সিকিম বিপর্যয়ে নিখোঁজ বাংলার ৩২ পরিযায়ী শ্রমিক


  • October 18, 2023
  • (0 Comments)
  • 1249 Views

ঘটনার পর প্রায় দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছে । এ রাজ্যের অন্তত ৩২ জন পরিযায়ী শ্রমিকের কোনও খোঁজ নেই। উত্তরবঙ্গের জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে উদ্বেগে ভেঙে পড়া বাবা-মা, স্ত্রী, আত্মীয়দের কাছে ‘খোঁজ চলছে’ বলা ছাড়া আর কোনও খবর পৌঁছে দিতে পারছে না জেলা বা রাজ্য প্রশাসন।

দেবাশিস আইচের রিপোর্ট।

 

 

হতবাক করে দেওয়ার মতোই দৃশ্য। একটা গাছের উঁচু ডালে বসে কাণ্ডটি দু’হাতে জড়িয়ে বসে আছেন এক অসহায় মানুষ। তাঁর পায়ের নীচ দিয়ে উন্মত্তের মতো ছুটে চলেছে তিস্তা। পাড় উপচিয়ে মত্ত হাতির মতো ধাক্কা মারছে গাছের গোড়ায়। ব্যক্তিটির মুণ্ডিত মস্তকের মতোই গাছটির ডালপালা ন্যাড়া। শুধু দু’টি ডাল জড়িয়ে রয়েছে অর্কিডগুচ্ছ। ছবিটা ভাইরাল হয়েছিল তিস্তা মহাবিপর্যয়ের প্রথম সকালেই।

 

ক’দিন পর জানা গেল ওই ব্যক্তি শিলিগুড়ির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মহারাজা কলোনির বাসিন্দা। নাম মহম্মদ মোক্তার। সিকিমের রংপোতে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতেন। সঙ্গে থাকত তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। স্ত্রী কোলের শিশু নিয়ে বাপের বাড়িতে ছিলেন সেই সময়। ৪ তারিখ ছেলেমেয়েদের নিয়ে শুয়ে ছিলেন ঘরে। হঠাৎই চারপাশে আর্তচিৎকারে উঠে বসে দেখেন ঘর ভেসে যাচ্ছে। দরজা খুলে কোনওক্রমে বাইরে আসেন সবাই। গভীর অন্ধকারে জলের তোড়ের থেকে তিন ছেলেমেয়েকে সামলে উঠতে পারেননি। ছেলেটি চোখের সামনেই মারা যায়। ভেসে যায় দুই মেয়ে তাঁরা এখনও নিঁখোজ। ছেলের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। শিলিগুড়ি ফিরে পোস্টমর্টেমের পর চুকেছে মাটি দেওয়া। হিমবাহ-ভাঙা প্রবল ক্রোধে সিকিম থেকে জলপাইগুড়ি দক্ষযজ্ঞ ঘটিয়ে তিস্তা এখন শান্ত। আর সদ্য মৃত্যুর হাত থেকে ফেরা, সন্তান হারানো মহম্মদ মোক্তারের বুক যেন সেই টন টন লোহা-পাথর-সিমেন্ট চাপা তিস্তা। মহম্মদ ভাষা হারিয়ে মূক। প্রশ্ন করলে গোঙানির মতো শব্দ ভেসে আসছে। ঠিক যেন স্টেজ থ্রি, স্টেজ ফাইভ… দফায় দফায় কংক্রিটের বাঁধনে তিস্তার গোঙানি।

 

ঠিক কত মানুষ চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছেন মানুষেরই সৃষ্টি এই বিপর্যয়ে? কত মানুষ নিখোঁজ? প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে তার সংখ্যা। সিকিমে মৃত, নিখোঁজদের মধ্যে কতজন এ রাজ্যের বাসিন্দা তারও কোনও হিসেব নেই। এই যে কালিম্পঙের তিস্তাবাজার, গেলিখোলা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত তার মোট ক্ষয়ক্ষতির হিসেব, কিংবা নিখোঁজ, আহত, মৃতদের কোনও পূর্ণ তালিকাই নেই কোথাও। পরিযায়ী শ্রমিকদের আলাদা তালিকাও মিলছে না। প্রতিদিনই তার টুকরো টুকরো হিসেব মিলছে। যেমন, ডিপিও নামচি জানাচ্ছেন, মাম্রিং থেকে দু’জন শ্রমিক ভেসে গিয়েছেন। বা জিআরইএফ জানাচ্ছে, সাংখালাং সাইট থেকে দু’জন শ্রমিক নিখোঁজ। কিংবা সেরওয়ানির এলএএনসিও (ল্যাংকো) সাইটের লেবার ক্যাম্প থেকে ছ’জন শ্রমিক নিখোঁজ।

 

প্রথম দু’দিনের মধ্যে জানা গিয়েছিল সিকিম উরজা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের, অর্থাৎ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া তিস্তা স্টেজ থ্রি’র এজিএম-সহ ছ’জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচ জন শ্রমিক। এবং বেশ কয়েকজন নিখোঁজ। ১৫ অক্টোবর দ্য ভয়েস অব সিকিম নাম-ধাম, ছবি, বয়স, বাড়ির ঠিকানা, মোবাইল নাম্বারের তালিকা প্রকাশ করে জানাচ্ছে আরও ১৪ জন কর্মীর কথা। দু’জনের মৃতদেহ মিলেছে, ১২ জন নিখোঁজ। এঁদের কেউ সিকিম উর্জার কর্মী, কেউ অন্যান্য সংস্থার হয়ে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অধিকাংশই ভিন রাজ্যের। তিন জন এই রাজ্যের বাসিন্দা। যেমন, এএনজেড ইনফ্রাসলুশনসের দুই কর্মী শুভঙ্কর দাস (২৮) ও ঋষিকেশ রায় (৩৭)। তালিকায় দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী প্রথম জন কোচবিহার জেলার দিনহাটার ভেটাগুড়ির বাসিন্দা, দ্বিতীয় জন মধ্য রঙ্গোলি বাজার জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। অন্যজন সুরেশ গুরুঙের ঠিকানা শ্রীধুরা পামং টি এস্টেট, রংলি রংলিয়ট, পশ্চিমবঙ্গ। তিনি এসআইএস লিমিটেডের (সম্ভবত কোনও নিরাপত্তা সংস্থা) কর্মী।

 

কোম্পানির কেউ নয় এমন অসংখ্য ঠিকা শ্রমিক এই মহাবিপর্যয়ের শিকার। অসংখ্য কেননা, নানা রাজ্য থেকে আসা এই শ্রমিকদের পূর্ণ হিসেব মেলে না কোথাও। বেঁচে থাকতে যাঁরা নেই, মরলে যাঁদের খোঁজ মেলে এই বিপর্যয়ে সেই পরিযায়ী শ্রমিকদের খবর কী? রংপো বিধ্বস্ত সেখানে চলছে সেবক-রংপো রেল টানেল তৈরির কাজ। তিস্তার বুকে নির্মীয়মাণ এনএইচপিসি’র একাধিক বাঁধ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ সেখানকার শ্রমিক, কর্মচারীদের খবর কী? ৬ অক্টোবর নামচির জেলাপ্রশাসন জানাচ্ছে, তিস্তার তীরে থাথালের এনএইচপিসি’র তিস্তা-৬ এলাকা থেকে পাঁচশোরও বেশি শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়েছে। এডিসি নামচি অনন্ত জৈন এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক, শ্রম দফতরের আধিকারিকদের নেতৃত্বে উদ্বারকারীরা দীর্ঘপথ ট্রেক করে গিয়েছেন। উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের রংপো ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পৌঁছে দিলে তাঁরা যে যার গন্তব্যে চলে যান বলে ডিসি নামচি এক প্রেস বিবৃতিতে জানান। ওই নির্মীয়মাণ এলাকাটি ৪ তারিখ তিস্তার বন্যার জল এবং প্রায় ২০-২৫ ফুট কাদামাটি-পাথরের নীচে চাপা পড়ে যায় (উপরের ছবি দেখুন)। বোঝা যাচ্ছে, বেঁচে ফেরা ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা পালিয়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু, মোট কতজন নির্মাণ শ্রমিক ছিলেন ওই প্রকল্পে, বানের তোড়ে কেউ ভেসে গেলেন কি না, কাদামাটির স্তূপের নীচ থেকে আর কোনও দেহ উদ্ধার হল কি না—এমন কোনও তথ্য দেয়নি রাজ্য বা নামচি প্রশাসন কিংবা এনএইচপিসি বা কোনও ঠিকাদার সংস্থা।

 

ঘটনার পর প্রায় দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছে এ রাজ্যের অন্তত ৩২ জন পরিযায়ী শ্রমিকের কোনও খোঁজ নেই। উত্তরবঙ্গের জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে উদ্বেগে ভেঙে পড়া বাবা-মা, স্ত্রী, আত্মীয়দের কাছে ‘খোঁজ চলছে’ বলা ছাড়া আর কোনও খবর পৌঁছে দিতে পারছে না জেলা বা রাজ্য প্রশাসন। ১৪ অক্টোবর বালুরঘাটের নয়ন মার্ডি, জয়ন্ত মুর্মু, সুজয় টুডুর বৃদ্ধা মা কিংবা অন্ত্ব:সত্ত্বা স্ত্রী বা অন্যান্য আত্মীয়রা ৭-৮ কিলোমিটার উজিয়ে বালুরঘাট থানায় এসে কান্নাকাটি শুরু করলে প্রশাসনের ঘুম ভাঙে। ৪ তারিখ সিকিমে বিপর্যয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আত্মীয়রা মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে দেখা যায় ফোন বন্ধ। অথচ অনেকেই আগের রাতেও স্ত্রী, বাবা কিংবা মায়েদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘরের লোকের খোঁজ না পেয়ে ঠিকাদারকে ধরেন তাঁরা। ঠিকাদার তাঁদের আশ্বস্ত করায় একরকম চুপই ছিলেন সকলে। এর পর অপেক্ষার বাঁধ ভাঙলে ১০ দিন পর বালুরঘাট থানায় ছুটে যান। দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার চিন্ময় মিত্তালের হিসেব অনুযায়ী অন্তত ৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন। বেসরকারি মতে অন্তত ১৪। বালুরঘাটের ডাঙা বিজশ্রীগ্রামের ৭ জন নিখোঁজ তাঁরা ২৯ সেপ্টেম্বর এক ঠিকাদারের সঙ্গে সিকিমে গিয়েছিলেন। সিকিমের কোথায়, কোন কাজে যান তা পরিবার জানে না। জেলাশাসক বিজিন কৃষ্ণ জানিয়েছেন, দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে ২৫ জন সিকিমে কাজ করতে গিয়েছিলেন বলে জানতে পারা গেছে। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলেও কিছুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। চেষ্টা চলছে। এর মধ্য স্বস্তির খবর এই সিকিমের লাচুং থেকে চোপড়া, দাসপাড়া পঞ্চায়েতের গুয়াবাড়ি গ্রামের আট শ্রমিক বাড়ি ফিরেছেন। তাঁরা লাচুঙে রাজমিস্ত্রির কাজে গিয়েছিলেন। লাচুং থেকে ৭০ কিমি হেঁটে তাঁরা প্রথমে মঙ্গনে পৌঁছান। সেখান থেকে গ্যাংটক, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি হয়ে বাড়ি পৌঁছান।

 

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত কোচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি মিলিয়ে নিখোঁজ পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৩২ জন। নিখোঁজদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা নীচে দেওয়া হল।

 

কোচবিহার, গোঁসাইহাট গ্রাম পঞ্চায়েত, ছোট ধাপেরচাত্রা

(১) প্রসেনজিৎ বর্মণ, (২) বিষ্ণু বর্মণ, (৩) সহদেব বর্মণ, (৪) সুজন বর্মণ

 

শীতলকুচি, লালবাজার গ্রাম পঞ্চায়েত

(১) উত্তম সরকার, (২) রাজু বর্মণ, (৩) বিনয় বর্মণ

 

জলপাইগুড়ি, ধূপগুড়ি, ডাউকিমারি এলাকা

(১) গোপাল রায়, (২) উজ্জ্বল রায়, (৩) চন্দন রায়

 

উত্তর দিনাজপুর, গোয়ালপোখর ১, ঢোকিয়াটোলি

(১) সাজ্জাদ

 

দক্ষিণ দিনাজপুর, বালুরঘাট, ডাঙা বিজশ্রী গ্রাম, পালপাড়া

(১) মৃদু পাল, (২) সুধু পাল, (৩) দুলাল পাল, (৪) বেলাই পাল, (৫) সামরা পাল, (৬) তজু পাল, (৭) নবীন পাল।

 

বালুরঘাট, বোয়ালদা গ্রাম পঞ্চায়েত, পশ্চিম কৃষ্ণপুর

(১) নয়ন মার্ডি, (২) জয়ন্ত মুর্মু, (৩) সুজয় টুডু

 

বালুরঘাট, চিঙ্গিসপুর পঞ্চায়েত, নওপাড়া গ্রাম

(১) বিজয় মুর্মু

 

কুমারগঞ্জ, কুড়ালডাঙা

(১) নগেন মুর্মু, (২) বিক্রম সোরেন, (৩) বাদল সোরেন, (৮) ও (৯) নাম জানা যায়নি।

 

এছাড়াও গ্রামবাসীদের মতে পার্শ্ববর্তী তিনটি গ্রামের আরও পাঁচ জনের খোঁজ মিলছে না।

 

সূত্র: (১) বর্তমান, ১৫ অক্টোবর ২০২৩, (২) গণশক্তি, ১৫ অক্টোবর ২০২৩, (৩) ইটিভি ভারত, ৯ অক্টোবর ২০২৩ (৪) দ্য সিকিম টাইমস, ৬ অক্টোবর ২০২৩

 

Share this
Tags :
Leave a Comment