ফ্যাসিবাদ ও বিপ্লব


  • September 1, 2023
  • (0 Comments)
  • 772 Views

নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয়কেও দেখতে হবে দ্রুত শ্রেণিসংগ্রাম বিকশিত করা ও বাম-বিপ্লবী শক্তির উত্থানের শর্তের অধীন হিসাবে। সামাজিক আন্দোলনের বিকাশ ও ঐক্য, শ্রেণিসমূহের সংগ্রামী বিকাশ ও ঐক্য ও বিপ্লবী শক্তির ঐক্য – এই তিনটি হচ্ছে বাম-বিপ্লবীদের কর্তব্যের প্রধান দিক। তবে শুধুমাত্র কর্মসূচি ও ঘোষণ দিয়েই বাম-বিপ্লবী পরিচিতি নির্ধারণ হয় না – রাজনৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বিচার্য বিষয়। লিখলেন অরূপ বৈশ্য

 

পুঁজির সঞ্চয়নের সাধারণ সূত্র নির্দিষ্টভাবে নির্ভরশীল অর্থনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করে তার নিয়ম সূত্রায়িত করার ক্ষেত্রে মার্কসীয় তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এখনও অসম্পূর্ণ। নির্ভরশীল অর্থনীতি পরিচালনার নির্দিষ্ট সূত্র নির্মাণ করা নির্ভরতার মার্ক্সীয় তত্ত্বের একটি মৌলিক কাজ। পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্কে পরম উদ্বৃত্ত মূল্য থেকে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্যে রূপান্তরের ক্ষেত্রে নির্ভরশীল পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমের অতি-শোষণ ও বেকার শ্রমবাহিনীর বৃদ্ধি বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু উন্নয়ন ও নির্ভরশীলতা যখন যুগপৎ বিকশিত হয়, তখন এই দু’য়ের নির্দিষ্ট সম্পর্ক নির্ধারণ করা জরুরি। উপরন্তু, ভারতের গ্রামীণ পরিসরের বিষয়ীগত পরিস্থিতি শুধুমাত্র কৃষির উৎপাদন পদ্ধতির বিতর্ক দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়, অন্যান্য গুরুত্ত্বপূর্ণ সূচক ও সমাজ-রাজনীতিতে উঠে আসা ঘটনা পরম্পরার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দ্দিষ্ট ব্যাখ্যা নির্দিষ্ট বিপ্লবী কাজের দিশা দেখাতে পারে।

 

রাজনৈতিক পরিসরের বামদিকে অবস্থিত প্রায় সবাই ফ্যাসিবাদের বিপদের কথা বলছেন এবং তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধরনের সংজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সবাই এব্যাপারে একমত যে এই বিপদ দেখা দিয়েছে আরএসএস ও বিজেপিকে কেন্দ্র করে। ফ্যাসিবাদ ও সাংবিধানিক গণতন্ত্রের দ্বৈত শক্তির প্রকাশ ঘটেছে এনডিএ ও ইন্ডিয়া জোটের মধ্য দিয়ে। ছোট ও বড়ো বাকি সব শক্তি এই দুই জোটের চারপাশে জিগস গেম বা ধাঁধার খেলার মত ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বাম ও বিপ্লবীরা তাদের সংসদীয় নির্বাচনী শক্তির বিচারে সামান্য উপস্থিতি নিয়ে ইন্ডিয়া জোটের পেছনে আত্মগোপন করতে বাধ্য। যদিও ঘটনাপ্রবাহের আন্তঃসম্পর্ক বিপ্লবী গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে দেখিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু বিষয়ীগত পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় বিপ্লবী শিবিরে চূড়ান্ত ভ্রান্তি বিরাজ করায় ঢাল হিসাবে ইন্ডিয়া জোটকেই রাখতে হচ্ছে। মৌলিকভাবে ফ্যাসিবাদের বিপদের অর্থ হচ্ছে, শাসকশ্রেণি আর পুরোনো কায়দায় শাসন করতে অপারগ এবং শাসিতরা আর পুরোনো কায়দায় শাসিত হতে অনিচ্ছুক। ফ্যাসিবাদের এই বিষয়ীগত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিষয়ীগত বাস্তবতাকে সংক্ষেপে পরখ করে দেখা যাক।

 

চলমান ও পরিবর্তনশীল বাস্তবতা নির্মিত হয় বিভিন্ন অংশের আন্তঃক্রিয়ায় গতির পরিবর্তনের নিয়ম মেনে। বাস্তব পরিস্থিতির ব্যাখ্যা সম্ভব বিভিন্ন অংশের বর্ণণা করে এবং একে অপরের উপর প্রভাবকে নির্ধারণ করে এবং সেজন্যই সেই ব্যাখ্যা একটি ধারণার স্তরে বিদ্যমান থাকে। বিদ্যমান ধারণা থেকে নির্দিষ্ট কাজের রূপরেখা তৈরি করতে হলেও, সেই ধারণা নিয়ত পরিবর্তনশীল বলেই বাস্তব পরিস্থিতির ব্যাখ্যা প্রতিনিয়ত চালিয়ে যেতে হয় এবং সে অনুসারে কাজের রূপরেখার পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে হয়। বাস্তবের এই বিভিন্ন অংশকে আমরা কতকগুলো ভাগে ভাগ করতে পারি—যেমন সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক। প্রতিটি ক্ষেত্র যাচাই করে দেখা যাক।

 

সামাজিক পরিসরকে মার্ক্সীয় সেই সূত্রকে প্রেক্ষিতে রেখে বিচার করতে হবে যেখানে বলা হয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস ও প্রাগৈতিহাস শ্রেণিহীন শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। সমস্ত সময় ধরে সমাজের অভ্যন্তরে যে নিষ্ক্রিয় চলমান শ্রেণিসংগ্রাম তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না। সেই শ্রেণিসংগ্রামের একটি আবছা চিত্র বিধৃত হতে পারে উপন্যাসে এবং খানিকটা গবেষণাধর্মী কাজে। চলমান শ্রেণিসংগ্রাম রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণে ধরা দেয় যখন তা একটি শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এনার্জি অর্থে শক্তি মানে শক্তি-বলয় বা এনার্জি-ফিল্ড। সচেতন রাজনৈতিক শক্তি যখন নিজেকে এই এনার্জি-ফিল্ডের অভ্যন্তরে আবিষ্কার করে তখনই দু’য়ের মধ্যে আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে উভয়ই পরিবর্তিত হয় এবং শ্রেণিসংগ্রামের স্বরূপ ধরা পড়ে।

 

সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে কৃষকের সংগ্রামের মূলত দু’টি প্রধান ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশি বিদেশি কর্পোরেট পুঁজি সমগ্র কৃষি বাজারকে উন্মুক্ত করে দিয়ে তার দখল নিতে চাইছে। এই দখলদারির দু’টি স্পষ্ট দিক রয়েছে। প্রথমত কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সমস্ত উৎপাদন ও বিতরণের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নিয়ে নেওয়া যাতে বাজারের নিয়মে সামগ্রীর দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে অতি-মুনাফাকে নিশ্চিত করা যায়। দ্বিতীয়ত, কৃষি উৎপাদন সম্পূর্ণ রূপে আমদানি-রফতানি ব্যবসার সাথে যুক্ত করা এবং সেজন্যই আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা-যোগানের উপর নির্ভরশীল ক্যাশ-ক্রপ উৎপাদনে জোর পড়ে – পাম চাষে গুরুত্ত্ব তারই পরিণতি। এটি হচ্ছে নির্ভরশীল নিওলিবারেল কৃষি নীতির একটি রূপ যেখানে আম-গ্রামীণ সমাজের আয় কমে গিয়ে ও খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে গিয়ে দেশীয় চাহিদা সঙ্কুচিত থাকবে এবং প্রতিযোগিতার বাজারে সস্তায় রপ্তানি করেও মুনাফা ঘরে তোলা যাবে। সাম্প্রতিক এক তথ্যে দেখা গেছে যে, আনুমানিক ৩০ লক্ষ টন টমেটো টমেটো-চাষিদের কাছে পড়ে আছে, অথচ সরকার নেপাল থেকে ১ লক্ষ টন আমদানি করার অনুমতি দিয়েছে যাতে আকাশছোঁয়া টমেটোর দামের বাজারে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা মুনাফা করতে পারে। কৃষকদের ক্ষোভের চাপে পড়ে সরকার এমএসপিতে মাত্র ১ লক্ষ টন কেনার কথা ঘোষণা করেছে। যেহেতু কৃষিপণ্যের বাজার মূলত বৃহৎ দেশি বিদেশি কর্পোরেট বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে, সেজন্য দর-নির্ধারণে যোগান ও চাহিদাকে তাদের মুনাফার অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে কৃষক বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে দেশি বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে বিস্থাপনের মাধ্যমে পুঁজির সঞ্চয়নের ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ফলে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কৃষকের প্রতিরোধ স্পৃহারও বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এই উচ্ছেদ শুধুমাত্র জমি থেকে উচ্ছেদ নয়, বেসকারিকরণ এবং সংযুক্তি ও অধিগ্রহণের মাধ্যমে স্থায়ী শ্রমিকদেরও উচ্ছেদ। এই উচ্ছেদ শুধুমাত্র মাটির নিচের সম্পদ আহরণে “আদিবাসী” উচ্ছেদ নয়, এই উচ্ছেদ পুঁজিবাদী বিকাশের ও রিয়েল-এস্টেট ব্যবসার প্রাথমিক শর্ত হিসাবে প্রাইম-ল্যান্ড থেকে তথাকথিত উন্নত চাষি সম্প্রদায়েরও উচ্ছেদ। বিপরীতে ফর্মাল ও ইনফর্মাল সেক্টরে পুঁজি-বিনিয়োগ ও বিত্ত-পুঁজির অনুপ্রবেশ গ্রামীণ শ্রেণি-সম্পর্কের দ্রুত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ক্যাশ-ক্রপ উৎপাদনে কন্ট্র্যাক্ট-ফার্মিং ও কৃষি বাজারের চরিত্র বদল একদিকে যেমন ক্ষুদ্র-চাষিদের চরিত্র বদলে দিচ্ছে, অন্যদিকে এই নিয়ম, উচ্ছেদ এবং পুঁজির পুনর্নির্মাণ ও বিনিয়োগের বর্তমান ধারা গ্রামীণ পরিসরে ব্যাপক নিঃস্ব ও প্রলেতারিয়েত শ্রেণির জন্ম দিচ্ছে। এই গ্রামীণ প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সংগ্রাম প্রাথমিকভাবে ও প্রধানত গ্রামীণ পরনির্ভর বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছে, যদিও সেটা এখনও এলাকাভিত্তিক স্তরেই সীমাবদ্ধ আছে ও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কৃষকদের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, এক দু’জন টিকায়েতকে ব্যবস্থায় আত্মস্থ করে নিতে পারলেও সামগ্রিকভাবে কৃষকশ্রেণিকে ব্যবস্থায় আত্মস্থ করার মতো কোনও পরিকল্পনা নেওয়ার মতো অবস্থা এই মুহূর্তে শাসকশ্রেণির হাতে নেই। দ্রুত নিঃস্ব ও প্রলেতারীয়করণে শঙ্কিত কৃষকরা অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহের দোরগড়ায় বসে আছে — কৃষকশ্রেণিকে সংগঠিত করতে বাম-বিপ্লবীরা সক্ষম না হলে, ইন্ডিয়া জোটের বুর্জোয়ারা তাতে হস্তক্ষেপ করবে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই বুর্জোয়া অংশের বিকল্প কোনও পরিকল্পনা নেই।

 

সব তথ্যই বলছে পরিকাঠামো ও সার্ভিস সেক্টরে বিনিয়োগ সবচাইতে বেশি। মার্ক্স এই সেক্টরকে উল্লেখ করেছেন পুঁজিবাদী উৎপাদনের অফসুট বিনিয়োগের সহযোগী তৃতীয় ক্ষেত্র হিসাবে। ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য উৎপাদনের হাতিয়ার উৎপাদন হচ্ছে দু’টি প্রধান বিভাগ। কিন্তু পুঁজি ও শ্রমের নিওলিবারেল পুনর্গঠনের দীর্ঘ পর্যায়ে ফিনান্স ও ইনফ্রাস্ট্রাকচারে বিপুল বিনিয়োগের নিজস্ব নতুন বাজার গড়ে ওঠে যার মাধ্যমে বিশ্ব-পুঁজির ক্রমবর্ধমান সংকটেও মুনাফার হার পড়ে যাওয়াকে রোধ করে মুষ্টিমেয় কিছু কর্পোরেট পুঁজিপতি মুনাফার পাহাড় সঞ্চিত করেছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিকাঠামো ও পরিষেবায় ব্যাপক নতুন শ্রমিকবাহিনীর আবির্ভাব ঘটেছে। আপাতদৃষ্টিতে মার্ক্সীয় পরিভাষায় পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্কে এই শ্রম পুঁজির কাছে প্রকৃত (Real) নয়, আনুষ্ঠানিক অধীনতা (Formal Subsumption)। দ্রুত নগরায়নের পরিস্থিতিতে পরিবহণ, নির্মাণ থেকে শুরু করে গিগ ও মলকর্মীদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যেসব কাজে সামান্য হলেও মানসিক শ্রমের বৈশিষ্ট্য রয়েছে সেখানেও এমন বন্দোবস্ত করা হচ্ছে যাতে সব শ্রমই কঠোর দৈহিক শ্রমে রূপান্তরিত হয়। বৃহৎ মলগুলিতে যে শ’য়ে শ’য়ে সেলস বয় ও গার্লস দেখা যায় তাদের বসার জন্য একটা টুলও রাখা হয় না, যাতে শ্রম পুরোপুরি কায়িক শ্রমে পরিবর্তিত হয়, ভাবনার জগতের জন্য সামান্য অবকাশও পরিশ্রান্ত দেহ বজায় না রাখে। এই বিনিয়োগের বিপরীতে উৎপাদনী বিনিয়োগ বেড়েছে বটে, কিন্তু তা এখনও নগণ্য, এমনকি বিদেশি বিনিয়োগও। সেই ফর্মাল সেক্টরে সংগঠিত শ্রমিকদের বৃহৎ অংশ সরাসরি কঠোর কায়িক শ্রমের সাথে যুক্ত। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে যারা মানসিক শ্রমে যুক্ত তাদের কাজের চরিত্রকেও একঘঁয়ে কঠোর কায়িক শ্রমের পর্যায়ে পর্যবসিত করে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে কেইন্সীয় অর্থনীতি বা কল্যাণকামী মিশ্র অর্থনীতি বা পরিকল্পনা অর্থনীতির পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মতাদর্শগতভাবে আত্মস্থ করে নেওয়ার প্রধান বিষয়ীগত শক্তি হিসাবে বিদ্যমান ছিল ‘অ্যারিস্ট্রোক্রেসি অব লেবার’ বা অভিজাত শ্রমিকের অংশ। সেই অভিজাত শ্রমিকের অংশটি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং তার সাথে শুকিয়ে গেছে বদলি-পদোন্নতি-বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আবদ্ধ থাকা সেই চিরায়ত ট্রেড-ইউনিয়ন। এরকম বিষয়ীগত পরিস্থিতিতে শ্রমিকশ্রেণির উপর শাসকশ্রেণির মতাদর্শগত আধিপত্য বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব। গোটা ব্যবস্থা জুড়ে মজুরি ও আয় কমিয়ে রেখে শ্রমের অতি-শোষণের ভিত্তিতে মুনাফার হার বৃদ্ধি ও শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা অবদমিত রাখাই পরিস্থিতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সমগ্র বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জুড়ে ক্রয়ক্ষতা হ্রাস পুঁজির অতি-উৎপাদনের দীর্ঘস্থায়ী সংকটেরও অন্যতম কারণ। এমতাবস্থায় শ্রমিকরা কি বিদ্রোহ করবে না? বিদ্রোহ করছে, কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে। মনে রাখা দরকার যে শ্রমিকের শ্রমিকশ্রেণিতে রূপান্তর এক হয়ে ওঠার নাম। যখন পরস্পর বিচ্ছিন্ন শ্রমিক গোষ্ঠী একজোট হয়ে, উদাহরণস্বরূপ নতুন শ্রমকোডের বিরুদ্ধে, একযোগে জেগে ওঠবে তখনই শুরু হবে শ্রমিকের শ্রেণিতে রূপান্তরের পর্যায়। ভারতে বিষয়ীগতভাবে এই পরিস্থিতি বিদ্যমান, রয়েছে বিষয়গত প্রস্তুতির অভাব – কিন্তু শাসকশ্রেণির কাছে শ্রমিকশ্রেণিকে মতাদর্শগতভাবে বশ্যতা স্বীকার করানোর জন্য শ্রমিকের অভ্যন্তর থেকে যে শ্রেণির আত্মপ্রকাশ প্রয়োজন তা অনুপস্থিত।

 

এবার আসা যাক নারী আন্দোলন প্রসঙ্গে। বিগত কয়েক দশক যাবত বিশেষ করে ইউপিএ আমলে নারী প্রশ্ন ও নারী আন্দোলন মানে ছিল প্রধানত সর্বস্তরে সংরক্ষণের প্রশ্ন এবং তার সাথে জড়িয়ে ছিল জাতি-বর্ণে বিভাজিত নারীর সংরক্ষণের বিতর্ক – সংসদেও এনিয়ে উত্তাল বিতর্ক আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই দাবি মূলত মধ্যবিত্ত ও এলিটিস্ট দাবি এবং সেজন্যই এই দাবির পেছনে ব্যবস্থার অভ্যন্তরেই গণতন্ত্র ও প্রতিক্রিয়ার উভয় অন্তর্বস্তু যুগপৎ উপস্থিত ছিল। নারী আন্দোলনের সেই পর্যায় অতিক্রান্ত হয়েছে – সেই দাবিতে জনমনে আলোড়ন নিস্তব্ধ হয়ে শুকিয়ে গেছে। এবার নারী আন্দোলন ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ জানানোর অন্তর্বস্তু নিয়ে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পুঁজির বিনিয়োগ ও পুনর্গঠন নারীকে সস্তা মজুর হিসাবে সামাজিক শ্রমে টেনে আনছে। পরিসংখ্যানবিদরা নারীর সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও হ্রাস নিয়ে তথ্য সরবরাহ করে থাকেন – ট্র্যাডিশনাল কৃষিকাজে নারীর পারিবারিক শ্রমের বাইরে অংশগ্রহণকেও তাঁরা সামাজিক শ্রমের হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু ট্র্যাডিশনাল কৃষিকাজে সামাজিক অংশগ্রহণ পারিবারিক শাসন-কাঠামোর গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। বর্তমানে নারীর সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ চরিত্রগতভাবে আলাদা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে শপিং মল সর্বত্র নারী-শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ করছেন, এমনকি বস্ত্র শিল্পোৎপাদনে যে সামান্য বৃদ্ধি ঘটেছে তাতে নারীরা যুক্ত কঠোর কায়িক শ্রমে – আর পুঁজি নারীকে টেনে আনছে সামাজিক শ্রমের বাজারে দ্বিবিধ কারণে – নারী শ্রম সস্তা এবং একঘেঁয়ে কাজে নারীদের স্বাভাবিক সেবামূলক ধৈর্যের ঐতিহ্য রয়েছে। সস্তা শ্রম ও নিবিড় শ্রম-শোষণ নারীদের ক্রমাগত আন্দোলনমুখী করে তুলছে। বৃহত্তর শ্রমিক-আন্দোলনে নারী-শ্রমিকের অংশগ্রহণ শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনকে প্রাণবন্ত করে তোলার পরিস্থিতি ক্রমাগত গভীর হচ্ছে। প্যারিস বিদ্রোহ দেখে এঙ্গেলস বলেছিলেন, নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া প্যারিস প্রাণহীন হয়ে পড়ত। সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ নারীকে করে তুলছে দ্বিবিধ শোষণেরর শিকার – উৎপাদনী শ্রমে ও শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের জন্য ঘরোয়া শ্রমের শোষণ। পরিবার ও পিতৃতন্ত্র হচ্ছে এই দ্বিতীয় শ্রম-শোষণের মৌলিক কাঠামো। নারীর সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ একদিকে যেমনি ঘরোয়া শ্রমের ক্ষেত্রে তাদের মতপ্রকাশের পরিসরকে খুলে দিয়েছে, ঠিক তেমনি পরিবার, জনগোষ্ঠী ও এলাকার গণ্ডী ছাড়িয়ে নারী পুরুষ উভয়ের সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ নিজেদের অজ্ঞাতেই মনের ভেতর বিদ্যমান জাতি-বর্ণ-ধর্মের পরিচয়গত সংকীর্ণতায় আঘাত করছে। পরিবারের অভ্যন্তরে পুরুষ সদস্যকে যেমনি বলতে পারছে – আজ সে পরিশ্রান্ত, সন্তান দেখভাল পুরুষ সদস্যকে করতে হবে – ঠিক তেমনি আন্তঃবর্ণ, ভিন-ধর্মে বিবাহ ক্রমশঃই বাড়ছে। এতেই শঙ্কিত হয়ে পড়ছে আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবার। মতাদর্শগত আধিপত্য বজায় রাখার পুরোনো পারিবারিক কাঠামো শিথিল হয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই লাভ জেহাদ, সমগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ ইত্যাদি আইন প্রণয়ণ ও আন্দোলনে সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপি ময়দানে নেমে পড়েছে। ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে আর্থিক কাঠামো ও মতাদর্শগত আধিপত্যে যুগপৎ আঘাত করার জন্য প্রয়োজনীয় নারী আন্দোলন বিকশিত করার বিষয়ীগত পরিস্থিতি পরিপক্ক হয়ে আছে।

 

পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া যেভাবে প্রকৃতি ও শ্রমের জৈবিক সম্পর্ককে ভাঙতে ক্রমাগত পরস্পরকে দূরে সরিয়ে দিয়ে উভয়ের ধ্বংসকে সুনিশ্চিত করে, সেই প্রক্রিয়ার এক চূড়ান্ত পরিণতি বিশ্ব-উষ্ণায়নের মাধ্যমে মানব সমাজের সামনে হাজির হয়েছে। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন শুধুমাত্র মানব সভ্যতার বাঁচার লড়াই নয়, তা প্রাথমিকভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরাস্ত করার সংগ্রাম। বহু বিলম্বে হলেও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভয়ানক আকার নেওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশ আন্দোলনও ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। পুঁজিবাদ ধরিত্রীকে আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে সক্ষম নয় – কোনও কোনও বিজ্ঞানীর এই চরম মতকে যদি উপেক্ষাও করা হয়, তথাপি এটা নিশ্চিত যে বিশ্ব-উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পুঁজির পুনর্গঠন ও যে পরিমাণ নতুন বিনিয়োগ করতে হবে তাতে যে সাময়িকভাবে মুনাফা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে, তাতে কর্পোরেট দুনিয়া শঙ্কিত এবং সেই পথ মাড়াতে তারা রাজী নয়। সেই অর্থে পরিবেশ আন্দোলন ব্যবস্থা বদলের বিপ্লবী সংগ্রামের সাথে যুক্ত হয়ে রয়েছে।

 

ভারতবর্ষের মতো দেশে জনগোষ্ঠী শব্দবন্ধ দিয়ে দলিত থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ও রাজ্যিক এবং দেশীয় পরিচিতিকে বোঝানো সম্ভব। দেশীয় পরিচিতির ক্ষেত্রে হিন্দুত্বের ভারতের কাল্পনিক জাতীয়তার গৌরবকে চাগিয়ে দেওয়ার পেছনে যে শ্রেণিশক্তি রয়েছে তা সবাই চিহ্নিত করতে সক্ষম – সেই শ্রেণিটি হচ্ছে দেশি বিদেশি কর্পোরেট পুঁজিপতি শ্রেণি। আপাতদৃষ্টিতে বাকি সব পরিচিতি এবং বিশেষ করে সবচাইতে নিপীড়িত ও বঞ্চিত পরিচিতির সংগ্রাম তার বিপরীতে অবস্থান করে এবং সেজন্যই হিন্দি-হিন্দুত্বের এক ভাষা, এক সংস্কৃতির ফ্যাসিস্ট প্রকল্পের বিরুদ্ধে অনেকেই ভারতীয় বৈচিত্র্য রক্ষার সংগ্রামকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করেন। কিন্তু বাস্তবে শ্রমিকশ্রেণিশক্তির প্রতিরোধ ছাড়া পুঁজি বৈচিত্র্য ও বিকেন্দ্রীকরণ উভয়কেই ব্যবহার করতে পারে। দেখা গেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মত সবচাইতে বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলেও এই ফ্যাসিস্ট প্রকল্প প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। কী সেই বিষয়ীগত শ্রেণিশক্তি যার উপর ভিত্তি করে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শগত আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব হয়ে ওঠে? আসলে পুঁজি ও শ্রমের নিওলিবারেল পুনর্গঠন এবং ফিনান্স ও পরিকাঠামোয় উপরুল্লিখিত পুঁজির বিনিয়োগের প্যাটার্ন ক্লায়েন্ট-পেট্রন সম্পর্কে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে এক নব্য-ধনিক শ্রেণি গড়ে তুলেছে যারা শুধুমাত্র কমিশন এজেন্ট হিসাবেই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর বিচারে বিপুল সম্পদের মালিক। ফিনান্স পুঁজির অনুপ্রবেশ ছাড়াও আরও বহুবিধ উপায় আছে, উদাহরণস্বরূপ জমি-অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে জমি হস্তান্তরের আগে মধ্যসত্ত্বভোগী হিসাবে জনগোষ্ঠীয় প্রভাবশালীরা কমিশন এজেন্ট হিসাবে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। উপরন্তু জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরের শ্রেণি-বিভাজনের ফলে সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণি আলোকপ্রাপ্ত শ্রেণির ভূমিকার বিপরীতে শাসকশ্রেণির ফ্যাসিস্ট প্রকল্পের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করছে। জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরের সেই শ্রেণি-শক্তি ফ্যাসিস্ট মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়ীগত শক্তি। শ্রেণি-বিন্যাসের এই বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার তাদের হিন্দুত্ব প্রচারের রণকৌশলগত পরিবর্তন করে নিয়েছে। সেই কৌশলের অঙ্গ হিসাবে আদিম দেবদেবী, ভাষা-সংস্কৃতির পুনরুত্থানের উন্মাদনাকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্বের প্রকল্পের সাথে অনায়াসে জুড়ে দেওয়ার ব্যাপক ও বিস্তৃত আয়োজন সেরে ফেলেছে।

 

অর্থাৎ সামাজিক পরিসরে শাসকশ্রেণির বিবিধ দুর্বল যোগসূত্রের মধ্যে জনগোষ্ঠীই হচ্ছে একমাত্র শক্তপোক্ত যোগসূত্র। সামাজিক পরিসরে চলমান শ্রেণিসংগ্রামের বিভিন্ন রূপকে ব্যবস্থায় আত্মস্থ করার বিষয়ীগত সুযোগ অনুপস্থিত থাকলেও, জনগোষ্ঠীগত আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিক্রিয়াশীল পথে পরিচালিত করার ও ব্যবস্থায় আত্মস্থ করে ফ্যাসিস্ট প্রকল্পে সামিল করার বিষয়ীগত সুযোগ বিদ্যমান। বর্তমান ভারতবর্ষে শ্রমিক-কৃষকই সেই অক্ষশক্তি হয়ে উঠেছে যার জাগরণ জনগোষ্ঠীগত প্রশ্ন সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রশ্নকে সমাধান করতে সক্ষম। ফ্যাসিবাদের বিপদও সেখানে নিহিত এবং তার বিপরীতে বিপ্লবী বিকল্পের সম্ভাবনাও সেখানেই বিষয়ীগতভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কিছু দিক যেভাবে বিকশিত হচ্ছে তাতে আলোকপাত করলে বিষয়টির গভীরতা বোঝা সম্ভব এবং কোনও দীর্ঘস্থায়ী তৃতীয় বিকল্পও কী সম্ভব এও বিবেচনায় আনা যাবে।

 

রাষ্ট্রের একটি অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমলাতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্রের সেই অঙ্গ যা অনগ্রসর দেশে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তশ্রেণির যোগসূত্র বজায় রাখে। এতাবৎ আমলাতন্ত্র ছিল রাষ্ট্র পরিচালনা ও নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক-শ্রেণির পরামর্শদাতা। বর্তমানে সরকার পরিচালনার সমস্ত পরিসরে বসে আছে “বিশেষজ্ঞ কনসালটেশন ফার্ম” যে ফার্মগুলি আসলে হচ্ছে দেশি বিদেশি বৃহৎ কর্পোরেটদের পক্ষে সরকারের অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শ্রেণির পরামর্শদাতা। তারা সরাসরি ফাইল পাঠায় মন্ত্রীদের কাছে, আমলাতন্ত্রের কাছে যা ঘুরে আসে শুধুমাত্র তাকে চালু আইনের বৈধতা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সেরে নিতে কিংবা প্রচলিত আইনে কোনও বাধা থাকলে আইন সংশোধনের পরামর্শ দিতে যাতে বিচার-বিভাগের গ্যাঁড়াকলে আটকে না পড়ে। রাজনৈতিক শ্রেণির কাছে আমলাতন্ত্রের এই অধীনতা আমলাতন্ত্রকে অসন্তুষ্ট করতে বাধ্য। ইন্ডিয়া জোটের যত জনসমর্থন ও সম্ভাবনা বাড়বে ফ্যাসিস্ট রক্তচক্ষুকে অবজ্ঞা করে তাদের বিরোধী ভূমিকা প্রকাশ্যে আসতে থাকবে।

 

জাতীয় পরিস্থিতির মুখ্য দিক হলো দ্রুত ইন্ডিয়া জোট গড়ে ওঠা। ঘৃণার বিপরীতে ভালবাসার রাজনীতির স্লোগান ছাড়া অর্থনীতি ও উন্নয়নের প্রশ্নে ইন্ডিয়া জোটের তেমন কোনও বিকল্প কর্মসূচি নেই – কিছু সংস্কারমূলক ঘোষণা ছাড়া ইন্ডিয়া জোট তেমন কোনও কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলেও মনে হয় না। এমনকি ২০১৪ সাল থেকে এতাবৎ বিজেপির সরকারি নীতির বিরুদ্ধে বামপন্থীরা ছাড়া জোটসঙ্গী কারুরই আন্দোলনের তেমন কোন কর্মসূচি নেই। রাজনৈতিকভাবে চিনের বিরোধিতা করলেও ইণ্ডিয়া জোটের অন্যতম শরিক ডিএমকে সম্প্রতি চিনা কোম্পানির সাথে টেক-প্রজেক্টের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তথাপি এত দ্রুত ইন্ডিয়া জোট গড়ে ওঠা কী করে সম্ভব হচ্ছে? তার মৌলিক কারণ হচ্ছে বিষয়ীগতভাবে বিপ্লবী পরিস্থিতির গভীরতা – সামাজিক শ্রেণিসমূহ এই ঐক্যের বাধ্যবাধকতাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে – ফ্যাসিস্ট বিপদে জনগণের উপর অত্যাচার বৃদ্ধিতে বুর্জোয়াদের কিছু আসে যায় না, বরঞ্চ তাঁরা আত্মসমর্পণ করে নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত করতেই বেশি আগ্রহী যেমনটি মমতা কৌশলগতভাবে করছেন, আর মায়াবতী রণনীতিগতভাবেই করে ফেলেছেন – আসল কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের জন্য জনগণের অস্থির হয়ে ওঠা। কিন্তু কোনও ব্যাপক সংগ্রামী ভূমিকা ছাড়াই এধরনের মোর্চা দ্রুত গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না, যদি না আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে নতুন কিছু দিক দেখা দিত।

 

২০১৪ সালে মোদী সরকার যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন আরএসএসের হিন্দু-রাষ্ট্রের প্রকল্পকে দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মোদী সরকার দ্রুত সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার কোলে আশ্রয় নিতে শুরু করেছিল। নিওলিবারেল ইকোনমিক পলিসি দ্রুত লাগু করলে ‘ওয়াশিংটন কনশেনসাস’কে স্বীকার করে ‘আমেরিকান ডিক্টেশন’ মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তরও ছিল না, যদিও বিশ্ব আধিপত্যের জন্য আমেরিকার সামরিক ক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করেছিল। চীন-রাশিয়া অক্ষশক্তির চ্যালেঞ্জের মুখে – বিশ্ব-পুঁজিবাদের সংকট আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সংকটকেও বাড়িয়ে তুলছিল – কোয়ান্টিটিটিভ ইজিং, বেইল-আউট প্যাকেজ ও নোট-ছাপিয়ে ভর্তুকি বাজেট দিয়েও ২০০৮ সালের সাব-প্রাইম ক্রাইসিসের পর অর্থনীতিকে সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। তথাপিও নিওলিবারেল ইকোনমি থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছা থাকলেও কোনও দেশ সাহস দেখাচ্ছিল না। নিওলিবারেল ইকোনমি পুঁজিবাদের কাঠামোগত সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে সবধরনের কার্যকারিতা হারিয়েছে সে ব্যাপারে পুঁজিবাদের পথিকরা প্রায় সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু আমেরিকার সামরিক দাদাগিরি ও ‘স্যাংশন রেজিমে’র ভয় ছিল। কিন্তু কোভিড বিপর্যয় গ্লোবাল ভ্যালু চেইনকে ভেঙে দেওয়ায় এবার নিওলিবারেল ইকোনমি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করল, আবারও পুরোনো প্রটেকশনিজমে ঘুরে যাওয়া যায় কিনা সেব্যাপারে পুঁজিবাদী দুনিয়া সুযোগের সন্ধানে রয়েছে, ডলারকে বাদ দিয়ে রিজিওন্যাল কারেন্সির মাধ্যমে বাণিজ্যের প্রস্তুতি বৃদ্ধি পাছে। পতনোন্মুখ আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও চিন-রাশিয়া অক্ষশক্তির উত্থানে অনেক দেশই শিবির বদল করছে বা শিবির বদলের জন্য মুখিয়ে আছে। রাশিয়ার – ইউক্রেনে যুদ্ধে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে ও বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের পরিস্থিতি তৈরি করেছে, সেই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে কোনও পক্ষ ভাবেনি— ‘আমেরিকান স্যাংশন রেজিম’ যেমন অকার্যকরী হয়েছে, ঠিক তেমনি রাশিয়ার পরিকল্পনাও দ্রুত বাস্তব হয়ে যাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সেই অবস্থায় ইউরোপ নিজস্ব শক্তি পুনর্বিন্যাসের জন্য শ্বাস নেওয়ার খানিক সুযোগ পেল। ইউরোপকে দুই অক্ষশক্তির কোনও এক পক্ষে সামিল করার বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদী রণনীতির এক গুরুত্ত্বপূর্ণ অঙ্গ। এদিকে সৌদি-আরব ও ইরানের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করে আরবের তেলের দুনিয়ায় ও ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে আরব আধিপত্যের আমেরিকার প্রকল্প দুর্বল ভিতের উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে। এশিয়ায় চীনের দ্রুত আর্থ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে বাধা দিতে আমেরিকা ভারতকে ব্যবহার করতে উদগ্রীব –পুঁজির গভীর সংকটকালে ভারতের মতো দেশের সস্তা শ্রম, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বাজারও লোভনীয় গন্তব্যস্থল। কিন্তু ভারতীয় পুঁজিপতিশ্রেণি বুঝে গেছে যে আমেরিকার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে তাদের লাভ নেই, বরঞ্চ ভারসাম্যের খেলায় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের সহযোগী পার্টনার হিসাবে মুনাফাকে সুনিশ্চিত করা যাবে। সংকটের পরিস্থিতিতে ভারতীয় পুঁজিপতিরা উৎপাদনী বিনিয়োগে এখনও ভীত এবং রাষ্ট্রের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। সরকার চাইলেও ম্যানুফ্যাকচারিং-এ তেমন দেশি বিদেশি কোনও বিনিয়োগই আসছে না, যদিও ব্যক্তি পুঁজির বিনিয়োগ সুনিশ্চিত করতেই সরকার তাদের জন্য বিনামূল্যে জল-জমি-রাস্তা সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে এবং সেজন্যই ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযান এবং লাভজনক ক্ষেত্রের দ্রুত বেসকারিকরণ চলছে। একদিকে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী সাপোর্ট-সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাওয়া ও দেশীয় পুঁজিপতিদের দোদুল্যমানতা এবং অন্যদিকে তীব্র বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধি – সেরকম আবহে কাল্পনিক রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখানো বেশ দুরূহ কাজ। দেশীয় পুঁজিপতিরা এমনই দোদুল্যমান যে “২জি স্ক্যামের” তথাকথিত দুর্নীতির মাধ্যমেই হোক কিংবা বর্তমান সরকারের ৫জি নিলামের মাধ্যমেই হোক, ভারতীয় পুঁজিপতিরা সস্তায় সরকারের কাছ থেকে স্পেক্ট্রাম পেয়েও তাকে টেলিকম ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবহার করতে সাহস পাচ্ছে না, তাঁরা রিয়েল-এস্টেট ব্যবসার মতোই সেই স্পেক্ট্রাম বিদেশি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে মুনাফা করে নিচ্ছে। এদিকে চীন সীমা-বিবাদকে রণনীতিগতভাবে ব্যবহার করছে ভারতীয় সস্তা শ্রম শোষণে বিনিয়োগের জন্য, ভারতের চতুর্সীমায় প্রায় সবক’টি দেশের উপর চীনের আর্থ-রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা থাকলেও ভারত চীনের সাথে অসম সমঝোতার পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের পরিস্থিতিতে ফ্যাসিস্ট রাজনীতির সাথে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের রণনীতি খাপ খায় না। ভারত কি বিপরীত পথে হাঁটতে পারত, দেশীয় পুঁজিপতিদের ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে বাধ্য করতে পারত? কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্ক্স রাষ্ট্র-পরিচালকদের পুঁজিপতি-শ্রেণির ম্যানেজার হিসাবে বিধৃত করলেও, অন্যত্র তার আগে ও পরে রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন – ব্যবস্থাকে অটুট রেখে রাষ্ট্রনীতি অনুসরণে কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পুঁজিপতিদের বাধ্য করতে পারে। ইন্ডিয়া জোট কি সেই পথে হাঁটবে? সেরকম কোনও ইঙ্গিত এখনও মেলেনি – স্বাধীনোত্তর ভারতের ইতিহাস থেকে কংগ্রেস জোটের কাছ থেকে সেরকম আশা করাও যায় না। রাষ্ট্রের সেরকম ভূমিকা একমাত্র সম্ভব বহুমেরুর বিশ্বে বিশ্বপুঁজির আরেকদফা পুনর্গঠনের পরিস্থিতিতে। বর্তমান বিশ্বে সেরকম পুনর্গঠন কি সম্ভব? তার কোনও পথের বিশ্ব-পুঁজি এখনও খোঁজে পায়নি, যদি সেরকম পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ঘটেও, সেই প্রক্রিয়ায় বর্তমান শ্রমিকশ্রেণির উপর আঘাত আসবে এবং বিপ্লবী উত্থানের সম্ভাবনাকে প্রকট করে তুলবে। আরেকটি পথ হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর পুনর্নির্মাণ – কিন্তু বহু দেশ যখন পারমানবিক শক্তি হয়ে উঠেছে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে সেরকম পরিস্থিতিতে আকস্মিক কোনও ঘটনায় বাধ্য হয়ে বিশ্বযুদ্ধ ঘটে যাওয়া ছাড়া মানবসভ্যতার চূড়ান্ত ধ্বংসের সম্ভাবনার ভয়ে পুঁজিবাদের পথিকরা পরিকল্পনামাফিক বিশ্বযুদ্ধের পথ মাড়াতে রাজি নয়।

 

সস্তা শ্রমের মাধ্যমে অতি-শোষণের জন্য ভারতের বাজারে ও সীমা-বিবাদে চীনের সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের আচরণের বিরোধিতা করতে হবে। চীনের শেনঝেন প্রদেশে আমেরিকার অ্যাপল আই-ফোনের যে অ্যাসেম্বলি-লাইন ম্যানুফেকচারিং হয়ে বাজারজাত হতো, তাতে অ্যাপল মুনাফা করত ২৭%, আর চিনের মুনাফা ছিল ৩%। চিনের সেই মুনাফা বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল একমাত্র চীনা শ্রমিকদের শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে। কিন্তু চীন ইতিমধ্যে সরকারিকরণের মাধ্যমে তার অভ্যন্তরীণ বাজার বৃদ্ধি করার ও মধ্যশ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশীয় অর্থনীতি বিকাশে মনোযোগ দিয়েছে। অ্যাপলের ভারতীয় বাজার দখলের নীতির অঙ্গ হিসাবে চিন ভারতে সেই কারখানা স্থানান্তরিত করার পলিসি নিয়েছে যাতে ভারতীয় সস্তা শ্রমের মাধ্যমে মুনাফা বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং ভারতীয় শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য চিনে স্থানান্তরিত করতে পারে – শ্রম-লুণ্ঠনের এই চীনা নীতিকে বিরোধিতা করতে হবে। কিন্তু চীন কী সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত হয়েছে? লেনিনীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে বহুবিধ প্যারামিটারের তূলনামূলক বিচার করে সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে চীন বিশেষজ্ঞ মিঙ্কি লি দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন দেশের শ্রম ও সম্পদ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে চীন সাম্রাজ্যবাদের মতো আচরণ করলেও এখনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয়ে ওঠেনি। সে ব্যাপারে আরও গভীর অনুসন্ধান জরুরি, কারণ এই প্রশ্নের মীমাংসা চলমান শ্রেণিসংগ্রামকে প্রভাবিত করবে।

 

সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির যোগসূত্রে ভারতের বর্তমান বিষয়ীগত পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ ও বিপ্লবী বিকল্প বিরাজ করছে। কিন্তু বিষয়গতভাবে বিপ্লবী শক্তির দুর্বল উপস্থিতিতে, জনগণের কাছে নির্বাচনী লড়াইয়ে ইন্ডিয়া জোটকে ক্ষমতায় বসানো প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্যাসিবাদের কোনও বুর্জোয়া বিকল্পের সম্ভাবনা দেখা না দেওয়ার পরিস্থিতিতে, যদি ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতও হয়, সেক্ষেত্রেও জনগণ নতুন সরকারের কাজকর্ম কিছুদিন দেখতে চাইবে। সেই স্থিতাবস্থার পরিস্থিতিতে ফ্যাসিস্ট শক্তি পুনরায় নতুন শক্তি সঞ্চয় করে ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নেবে। আর যদি কোনও বুর্জোয়া বিকল্প দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিপ্লবের কর্মসূচি স্থগিত হয়ে যাবে। সুতরাং আজকের নির্দ্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শ্রমিক-কৃষক অক্ষশক্তির জন্য বিপ্লবী অনুশীলনের গর্ভে বাম-বিপ্লবীদের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা প্রধান কর্মসূচি হিসাবে হাজির হয়েছে। আজকের সময়ে বাম-বিপ্লবী শ্রেণিসংগ্রামের ও শ্রেণিশক্তির দ্রুত বিকাশই ভবিষ্যত নতুন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ও সমাজবাদী গঠন-প্রক্রিয়ার গ্যারান্টি – অন্যথায় বাম-বিপ্লবী রাজনীতির আরেকদফা দীর্ঘকালীন সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না এবং তাতেও পিছু হঠার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেওয়া যায় না। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয়কেও দেখতে হবে দ্রুত শ্রেণিসংগ্রাম বিকশিত করা ও বাম-বিপ্লবী শক্তির উত্থানের শর্তের অধীন হিসাবে। সামাজিক আন্দোলনের বিকাশ ও ঐক্য, শ্রেণিসমূহের সংগ্রামী বিকাশ ও ঐক্য ও বিপ্লবী শক্তির ঐক্য – এই তিনটি হচ্ছে বাম-বিপ্লবীদের কর্তব্যের প্রধান দিক। তবে শুধুমাত্র কর্মসূচি ও ঘোষণ দিয়েই বাম-বিপ্লবী পরিচিতি নির্ধারণ হয় না – রাজনৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বিচার্য বিষয়।

 

(লেখক অসমের বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী। মতামত লেখকের নিজস্ব।)

 

Share this
Leave a Comment