মণিপুর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বামপন্থা


  • July 29, 2023
  • (0 Comments)
  • 1518 Views

“উনিশশো আশির দশক থেকে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতিতে পুঁজি ও শ্রমের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার পথ ধরে এক নতুন জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়। সামাজিক ও জনগোষ্ঠীগত ভারসাম্য ভেঙে সংঘাত ও হিংসা এবং প্রতিযোগিতামূলক অমানবিক জাতি-ঘৃণার জন্য পরিস্থিতি পরিপক্ক হতে থাকে। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী লুক ইস্ট যা বর্তমানে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি তার রূপায়ণে জনজাতীয়দের জমি দখল, উচ্ছেদ, আধিপত্যাধীন স্থিতিস্থাপক ভূখণ্ডগত সামাজিক ক্যানভাসের আমূল চেহারা বদল, সভ্যতা ও গণতন্ত্রের মানদণ্ডকে ধূলিস্যাৎ করে নাগরিকত্ব ও প্রব্রজনের বিষয়কে কেন্দ্র করে জনগোষ্ঠীগত পৃথকীকরণ, ধর্ম-সংস্কৃতির পুনরুত্থানের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো এবং সর্বোপরি সমস্ত বাণিজ্য পথে বিশেষ করে মায়ানমার, যে দেশটি উত্তর-পুবের তিনটি রাজ্যের গুরুত্ত্বপূর্ণ সীমান্ত দেশ, তাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী ভূ-রাজনীতি ইত্যাদি উপাদান বিস্ফোরণের জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে।” বর্তমান মণিপুরের জাতিদাঙ্গার উৎসের সন্ধান করলেন অরূপ বৈশ্য

 

 

মণিপুরের জাতিদাঙ্গার বীভৎসতা দেখে সমগ্র বিশ্ব বিস্মিত। ভারত ভূখণ্ড তো বলকান ভূমি নয়। কী হল ভারতবর্ষের দীর্ঘ স্বাধীনতা-উত্তর সংসদীয় গণতন্ত্রের – কী হল নির্দিষ্ট ভারতীয় সভ্যতার গণতান্ত্রিক গরিমা কিংবা বসুধৈব কুটুম্বকমের হিন্দুয়ানি গৌরবগাথার? মাত্র চার দশক আগে “আসাম আন্দোলন” নামে বৃহত্তম ছাত্র আন্দোলন সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং এভাবেই সচেতন প্রগতিশীল বিশ্ব বিস্মিত হয়েছিল তার করুণ পরিণতি দেখে। বিস্ময়ই সৃষ্টির আঁতুড়ঘর। কিন্তু সেই বিস্ময় উত্তর-পুর্বে জন্ম দিল না কোনও সৃষ্টিশীল সমাজ-রাজনীতির, সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটল বীভৎসতার আতঙ্কে। আসলে আত্মগরিমা যখন বাঁধা পড়ে নির্দিষ্ট সংকীর্ণ ভূখণ্ড ও জাতির সীমানায়, তখন মানব সভ্যতার ইতিহাস বিস্মৃত হওয়া স্বাভাবিক। গুহাবাসী আদিম মানব সভ্যতা গড়ে তোলার দিকে যাত্রা করেছিল সীমানাহীন ভূখণ্ডের বুক চিরে প্রব্রজিত হয়ে, তারপর আটকা পড়েছে ভূখণ্ডের সীমানায় বিভিন্ন পরিচয়ে। সেই থেকে মানুষের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়েছে সেই ভূখণ্ডের নির্দিষ্ট সম্পত্তির সম্পর্ক – মালিকানার সম্পর্ক। সেজন্যই বলা হয়, মানব সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস, আর প্রাগৈতিহাস শ্রেণিহীন শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। আদিম মানব যেমনি সভ্যতার দিকে যাত্রা করেছিল সীমানাহীন বাধহীন প্রব্রজনের মাধ্যমে, সভ্যতার অভ্যন্তরে যে সংঘাত তারও সমাপ্তি নিহিত শ্রম ও শ্রমিকের সীমানাহীন মুক্ত প্রব্রজনের পরিবেশের গর্ভে। সে এক দীর্ঘ যাত্রা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বেঁধে ফেলা হয়ছে আষ্টেপৃষ্ঠে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বুঝতে হলে সেই বন্দিত্বকে বুঝতে হবে। এই বন্দিত্ব যে উত্তর-পুবের বিভিন্ন স্তরে বিকশিত জনগোষ্ঠীয় রঙিন ক্যানভাস তৈরি করেছে তার অভ্যন্তরিণ ডায়নামিক্সের ভেতর থেকে গণতান্ত্রিক সমাধানের আত্মশক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। বুঝে নিতে হবে সমকালীন সমাজ-রাজনীতিকে যে সমকালের মধ্যেই ইতিহাস কথা বলে।

 

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগোষ্ঠীগত বন্দিদশার উদ্ভব হয়েছে দু’টি পরস্পর বিপরীত প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা ও তার রূপায়ণের ঐক্যের গর্ভে। এই বৈপরীত্যের ঐক্যের একদিকে রয়েছে ইউরোপীয় আধুনিকতা ও আধুনিক নির্মাণ এবং বিপরীতে রয়েছে আদি বা ইন্ডিজেনাস ধর্ম ও সংস্কৃতি ও সেই সংস্কৃতির ধারণায় পরিচিতির নির্মাণ। এই দু’টি ধারণা ও নির্মাণ-প্রক্রিয়ার মধ্যে সাধারণ মিলের জায়গা হচ্ছে – পরিচিতির রাজনীতির ভূখণ্ডগত যোগসূত্র। ভূখণ্ডের স্থানিক মাত্রা দিয়ে নির্ধারিত পরিচিতির নির্মাণ প্রদান করেছে উভয় প্রক্রিয়ার স্থাণু বৈশিষ্ট্য। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উভয়ের যাত্রা শুরু মূলত ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে। ব্রিটিশ শাসনের সম্পদ লুণ্ঠনের অনুসারী পরিকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক বন্দোবস্তের সাথে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা ও খ্রিষ্ট ধর্ম-সংস্কৃতি পরিচিতির ভূখণ্ডগত ক্ষমতা ও মালিকানার স্পৃহাকে মদত জুগিয়েছে। অনেকগুলো প্রদেশে অসমের বিভাজন, নাগালিমের দাবি থেকে সাম্প্রতিক বড়োল্যান্ডের আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি অঙ্কুরিত হয়েছে এই পথ বেয়েই এবং স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে উন্নয়নের এই ‘আধুনিক’ পথে কোনও ছেদ না পড়ায় তা মহীরূহের আকার ধারণ করেছে। বিপরীতে যাহা আদি, প্রাকৃতিক ও স্থানিক ধর্ম-সংস্কৃতি তাহাই মূল পরিচিতি ও সেখানেই ভারতীয় সনাতন ধারণার সাথে তার যোগসূত্র এবং সেই সূত্র ধরেই হিন্দুত্বে আত্মসমর্পণ কারণ হিন্দুত্ব মানে ভারতীয় প্রাচীন ধর্ম-সংস্কৃতি। সাভারকরের হিন্দুত্বের ধারণায় উত্তর-পূবের ইণ্ডিজেনাস বা আদি সংস্কৃতির স্থানিক ধারণা অনায়াসে সামিল হয়ে যেতে পারে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আরুণাচল ও অসমের এক আদি দেবতা ও ধর্ম হচ্ছে রাঙফ্রা। এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরনের জন্য গড়ে উঠেছে রাঙফ্রা ফেইথ প্রোমোশন সোসাইটি – এই দেবতা নাকি হিন্দু দেবতা শিবের অনুরূপ। উত্তর-পুবের এরকম অসংখ্য আদি-দেবতা ও ধর্মের পুনরুত্থান ঘটছে যার বিবরণ পাওয়া যায় আরএসএস ও আরএসএসের মদতপুষ্ট ম্যাগাজিনগুলিতে এবং সেগুলির অসংখ্য বিস্তৃত পাঠককুলও রয়েছে। যে সব জনগোষ্ঠী সেমিটিক ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়নি এবং আদি জনজাতি ধর্ম-সংস্কৃতির সাথে যোগসূত্র বজায় রেখে ও তাকে ব্যবহার করে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম করেছে, ভারতীয় হিন্দুত্বের সাথে যুক্ত করতে তাদের আইকনদেরও ব্যবহার করছে আরএসএস। উদাহরণস্বরূপ হাইপো জাদোনাং-এর নেতৃত্বে যে ব্রিটিশ বিরোধী নাগা-রাজ গঠনের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা-উত্তর দেশগঠনের আধুনিকতাবাদের বিরুদ্ধে রানি গাইদোলুঙের নেতৃত্বে যে জেলিয়ানরং হোমল্যাণ্ডের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাকে স্থানিক আদি ধর্ম-সংস্কৃতির যোগসূত্রে ব্রিটিশ শাসন তথা ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ধর্ম-সংস্কৃতি ও আধুনিকতার প্রভাব থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিদ্রোহ হিসাবে দেখিয়ে গাইদোলুঙের মত আইকনরা হয়ে উঠলেন হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদের আইকন। জনজাতীয়দের স্থানিক আদি ধর্ম-সংস্কৃতির মাতৃভূ হয়ে উঠল হিন্দুত্বের ভারতীয় মাতৃভূ, জনজাতীয় আদি-পিতা যোগসূত্র খুঁজে পেল হিন্দুত্বের আদি-পিতা রামের সাথে। আধুনিকতা ও বিদেশি-ধর্মের বিরোধিতার নামে আসলে আদি ধর্ম-সংস্কৃতির রিভাইভেলের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের লজিককেই আত্মস্থ করা হল, বাদ পড়ল ইউরোপীয় রেনেসাঁর যুক্তিবাদ। এই রিভাইভেলিজমের টান এতোই প্রবল যে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত জনজাতীয়দের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ‘খ্রিষ্টান-হিন্দু’ এই ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদী ভারত নির্মাণের অংশীদার হয়ে উঠল। এই রিভাইভেলিজমের টান কেন এতো প্রবল তার কারণ নিহিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামাজিক উৎপাদনী সম্পর্কের বা আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে।

 

প্রথম প্রক্রিয়ায় আধুনিকতা যেমনি স্থানিক সাংস্কৃতিক অপরকে খুঁজে পেল, দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের মতো ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতিকে অপর হিসাবে খুঁজে পেল। এই দু’য়ের ঐক্যের সমাজ-রাজনীতি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভয়ঙ্কর সংঘাতপূর্ণ বিদ্বেষ ও হিংসার পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। একটি বিকল্প সমান্তরাল ধারা অনেক আশা ও সম্ভাবনা জাগিয়ে উত্তর-পুবের সমাজ-রাজনীতিতে বেড়ে উঠছিল যে ধারাকে আমরা বলতে পারি বামপন্থী বা মার্কসবাদী ধারা। কিন্তু এই বিকল্প ধারাটিও এই দু’য়ের টানাপড়েনে ও দ্বন্দ্বে যান্ত্রিক স্থবিরতার বশবর্তী হয়ে পক্ষ অবলম্বন করতে গিয়ে গ্রহণযোগ্যতা হারাল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমাজ-রাজনীতিতে এই তিনটি প্রক্রিয়ার ঘাত-প্রতিঘাত ও পরিণতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা হয়েছে এই নিবন্ধে যাতে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নতুন পথ খুঁজে নেওয়া যায়।

 

শুরুতেই বাম ও বিপ্লবী বা মার্ক্সবাদী প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাধারণ কিছু কথা বলে নেওয়া সমীচীন হবে। বিমূর্ত ধারনা থেকে নির্দিষ্ট উদাহরণে যাওয়াই মার্কসবাদী পথ বলে আমার মনে হয়। বামপন্থীরা স্বাধীনতা-উত্তর আধুনিক উন্নয়নের ইউরোপীয় ধারণার বিরুদ্ধে কোনও তাত্ত্বিক প্রতিরোধ গড়ে তলেননি। তাদের কাছে শ্রেণির এক পূর্বনির্ধারিত সংজ্ঞাই ছিল আধুনিক নির্মাণের শ্রেণি প্রতিরোধের পথ। সেই পথ ধরে তারা বিভ্রান্ত হলেন যখন পুঁজি ও শ্রমের নিওলিবারেল পুনর্গঠন শ্রমিকের চরিত্র বদলে দিল, তারা আত্মসমর্পণ করলেন নিওলিবারেলিজমের কাছে – তাদের জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার যাত্রা শুরু সেই উনিশশো আশির দশক থেকে। বিপরীতে নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহের গর্ভ থেকে যে বিপ্লবী ধারার জন্ম হল, সেই ধারার নেতৃস্থানীয়রা মার্ক্সবাদী শ্রেণি-রাজনীতির পথ পরিহার করলেন না, তাদের বিপ্লবী আন্তরিকতা এই চিন্তারও উদ্রেক করেছিল যে বাম ও বিপ্লবী উভয় পক্ষই কেন ক্রমাগত পিছু হঠছে। কিন্তু এই বিপ্লবী নেতৃত্বের পরবর্তী প্রজন্ম যাদের মধ্যে নকশালবাড়ির আবেগ ছিল খুবই দুর্বল, তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আশ্রয় নিলেন শ্রেণি-সমঝোতায় কিংবা কালচারেলিজমে যাতে আরএসএস প্রজেক্ট থেকে মতাদর্শগতভাবে দূরত্ব বজায় রাখার মানসিক বাসনা থাকলেও, বস্তুগতভাবে আরএসএস একে ব্যবহারই করেছে। হিন্দুত্ব ও ইন্ডিজেনাইজেশনের সংশ্লেষের যে পথ আরএসএস নিয়েছে (তাতে আন্তর্জাতিক ইন্ডিজেনাস সংজ্ঞাও সামিল), ধর্ম-সংস্কৃতির পুনরুত্থানের সেই পথে ভাষার আধুনিক সাধারণিকরণের প্রগতিশীল বিকাশও বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হারিয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীয় ভাষার পুনরুত্থানেরও প্রশ্নও অনুষঙ্গ হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে। বিপ্লবী বামেদের একাংশ সেখানে নিপীড়ন-বিরোধিতার লজিক খুঁজতে চেয়েছেন। ইউরোপীয় আধুনিকতার ধারণায় যেখানে শাসনের কেন্দ্রীকতার জন্ম দেয়, কালচারেলিজমের গর্ভে সেই বিপ্লবীরা ভেবে বসলেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষার অধিকারের সংগ্রাম বিকেন্দ্রীকরণের সংগ্রাম, সুতরাং নিজের অজান্তেই হিন্দু ধর্মীয় হেতুবাদের লজিকে তাকে গণতন্ত্রের সংগ্রাম হিসাবে গণ্য করতে শুরু করলেন। তারা সেটা অনুধাবন করতে চাইলেন না, যে আধুনিকতা প্রতিক্রিয়াশীল অসম আন্দোলন, বড়োল্যান্ড আন্দোলনের জন্ম দেয়, নাগালিম গঠনের পক্ষে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলতে বাধ্য করে, বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষেত্রে সেই আধুনিকতার এক গণতান্ত্রিক অন্তর্বস্তুও রয়েছে। আধুনিক গণতন্ত্র অসমিয়া ভাষাকে লিঙ্ক ল্যাঙ্গুয়েজ বা লিঙ্গুয়াফ্র্যাঙ্কা হিসাবে গড়ে তুলতে পারত, একে অপরের ভাষা বুঝতে অক্ষম বিভিন্ন নাগা কৌমের মধ্যে নাগামিজ ভাষা সভ্যতার দিকে গণতান্ত্রিক অগ্রগতি হয়ে উঠতে পারত। আধুনিকতার ও আদিমতার ধ্বংসাত্মক ঐক্য যা আমরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দেখছি, তারই কাছে আপাত ও সাময়িক পরাভূত হল দিশাহীন বাম ও বিপ্লবী বিকল্প – পরাভূত হল দুই বিপরীত দিক থেকে।

 

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনকে নতুন সামাজিক নির্মাণের দিকে পরিচালিত করার ব্যর্থতা যেমনি নয়া-উদারবাদে আত্মসমর্পনের কারণে ঘটল, ঠিক তেমনি সংস্কৃতি ও পরিচিতির স্থানিক বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে মার্ক্সবাদী ও শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টভঙ্গী হারিয়ে গেল। সুতরাং বিকল্প প্রগতিশীল বামপন্থী নির্মাণে আমাদের যে বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দিতে হবে তার মধ্যে অন্যতম – (১) উন্নয়নের বিকল্প পথ (২) জমির মালিকানা ও নাগরিকত্ব (৩) শাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ও সহাবস্থান এবং আত্মীকরণের আধুনিক দৃষ্টিকোণ। মানব সভ্যতার বিকাশের যে অন্যতম চাবিকাঠি সেই প্রব্রজনকে অস্বীকার করে নাগরিকত্বের সংজ্ঞায় যে আদি – আদি নয়, খিলঞ্জিয়া–অখিলঞ্জিয়া, আগে ও পরে আসার ভিত্তিতে ভূখণ্ডের মালিকানার ধারণার সংযোজন ঘটছে তাকে নাকচ করে স্বাধীন ভারতের ঊষালগ্নে ভারতের স্থায়ী বাসিন্দারাই ভারতের নাগরিক — এই যে ধারণা তৈরি করা হয়েছিল তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। সংস্কতি সম্পর্কে মার্ক্সবাদী ধারণাকে আবারও চর্চায় আনতে হবে। ইপি থম্পসনের সংজ্ঞাকে ব্যবহার করে সংস্কৃতি সম্পর্কে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গীকে এভাবে বলা যায় – সংস্কৃতি হচ্ছে সংস্কৃতি ও যা কিছু সংস্কৃতি নয় এই দু’য়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের গতি — এই গতির মধ্যেই সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল।

 

এবার আসা যাক মণিপুর প্রসঙ্গে। মণিপুর অশান্ত হয়ে ওঠার শুরুতে তথ্যভিজ্ঞ মহল মণিপুরের জনবিন্যাস ও মৈতৈদের এসটি স্বীকৃতির দাবিকে মূল কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন। সেটা যে শুধুমাত্র ‘ট্রিগার-এফেক্ট’ ছিল সেকথা বুঝতে সময় লাগেনি। মণিপুরের উপত্যকায় মোট জনসংখ্যার ৫৩% মৈতৈরা মাত্র ১০% জমিতে বাস করে, আর চারপাশের ৯০% পাহাড়ি জমিতে বাস করে জনজাতীয়রা। প্রায় একই চিত্র ত্রিপুরাতেও। ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার ৭০% বাঙালি বাস করে মোট জমির ৩০% এলাকায়, আর ৩০% জনজাতীয়রা বাস করে মোট জমির ৭০% এলাকায়। পাহাড়ি অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম হওয়াই স্বাভাবিক। উত্তর-পূবের জনজাতীয়দের হিন্দু-ভারতীয় পরিচিতির অঙ্গ করে তোলার আরএসএসের প্রকল্পে অভিবাসী বিরোধী প্রচারও যুক্ত রয়েছে — বাঙালি মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণাত্মক, কিন্তু বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রে (মূলত তপসিলিভুক্ত দলিত হিন্দু) পরোক্ষে কৌশলে — যাতে হিন্দু হিসাবে উভয় পক্ষকে ম্যানেজ করা যায়। সেই প্রচার মূলত পরিচিতি হারানোর কাল্পনিক শঙ্কা ও ঘৃণার রাজনৈতিক নির্মাণ। মণিপুরের শাসন ব্যবস্থায় মৈতৈদের আধিপত্য এবং ত্রিপুরায় বাঙালি আধিপত্য বজায় থাকলেও, ত্রিপুরার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের গঠনমূলক হস্তক্ষেপের একটা পর্যায় ছিল। মণিপুরের জনজাতীয় এলাকায় পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলের কোনও প্রয়োগ নেই, রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত আইনের অধীনে জনজাতীয়রা জমির বিশেষ অধিকার ভোগ করলেও এই আইন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের শর্ত পূরণ করে না। তথাপি রাজ্যস্তরের প্রশাসনিক এই ব্যবস্থা উপত্যকা ও পাহাড়ের মধ্যে ব্যাপক জনগোষ্ঠীগত তিক্ততা, ঘৃণা ও সংঘর্ষের পরস্থিতি তৈরি করেনি। তার কারণ মণিপুর উপত্যকায় মৈতৈদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য সুরক্ষিত ছিল— সমতলের উর্বর কৃষিভূমি ও পাহাড়ের রাজস্ব আর্থিক কর্মকাণ্ডে সরকারি ব্যয়ের জন্য কোষাগার আপাত সুরক্ষিত ছিল, দিল্লির কেন্দ্রীভূত শাসনের প্রতি অনীহা ও বিরোধের দীর্ঘদিনের ইতিহাস মৈতৈ মনোজগতে প্রচ্ছন্ন ছিল এবং ঐতিহ্যবাহী শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে জনজাতীয়দের চেয়ে উন্নত জাতি হিসাবে এক আত্মগরিমাও ছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার বিন্যাসের ক্ষেত্রে আধিপত্যের আপাত স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রশ্নে এই তিনটি কারণই ক্রিয়াশীল ছিল। বিগত কয়েক দশকে সবগুলো ক্ষেত্রেই এই ভারসাম্য ভেঙে পড়ে, কিন্তু আর্থিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন কোন গণতান্ত্রিক বিকল্পের অভাবে প্রতিক্রিয়াশীল সংঘাত ও বিদ্বেষ সামাজিক পরিবেশকে গ্রাস করে ফেলে। আফস্পা বাতিল ও কেন্দ্রীয় সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে মৈতৈ সমাজকর্মীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও, নব্য স্বচ্ছল ও শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি বাজারের কনজিউমারিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমজীবীদের প্রতি মধ্যশ্রেণির যে দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া জরুরি সেই রাজনীতি একেবারেই অনুপস্থিত থেকে যায়।

 

১৮৯১ সালে ব্রিটিশ ভারতের কাছে মণিপুর তার স্বাধীনতা হারায়। তার পরবর্তীতে উত্তর-পুবের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-প্রশাসনিক পরিসীমা দীর্ঘ সময় ধরে বার বার পুনর্গঠন ও পুনর্নির্ধারণের মধ্য দিয়ে যায়। অবশেষে ১৯৭২ সালে পৃথক রাজ্য হিসাবে মণিপুর স্বীকৃতি লাভ করে। পৃথক ভূখণ্ডগত রাজ্যের আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয় ভারতরাষ্ট্রের উপর থেকে পরিকল্পিত বিকাশের আধুনিক গঠনপ্রক্রিয়ার গর্ভে এবং ক্ষুদ্র-জাতীয়তাবাদের সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তব সমাধানও করা হয় ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসাবে। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র ও গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে। ফলে দিল্লির কেন্দ্রীভূত শাসনের উপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে। এটাই হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতীয়তার উগ্রজাতীয়তাবাদী ভিত। উনিশশো আশির দশক থেকে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতিতে পুঁজি ও শ্রমের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার পথ ধরে এক নতুন জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়। সামাজিক ও জনগোষ্ঠীগত ভারসাম্য ভেঙে সংঘাত ও হিংসা এবং প্রতিযোগিতামূলক অমানবিক জাতি-ঘৃণার জন্য পরিস্থিতি পরিপক্ক হতে থাকে। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী লুক ইস্ট যা বর্তমানে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি তার রূপায়ণে জনজাতীয়দের জমি দখল, উচ্ছেদ, আধিপত্যাধীন স্থিতিস্থাপক ভূখণ্ডগত সামাজিক ক্যানভাসের আমূল চেহারা বদল, সভ্যতা ও গণতন্ত্রের মানদণ্ডকে ধূলিস্যাৎ করে নাগরিকত্ব ও প্রব্রজনের বিষয়কে কেন্দ্র করে জনগোষ্ঠীগত পৃথকীকরণ, ধর্ম-সংস্কৃতির পুনরুত্থানের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো এবং সর্বোপরি সমস্ত বাণিজ্য পথে বিশেষ করে মায়ানমার, যে দেশটি উত্তর-পুবের তিনটি রাজ্যের গুরুত্ত্বপূর্ণ সীমান্ত দেশ, তাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী ভূ-রাজনীতি ইত্যাদি উপাদান বিস্ফোরণের জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে।

 

উত্তর-পুবের রাজ্যগুলির প্রায় সবক’টার সমতল ভূমি চাষের জন্য উর্বর – মণিপুরের সমতলের কৃষি ভূমি অত্যন্ত উর্বর, পাহাড়ে রয়েছে জৈব বৈচিত্র্য, রয়েছে হস্তশিল্পের ভাণ্ডার। স্বকীয় আধুনিক পুঁজিবাদী বিকাশের পথ রুদ্ধ করে ‘বিকৃত পুঁজিবাদী’ বিকাশ ও কেন্দ্রীভূত শাসনের নিয়ন্ত্রণ ভারতীয়ত্ব গড়ে তোলার পথ হিসাবে বেছে নিল স্বাধীনতা-উত্তর ভারত। দিল্লির শাসনের সাথে ক্লায়েন্ট-পেট্রন সম্পর্কের মধ্যে কিছুটা আঞ্চলিক দরকষাকষির ক্ষমতার পরিসর বজায় ছিল। উনিশ আশির দশক থেকে নিওলিবারেল পুনর্গঠন ও ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীভবন আঞ্চলিক ক্ষমতার অস্তিত্বকে নিঃশেষ করে দেওয়ার পথে হাঁটল। বিজেপি সরকার সেই নীতি দ্রুত কার্যকরী করে ও সঙ্ঘের সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে দখলে নিয়ে নেয়। কুকি, নাগা সবাইকে সামিল করেই মণিপুরের বিজেপি সরকার গঠিত হয়। ক্লায়েন্ট হিসাবে সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে নব্য ধনী মধ্যশ্রেণি গড়ে উঠেছে, তাদেরকে বিজেপি ক্যাম্পে সামিল করার রণনীতি নিয়েছে বিজেপি। অন্যদিকে নব্য মধ্যশ্রেণি, কৃষি বিপর্যয়ে উদ্বৃত্ত শ্রম এবং শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ প্রব্রজন উদ্ভূত পরিস্থিতিকে একদিকে কনজিউমারিজমের মতাদর্শে, অন্যদিকে জমি বিবাদে রূপ দিতে পেরেছে বিজেপি সরকার। দেশি বিদেশি পুঁজির জন্য জমি দখলের সরকারি অভিযানকে শাসক জনগোষ্ঠীর সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ও তাদের ক্লায়েন্ট রাজ্য সরকার। দ্য ওয়্যারের এক প্রতিবেদনে মণিপুরের সংঘর্ষের শুরুয়াতি পর্যায়ে পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত মৈতৈ বাহিনী কুকি-প্রধান অঞ্চল দখলে অভিযান চালানোর এবং এলাকা দখলের পর কুকি মিলিট্যান্টদের অতর্কিত চোরাগোপ্তা হামলায় পর্যুদস্ত হওয়ার খবর বেরিয়েছে। এতে স্পষ্ট যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দেশি বিদেশি পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রীয় মদতে যে জমি দখলের প্যাটার্ন গড়ে উঠেছে তার বর্বরতম নজির হচ্ছে মণিপুরের ঘটনা। জমি দখল করে প্রথমে স্থানীয় এজেন্টদের হাতে তুলে দেওয়া এবং তাদের মাধ্যমে পুঁজিপতিদের হাতে জমি হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় স্থানীয় এজেন্টদের কমিশন সুনিশ্চিত করা—সেই ক্লায়েন্ট শ্রেণি বিজেপির রাজনৈতিক শক্তি—আর মৈতৈ জঙ্গিরা ব্যবহৃত হল সরকারি পরিকল্পনা ও সরকারি বাহিনীর মদতদাতা প্রাইভেট আর্মি হিসাবে। তবে মায়ানমারের সীমানায় ভারতীয় রাজ্যগুলিতে অস্ত্র সরবরাহ এবং জঙ্গি গোষ্ঠীর উপস্থিতির পেছনে সাম্রাজ্যবাদী মদতও রয়েছে, মায়ানমারের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে রয়েছে চিনের শক্তিশালী উপস্থিতি।

 

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল পরিণতির কী কোনও বিকল্প প্রগতিশীল পথ ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগোষ্ঠীগুলোর অনগ্রসরতার মধ্যেই বাম রাজনীতির প্রতি এক সুপ্ত আকর্ষণ সব সময়ই প্রচ্ছন্ন ছিল। নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহের যে বাম-বিপ্লবী ধারার জন্ম হয়েছিল সেই ধারায় উত্তর-পুবের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আকৃষ্ট হয়েছিল, মৈতৈদের মধ্যে সেই ধারার উপস্থিতি একেবারে নগণ্য ছিল না। তবে বিকল্প বামপন্থী নির্মাণের ও প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ত্রিপুরা রাজ্য। উনিশশো চল্লিশের দশক থেকে জনজাতীয় সশস্ত্র সংগ্রামে কম্যুনিস্টদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ সালে গঠিত ‘ত্রিপুরা জাতীয় মুক্তি পরিষদের’ আন্দোলনের মাধ্যমে ত্রিপুরায় বাম রাজনীতি মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, দশরথ দেববর্মার মতো জনজাতীয় নেতারা বাম রাজনীতির নেতৃত্বের স্তরে উঠে আসছিলেন। বাঙালি ও জনজাতীয় নেতা-কর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিক্ষা-আন্দোলনের মতো বহু সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ত্রিপুরায় দেশভাগ জনিত ও বাংলাদেশ গঠনের পর্যায়ের বাঙালি প্রব্রজন যে জনগোষ্ঠীগত ভারসাম্যের সমস্যা তৈরি করেছিল শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টিতে তার গণতান্ত্রিক সমাধানের এক প্রয়াস ছিল। ত্রিপুরার ৩০% সমতলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি রাজ্যের শাসন-কেন্দ্রের নৈকট্য ও শাসনে স্বাভাবিক একপক্ষীয় বাঙালি প্রভাবকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে পাহাড়ে জনজাতীয়দের ক্ষমতায়নের নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল। পাহাড়ের পাদদেশে যে তফসিলি শ্রমজীবী বাঙালিদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল, তাতেও জনজাতি-বাঙালি শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে জনগোষ্ঠীয় বৈরিতার রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম ছিল। ষাট-সত্তর দশকে ‘রিফিউজি সমস্যাকে’ হাতিয়ার করে কংগ্রেস-টিইউজেএসের মধ্যবিত্ত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে প্রতিহত করে ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে, কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালের ‘মান্দাই হত্যাকাণ্ড’ হিসাবে কুখ্যাত সংঘাতে প্রায় ৩৫০ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই বামফ্রন্ট ধীরে ধীরে নিওলিবারেল উন্নয়ন মডেলকে গ্রহণ করতে শুরু করে এবং তার অনুষঙ্গ হিসাবে শ্রেণি-সমঝোতার লাইনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে বাঙালি-জনজাতির মধ্যেকার প্রগতিশীল কোর হিসাবে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যের যে অক্ষ চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের মধ্যে বিকশিত হচ্ছিল তা ভেঙে পড়ে। পরবর্তীতে বামফ্রন্ট সরকারের এমনকি জাপানি পুঁজির মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নের পথ অনুসরণের ফলে সমগ্র জনজাতীয় কৃষি অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়ে। সেই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যহীন অস্থির পরিস্থিতিতে দু’টি বিপরীতমুখী শক্তির গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। একদিকে নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ থেকে উদ্ভূত নতুন বাম-বিপ্লবী রাজনীতি, বিপরীতে সঙ্ঘ পরিবারের চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী রাজনীতি। কিন্তু প্রথম ধারার ঝোঁক ছিল কৃষি বিপ্লবের দিকে এবং তার উপর নির্ভর করে জনজাতীয় ও জনগোষ্ঠীগত অধিকারের বিষয়কে সমগ্র বাম-রাজনীতির ভরকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার উপর। সত্তর ও আশির দশক থেকেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব জনগোষ্ঠীর মধ্যেই যে নতুন শ্রেণিবিন্যাস গড়ে উঠছিল তা দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেল। সামগ্রিকভাবে উৎপাদন ব্যবস্থায় এক নতুন শ্রমিকশ্রেণির আবির্ভাব ঘটছিল যার গঠন ইউরোপের শিল্পায়নের যুগের শ্রমিকের গঠন থেকে আলাদা এবং জন্ম হল বিত্ত-পুঁজির সাথে গাঁটছড়া বাঁধা এক নতুন মধ্যশ্রেণির যারা চরিত্রগতভাবে শিল্পায়নের সাথে যুক্ত মধ্যশ্রেণি থেকে আলাদা ও চূড়ান্ত ভোগবাদী। মণিপুরের সমতল উপত্যকায় যেমনি ধনী ও প্রভাবশালী জনজাতীয়দের বাস চোখে পড়ে, ঠিক তেমনি ত্রিপুরার সমতলেও সেরকম জনজাতীয় উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। মণিপুরের এবারের দাঙ্গায় সেই চেহারা পাল্টে দিয়েছে, তাই কুকিল্যান্ড বা জো-ল্যান্ডের দাবি জোরদার হয়েছে অর্থাৎ জনগোষ্ঠীগত সহাবস্থান ও মিলনের গণতান্ত্রিক পথ যখন সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়, তখন পৃথক ল্যান্ডের দাবি জোরদার হয়। মধবিত্তের ভোগবাদী মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারত একমাত্র সেই বাম-রাজনীতি যা শ্রমিকশ্রেণির জাগরণ ও মতাদর্শকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রে স্থাপন করেছে, বিচ্ছিন্নতার বদলে গণতান্ত্রিক আত্মীকরণকেই মূল ধারা হিসাবে বিকশিত করেছে।

 

কিন্তু বাম রাজনীতিতে সেরকম কিছু ঘটল না, আর তার সম্পূর্ণ সুযোগ নিল সঙ্ঘ পরিবার। জমির প্রশ্নকে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির চাহিদার সাথে যুক্ত করা, জনজাতীয় ধর্ম-সংস্কৃতিকে হিন্দুত্বের ভারতীয়ত্বের সাথে যুক্ত করা এবং নাগরিকত্বের প্রশ্নকে প্রব্রজন বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে নাগরিক অধিকারকে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার এক নতুন রাজনৈতিক নির্মাণের মাধ্যমে সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে গ্রাস করে নিল — বামপন্থীরা হয়ে পড়ল অতি-প্রান্তিক শক্তি। মণিপুরের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা তার চূড়ান্ত সীমায় এসে পড়েছে, পিছু হটে ফ্যাসিস্ট কায়দা নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই, এবং সেটাই বিপরীতে বাম রাজনীতির পুনরুত্থানের সম্ভাবনাকেও দেখিয়ে দিচ্ছে — যদি বামপন্থীরা মন-মস্তিষ্ক খোলা রেখে শ্রমিকশ্রেণির দৃষ্টিতে বাস্তব পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করায় ও শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেন।

 

(লেখক অসমের বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী। মতামত লেখকের নিজস্ব।)

 

Share this
Leave a Comment