যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেখল বাংলা, উন্নয়নের রাজনীতির নিরিখে তা অর্থহীন, মূল্যহীন


  • July 14, 2023
  • (0 Comments)
  • 1491 Views

যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেখল বাংলা, উন্নয়নের রাজনীতির নিরিখে তা অর্থহীন, মূল্যহীন। পঞ্চাশটা প্রাণ কার জন্য নবজীবনের বার্তা বহন করে আনল? লিখলেন স্বাতী ভট্টাচার্য

 

 

বলিহারি, বলিহারি। ক্ষমতা একেই বলে। ভালই বল আর মন্দই বল, করে তো দেখাল মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল! মনোনয়ন জমার কেন্দ্র থেকে গণনাকেন্দ্র, কী দাপট, কী দাপট! কেন্দ্রীয় বাহিনী এল যেন বরযাত্রী, ঘটা করে এসে, আয়েশ করে বসে, খেয়েদেয়ে বিদায় নিল। রাজ্য পুলিশ নিল উর্দিপরা বেয়ারার পার্ট। আর রাজ্য নির্বাচন কমিশনার? সেই যে সুকুমার রায়ের কবিতায় হেড অফিসের বড়বাবু বলেছিলেন, ‘ইচ্ছে করে এই বেটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি,’ পঞ্চায়েতের ভোট দেখে সারা রাজ্যের মানুষের তেমন নাচের সাধ জাগল। আহা, বেঁচে থাক ওই পুরুষ্টু, মিম-উস্কানো গোঁফ। জীবনে উন্নতি চান? গোঁফ চিহ্নে ভোট দিন।

 

তা বলে ক্ষমতা মানে কি আর দুটো প্যাঁকাটি-পানা পুলিশ আর চারটে ভ্যাঁক-করে কেঁদে ফেলা ভোটকর্মীকে ধমকে-চমকে ছাপ্পা দেওয়া? ক্ষমতার আসল পরিচয় সত্যের বয়ান রচনার শক্তিতে। রাজ্য দেখল হিংসা, নির্বাচন কমিশন বলল — শান্তি। মিডিয়া গুনল পঞ্চাশটা লাশ, মুখ্যমন্ত্রী বললেন, উনিশ। এই সব ‘সত্য’-কে খারিজ করতে বিরোধীরা বারবার যাচ্ছে আদালতে — ‘স্যর, এই দেখুন ভিডিও, এই দেখুন ছেঁড়া ব্যালট’। এ কেবল পরাজিতের সান্ত্বনা। আদালতের উপর আরও বড় আদালত রয়েছে, মামলা গড়াতে থাকবে যত দিন না তার ফল অর্থহীন হয়ে যায়। আসলে, মানুষের সমর্থন নেতাদের সরকার গড়ার ক্ষমতা দিলেও, তার সঙ্গে নেতারা ‘ফাউ’ বলে ধরে নেন সত্য গড়ার ক্ষমতা। সেই জন্যই নরেন্দ্র মোদীর অনুচরেরা বলেন, মণিপুরে এমন কিছু অশান্তি হয়নি। আর মমতার মুখপাত্ররা বলেন, পশ্চিমবঙ্গে এমন কিছু হিংসা হয়নি।

 

সত্যের নাগাল পাওয়া যখন কঠিন, তা হলে কল্পনাই করা যাক। আচ্ছা, এই যে প্রবল রাজনৈতিক শক্তি, যা পুলিশ-প্রশাসনকে হাতের পুতুল করতে পারে, পাড়ায় পাড়ায়, জেলায় জেলায় সবার ইচ্ছার উপরে নিজের ইচ্ছার ছাপ ফেলতে পারে — কেমন হত যদি সেই ক্ষমতা বিড়ি কোম্পানির মালিকের এজেন্টকে বলত, “হাজার বিড়ি প্রতি ১৯৩ টাকার এক পয়সা কম দিয়েছিস, তো এ পাড়ায় ঢুকতে পাবি না?” যদি প্রতিটা আড়তদারকে গিয়ে বলত, সরকারি দরের চাইতে এক টাকা কম দিলে এক ছড়া ধানও মিলবে না কোনও খেত থেকে? যদি ইটভাটা মালিককে জেলে পুরত একটাও শিশুকে ইট উল্টোতে দেখলে, যদি খাদান মালিক, ভেড়ি মালিককে বাধ্য করত দাসত্বের দশা থেকে মজুরদের মুক্তি দিতে? কেমন হত, যদি বাজার নামক সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠানও চোখ নিচু করত রাজনৈতিক শক্তির সামনে, যেমন করেছে নির্বাচন কমিশন?

 

কেমন হত, যদি ছাত্র নিরক্ষর থাকলে স্কুল ঘেরাও করত বিরোধী দল, সরকারি হাসপাতালে বিনাপয়সার ওষুধ না মিললে ধর্নায় বসত? যদি মাতাল তার বউয়ের গায়ে হাত ওঠাতে গিয়ে থমকে যেত, যদি নারী পাচারকারী চমকে যেত গ্রামের বড়-মেজ নেতার ধমক খেয়ে? যদি হাড়ি-ডোমকে আলাদা করতে চাইলে শাসক দল এসে একঘরে করত বামুন-কায়েতদের? সমাজের ঘুণ-ধরা খুঁটিগুলো যদি রাজনৈতিক ক্ষমতার শক্তিতে মড়মড় করে ভেঙে পড়ে ধুলোয় মিশে যেত, কেমন হত তা হলে?

 

যদি বলেন, ‘তা হলেই হয়েছে, তৃণমূল-বিজেপি, সিপিএম-কংগ্রেস করবে এ সব কাজ?’ তা হলে বলব, আর কে-ই বা করবে? রাজনৈতিক দল ছাড়া আর কার ক্ষমতা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবনকে স্পর্শ করার? সমাজ-জীবনে যার যা কিছু শক্তি, তা পাঁচজনের দেওয়া শক্তি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ধর্মীয় সংস্থা, নাগরিক সংগঠনকে প্রধান না করে, দলীয় রাজনীতিকেই সেই শক্তি দিয়েছে। সেই পথ ধরেই ভূমিহীনের জমি, কৃষির উন্নতি, গ্রামীণ দারিদ্রের নিরসন হয়েছিল এক সময়ে। মমতাও ক্ষমতায় এসেছিলেন চাষের জমিতে ভূমিহীন চাষির দাবিকে মর্যাদা দিয়ে। আজ এ রাজ্যের দলগুলো ফুলে-ফেঁপে ওঠা নেতাদের মধ্যে বখরা লোটার কুচ্ছিত ঝগড়াকে ‘উন্নয়নের বিতর্ক’ বলে চালাতে চাইছে। দারিদ্র, বেকারত্ব, মজুরিবঞ্চনা, চাষির আত্মহত্যা, তীব্র জলকষ্ট, মাটির অনুর্বরতা, বিপুল স্কুলছুট, পরিযায়ী শ্রমিকের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা — পশ্চিমবঙ্গের এই সব সত্যই শাসকের কাছে হয় মিথ্যা, নয় গুরুত্বহীন। বিরোধীরাও শাসককে গাল দিয়েই কাজ সারে। কেউ জানে না, ভূগর্ভের জল সংরক্ষণ করেও বাহাত্তর লক্ষ চাষির সেচের জল জোগানোর কী উপায় ভেবেছে তৃণমূল, আর কী ভেবেছে বিজেপি বা সিপিএম। কিংবা, স্কুলছুট কিশোরদের স্কুলে ফেরাতে কী করতে চায়। ফড়েরাজ, ঠিকাদার-রাজ যে ভাবে গেড়ে বসেছে তৃণমূল জমানায়, কংগ্রেস বা বিজেপি কী করে তা উৎখাত করবে? তার আলোচনাও হল না নির্বাচনের আগে। যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত দেখল বাংলা, উন্নয়নের রাজনীতির নিরিখে তা অর্থহীন, মূল্যহীন। পঞ্চাশটা প্রাণ কার জন্য নবজীবনের বার্তা বহন করে আনল?

 

বাংলা তথা ভারতের দলগুলো কেবল ভোটে জিততে চায়, এমন নয়। তারা উন্নত জীবন কল্পনা করার শক্তিটাই কেড়ে নিতে চায় মানুষের থেকে। অথচ, প্রবল নিপীড়ন, আকুল হতাশার সামনে দাঁড়িয়েও নিরন্ন, নিরক্ষর মানুষ বিকল্প কল্পনার শক্তি প্রয়োগ করেছিল বলেই এক দিন শাসক দল ক্ষমতায় এসেছিল। সেই কল্পনাশক্তিই রাজনীতির প্রাণশক্তি। উনিশটাই মৃত্যু হোক, আর পঞ্চাশটা, সেই শক্তি স্তিমিত হওয়ার নয়। সন্তানের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ — গরিব মায়ের এই কল্পনা থেকে যত দূরে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল, ততই নিজের শক্তি খোয়াচ্ছে।

 

Share this
Leave a Comment