মানুষে মানুষ গাঁথার শাদিপুর নাট্য উৎসব


  • October 3, 2023
  • (4 Comments)
  • 625 Views

নাটক দেখবার স্বার্থে অডিটোরিয়ামের মধ্যে সমকক্ষ হয়ে পাশাপাশি বসে পড়েন রিকশাওয়ালা থেকে স্কুলপড়ুয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে অধ্যাপক। বিপ্লবী শ্রেণির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে নাটক দেখতে দেখতে অক্ষম পাতিবুর্জোয়া দর্শকের মনে হয়তো উঁকি দিতে পারে সমর সেনের কবিতার লাইন “ঘুণ ধরা আমাদের হাড় / শ্রেণীত্যাগে তবু কিছু আশা আছে বাঁচবার।” মানুষে মানুষ গাঁথার কাজে কমিউনিটি থিয়েটারের জুড়ি মেলা ভার। সেকাজেরই সার্থক প্রয়াস ‘শাদিপুর নাটক উৎসব’। লিখলেন ঊর্মিমালা

 

২০২৩-এ তিন বছরে পা দিল দিল্লির শাদিপুর নাটক উৎসব। ২০১৯-এ শুরু, মাঝে অতিমারির কারণে বন্ধ ছিল দু’বছর। আয়োজনে বরাবরের মতোই ‘স্টুডিও সফদার’, অর্থাৎ কিংবদন্তি থিয়েটার শিল্পী যিনি ১৯৮৯ সালে দিল্লির রাজপথে পথনাটক করার সময় গুন্ডাদের আক্রমণে খুন হন — সেই সফদার হাশমির নামে নামাঙ্কিত একটি ব্ল্যাক বক্স স্পেস। ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক স্ট্রিট থিয়েটার গ্রুপ ‘জন নাট্য মঞ্চ (জনম)’ ২০১২ সালে এটির প্রতিষ্ঠা করে, শাদিপুরের পুরোনো একটি বিল্ডিংয়ের মধ্যে রেট্রোফিটিং করে। গোড়া থেকেই শাদিপুর মহল্লাবাসীদের সাথে নাটক ছাড়াও নানান কার্যকলাপের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে ‘স্টুডিও সফদার’। যার মধ্যে বিশেষতম ‘বাচ্চাদের লাইব্রেরি’।

 

যাই হোক সেই ‘স্টুডিও সফদার’-এর কমরেডরা, তার সাথে এক ঝাঁক স্বেচ্ছাসেবক সকলে মিলে হই হই করে নাট্য দলগুলোর সাথে কাঁধে কাঁধ দিয়ে মঞ্চ সাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে, ঘণ্টা বাজিয়ে, টিকিট বিক্রি করে, খাবারের থালা বাসন ধোয়া, মায় শৌচালয় পরিষ্কার করে সেপ্টেম্বর মাসের ছ’দিনে দেখাল সাতটি নাটক। প্রতিদিন দু’টি প্রদর্শন, দুপুর তিনটে ও সন্ধে ছটায়। আর পাঁচটা নাটক উৎসবের থেকে শাদিপুর নাটক উৎসব অনেক কারণে বিশেষ। প্রথম বিশেষত্ব উৎসবের নাটক মনোনয়ন কমিটি। এটাই ভারতের প্রথম কমিউনিটি কিউরেটেড থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল। নির্বাচক কমিটির প্রত্যেকেই—স্থানীয় দর্জি, চা বিক্রেতা, প্রবীণ স্থানীয় দোকানি, সেলস এক্সিকিউটিভ, পড়ুয়া কিংবা স্কুল শিক্ষক। অর্থাৎ সাধারণভাবে যাঁরা কেউই কিন্তু সেই তথাকথিত নাট্যবোদ্ধা বুদ্ধিজীবী পরিসরের মানুষ নন। এঁদের বসবাস শাদিপুর ও তার পার্শ্বস্থ অঞ্চল জুড়ে বহু-সাংস্কৃতিক, বহু-ভাষিক এবং বহু-বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট ঠাসবুনোটের একটি নকশিকাঁথায়। আর কী নেই সেখানে! একই চৌহদ্দির মধ্যে জড়ামরি করে রয়েছে গুরুদ্বার, পঞ্চমুখী হনুমান মন্দির থেকে মদিনা মসজিদ এবং যিশু পরিবার চার্চ। সব পাবেন এখানে — পানিপুরি থেকে পিৎজা, গুড় থেকে গৌলাশ, পোড়ামাটি থেকে প্লাস্টিক, ঝুপড়ি থেকে মাল্টিপ্লেক্স, রিকশা থেকে মেট্রো, ডিডিএ ফ্ল্যাট থেকে ডাকাত ভুলি ভাটিয়ারিনের মহলের ধ্বংসাবশেষ। ইতিহাস থেকে বর্তমান। দ্বাদশ শতাব্দীর রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের বংশধররাও থাকেন, থাকেন শাহজাহানের সময়কালে শাহজাহানাবাদ থেকে চলে আসা পরিবার, আবার কেউ এসেছেন লাহোর থেকে। বেশ কয়েকটি অপূর্ব কারুকাজ খোদাই করা দরজা এবং চওড়া উঠোনওয়ালা প্রাচীন হাভেলি রয়েছে। আছে দেশভাগের আগেকার কূপ, যেখানে অঞ্চলবাসীরা এখনও বিবাহ কিংবা পুত্র সন্তান জন্মালে পুজো করে থাকে। পুসা ইনস্টিটিউট এসেছিল ১৯৩৪ সালের বিহারের ভূমিকম্পের পর। দেশ ভাগের পরে আসে জমির দালালরা। গড়ে ওঠে উদ্বাস্তু কলোনি। সরকারি উদ্যোগে আসে বড় বড় প্রতিষ্ঠান — দিল্লি ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন, দিল্লি মিল্ক স্কিম, জল সরবরাহ প্ল্যান্ট, স্থাপিত হয় বেশ কিছু বেসরকারি ও সরকারি ব্যাংকের শাখা। আর আসতে বাধ্য হয় ১৯৭৬ সালের কুখ্যাত তুর্কমান গেটে বস্তি উচ্ছেদ ও গুলিবর্ষণে বাস্তুচ্যুত মানুষ, কিছু মানুষের হাতে বিধ্বস্ত অসংখ্য মানুষ। শাদিপুরের ঘেটো XYZ ব্লক রয়েছে ইমার্জেন্সি, উচ্ছেদ, বুলডোজার, স্টেরিলাইজেশনের দিনগুলোর স্মৃতি নিয়ে। রুশদির “the ghetto of the magicians which keep moving …while bulldozers moved forwards into the slum, a door was slammed shut…but not all the magicians were captured; not all of them were carted off…and it said that the day after the bulldozing of the magicians’ ghetto, a new slum was reported in the heart of the city.” [Salman Rushdie, Midnight’s Children (1980)]। স্টুডিও সফদারের ঠিক বাইরের পার্কিং লটটিকে বলা হয় ‘বিয়াসিনম্বর’। ওখানেই ছিল ডিটিসি বাস রুট নম্বর ৮২, চলত জামা মসজিদ এবং এক্সওয়াইজেড ব্লকের মধ্যে। বাসটি আর চলে না, তবে নামটি রয়ে গেছে। বাসিন্দারা কেউ এসেছে দেশ ভাগে ভেসে, গিহার (ঘর+হারা) সম্প্রদায়ের মত কেউ কেউ উৎপাটিত হয়ে, জীবিকার সন্ধানে এসেছেন বহু। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, কেরালা, বিহার, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, আসাম, বাংলা কি রাজস্থান থেকে। কেউ কেউ থেকে গেছেন শিকড় গেড়ে, কেউ-বা সদা বহমান। ১৯৮৪ সালের দাঙ্গার পর চলে গেছে কিছু শিখ পরিবার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পড়ুয়ারা আসে নানা রাজ্য থেকে। আছেন দরিদ্র অভিবাসীরা—সাইকেল রিকশাচালক, গৃহকর্মী। স্টুডিও সফদারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বেশিরভাগ রিকশাওয়ালা উত্তর প্রদেশের লখনউ, রায়বেরেলি এবং বেহরাইচের আশেপাশের গ্রামগুলির, কেউ কেউ বিহারের। আছেন ঝাংরি থেকে যাদব, দলিত থেকে ব্রাহ্মণ, মুসলমান, শিখ, জাঠ, রামগড়িয়া, খাটিক, বাল্মীকি সম্প্রদায়। ভাষা বিবিধ, পেশাও। সরকারি চাকুরে থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সাফাই কর্মী থেকে রঙের মিস্ত্রি, শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে চামড়ার কারিগর, ছুতোর, কুমোর, রিকশাওয়ালা থেকে রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ। জগন্নাথ হোটেলের পাশাপাশি বিরিয়ানি হাউসও। মধ্যবিত্ত গুরু নানক নগর আছে তার পরিপাটি বক্সে সাজানো। আছে ছোট ঘিঞ্জি এক বা দেড় রুমের ফ্ল্যাট নিয়ে এক্সওয়াইজেড ব্লক। অকারণে বিদেশি প্রতিনিধিদের সামনে মন্ত্রীদের বিব্রত করবার জন্যই যাদের জন্ম, সকল দেশের রানি আমার জন্মভূমির মুখ রক্ষা করতে সময়ে অসময়ে যাদের অতি।যত্নে ঢেকে দেওয়ার দরকার পড়তে পারে সবুজ তেরপল কাপড়ে! অন্ধকূপের মতো ছোট ছোট পায়রার খোপ, বাড়ির গায়ে বাড়ি, মাঝখান দিয়ে অপ্রশস্তগলি, মাথায় ঝুলন্ত তারের কুণ্ডলি, সরু ফিতের মতো একফালি আকাশ চোখে পড়ে কি পড়ে না, বাতাস ঢুকতে ইতস্তত করে। স্থানে অস্থানে স্তুপ করা জঞ্জাল, দুর্গন্ধের তীব্র ঝাঁজ। কোলের শিশুরা পর্যন্ত নিজের মনে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় রাস্তায়, দেখবার কেউ নেই, মা বাপকে ছুটতে হয়েছে পেটের ধান্দায়। আছে বাসন-কোসন থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড়, পানের দোকান, হেয়ার কাটিং সেলুন, বিউটি পার্লার, মুদিখানা, ডাক্তার ও ডেন্টাল ক্লিনিক, টিউশন সেন্টার, স্ক্র্যাপ ডিলার, মেরামত ও পরিষেবা কেন্দ্র, উৎপাদন ওয়ার্কশপ, গোডাউন, টেলারিং ইউনিট এবং অবশ্যই সর্বব্যাপী সম্পত্তি এজেন্ট! ভিড়ে গিজগিজ করে শনিবারের হাট। ভিক্ষুক, কাগজকুড়ানি, ফেরিওয়ালা। আছে সন্দেহবাতিক গায়ে চড়া এক পাল কুকুর। নানান স্তরের সহাবস্থানে ও সংঘাতে শাদিপুর সদা মুখরিত।ঘুরে দেখলে অনায়াসে সারা ভারতের ঝাঁকি দর্শন হয়ে যায়!

 

এই হেন শাদিপুরের নাটক উৎসবের দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল টিকিটের দামে। যে সমস্ত দর্শক স্থানীয় বাসিন্দা নন এবং যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তাঁদের জন্য টিকিটের মূল্য দু’শ টাকা। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য টিকিটের মূল্য কুড়ি টাকা। পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ ছাড়। বাচ্চারা এক-দু টাকা যে যা পারে নিয়ে আসে। আনতে ভুলে গেলেও টিকিট দেওয়া হয়, শুধু মনে করিয়ে দেওয়া হয় পরের দিন যেন নিয়ে আসে। অবশ্য পরের দিন আনতে না পারলে তার পরের দিন। তার পরের দিনও অনেকেই পারে না। কোনও খুদে বলে, “এই নাও এক টাকা, আমাদের পাঁচ জনের”, তাও চলে! আর বিনামূল্যে টিকিট দেওয়া হয় রিকশাওয়ালা কি জঞ্জাল সাফাই কর্মীদের মানে যাঁরা দৈনিক মজুরি খাটিয়ে বা সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক স্তরের মানুষজন।

 

অবশ্য এই বছরের উৎসবের আরও একটা তৃতীয় বিশেষ দিক রয়েছে। এ বছরের উৎসব শিশুদের থিয়েটার উৎসব। কেন? উৎসব সার্থক করতে শাদিপুরের সমস্ত অধিবাসীদের (এবং অভিবাসীদের) সহযোগিতা অনস্বীকার্য হলেও গত দু’বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে এই উৎসব সবচেয়ে বেশি সাড়া তোলে অঞ্চলের শিশু-কিশোরদের মধ্যে। প্রতিদিন প্রতি শো-তে বিকেল হতে না হতেই স্টুডিও-র বাইরে নাটক দেখতে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় কুচোকাচার। নির্দিষ্ট একটি নাটক সঙ্গত কারণে তাদের বয়সোপযোগী নয়, একথা বোঝাতে স্বেচ্ছাসেবকরা রীতিমত হিমশিম খায়। তা কুচোদের বিপুল উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতাকে সম্মান জানানোর জন্যই ভাবা হলো, এ বছরের উৎসব শিশুদের থিয়েটার উৎসব করলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। আবেদন করা হলো, যদি আপনাদের কাছে বাচ্চাদের জন্য নাটক থাকে যা কি না ব্ল্যাক বক্স অডিটোরিয়ামে দেখানোর উপযুক্ত তাহলে আর দেরি না করে ভিডিও পাঠিয়ে দিন। একটা দুটো নয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের থেকে জমা পড়ল পঞ্চাশটিরও বেশি নাটক। আর সেগুলো দেখে উৎসবের জন্য বেছে দিল শাদিপুর নাটক উৎসবের ‘কিউরেটরিয়াল’ কমিটি। এবারের কিউরেটররা ছিলেন কৃতার্থ, টিনা, ধীরাজ, সোনিয়া এবং ডক্টর রজনী।

 

প্রতি বছরই উৎসবে অংশ নেন ভারতের নানা প্রান্তের নাট্যদল। এ বছরের মনোনীত দলগুলি ছিল জয়পুর থেকে ব্রিদিং স্পেস ইন্ডিয়া, মুম্বাইয়ের রং প্রবাহ থিয়েটার গ্রুপ, মুভ উইথ জয় অ্যান্ড স্মল টেলস এবং রেড নোজ এন্টারটেইনমেন্ট, মহারাষ্ট্রের কোলাপুরের টাইনি টেলস থিয়েটার কোম্পানি, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দল সন্তোষপুর অনুচিন্তন, মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট থেকে স্বয়ংবল পারফর্মিং আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়ার্ক সমিতি।

 

এত আনন্দ আয়োজন / সবই বৃথা আমায় ছাড়া নাহ! যাদের জন্য এত আয়োজন সেই বাচ্চাকুল নিরাশ করেনি। ভিড় বলে ভিড়! নাটক শুরু হবার ঘণ্টা দুয়েক আগে থেকে বাচ্চারা জড়ো হতে শুরু করত! বন্যার জলের মতো ক্রমশ বাড়তে থাকত। এমনকি শো শুরু হয়ে যাবার পরও। অথচ স্থান তো হতে পারে বড় জোর জনা পঞ্চাশ-ষাট, কী মেরে কেটে সত্তর! যতই বোঝাও কে শোনে কার কথা! ছেঁকে ধরে ঝুলোঝুলি করতে থাকবে! তারও পর ডাবল শো দেখতে চায় অনেকেই। তাদের নিরস্ত্র করতে ভলান্টিয়াররা নাকাল! কখনও আবার বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে লেগে যায় ঝগড়া! নারদ নারদ, ভলান্টিয়াররাই তখন রেফারি। উড়োনচণ্ডে, রোগা পটকা, বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো, ময়লা জামা গায়ে, নাকে শিকনি ঝরছে, শনের দড়ির মতো চুলগুলোতে কবে শেষ চিরুনি লেগেছে ভগায় জানতি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো শিশু নয় এরা। চারপাশের নোংরা-দূষণ, দারিদ্র্য, শিশু শ্রম, বেকারত্ব, নেশা আর অশিক্ষার মতো হাজার হাজার অনিশ্চয়তার মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশু। রূঢ়, রুক্ষ, দুর্বিনীত, দুর্দমনীয়। বাস্তবের কড়া রোদ প্রতিনিয়ত শুষে নেয় কোমলতা। জন্মে অবধি জীবন এদের রেওয়াত করেনি, ফলত কাউকে রেওয়াত করা তাদের বড় একটা ধাতে নেই, করেও না। অসহিষ্ণু হয়ে উঠলে দরজা পেটায়, ঢিল-পাথর ছোঁড়ে, বলিউডি ফিল্মি কায়দায় হুমকি দিয়ে অপ্রস্তুত অনভিজ্ঞ ভলেন্টিয়ারদের ঘাবড়ে দিয়ে মজা পায়। লিকলিকে হাড় জির জিরে শরীর, জোরে হাওয়া দিলে উড়ে যাবে ভয় হয়, কিন্তু কী তেজ! মিডনাইটস চিলড্রেন? কিংবা বুঝি তাদের নাতিপুতি! সেই কুম্ভীপাক থেকে উদ্ধারে এগিয়ে যায় মালা, মানে মলয় শ্রীহাশমি। নির্ভয়ে শান্ত মেজাজে ক্ষুদে গুন্ডাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, “মারবে? ঠিক আছে মারো, কিন্তু তাতেই বা নাটক দেখবে কী করে?” কাজ হয়। বাচ্চারা শান্ত হয়ে আসে। লাইন করে। রোজ আসত গুড়গুড়ি পিঠোপিঠি দুই ভাই ছোট্ট পিলপিলে পুঁচকে বোনকে নিয়ে। বেশি ছোট বলে পাছে বোনকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া না হয়, দাদারা বলত ক্লাস ওয়ান। মুখে কথা ফোটে না কিন্তু নাটক দেখে চুপটি করে অপার মনোযোগ সহকারে! আসত বছর দশেকের উমের। ফুটফুটে চেহারা, কাউকে কেয়ার করে না এমন ভঙ্গিতে হাঁটা চলা করে, বেশ দেখায়। একদিন খালি আসতে পারেনি। কারণ জিজ্ঞাসা করতে বলল, ওর এক বন্ধুর হাতের ওপর দিয়ে অটোরিকশা চলে গেছে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।

 

দর্শক ঢোকার ঘণ্টা বাজে। অভিনয়ের স্থান ঘিরে গোলাকৃতি বসবার জায়গা। একপাল খুদে পাঁচ জন করে করে ঢোকাতে শুরু করে ভলান্টিয়াররা। বসিয়ে দেয় সতরঞ্চির ওপর। শুরু হয় নাটক। আর নাটকের সাথে সাথেই সেইসব ধুলোমাখা ম্যাজিসিয়ানরা এক এক করে ভেসে চলে অজানায়, ব্যাগস অফ গ্যাগস বগলদাবা করে, মনের অলিগলি বেয়ে, মিয়া লিলোর দেশে কিম্বা পরিন্দাদের স্বাধীন মুলুক কাবুলে। ‘না’ পেয়েছির দেশ ছেড়ে হয়তো বা কোনও ‘সব না পেয়েছির দেশে’!

 

আচমকা একদিন ঝড়ের মতো হাজির হলেন এক মা। উদভ্রান্ত, উস্কখুস্ক চুল, রুদ্রমূর্তি।

– আয়ান আছে?

– আছে।

– বের করে দিন। পালিয়ে এসেছে কাজে না গিয়ে। ওর বাবা পিটছে আমায়।

 

নাটক চলছে। তবু ছেলেটাকে বের করে দিতে হল। আর বাইরে আসতেই আয়ানের গালে নেমে এল বিরাশি সিক্কার চড়। আয়ানের মতো কেউ কেউ স্কুল ফেরত সোজা চলে আসত, দুপুরের খাওয়া না খেয়ে। বলত বাড়ি গেলে মা তাদের ফাইফরমাসের কাজে পাঠিয়ে দেবেন, নাটক দেখা হবে না। ভেবেছিলাম ছেলে মানুষ অজুহাত দিচ্ছে। চড়টা ঘোর ভাঙিয়ে বুঝিয়ে দেয় মঞ্চে নয় প্রকৃত নাটক এদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায়! জীবন্ত নাটক।

 

নাটক দেখবার স্বার্থে অডিটোরিয়ামের মধ্যে সমকক্ষ হয়ে পাশাপাশি বসে পড়েন রিকশাওয়ালা থেকে স্কুলপড়ুয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে অধ্যাপক। বিপ্লবী শ্রেণির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে নাটক দেখতে দেখতে অক্ষম পাতিবুর্জোয়া দর্শকের মনে হয়তো উঁকি দিতে পারে সমর সেনের কবিতার লাইন“ঘুণ ধরা আমাদের হাড় / শ্রেণীত্যাগে তবু কিছু আশা আছে বাঁচবার।” মানুষে মানুষ গাঁথার কাজে কমিউনিটি থিয়েটারের জুড়ি মেলা ভার। সেকাজেরই সার্থক প্রয়াস ‘শাদিপুর নাটক উৎসব’।

 

নাটকের শেষে অভিনেতাদের সাথে আলাপ পরিচয়। শাদিপুরের বাচ্চারা অনায়াসে মিশে যায় সন্তোষপুর অনুচিন্তনের ভবানীপুরের পেয়ারা বাগান বস্তির শিশু অভিনেতাদের সাথে। নিয়মিত নাটক দেখে বাচ্চারা জানে এসময় প্রশ্ন করতে হয়। ‘কোথা থেকে এসেছ’-র মতো সরল প্রশ্নই শুধু নয়, একটি বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, ‘নাটকটি তুলতে কতদিন লেগেছে তোমাদের?’ ‘হিল মিল কর’ নাটকের শেষে বাচ্চারা শিখে নেয় কী ভাবে ফেলে দেওয়া জিনিস — ছেঁড়া কাপড়, বোতলের ছিপি, টিনের কৌটো, লোহার স্প্রিং দিয়ে বানানো যেতে পারে কস্টিউম, বাদ্যযন্ত্র। আসলে চেতনা পৌঁছে দেবার ডাকপিয়ন হয়ে ২০১২ থেকে শাদিপুরে এই অভ্যেসের বীজ, প্রশ্ন করবার অধিকার তাদের মধ্যে বপন করে চলেছে ‘স্টুডিও সফদার’। ব্রেখটের সেই দুটি শিল্প গড়ে তোলার পরামর্শ, অভিনয়ের এবং অভিনয় দেখার। আসলে ‘স্টুডিও সফদার’—জাগে, জেগে থাকে ও জাগায়।

 

আপনি কলকাতায় ছ’মাস নিয়মিত নাটক দেখুন, দেখবেন ৬০ শতাংশ দর্শকের মুখ চেনা হয়ে গেছে! কারণ কোনও এক অলিখিত নিয়মানুযায়ী সেই এক দল নাট্যমোদীই আহ্নিকগতি বার্ষিকগতিতে রবীন্দ্র সদন থেকে মধুসূদন মঞ্চ, গিরিশ মঞ্চ থেকে একাডেমি, নিরঞ্জন সদন থেকে সুজাতা সদন, মুক্তাঙ্গন থেকে অহীন্দ্র মঞ্চে অনবরত ঘুরে চলেছেন। তবে কি ‘মৃত্যু মাঝে চিতাভস্মে সবার সমান’ হবার অপেক্ষা?

 

আসলে সবাই জানে কোথাও একটা অদৃশ্য খড়ির গণ্ডি কাটা রয়েছে, এপারের কেউ ওপারে যায় না, অর্থাৎ একদল লোকই নাটক দেখেন, বাকিরা দেখে না। তেমন দিন কি আসবে, যে দিন ট্যাক্সিওয়ালা আপনাকে মঞ্চে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে এসে আপনার পাশের আসনটিতে বসে যাবেন, বা হলের লাগোয়া বাড়ির গিন্নি টিভি সিরিয়াল না দেখে নাটক দেখতে আসবেন, কিংবা চা দোকানের দিদি গ্রিনরুমে চা পৌঁছে দিয়েই ছুটে চলে যাবেন দর্শকাসনে? যখন নন্দন চত্বরের চালচুলোহীন বাচ্চাগুলো খুচরো টাকা বা আইসক্রিম কিনে দেবার জন্য ঝুলোঝুলি না করে, কলকাতার তাবৎ ফ্যাতাড়ুরাও মালসাট মেরে উঁচু গলায় দাবি জানাবে তাদের কেও রবীন্দ্র সদনে প্রবেশ করতে দেওয়া হোক? ‘শাদিপুর নাটক উৎসব’ ভরসা দেয়’ আসবে, আসবেই। অচলায়ন হটিয়ে কতিপয় ইন্টেলেকচুয়ালের কাঁচিছাঁটা টবের শৌখিন বাগান থেকে নাটককে অরণ্যের মাটিতে রোপন করে সংস্কৃতির বদ্ধজলাটা ভেঙে দেবে।

 

থিয়েটারের মায়া কাজল চোখে টেনে না বসিয়ে এভাবেই নাটক বদলে ফেলবে পৃথিবীটা। টি. জ্যাকসন অ্যান্ড জ্যাকসন, পাওলো ফ্রেইরির ক্রিটিক্যাল পেডাগজি ইন থিয়েটার (Critical Pedagogy in Theater), কী অগাস্টো বোয়াল নির্মিত থিয়েটার অব দি অপপ্রেসড (Theater of the Oppressed)-এর কলাকৌশল, সেলমান এবং প্রেন্টকির থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্ট, সেভ দ্য চিল্ড্রেন, চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড (Theater for Development, Save the Children, Change the World) কিন্তু বুঝে নেওয়া দরকার কোথাও এমন ম্যাজিক নেই, থিয়েটার পৃথিবীকে পাল্টাতে পারে না। বরং নীতিকথা গেলানোর, সমাজ সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নাটক করলে আরও বিপদ! বড়জোর এনজিও কিট-ব্যাগ সাইজের সৌখিন সমাজ সেবা, উন্নয়ন হতে পারে, সমাজের বদল করা যায় না। আমদর্শক দূর থেকেই পালাবে। সাধ করে পাচন গিলতে কার আর সাধ হয় বলুন? তবে? তবে, পাওলো ফ্রেইরিকে একটি উদ্ধৃতি সামান্য শব্দান্তরিত করে বলা যায়, ‘থিয়েটার পৃথিবীকে পাল্টাতে পারে না। থিয়েটার মানুষকে বদলে দেয়। মানুষ পৃথিবী বদলে দেয়।’  সফদারও জানতেন, সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে থিয়েটার আসলে একটা প্যারাডক্স, থিয়েটার আসলে নিজের থেকে কিছুই পরিবর্তন করে না। এমন কখনোই হয়না যে নাটকের একটি বিশেষ মুহূর্ত আসে এবং BINGO! সাথে সাথে দর্শকরা এবং পৃথিবী বদলে যায়। মানুষের সমাজের রূপান্তর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া ধরেই হবে, হবে শ্রেণি সংঘর্ষের দ্বারাই, কয়েকজনের দাসত্ব থেকে অসংখ্যর মুক্তি পাওয়ার মধ্যে দিয়ে। লক্ষ্য কঠিন, পথটাও লম্বা, কিন্তু সহযাত্রীও তো কম নয়। সকলের সমবেত ধাক্কায় একটু একটু করে হলেও সমাজটা বিবর্তনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে কি না, এ পথেই ক্রমোন্বতি ঘটবে কি না সে উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। তত দিন ‘ওরে ও তরুণ ঈশান! বাজা তোর প্রলয় বিষাণ! ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর/প্রাচীর ভেদি।’…উড়ুক উড়তে থাকুক প্রাচীর ভেদি।

 

(লেখিকা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী)

 

Share this
Recent Comments
4
  • খুব vivid আর প্রাণবন্ত রচনাশৈলী। বিষয়বস্তুর দিক থেকে সহমত পোষণ করি। সর্বহারা গণজাগৃতির ক্ষেত্রে
    এ ধরনের painstaking অথচ দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ উদ্যোগের মধ্যেই শ্রমজীবী সংস্কৃতির বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে ব’লে মনে করি।

  • খুব ভালো লেখা !

  • খুব ভালো লেখা !
    এখানেও এইধরণের কাজ হওয়া প্রয়োজন।

  • comments
    By: মনোজ on October 11, 2023

    আমাদের প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যার জন্য কি লেখাটা নিতে পারি?
    আমাদের নতুন পত্রিকা, নাম নগরঘাটা । এ লেখার উৎকর্ষ সন্দেহাতীত ভাবে পত্রিকার মানোন্নয়ন ঘটাবে । অনেক পাঠক আছেন, যাঁরা সত্যিকারের ভালো লেখা খুঁজে বেড়ান , এ লেখা যে তাঁদের চাহিদা পূরণ করবে শুধু নয়, তাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগও নেবেন প্রিয়জনদের এ লেখা পড়াবার ।
    আগ্রহভরে উত্তরের ( হ্যাঁ-সূচক) অপেক্ষায় রইলাম — মনোজ ।

Leave a Comment