স্কটিশ চার্চ কলেজ : তথ্যচিত্র ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমোনি’-র প্রদর্শনী বন্ধ!  


  • July 16, 2023
  • (1 Comments)
  • 1135 Views

গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন : অনিমেষ দত্ত

 

২০১১ সালে নন্দীগ্রামে দুই ছাত্রী আত্মহত্যা করেছিলেন, জানা যায় তারা একে অপরকে ভালোবাসতেন এবং তাদের পরিবার এই সম্পর্ককে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নেয়নি। এই প্রেক্ষাপটেই নির্মিত দেবলীনা মজুমদারের তথ্যচিত্র “এবং বেওয়ারিশ”। কেন এই ছবির কথা উল্লেখ করছি? এই ছবির একটি অংশে গ্রামের এক  ব্যক্তি বলেছিলেন ‘এসব’ তোমাদের শহরে হয়, গ্রামে হয় না। তার প্রত্যুত্তরে আরেক ব্যক্তি বলেছিলেন, আমি যখন শহরে দাঁড়িয়ে ভাবি তখন মনে হয় ‘এসব’ বিদেশে হয়, আমাদের দেশে হয় না। আমি যখন গ্রামে দাঁড়িয়ে ভাবি, তখন মনে হয় ‘এসব’ শহরে হয়, গ্রামে হয় না। আর যখন আমার গ্রামে, আমার ঘরে হয়, তখন? এরকমই একটা বাস্তবতা আজকে তৈরি হয়েছে। আমরা যারা কলকাতা শহরে বসে ভাবছি, সমকামিতা সমকামী বিবাহ নিয়ে তৈরি একটি তথ্যচিত্র পিছিয়ে থাকা কোন রাজ্যে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখাতে বাধা দেওয়াটা ‘স্বাভাবিক’, কারণ সেখানে দক্ষিণপন্থী সংগঠন কিংবা ‘রিগ্রেসিভ’ চিন্তাধারা কাজ করছে। আর এই ঘটনা যদি খোদ আমাদের শহরের ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ঘটে? তাহলে আমরা কী বলব? বাস্তবে ঘটেছেও তাই।

 

গত ১১ জুলাই মঙ্গলবার ‘প্রাইড বিয়ন্ড প্রাইড মান্থ : ফ্রম ডাউট টু ডায়লগস’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে দেবলীনা মজুমদার পরিচালিত ছবি ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ দেখানোর আয়োজন করেছিল স্কটিশ চার্চ কলেজের জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট সেল ও সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট। ছবি দেখানোর পাশাপাশি একটি আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হত, যেখানে ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’ সংগঠনের পক্ষ থেকে যোগ দেওয়ার কথা ছিল মীনাক্ষি সান্যাল ও কোয়েল ঘোষের। গত এক মাস ধরেই প্রস্তুতি চলছিল এই অনুষ্ঠানটির। পলিটিকাল সায়েন্স, ইতিহাস, দর্শন বিভাগও এই অনুষ্ঠানের সহযোগী উদ্যোক্তা হিসেবে ছিল। সমাজমাধ্যমে প্রচারও হয়েছিল বেশ জোরেসোরেই। অনুষ্ঠানের দিন সকালবেলায় হঠাৎই জানা যায় কলেজের কিছু ছাত্রের আপত্তির কারণে অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে৷ এরপরই বেশকিছু সংবাদমাধ্যমে এই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। এত অবধি মোটামুটি সকলেরই জানা। কিন্তু এর বাইরেও ঘটনাটির অনেকগুলি স্তর আছে, যেগুলি আলোচনায় আসা প্রয়োজন। শুধু তথ্যানুসন্ধান নয়, বরং ঘটনার শিকড়ে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদন।

 

গত মার্চ মাসে ওড়িশার র‍্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেও বন্ধ করে দেওয়া হয় ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ ছবির প্রদর্শনী। সমলিঙ্গ বিবাহের পটভূমিকায় নির্মিত এই তথ্যচিত্রটির পাশাপাশি সন্ত কবিরের দৃষ্টিভঙ্গিতে রাম — এই পটভূমিতে নির্মিত শবনম ভিরমনির পরিচালনায় তথ্যচিত্র ‘হদ অনহদ’-ও একই ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। জানা যায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের শাখা সংগঠন এবিভিপির চাপে বন্ধ করা হয় ছবির প্রদর্শনী। আপত্তি উঠেছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘চারুলতা’ ছবির প্রদর্শনীতেও। শেষমেশ আলোচনার পর সত্যজিৎ রায়ের ছবি দু’টি দেখানো হলেও বাদ যায় ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ ও ‘হদ অনহদ’। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। খোদ র‍্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করে। প্রতিবাদ করতে বাদ যায়নি কলকাতাও। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়, হাজরার সুজাতা সদন সহ একাধিক জায়গায় ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ ছবিটি দেখানো হয়েছে, দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। জুন মাস ছিল ‘প্রাইড মান্থ’। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রাইড ওয়াক’। কিন্তু বাধ সাধল স্কটিশ চার্চ কলেজের ঘটনা। এখানে দক্ষিণপন্থী কোনো সংগঠনের তরফে নয়, খোদ কলেজ কর্তৃপক্ষর থেকেই বাধা পেল ছবিটির প্রদর্শনী।

 

সংবাদমাধ্যমে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে কিছু ছাত্রের আপত্তির কারণে অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। বাস্তবে এই কথার ভিত্তি কতটা তা আমরা একে একে আলোচনা করব। ১১ জুলাই অনুষ্ঠানের দিন রাত ১২টা ৫৯ মিনিটে কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ইন্দ্রানুজ রায় একটি ইমেইল করেন চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া (এই চার্চের অধীনেই স্কটিশ চার্চ কলেজ), প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপালকে। পরেরদিন দেড়টা থেকে অনুষ্ঠান, সকাল আটটা নাগাদ কলেজের এক অধ্যাপিকা পরিচালককে ফোন করে অনুষ্ঠান বাতিলের কথা জানান। এ ব্যাপারে আমরা যোগাযোগ করি ছবির পরিচালক দেবলীনা মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, “দুপুর দেড়টা থেকে স্ক্রিনিং, আমায় সকাল আটটা নাগাদ ফোন করে জানানো হয় অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে, ‘আমরা খুবই দুঃখিত’। তার পর যখন সংবাদমাধ্যম থেকে যোগাযোগ করা হল, তখন দেখলাম পুরো বয়ানটা বদলে গিয়ে তারা (কলেজ কর্তৃপক্ষ) জানালেন আমরা প্রোগ্রাম বাতিল করিনি, স্থগিত রেখেছি৷ আমি যখন কারণ জিজ্ঞেস করলাম তখন আমায় জানানো হল যে পরীক্ষা আছে, প্রোগ্রামে স্টুডেন্ট আসবে না৷ আমার প্রশ্ন হল পরীক্ষা আছে, স্টুডেন্ট আসবে না সেটা আপনারা ভোরবেলায় জানতে পারলেন? তার কোনও সদুত্তর নেই। তারা বললেন ‘আমরা অন্যদিন ছবিটা দেখাব’। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন দিন দেখাবেন, তারিখটা কী? তার কোনো উত্তর পেলাম না।”

 

ছবির প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে একটা প্যানেল ডিসকাশন হওয়ার কথা ছিল। যেখানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’ সংগঠন-এর মীনাক্ষী সান্যালের। ১১ তারিখ সকালবেলা প্রথম ফোনটি আসে তাঁর কাছেই। তিনি বলেন, “এর আগেও ওনারা আমাদের ডেকেছেন, আমরা গিয়েছি। কখনও মনে হয়নি আমরা সেখানে স্বাগত নই। হঠাৎ করেই যখন ওইদিন সকালে ফোনটা এল এবং ওনারা জানালেন অনুষ্ঠান বাতিলের কথা, আমার পুরো বিষয়টাতেই ভীষণ অপেশাদারিত্ব লেগেছিল। কোনও নির্দিষ্ট শিক্ষকের ক্ষেত্রে এটা বলছি না, তাঁরা শুধুমাত্র নির্দেশ পালন করছিলেন, এটা আমি বলব অনেক বেশি কর্তৃপক্ষের অপেশাদারিত্ব।” মীনাক্ষী সান্যাল আরও বলেন, “আমাদের অনুষ্ঠানটা ছিল দেড়টা থেকে বিকেল ৪টে অবধি। আমরা চারটে চার মিনিটে একটা অফিশিয়াল ইমেল পাই, যেখানে ক্ষমা চেয়ে বলা হয় ‘ডিউ টু সাম আনঅ্যাভয়ডেবল রিজন’ অনুষ্ঠানটি স্থগিত রাখা হল। এটা আমার কাছে আরও বেশি অপেশাদারিত্ব মনে হয়েছে যে একটা অনুষ্ঠান ৪টেয় শেষ হওয়ার কথা, আর চারটে চার মিনিটে অফিশিয়ালি জানানো হচ্ছে! এটা খুবই হাস্যকর, অপ্রত্যাশিত।”

 

অপরদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ-র তরফে কিছু ছাত্রের আপত্তিকে অনুষ্ঠান বাতিলের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে। চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া ও কলেজ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া ইন্দ্রানুজ রায় নামের সেই ছাত্রের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি। ইন্দ্রানুজের দাবি, “আমাদের চিঠি দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল কলেজ যে বিভিন্ন বিষয়ে বাইরে প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে থাকলেও ভিতরে অত্যন্ত রক্ষণশীল ও অগণতান্ত্রিক পরিসরকে বজায় রেখে চলেছে, সেটাকে জনসমক্ষে আনা। কিন্তু আমাদের সেই চিঠির ফ্রেমিংয়ে গন্ডগোল থাকায় এবং চার্চকে টেনে আনার যে সিদ্ধান্ত তাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ সুযোগটা পায় অনুষ্ঠানটা বন্ধ করে দেওয়ার। আমরা এটাই জানতে চেয়েছিলাম যে, স্ক্রিনিংটা যদি ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের জায়গা থেকে হয় তাহলে কলেজ কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাব, কিন্তু এই ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন কলেজ কর্তৃপক্ষ কি অন্য ক্ষেত্রেও দেয়?” অতীতে বরাক উপত্যকার ভাষা দিবস নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করার কথা জানানো হলেও, সেক্ষেত্রে কলেজ কর্তৃপক্ষ ও বাংলা বিভাগের তরফে ফান্ড দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন ইন্দ্রানুজ। তিনি বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে সেল্ফ ফান্ডিং করে এরকম অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই আমরা ফান্ড চেয়েছিলাম, যা আমাদের দেওয়া হয়নি। আমরা এই (১১ জুলাইয়ের) অনুষ্ঠানটির সূত্র ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে পরবর্তীতে আমরা কোনও উদ্যোগ নিলে সেক্ষেত্রেও একইভাবে ফান্ড দেওয়া হবে কি না।” ইন্দ্রানুজ রায় একটি বামপন্থী ছাত্রছাত্রী সংগঠনের কর্মী। সংগঠনের তরফে পরবর্তীতে তাকে শোকজ করা হয়েছে। ইন্দ্রানুজ গত ১৩ তারিখ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা, স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি সংগঠন এবং পরিচালক দেবলীনা মজুমদারকে ইমেইল মারফৎ ক্ষমা চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। এক মাস আগে থেকে ঘোষিত একটি অনুষ্ঠান সেইদিন রাতেই এক ছাত্রের করা ইমেইল-এর জন্য বন্ধ বা স্থগিত করা কতটা যুক্তিসঙ্গত? পেশাদারিত্বের অভাব? নাকি ভয়? নাকি কর্তৃপক্ষ এই মুহূর্তে কোনো ঝুঁকি নিতে চান না? উঠছে একাধিক প্রশ্ন।

স্কটিশ চার্চ কলেজ কিংবা চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠানের এহেন ভূমিকা কি প্রত্যাশিত? কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নীতিপুলিশির অভিযোগ ওঠে। স্কটিশ চার্চ কলেজ সূত্রের খবর সেখানেও কিছুদিন আগে পরীক্ষা চলাকালীন এক ছাত্রী ‘হটপ্যান্ট’ পরে পরীক্ষা দিতে আসায় তাকে কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। তারপর সেই মেয়েটি লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়ে চিঠি দেওয়ার পরেই তাকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কলেজের ফিজিক্স বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র জয়র্ষি ভট্টাচার্য বলেন, “আমি যখন পড়তাম তখন দেখেছি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন বিষয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করার অনুমতি চেয়ে একাধিক ইমেইল করা সত্ত্বেও কলেজ কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। কলেজ কর্তৃপক্ষ নানান সময়ে তাদের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব পোষণ করেছে। এই অনুষ্ঠানটির ক্ষেত্রেও আমার মনে হয় এক ছাত্রের করা ইমেইলটি কোনও কারণ হতে পারে না। কারণ যে সময়ে ইমেইলটি করা হয়েছে সেটি অফিস আওয়ার্স নয়। যা হয়েছে সমস্তটাই এক্সট্রা অফিশিয়াল সিদ্ধান্তে হয়েছে।” জয়র্ষি আরও বলেন, “এটা ঠিক যে ইমেইল মারফৎ সেই ছাত্রটি যা যা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে অতীতের বিভিন্ন প্রোগ্রাম করতে না দেওয়া নিয়ে তা মিথ্যে নয়। কিন্তু তার মানে এটাও নয় যে সেইগুলো অজুহাত করে যে চিঠি দিয়েছে সেতা উচিত ছিল। চিঠিটি এইক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।” জয়র্ষি নিজেও ১১ তারিখ কলেজের প্রাক্তনী হিসেবে প্রিন্সিপালের কাছে একটি চিঠি দিয়ে এই গোটা ঘটনাটিকে ধিক্কার জানিয়েছেন।

 

দেবলীনা মজুমদারের ছবি ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ র প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যাওয়া এক্ষেত্রে আরও অনেকগুলি প্রসঙ্গকে উত্থাপিত করে। ব্রিটিশ শাসনে লর্ড ম্যাকাওলের প্রস্তাবিত ৩৭৭ ধারা আইনটি দীর্ঘ ঘাতপ্রতিঘাত ও লড়াইয়ের পর ভারতবর্ষের সুপ্রিম কোর্ট-এ ৫ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৮ সালে খারিজ করে দেন। সমকাম যৌনতাকে এতদিন ‘অপ্রাকৃতিক’ বলে চিহ্নিত করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়ে এসেছে। এই ‘ঐতিহাসিক’ রায়ের পরে সমকাম যৌনতা আর অপরাধ থাকে না, ব্যক্তি অধিকারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। গোটা দেশে সমকামী ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষেরা উৎসবে সামিল হন। কিন্তু একটা বিষয় রয়েই যায়। সমকাম আর অপরাধ নয়, অর্থাৎ দু’জন ব্যক্তি, তারা যে-কোনো লিঙ্গ পরিচয়ের হতে পারেন, তারা একে অপরের সম্মতিক্রমে যৌন সম্পর্ক করতে পারেন। কিন্তু যদি তারা বিয়ে করতে চান? দুজন সমকামী মানুষ চাইলেই কি বিয়ে করতে পারেন? সেক্ষেত্রে আইন কী বলছে? এরকম একাধিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’। আইনি স্বীকৃতি পাওয়া আর সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া এক জিনিস নয়। ২০১৮ সালের পর থেকে সমকামী মানুষেরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরে, পরিবারের মধ্যে। দেবলীনার তথ্যচিত্র সেই সামাজিক লড়াই, পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতগুলোকে পক্ষপাতহীন ভাবে ক্যামেরার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

 

সমকামী মানুষ মাত্রেই সবসময় একটা জীবন যন্ত্রণাকে তুলে ধরা হয়ে থাকে। একটা মানুষের জীবনে কি শুধুই যন্ত্রণা থাকে? প্রথাগত ভাবে বিয়ে করতে চাওয়া কিংবা তার উদযাপন করতে চাওয়াও তো আইনি ও সামাজিক অধিকারের মধ্যে পড়ে! অনলাইন ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট, ঘটকালি করার এজেন্সি, পাত্র কিংবা পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দাতারা ব্যবসার স্বার্থে হয়ত সমকামীদের কেউ কেউ জায়গা দেয়, আবার কেউ দেয় না, কিন্তু তারা এটাকে ব্যক্তিগত ভাবে এখনও ‘অসুখ’ মনে করে আসছেন। ভারতবর্ষের বিবাহ সংক্রান্ত আইনগুলিতে কিন্তু কোথাও সমকামী মানুষদের বিয়ের ব্যাপারে নিষেধ করা নেই। আবার বিয়ের পক্ষেও বলা নেই। কিন্তু বাস্তবত সমকামী যুগল আইনি মতে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করতে গেলে তার ফার্মটিই পূরণ করতে পারবেন না, কারণ সেখানে শুধুমাত্র পুং ও স্ত্রী লিঙ্গ পূর্বনির্ধারিত। পরিচালকের ক্যামেরা এই সমস্ত প্রশ্নকেই হাজির করেছেন স্বঃপ্রতিভ ও ‘নিরপেক্ষ’ দৃষ্টিভঙ্গিতে। বর্তমানে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে দীর্ঘ শুনানি চলেছে এই বিষয়ে। এখন শুধুমাত্র আদালতের রায়দানের অপেক্ষা। আর ঠিক এই রকম একটি সময়ে কলকাতার মতো শহরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা ও ছবি প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যাওয়া আমাদের নাগরিক সমাজকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।

 

স্বাধীন তথ্যচিত্রের ক্ষেত্রে এমন সেন্সরশিপ অতীতেও এসেছে, এখনও আসছে বিভিন্ন ভাবে। অন্যদিকে এই ভারতেই শেষ কয়েক বছরে সমকামিতা, এলজিবিটিকিউআইএ+ মানুষদের নিয়ে মূলধারার বলিউডে ‘বাধাই দো’, ‘শুভ মঙ্গল যাদা সাবধান’ ছবি তৈরি হয়েছে, এমনকি আমাদের বাংলাতেও তৈরি হয়েছে ‘সমান্তরাল’ ছবি। ‘এসআরএস’ বা সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির পটভূমিকায় তৈরি হয়েছে ছবি ‘চণ্ডীগড় করে আশিকী’ যেখানে বাণী কাপুর অভিনীত চরিত্রটি এক জন জন্মগত বায়োলজিকাল পুরুষ, কিন্তু তিনি মানসিক ভাবে একজন নারী, পরিণত বয়সে গিয়ে সার্জারির মাধ্যমে নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করেন যাকে প্রচলিত ভাষায় বলে ‘ট্রান্স ওমেন’ বা ‘রুপান্তকারী নারী’। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছবিই বেশ জনপ্রিয় হয়। তাহলে স্বাধীন ছবি ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’-র ক্ষেত্রে বাধা কেন? দেবলীনা মজুমদার জানাচ্ছেন, “আসলে আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশটা এমনই হয়ে গেছে যে একটু বিরুদ্ধ মত এলেই সেটা বন্ধ করে দিতে হবে। ন্যূনতম বিতর্ক কিংবা আলোচনার পরিসরটাই রাখা চলবে না। একটা অরাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। আর এই সমস্তটা আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও এক রকম ভাবে উন্মোচিত করে। এক জন আমাকে বলেছিলেন, গুজরাতে এমনটা হয়, আমি তাকে বলেছিলাম যে গুজরাতে আমি একটা গোটা ছবির শ্যুটিং করে এসেছি, কোনও আক্রমণের শিকার হইনি, মারটা আমি পাড়াতেই খেয়েছি বজরং দলের হাতে।” গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ শুধুমাত্র সমাজকে আয়না দেখায় না, বরং একটু এগিয়ে বিয়ে এবং বিয়েকে কেন্দ্র করে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানকেও একরকমভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলে।

 

স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রছাত্রীরা গত ১৪ তারিখ কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আকারে ৯১ জন ছাত্রছাত্রীর সই সম্বলিত একটি ডেপুটেশন দিয়েছেন যাতে তারা ১১ তারিখের অনুষ্ঠানটি বাতিল করার সঠিক কারণ ও ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন এবং অতিশীঘ্র এই অনুষ্ঠানটি পুনরায় আয়োজন করার দাবি জানিয়েছেন। কলেজের নোটিশ বোর্ডে দেওয়া হয়েছে পোস্টার। সুপ্রিম কোর্টে ম্যারেজ ইকুয়ালিটি নিয়ে যে শুনানি চলেছে তার অন্যতম পিটিশনার মীনাক্ষী সান্যালের গলাতেও একই সুর, তিনি বলেন, “ড্যামেজ হলে ড্যামেজ কন্ট্রোলও আছে। আমি তো বলিনি যে এতকিছুর পরে আমরা আর যাব না, আমরা মাথা উঁচু করে যাব। আমরা তো রাস্তাঘাটে, বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে কটুক্তি, আক্রমণের শিকার হয়েছি। আমরা তো হাল ছেড়ে দিইনি। আমরা সংগঠনের জন্ম দিয়েছি। আমরা এসবের পরোয়া করি না। এইগুলো থাকবে, এইগুলো আছে বলেই আমরা মনে করি শুধুমাত্র আইনের সংস্কার হলেই হবে না, সামাজিক সংস্কারও দরকার। আমি মনে করি অতি শীঘ্রই অনুষ্ঠানটি পুনরায় আয়োজন করার দরকার আছে, যে ছেলেটি চিঠি লিখেছিল সে-ই উদ্যোগ নিক।” কলেজ কর্তৃপক্ষ-এর তরফে এখনও কোনো উত্তর এ ব্যাপারে পাওয়া যায়নি। অনুষ্ঠানটি পুনরায় আয়োজন করা হবে কি না, সেখানে তথ্যচিত্রটি দেখানো হবে কি না তা সময়ই বলবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর কলেজের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আগামীকাল ১৭ জুলাই স্কটিশ চার্চ কলেজের সামনেই একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছে যেখানে প্রদর্শিত হবে ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’।

 

Share this
Recent Comments
1
Leave a Comment