নিরঙ্কুশ


  • July 15, 2023
  • (0 Comments)
  • 1518 Views

গণতন্ত্রে ‘নিরঙ্কুশ জয়’ আদৌ কোনও স্বস্তিদায়ক কিংবা উৎসাহব্যঞ্জক শব্দবন্ধ নয়। নিরঙ্কুশ অর্থে যেমন বোঝায়, প্রতিবন্ধহীন, অবাধ, অনিবার্য; তেমনি নিরঙ্কুশের অন্য আভিধনিক অর্থ উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল, যথেচ্ছাচারী, স্বেচ্ছাচারী। যেমন, নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, নিরঙ্কুশ স্বৈরাচার। লিখলেন দেবাশিস আইচ

 

…বারেক যখন

নেমেছে পাপের স্রোতে কুরুপুত্রগণ

তখন ধর্মের সাথে সন্ধি করা মিছে;

পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।”

   —গান্ধারীর আবেদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

নিরঙ্কুশ জয়ের মতোই দীর্ঘ বাহু, ক্ষমতাশালী দাঁড়া এক্সাভেটারের। দুই হেরো বিরোধী প্রার্থীর তিনটি দোকান যখন গুঁড়িয়ে দিল এক্সাভেটার, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সর্বস্তরে একাধিপত্যের সঙ্গেই তা যেন বেশ মানানসই হয়ে উঠল। শত্রুর শেষ রাখতে নেই — সেই আপ্তবাক্য মনে রেখেই যেন হুগলির চণ্ডীপুর ১ ব্লকের নবাবপুর পঞ্চায়েতের ভগবতীপুরে দুই বিরোধী প্রার্থী, আসফার হোসেন ও শেখ আতাউর রহমানের তিনটি দোকান দানবীয় ওই যন্ত্র দিয়ে ধ্বংস করল স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব। ওই দুই বিরোধী প্রার্থী যথাক্রমে ছিলেন আইএসএফ ও সিপিআইএম দলের। দুজনেই হেরে গিয়েছিলেন।

 

এক্সাভেটার, পে লোডার, বুলডোজার সবই উন্নয়নের প্রতীক। মাটির সঙ্গে সংযুক্ত। মাটি খোঁড়ো, মাটি দিয়ে বোজাও, মাটির স্তুপ সরাও এমন কত কী। আর সে কাজ তো একা একা যন্ত্র পারে না, তাকে চালনা করতে মানুষ লাগে। আর দুধের শিশুটিও জানে প্রায় একযুগ হল এ রাজ্যে মা-মাটি-মানুষের সরকার প্রতিষ্ঠিত। আবার ভিন্ন মত, প্রতিবাদ যা অঙ্কুশ হয়ে বাধা দেয়, গতি রোধ করে, থমকে দাঁড়াতে, ভাবতে বাধ্য করে—তাঁদের উদ্দেশে এই লৌহদানবের ব্যবহার এ দেশে এখন শাসকের ‘আইনি’ অস্ত্রও বটে। সংখ্যালঘু হলে তো কথাই নেই। স্রেফ বুলডোজার চালিয়ে দিলেই হল। জিজ্ঞাসা করলে বলা হবে ‘বেআইনি নির্মাণ’।

 

পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে, কিন্তু তা হতে হবে বিরোধী শূন্য। এমনটাই এ রাজ্যের শাসক দলের ঘোষিত নীতি। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাওয়া কেন? না করলে তো, হুমকি, মারধর, লুটপাট করতে হয় না। গণনা কেন্দ্রে হাঙ্গামা করতে হয় না। অকারণে এমন সব পরিশ্রম করানোটা তো একরকম অপরাধই। এমন অপরাধের পর দুই প্রার্থী ঘরছাড়া তাই হাতে মারা যায়নি, কিন্তু শাসকের হাত ওই এক্সাভেটারের দাঁড়ার মতোই, তা দিয়ে ভাতে মারার ব্যবস্থা করা গেল।

 

যোগী-ভূপেন্দ্রভাই-হিমন্ত-চৌহান-শাহের দিল্লির প্রশাসন তো বহুকালই স্ব স্ব রাজ্যে এই ‘বুলডোজার-রাজ’ কায়েম করে ফেলেছে। এবং তাঁদের সকলেরই প্রতিবন্ধহীন, অবাধ রাজত্ব। নিরঙ্কুশ। সে সব বিজেপি শাসিত রাজ্যে নিয়মকানুনই আলাদা। মুসলমান এলাকায় রামের নামে, হনুমানের নামে দাঙ্গা বাঁধাও, দাঙ্গাবাজরা রাষ্ট্রীয় ঘেরাটোপে নিরাপদে সরে গেলে আসবে পুলিশ সঙ্গে পুরসভার নেতৃত্বে কোথাও বুলডোজার, কোথাও পে লোডার, এক্সাভেটার বাহিনী। বাছাই করে করে মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে এবং এই অজুহাতে যে এ সকলই বেআইনি নির্মাণ। আইনমাফিক নোটিশ দেওয়া হল কি না? সে নোটিশের উত্তর মিলল কি না? নোটিশের বিরুদ্ধে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ মিলল কি না—এ সবই অবান্তর প্রশ্ন। বিগত প্রায় ছ’সাত বছর যাবৎ রাজ্যে রাজ্যে এ এক বাৎসরিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, নগরায়নের চক্ষুশূল দলিত-আদিবাসী-মুসলমানদের বস্তি, হাইলাইফ সিক্স লেনের পথে বাধা লো-লাইফ ঝুগগি-ঝুপড়ি, খনি-কারখানার পথে বাধা বনাঞ্চল, আদিবাসী বনবস্তি—সে বাধা সরিয়ে নিরঙ্কুশ উন্নয়নের ‘আচ্ছে দিন’ বা ‘অমৃতকাল’ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বুলডোজারের বিকল্প নেই যে। নিরঙ্কুশ জয়ের মতোই যে আমাদের নিরঙ্কুশ নগর চাই, চাই নিরঙ্কুশ পথঘাট, খনি-খাদান-কারখানা। আর এ সবের জন্য প্রথমে চাই সংসদে, বিধানসভায়, পুরসভা, পঞ্চায়েতে নিরঙ্কুশ জয়। শাসন করার অবাধ স্বাধীনতা।

 

সম্প্রতি বড় ফ্যাসাদে পড়েছেন মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। তাঁর রাজ্যে এক ভক্ত ব্রাহ্মণ, তাও আবার স্থানীয় বিজেপি নেতা, প্রবেশ শুক্লা মুতে দিয়েছে এক আদিবাসী যুবকের মাথায়। যেমন ল্যামপোস্টে ঠ্যাং তুলে কুকুর মুতে দিয়ে যায়, হঠাৎ মুত পেলে জঞ্জালের স্তুপে বা রাস্তার ধারে, দেওয়ালে, নর্দমায় মোতে মানুষ, ওরকমই আরকি। সিগারেট টানতে টানতে নিশ্চিন্তে মুতেটুতে সে চলে গেছে। আদিবাসীটিও প্রতিবাদ করেননি, কেউ কোনও কথাও বলেনি। বলবেই বা কেন উচ্চবর্ণ তো, তাও আবার ব্রাহ্মণ। এমনটা করা তো তাদের হাজার হাজার বছরের অধিকার। আর তা ছাড়া গাঁয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে গেলে এমন একটু-আধটু সহ্য করে নিতেই হয়। মুতে দেবে, গু চেটে খাওয়াবে, একটু সাজগোজ করলে ‘খুব উড়ছিস যে’ বলে বেদম পেটাবে— রাজ্যে রাজ্যে আদিবাসী, দলিত জীবনে এতো খুব সাধারণ ঘটনা। কিন্তু, এখানে গোল বাঁধালো সেই ব্রাহ্মণ্য মুত্রত্যাগের একটি ভিডিও। আর তা প্রকাশ্যে চলে এল নির্বাচনের বছরেই। এমনিতে দেশে আদিবাসী নির্যাতনের মোট ঘটনার ২৪% ঘটে মধ্যপ্রদেশে। সেটা খুব সমস্যার কথা নয় শিবরাজের কাছে, সমস্যাটা হল প্রকাশ্যে মাথায় মুতে দেওয়া। তাও নয়, সে ভিডিওর ভাইরাল হয়ে যাওয়া। সেও বড় কথা নয় বর্ণহিন্দুরা অমন একটু-আধটু এর-ওর-তার মাথায় মুতেই থাকে। কিন্তু এ যে বিধানসভা নির্বাচনের বছর।

 

ইহাকে ব্রাহ্মণ্যবাদ বলে। যে ব্রাহ্মণ্যবাদ গণহত্যা সংগঠিত করে কিন্তু সে দেশের আইন গণহত্যাকারীদের শাস্তি দিতে পারে না। স্রেফ ব্রাহ্মণ্য বিশ্বাস বলে রামমন্দির নির্মাণে সবুজ সংকেত দেয় দেশের শীর্ষ আদালত। যে ব্রাহ্মণ্যবাদে তামিল ব্রাহ্মণ পরিবেষ্টিত হয়ে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে দেশের সাংবিধানিক প্রধান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর স্থান হয় না। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে এমন ‘পুণ্যকর্মে’ দলিত, আদিবাসীর স্থান নেই যে। এমন সব কর্মকাণ্ডে হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠা স্বচ্ছ হয়। সেই স্বচ্ছ ভারতে এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রও নিরঙ্কুশ। সংসদীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। মধ্যপ্রদেশে ফিরি। ব্রাহ্মণ বিজেপি নেতার মুতে দেওয়ার ঘটনায় নিন্দার ঝড় বইল, বিরোধীরা নির্বাচনের আগে ইস্যু পেয়ে গেল। খেপেটেপে শিবরাজ বলেই ফেললেন, “শয়তানটা সিস্টেমের মাথায় মুতে দিয়েছে।” ঠিকই বলেছেন, ওই মুতের ধারায় ‘সিস্টেমের’ আদিবাসী ‘প্রেম’-এর রংচং ধুয়ে দিয়েছে ‘শয়তানটা’। ক্ষিপ্ত রাজপুত তড়িঘড়ি  ব্রাহ্মণের বাড়ি ভাঙতে পাঠিয়ে দিলেন এক্সাভেটার। বাড়ি ভাঙা হল, যথারীতি বলা হল ওই বাড়িটিতে যতটুকু বেআইনি নির্মাণ ছিল তা ভাঙা হয়েছে। যুবক শুধু ব্রাহ্মণ নয়, স্থানীয় বিজেপি নেতাও বটে। তার বাবাও এলাকার হোমড়াচোমড়া। ব্রাহ্মণ সমাজ এবার পালটা খেপে গেল। যন্ত্র পাঠিয়ে বাড়ি ভাঙলে কেন? কোন আইনে? রেগেমেগে প্রশ্ন তুলল তারা। শুধু প্রশ্ন তোলা নয়, কমিটি-টমিটি গড়ে তারা বাড়ি সারানোর জন্য চাঁদাও তুলে ফেলেছে। শিবরাজ চুপ। এতো আর মুসলমানের বাড়ি নয়। এখন উল্টো ফ্যাসাদে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, তিনি পড়েছেন ফাটা বাঁশে।

 

এ হল নিরঙ্কুশতার ধর্ম। এ রাজ্যে এক্সাভেটার নামিয়ে যা ঘটিয়ে তোলা হল তাও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার ধর্ম। যা ঘটেছে এই নির্বাচনে, যা ঘটানো হয়েছে ভাঙরে, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কোচবিহারে, হত্যা, সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে; যা ঘটেছে কেশপুরের মতো নি:শব্দে ‘অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’ ভাবে—সবই ওই নিরঙ্কুশ জয়ের লক্ষ্যে। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত দখলের লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন সরকার, রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বাধীন রাজ্য ও জেলার আমলা ও পুলিশকুল এবং নিচের স্তরে দলীয় দুর্বৃত্তদের আর এক ত্রিস্তরীয় ঝটিকা বাহিনী নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। হুগলির চণ্ডীপুর সেই অবাধ সন্ত্রাসের তালিকায় আর এক সংযোজন। ভারতে বুলডোজার-রাজের বঙ্গীয় সংষ্করণের মোড়ক উন্মোচিত হল। চণ্ডীপুরের বিশেষত্ব এটাই। ভবিষ্যতে আরও এমনটা হবে তার সম্ভবনার দিকটাও খুলে গেল এই ঘটনায়।

 

ধান ভানতে এই শিবের গীত গাওয়ার কারণ হল যে, গণতন্ত্রে ‘নিরঙ্কুশ জয়’ আদৌ কোনও স্বস্তিদায়ক কিংবা উৎসাহব্যঞ্জক শব্দবন্ধ নয়। নিরঙ্কুশ অর্থে যেমন বোঝায়, প্রতিবন্ধহীন, অবাধ, অনিবার্য; তেমনি নিরঙ্কুশের অন্য আভিধানিক অর্থ উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল, যথেচ্ছাচারী, স্বেচ্ছাচারী। যেমন, নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, নিরঙ্কুশ স্বৈরাচার।

 

ছবি : প্রতিনিধিমূলক

Share this
Leave a Comment