November 29, 2023
  • (0 Comments)
  • 385 Views

৪১ জন শ্রমিকের বাঁচার ইচ্ছাকে দেশসুদ্ধ সবাই কুর্নিশ করছেন। মরে গেলেও ভুলেই যেত, বেঁচে গেছেন বলে তাও পরের শিরোনাম তৈরির আগে পর্যন্ত মনে রাখবে। লিখেছেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

আমরা আসলে একটা স্পেকটাকেল চাই। সেটা যতক্ষণ না তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ আমোদ হতে পারে না। জীবন, মৃত্যু, ভয়, ট্রমা, অপেক্ষা – এই শব্দগুলো যতক্ষণ না সেই স্পেকটাকেল-এর অংশ হয়ে উঠছে ততক্ষণ ঠিক দর্শক পাওয়া যায় না। এখন হাততালির অনুরণন শোনা যাচ্ছে কারণ, ৪১ জন শ্রমিক ১৭ দিন ধরে সেই স্পেকটাকেল তৈরি করে গেছেন। ১২ থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত টানা ১৭ দিন উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে ধসে আটকে থেকে বেঁচে ছিলেন তারা। কী আশ্চর্য না? ‘বেঁচে’ ছিলেন তারা, হেরে যাননি, মরে যাননি, বেঁচে গেছেন। আর ১৭ দিন ধরে সুড়ঙ্গের ভেতরে থাকতে থাকতে, বাঁচতে বাঁচতে স্পেকটাকেল হয়ে উঠেছেন ক্রমশ। ৪১ জন শ্রমিক।

 

মজার ব্যাপার হল ১২ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত ৭/৮ দিন তারা খবরের শিরোনাম হননি। স্রেফ টুকরো খবর হয়ে রয়ে গিয়েছিলেন। তখন ক্রিকেট বিশ্বকাপের ভরা মরশুম। ১২ বছর পর ভারতের সামনে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জেতার সুবর্ণ সুযোগ ছিল। এই সব শ্রমিকদের সুড়ঙ্গে আটকে থাকার খবর খুব একটা বিক্রিযোগ্য ছিল না।

 

১৯ নভেম্বর রবিবার যখন গুজরাটের আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখার জন্য ১ লাখ ৩০ হাজার দর্শক গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন, তখন ৪১ জন শ্রমিক আট দিন সুড়ঙ্গের ভেতরে কাটিয়ে ফেলেছেন, বেঁচে আছেন। সেদিন, ১১ জন ভারতীয় ক্রিকেটারের জয়ী হওয়া দেখার জন্য শুধু গ্যালারি নয়, সারা দেশের আরও লাখ লাখ মানুষ খেলা দেখেছেন। ফাইনাল এই ম্যাচ টিকিট বিক্রি শুধু নয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের স্বত্ত্ব থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। সেখানে এই ৪১ জন শ্রমিকের জীবনের মূল্যের হিসাব করার সময়, সুযোগ কোথায়!

 

দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯ তারিখ নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জয়ী দলের ক্যাপ্টেনের হাতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ তুলে দেন, ভারতের ড্রেসিং রুমে গিয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেখাও করেন। সেদিন ও পরের দিন সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদ মাধ্যমে সেই ছবি ভরে যায়। মিম, ট্রোল ইত্যাদিও হয়। তবে সবই তো ‘ফটো অপ’ আর কথায় বলে ‘নেগেটিভ পাবলিসিটি’-ও পাবলিসিটি। সুতরাং…।

 

১২ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত সুড়ঙ্গে আটক ৪১ জন শ্রমিক সম্পর্কে একটি বাক্যও প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়নি। বিশ্বকাপের উত্তেজনায় সম্ভবত সময় পাননি বা মনে ছিল না। ১৯ তারিখের পর প্রথমবার ২০ তারিখ তিনি এই বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দেন ও শ্রমিকদের উদ্ধারে যাবতীয় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।

 

উদ্ধারকাজ প্রথম দিন থেকেই চলছিল। কিন্তু ভেঙে পড়া টানেলে যে জায়গায় শ্রমিকেরা আটকে ছিলেন, সেখানে পৌঁছতে ঠিক কী ধরনের প্রক্রিয়া উপযোগী হবে তা স্থির করতে, একের পর এক পদ্ধতি ব্যর্থ হচ্ছে যখন, তখন বিকল্প খুঁজে বের করতে গিয়েই অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। উদ্ধারকারী দলের সদিচ্ছা ও চেষ্টার অভাব ছিল না। তার ফলশ্রুতিতেই শেষ পর্যন্ত ৪১ জন শ্রমিকের উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকারের যে ভূমিকা এক্ষেত্রে হওয়া উচিৎ ছিল তা আদপেই চোখে পড়েনি। ৪১টি মানুষের প্রাণের মূল্য দেশের সরকারের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ বা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কি না, তা বোঝার কোনও উপায় ছিল না। কারণ উত্তরাখন্ড সরকার উদ্যোগী ভূমিকা নিলেও কেন্দ্রের তরফ থেকে কোনও রকম বিবৃতি, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি কিছুই চোখে পড়েনি।

 

অবশ্য এই টানেল নির্মাণ, হিন্দু ধর্মালম্বীদের তুষ্ট রাখতে আর হিন্দুত্ববাদের ধ্বজা ওড়াতে চারধাম প্রজেক্ট-এর সফল রূপায়ন তো প্রধানমন্ত্রীরই স্বপ্নের প্রকল্প। সেখানে উত্তরাখন্ডের পরিবেশ, প্রকৃতি কতটা বিপন্ন হবে, এই ধরনের টানেল নির্মান কতটা বিপজ্জনক, পরিবেশবিদেরা কী বলছেন – কোনও বক্তব্য, কোনও কিছুই বিবেচ্য হয়নি। তৈরি হওয়ার সময়েই সুড়ঙ্গে ধস নামল কেন তা নিয়েও আলোচনা হবে না। এই ৪১ জন শ্রমিক যদি বেঁচে নাও থাকতেন, তাহলেও দু’মিনিটের নীরবতা আর কিছু টাকা পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও দায়িত্ব থাকত না সরকারের। শ্রমিকের প্রাণ তো, হাজার হলেও যুঝতে শিখে গেছে, তাই মানুষগুলি জীবিত বেরিয়েছেন সুড়ঙ্গ থেকে। এই বিপর্যয়ের পরেও না টানেল নির্মাণ, না চারধাম প্রজেক্ট – কোনওটাই বন্ধ হবে না। এক্স হ্যান্ডেল (পূর্ববর্তী ট্যুইটার)-এ প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের সাহস আর ধৈর্য্যের প্রশংসা করে বলেছেন তা সবাইকে প্রেরণা দেবে, তাদের সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন, তাদের পরিবারের সংযম আর সাহসের প্রশংসা করেছেন, উদ্ধারকারী দলকে অকুন্ঠ প্রশংসা জানিয়েছেন। বলেছেন এই শ্রমিকদের উদ্ধার হয়ে আসা সারা দেশকে ভাবুক করে তুলেছে। মানবতা আর টিম ওয়ার্কের জয় হয়েছে বলে লিখেছেন।

 

এই ফাঁপা বুলি আসলে ৪১ জন পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনের এক বিন্দুও ছুঁতে পারে না। যে পরিজনেরা বাইরে অপেক্ষা করছিলেন, তারা কেউ ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে মাত্র ন’হাজার টাকায় স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে এসেছেন; কোনও বাবা বারেবারে বলেছেন এক ছেলেকে মুম্বইতে দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন, ছোট ছেলে বেঁচে বেরোলে কিছুতেই আর এমন ঝুঁকির কাজে পাঠাবেন না। ঠিক কোন্‌ সংযমের কথা বলতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী? এই অসহায় মা-বাবা-ভাই-বোনেদের বুকের ভেতরের তোলপাড় ধরার সাধ্যি আছে কারওর?

 

যে ৪১ জন শ্রমিক সুড়ঙ্গে আটকে ছিলেন তাদের এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ ও আরও অন্য রাজ্য থেকে যে মানুষগুলি এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়েছেন, তাদের এইভাবেই জীবন-জীবিকা চালিয়ে যেতেই হয়। আজ এই টানেল থেকে বেঁচে বেরিয়েছেন, তবে আবারও তাদের এই ধরনের কাজেই বেরোতে হবে তা নিয়ে সংশয় নেই। সুড়ঙ্গ, খনিতে কাজ করা শ্রমিকদের সুরক্ষা সরঞ্জাম, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে আগেও কারওর মাথাব্যথা ছিল না, এরপরেও থাকবে না। যে সুপারভাইজার নিজে আটকে থেকেও বাকি সাথীদের মনোবল বাড়িয়েছিলেন, সেই গব্বর সিং নেগি নিজেই এহেন অনেক সুড়ঙ্গ ধসের সাক্ষী। অর্থাৎ এদেশে এই ঝুঁকি খুবই ‘কমন’। এতগুলি মানুষের জীবন সংশয় হয়ে যাওয়ার পরেও কোনও ট্রেড ইউনিয়ন রাস্তায় নামেনি। এই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, জীবনবিমা ইত্যাদি বিষয়গুলি আগেও ছিল এবং এখনও আলোচনার বাইরেই রয়ে যাবে।

 

১৯ নভেম্বর বিশ্বকাপ জ্বর শেষ হওয়ার পর, যখন দেখা গেল এই মানুষগুলি তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, তখন থেকেই সংবাদমাধ্যম ও দেশের মানুষ ধীরে ধীরে স্পেকটাকেল তৈরি করতে শুরু করল। না, খাবার-অবসাদের ওষুধ-মোবাইল ফোন পাঠিয়ে কোনও মহান কাজ করা হয়নি, এটা ন্যূনতম, যা এই মানুষগুলির জন্য করা যেত সেই সময়ে। ধুলিধূসরিত শরীরে-পোশাকে, একটা সরু সুড়ঙ্গের মধ্যে দিনরাত কাটিয়ে যেতে কেমন লাগছিল তাদের? শৌচকর্ম কোথায় করতেন তারা? ঘুম আসত? এই প্রশ্নগুলো মাথা চাড়া দেয়নি। বাঁচবেন না মরবেন – এই কাউন্টডাউন চলছিল।

 

আসলে অনুপ্রেরণা, সাহসী, ধৈর্য্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে ‘হিরো’ বানিয়ে দিলে অনেক দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে যাওয়া যায়। মরে গেলে না হয় চারধাম প্রজেক্টে ‘শহীদ’ হয়েছে বলে দেওয়া যেত। এখনই তো জুড়ে দেওয়া গেছে সুড়ঙ্গের সামনে অস্থায়ী মন্দির তৈরির সুফলের অনুষঙ্গ। ১৭ দিন দমবন্ধ উৎকন্ঠায় কাটিয়ে, জীবন-মৃত্যুর দড়ি টানাটানিতে যে ট্রমা তৈরি হয়, এই শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্যে তার যে প্রভাব পড়তে পারে ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি আর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট তা ধরতে পারে না। আপাতভাবে তারা শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ, পেশার উদ্বেগ, রোজগারের চাপ এগুলির কী হবে?

 

যে র‍্যাট হোল মাইনিং পদ্ধতিতে শেষ পর্যন্ত তারা উদ্ধার হয়েছেন, সেই পদ্ধতিটি ২০১৪ থেকে ন্যাশনল গ্রীন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে নিষিদ্ধ। কারণ খনি থেকে কয়লা বা অন্য খনিজ পদার্থ তোলার এই প্রক্রিয়াটি এতটাই মারাত্মক যে ভারতে বহু শ্রমিক তাতে প্রাণ হারিয়েছেন। অতি সরু গর্ত করে ইঁদুরের মতো তার ভেতর দিয়ে ওঠা-নামা করতে হয়। অর্থাৎ শ্রমিকের প্রাণ সব সময়েই ঝুঁকির মুখে ফেলে দেওয়া যায়, তা মূল্যহীন। এবারে সেই নিষিদ্ধ পদ্ধতিই অতি দক্ষ র‍্যাট হোল মাইনিংএ শ্রমিকদের হাতে, যন্ত্রকে হার মানিয়ে মানুষগুলির প্রাণ বাঁচাল। কারণ এই নিষিদ্ধ প্রক্রিয়ার বিকল্প, উপযুক্ত উদ্ধারের পন্থা সরকার এখনো তৈরি করতে পারেনি।

 

৪১ জন শ্রমিকের বাঁচার ইচ্ছাকে দেশসুদ্ধ সবাই কুর্নিশ করছেন। মরে গেলেও ভুলেই যেত, বেঁচে গেছেন বলে তাও পরের শিরোনাম তৈরির আগে পর্যন্ত মনে রাখবে।

 

শ্রমিকদের না বেঁচে উপায়? পরিবার তাকিয়ে থাকে যে তাদের মুখের দিকে।

 

Share this
Leave a Comment