অমৃতকালে খাওয়া না খাওয়ার কথকতা


  • October 19, 2023
  • (2 Comments)
  • 815 Views

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২৩ (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২৩ / জিএইচআই) রিপোর্ট অনুযায়ী ১২৫ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১। যার অর্থ ভারতে ক্ষুধা পরিস্থিতি গুরুতর (serious) রাষ্ট্রকেই মানুষের খাবার পাওয়ার  অধিকারকে স্বীকার করতে হবে এবং এই লক্ষ্যেই রাজনীতিকে চালিত না করতে পারলে এক ক্ষুধার্ত প্রজাতন্ত্রের তকমা নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। লিখলেন সুমন কল্যাণ মৌলিক

 

কর্পোরেট মিডিয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্বেও ইশ্বরের বরপুত্রের জমানায় ভারতের ‘সুপার পাওয়ার’ হয়ে ওঠার গল্পটা ঠিক জমছে না। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা বা মিডিয়ার স্বাধীনতা –একের পর এক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ভারতের স্থান ক্রমাগত পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে।  এমনকি কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করে জি২০ অধিবেশনের ঠিক আগে প্রকাশিত হল যে এই গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মাথা পিছু জিডিপির হিসাবে আমাদের স্থান সর্বনিম্ন। এই তালিকার শেষতম  সংযোজনটি হল বিশ্ব ক্ষুধা সূচক (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স / জিএইচআই) এর প্রকাশ। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ১২৫ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১। এই উপমহাদেশে  যে সমস্ত দেশগুলোকে আমরা নেহাৎই  তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি যেমন শ্রীলঙ্কা (৬০), নেপাল (৬৯), বাংলাদেশ (৮১), পাকিস্তান (১০২) ক্ষুধাকে জয়ের প্রশ্নে ভারতের থেকে ভালো অবস্থায় আছে। ভারতের থেকে খারাপ অবস্থায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে আছে সোমালিয়া, বুরুন্ডি, সাউথ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মাদাগাস্কার, ইয়েমেন, রিপাবলিক অব কঙ্গো, লাইবেরিয়া, চাদ, হাইতির মত যুদ্ধ বিধ্বস্ত সাব-সাহারান দেশগুলো এবং অবশ্যই গৃহযুদ্ধ দীর্ণ আফগানিস্তান। এই রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে ৭৪.১% ভারতীয় স্বাস্থ্যকর খাবার জোগাড় করতে অসমর্থ স্বাভাবিক ভাবেই এই লজ্জার তথ্যসারণীকে স্বীকার করা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই শুরু হয়ে গেছে এই রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, মানদণ্ডগুলোর কার্যকারিতাকে নাকচ করা ও সর্বোপরি আন্তর্জাতিক চক্রান্তের গল্প বর্তমান নিবন্ধে আমরা মানদণ্ডগুলো নিয়ে তো আলোচনা করবই, সঙ্গে সঙ্গে বিগত বছরের পরিসংখ্যানগুলোর একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।

 

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২৩ (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ২০২৩ / জিএইচআই) রিপোর্ট অনুযায়ী ১২৫ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১। যার অর্থ ভারতে ক্ষুধা পরিস্থিতি গুরুতর (serious) রাষ্ট্রকেই মানুষের খাবার পাওয়ার  অধিকারকে স্বীকার করতে হবে এবং এই লক্ষ্যেই রাজনীতিকে চালিত না করতে পারলে এক ক্ষুধার্ত প্রজাতন্ত্রের তকমা নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। লিখলেন সুমন কল্যাণ মৌলিক। 

 

একটা কথা প্রথমেই পরিষ্কার বলা দরকার যে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের এই হতাশাজনক ফল কোন নতুন ঘটনা নয়। ২০১৯ সালে ভারত ১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২ স্থানে ছিল। ২০২০ সালে ১০৭ টি দেশের মধ্যে ৯৪  এবং ২০২১ সালে ১১৬ টি দেশের মধ্যে ১০১। ২০০৬ সাল থেকে আয়ারল্যান্ডের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ এবং জার্মান সংস্থা ‘ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ’ যৌথ ভাবে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ক্ষুধার পরিমাণ নির্ধারণ করে এবং প্রতিবছর আন্তর্জাতিক খাদ্য দিবসে  (১৬ অক্টোবর) তাদের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই সূচক নির্ধারণে চারটি মাপকাঠি রয়েছে : (১) শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের অপুষ্টি (Undernourishment) (২) ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস অর্থাৎ বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা (Child Stunting) (৩) ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু হার (Child Mortality) (৪) ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষয় অর্থাৎ উচ্চতার তুলনায় কম ওজন যার মূলে রয়েছে পুষ্টির অভাব (Child Wasting)।

 

এই মাপকাঠিতে ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের স্কোর হিসাব করে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশ করে থাকে ইন্টারন্যাশানাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট। সূচকে সেরা স্কোর হল শূন্য।  আগের বছরের তুলনায় স্কোর বাড়ার  অর্থ হল সেই দেশের ক্ষুধা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর স্কোর কমে যাওয়ার অর্থ হল সেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে এবারের সূচকে পাঁচেরও কম  স্কোর নিয়ে ক্ষুধা সূচকের শীর্ষে অবস্থান করছে ১৮টি দেশ যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চিন,  বেলারুশ, ব্রাজিল, তুরষ্ক, কিউবা ও কুয়েত। এই স্কেলে ভারত এবার পেয়েছে ২৮.৭ যার সূচক অনুযায়ী অর্থ ভারতে ক্ষুধা পরিস্থিতি গুরুতর (serious)।

 

এবার এই মানদণ্ডগুলোর নিরিখে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ণ করা দরকার এবং তুলনামূলক বিচারের জন্য আমরা ২০২১ সালের পরিসংখ্যানকে বেছে নিচ্ছি। অপুষ্টির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সমস্ত জনগণের ১৬.৬% অপুষ্টির শিকার। এটা একটা গুরুতর সমস্যা। ২০২১ সালে দেশে অপুষ্টির শিকার ছিলেন ১৫.৩% মানুষ। এবার দেখা যেতে পারে বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার (child stunting) এর প্রশ্নটিকে। এবারের সূচকে সংখ্যাটা ৩৫%। ২০২১ সালে সংখ্যাটা ছিল ৩৪.৭% পাঁচ বছরের  কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ৩.১% (মানদণ্ড অনুযায়ী এটা বিপদসীমার বাইরে), ২০২১ সালে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ৩.৪%। এবার দেখা যেতে পারে শিশুদের ক্ষয়ের প্রশ্নটিতে (child wastage)। এক্ষেত্রে ভারত পৃথিবীতে প্রথম ভারতে শতকরা পরিমাণ  ১৮.৭% (দ্বিতীয় ইয়েমেন – ১৪.৪%,  তৃতীয় সুদান – ১৩.৭%) যা অপুষ্টি ও ক্ষুধার প্রশ্নে সবচেয়ে বিপদজনক। ২০২১ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ১৭.৩%। এই তুলনামূলক  বিচারে একথা স্পষ্ট যে এবার চারটি  মানদণ্ড অনুযায়ী ভারতের ফল কোন নতুন  তথ্য উন্মোচন নয় বরং এর একটা ধারাবাহিকতা আছে আরো পতনের দিকে।

 

ভারত সরকার গতবছরের মত এবারও এই সূচককে মানতে অস্বীকার করেছে। এই অস্বীকৃতির আদৌ কোন বস্তুগত ভিত্তি আছে কি না তা আমাদের দেখে নেওয়া দরকার ভারত সরকারের সবচেয়ে বড়ো আপত্তি  অপুষ্টি সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি  নিয়ে যার নাম ‘proportion of undernourished’ (SOFI report)। এখন এই অংশটি নিয়ে আপত্তির কারণ এটার স্যাম্পেল সাইজ কম। এই আপত্তির জবার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি খুব স্পষ্ট ভাষায় দিয়েছে এই রিপোর্টের একটা  অংশের তথ্য দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (FAO), ইউনিসেফ এবং ইন্টারন্যাশানাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভলপমেন্ট। আর রিপোর্টের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরি হয়েছে Average Per Capita Availability of Food শীর্ষক তথ্যভান্ডার থেকে যা সংগৃহীত হয়েছে বিভিন্ন দেশ সরকারি ভাবে যে তথ্য পাঠিয়েছে তা হিসাব করে। অর্থাৎ ভারত সরকার প্রদত্ত তথ্যই মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।

 

দ্বিতীয় আপত্তিটি হল বয়সের তুলনায় ওজন ও উচ্চতার মত শিশু স্বাস্থ্য মাপার মানদণ্ড দিয়ে অপুষ্টি ও ক্ষুধা মাপা কী সম্ভব! এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) বক্তব্য দেখে নেওয়া যেতে পারে: “Malnourished children particularly those with severe acute malnutrition have a higher risk of death from common childhood illness such as diarrhoea, pneumonia and malaria. Nutrition related factors contribute to about 45% of death in children under 5 year of age”।

 

ভারত সরকার যতই প্রকাশিত তথ্যগুলোকে অস্বীকার করার চেষ্টা করুক, ক্ষুধার পরিস্থিতি কিন্তু ভয়ঙ্কর রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত এলাকাগুলোতে ক্ষুধা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উপরিউক্ত মানদন্ডগুলোকে  ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে রাজ্য  ক্ষুধা সূচক বা স্টেট হাঙ্গার ইনডেক্স (SHI)। এই তালিকা (How do Indian states perform as far as hunger eradication is concerned / Nandalal Mishra / 16 Oct, 2023) অনুযায়ী পাঁচটি রাজ্যে ক্ষুধার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক এই রাজ্যগুলি হল বিহার (৩৫.৫), ঝাড়খণ্ড (৩৫.৫), ছত্তিসগড় (৩৫.৫), গুজরাট (৩৩.৫) এবং উত্তরপ্রদেশ (৩৩.৫)।

 

ক্ষুধার প্রকোপ সবচেয়ে কম যে পাঁচটি অঞ্চলে তা হল চন্ডীগড় (১২.৪), সিকিম (১৪.৮), পন্ডিচেরি (১৫.২), কেরালা (১৫.৭), মনিপুর (১৬.৭)  এখানে নজর করার মত বিষয় হল গুজরাট ও কেরালার  জিডিপি পার ক্যাপিটার পরিমাণ এক হলেও কেরালায় ক্ষুধার সমস্যা কম, অন্যদিকে মডেল গুজরাটে একটা বড় অংশের মানুষ খেতেই পায় না। অবশ্য এ তথ্যটা নতুন নয়, মানব উন্নয়ন সূচকের বিভিন্ন মানদণ্ডে গুজরাট নেহাৎই এক পিছিয়ে থাকা রাজ্য।

 

এই অমৃতকালে এই প্রশ্নটা তোলা আবশ্যক যে ২০১৩ সালে ‘ন্যাশানাল ফুড সিকিউরিটিজ অ্যাক্ট’ লাগু হওয়া সত্বেও ভারতের একটা বড়ো অংশের মানুষের দুবেলা খাবার জোটে না কেন! ২০২০ সালের একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে দেশে ৭০ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য মজুত অথচ মানুষ ক্ষুধার্ত। আজ এর কারণ অনুসন্ধান জরুরি। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণায় চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আলোকপাত করেছেন। সেগুলো হল খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য কেনার ক্ষমতা, খাদ্যের জন্য শ্রম ও অন্যের থেকে খাদ্য পাওয়া। এক্ষেত্রে প্রথমে উল্লেখ করা দরকার যে খাদ্য জোগাড় করতে না পাওয়ার সমস্যা সবচেয়ে বেশি রয়েছে গ্রাম ভারতে। এর কারণ ভারতে ৫ কোটি পরিবার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এই পরিবারগুলি জমি থেকে সামান্য যে ফসল ফলায় তা থেকে সারা বছরের খাবারের সংস্থান হয় না। গ্রাম ভারতে বহু মানুষ আজ ১০০ দিনের রোজগার যোজনার উপর একান্ত ভাবে নির্ভরশীল কিন্তু সরকার আজ পরিকল্পিত ভাবে এই  প্রকল্পকে দুর্বল  করছে অথচ বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। আয় নেই তাই মানুষ ক্ষুধার্ত থাকছে। তাই সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের আয় বাড়ানোর বিয়য়ে। একই সঙ্গে ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তাকে দ্বিগুণ করতে হবে ভাবতে হবে রাষ্ট্রের দায়িত্বে কিভাবে রান্না করা খাবার আরো বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়।

 

মিড ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের সীমানা যেমন বাড়াতে হবে তেমনি সমাজে দুর্বল ও আর্থিক ভাবে বিপন্ন মানুষদের কাছে রান্না করা খাবার নামমাত্র মূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে একই সঙ্গে সময় এসেছে গণবন্টন ব্যবস্থাকে  আরো  উন্নত করার। নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে সার্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থাকে তুলে দিয়ে টার্গেটেড (এপিএল ও বিপিএল) গণবন্টন ব্যবস্থা চালু হয়। এই নতুন ব্যবস্থার কারণে বহু মানুষ রেশনিং ব্যবস্থার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন ক্ষুধার্ত মানুষের স্বার্থে আবার সার্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। রাষ্ট্রকেই মানুষের খাবার পাওয়ার অধিকারকে স্বীকার করতে হবে। এই লক্ষ্যেই রাজনীতিকে চালিত না করতে পারলে এক ক্ষুধার্ত প্রজাতন্ত্রের তকমা নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

 

 

Share this
Recent Comments
2
  • comments
    By: Bhaskar on October 21, 2023

    খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা। তথ্যসূত্র উল্লেখ থাকলে ভালো হত।

  • comments
    By: Jhuma on October 21, 2023

    তথ্যসমৃদ্ধ রচনা। প্রাবন্ধিক ভারতের বর্তমান অবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন।

Leave a Comment