প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতি পুলিশি ছাত্রছাত্রীদের ‘খাঁচায় পোরা’র চক্রান্ত


  • July 6, 2023
  • (0 Comments)
  • 670 Views

একদিকে যেমন এটি আশার কথা যে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক মহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত পরিকাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে, যার ফলে এই নিয়মাবলী এখনও পর্যন্ত লাগু হতে পারেনি; তেমনি এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে গত দশ বছরে ‘পিঞ্জরা তোড়’-এর মতো খাঁচা ভাঙার আন্দোলন-সহ ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে যেটুকু সীমিত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো গিয়েছিল, এই প্রস্তাব সেই পরিবর্তনের পরিমণ্ডলকে প্রায় গোটাটাই নাকচ করে দিয়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক আবহকেই ‘খাঁচায় পোরা’র চক্রান্ত করেছিল। গ্রাউন্ডজিরো-র প্রতিবেদন।

 

মোটামুটি ২০১৪-র পর থেকে, এ দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের ভেতরে ছাত্র, শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীদের গতিবিধিকে প্রাত্যহিক আরও আরও নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির ভেতরে আনার সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে যেমন আছে সমপ্রতি বেঙ্গালুরুতে আইএসএসসি-তে ‘পিঞ্জরা তোড়’ সংগঠনটির দুই অন্যতম মূল সংগঠক নাতাশা নারওয়াল ও দেবাঙ্গনা কলিতার ইউএপিএ বিষয়ে বক্তব্য পেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, তেমনি রয়েছে কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের ওপর নতুন নিয়মাবলী চাপানোর প্রচেষ্টা।

 

বিশেষভাবে বলতে গেলে, পড়ুয়াদের ব্যক্তিগত পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠছে কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনকি, পেন ড্রাইভে পড়ুয়াদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে রাখার মতো আরও নানা অভিযোগও উঠে এসেছে। সেইসব ফুটেজকে সাক্ষী রেখেই, সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকদের ডাকা হচ্ছিল ডিসিপ্লিনারি কমিটির বৈঠকে।

 

সম্প্রতি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী এবং পড়ুয়াদের জন্য একটি বিশেষ “কোড অফ কনডাক্ট”-র খসড়া সামনে আনেন। এখানে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে মিটিং–মিছিল করার জন্য অথবা ক্যাম্পাসের অডিয়ো/ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। প্রাক্তনীদের প্রবেশের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি, এবং আরও একগুচ্ছ বিধিনিষেধ চাপানো হয়েছে এই নির্দেশাবলীতে। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটিকে নিয়ম-নীতির নিগড়ে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে একাধিক স্থানিক নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলীর দ্বারা।

 

অন্যদিকে, সাধারণ পড়ুয়ারাও এই ঘটনার প্রতিবাদে কর্তৃপক্ষের জন্য পালনীয় বেশ কিছু পালটা নির্দেশাবলী তৈরি করেন। এবং সেখানে তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে, “প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রবৃন্দের পিতৃরূপ ধারণ করা নিষিদ্ধ।” বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের পড়ুয়া, রাজর্ষি ধাড়ার কথায়, “ক্যাম্পাসের মধ্যে কীভাবে আচরণ করা যাবে, ধূমপান করা যাবে কি না, কতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে — এইসব বিষয় নিয়ে মৌখিকভাবে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন আমরা হচ্ছিলাম গত কয়েকবছর ধরেই। কিন্তু, এখন যা হচ্ছে তাতে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, যারা একেবারেই সাবালক তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তারা কেমন ভাবে চলাফেরা করবে সে বিষয়ে নির্দেশিকা জারি করা একেবারেই অনৈতিক এবং তা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধীও। এটা যতদিন না বন্ধ হচ্ছে ততদিন লাগাতার প্রতিবাদ চলবে।”

আবার, ইউনিভার্সিটির প্রাক্তনী রিমঝিম সিনহা জানাচ্ছেন, “২০১৮ থেকে অথরিটি এক ধরনের কন্ট্রোল মেকানিজম তৈরি করে। আইডি কার্ড ছাড়া ক্যাম্পাসে ঢোকা যাবে না, ইউনিয়নগুলোকে কাউন্সিলে পরিণত করা, সিসিটিভি ক্যামেরায় ক্যাম্পাস মুড়ে দেওয়া, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ক্যাম্পাসে থাকতে না দেওয়া — এগুলোর মধ্যে দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক হয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়েছে। আমরা মোটামুটি একটা খোলামেলা পরিসর পেয়েছিলাম। কিন্তু, বর্তমান পড়ুয়াদের ওপর বিধিনিষেধ বাড়ছে। বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে যে শুধুমাত্র পড়াশোনাটুকু ছাড়া ক্যাম্পাসে আর কিছুই করা যাবে না।” অর্থাৎ, এক ধরনের পরিকাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। যে পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে, “বিশ্ববিদ্যালয়” বিষয়টির ক্ষেত্রেই মূলগত পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

 

উল্লেখ্য, জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় দেশের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে অরাজনৈতিক করে তোলার ঘোরতর চেষ্টা চলছে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের কথাতেও তা স্পষ্ট। তাঁরাও দাবি করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ক্রমাগত ছাত্র রাজনীতির প্রতিস্পর্ধাকে হিসেবমাফিক মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পড়ুয়াদের সঙ্গে শিক্ষালয়ের সম্পর্ক নিছক পঠনপাঠন এবং ডিগ্রির, এমন একটি ধারণাকেই প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা দেওয়া হচ্ছে ক্রমশ।

 

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র রাজনীতিকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা অবশ্য আজকের নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শাসকদল বহুবার চেষ্টা করেছে, পড়ুয়াদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখবার। এর সবচেয়ে বড় কারণ, সভ্যতার ইতিহাসে, নানা দেশে নানা সময় শাসকের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অধিকার আন্দোলন গড়ে তুলতে ছাত্রছাত্রীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা। গত কয়েক বছরের মধ্যেও বিজেপি সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কাজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে। কখনও দিল্লির দাঙ্গা, কখনও বা সিএএ-এনারসি নিয়ে সরব হয়েছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। এক্ষেত্রে, বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ‘পিঞ্জরা তোড়’ নামের মূলত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক যে ছাত্রীদের সংগঠনটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার স্থানিক নিয়ন্ত্রণ, নীতি পুলিশি ও পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তাদের এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং নাতাশা নারওয়াল ও দেবাঙ্গনা কলিতা—যে দুই সংগঠকের কথা দিয়ে শুরু হয়েছে এই প্রতিবেদন— তাঁদের ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য, সেই একই আইন ব্যবহার করে দিল্লির জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা উমর খালিদকে গ্রেফতার করা হয়।

 

অতএব, সিলেবাস ঢেলে সাজানোর থেকে শুরু করে পরিকাঠামোগত পরিবর্তন, শিক্ষক ছাঁটাইয়ের যে পরিমণ্ডল, সেখানে  ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে এই নীতি পুলিশি ও স্থানিক নিয়ন্ত্রণ অপ্রত্যাশিত নয়।  বরং, সারা দেশ জুড়ে যে অগণতান্ত্রিকতার আবহ গড়ে উঠেছে, বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে সমূলে উৎখাত করার যে বিভিন্ন ধরনের আইনি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে ও হচ্ছে, সেই ধারাবাহিকতাতেই এই নীতিগুলিকে দেখতে হবে। এই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির অংশ হিসেবে ক্যাম্পাসের মধ্যে পড়ুয়াদের জন্য এই ধরনের আচরণবিধি তৈরি করা, তথাকথিতভাবে ‘ক্যাম্পাস ঢেলে সাজানো’র প্রক্রিয়া এক ধরনের প্রগাঢ় পরিকাঠামোগত পরিবর্তন, যাকে ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’ বলেও অভিহিত করা যেতে পারে। যার মতাদর্শগত ভিত্তি সর্বসময়েই রয়েছে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বশংবদ ভবিষ্যৎ নাগরিক প্রস্তুত ও শিক্ষিত করার বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রকল্পে।

 

প্রেসিডেন্সির ক্ষেত্রে অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অভিভাবক হয়ে ওঠা, কিংবা সিসিটিভি ফুটেজের ঘনিষ্ঠমুহূর্ত নিয়ে ডিসিপ্লিনারি কমিটির বৈঠক ডাকা শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের সমস্যা হয়ে আটকে নেই। গত সোমবার মেয়েদের হস্টেলে নীতি পুলিশগিরি চালানোর অভিযোগকে ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়। সে নিয়েই আলোচনায় বসে ডিসিপ্লিনারি কমিটি। বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুই ছাত্রী হোস্টেলে ফিরতে সমস্যায় পড়ে। সেই মুহূর্তে, তাঁদেরই সহপাঠী দুই ছাত্র সাহায্য করে তাদের হস্টেলে পৌঁছতে। ছাত্রদের মধ্যে এক জন শারীরিক অসুস্থতা বোধ করলে হস্টেলের গেটের বাইরে বিশ্রাম নেয়। এর প্রেক্ষিতেই, উক্ত দুই ছাত্রীর বিরুদ্ধে হস্টেল সুপার অভিযোগ আনেন, তাঁরা রাতে ছেলেদের নিয়ে হস্টেলে ঢুকছে। সিকিউরিটি গার্ডদেরও সাসপেন্ড করা হয় এই মর্মে।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর এই জাতীয় নীতি পুলিশি নতুন নয়। কলকাতা থেকে দিল্লি সর্বত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হস্টেলে সন্ধের পর বাইরে বেরোনোর উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মেয়েদের আচার-আচরণ থেকে শুরু করে ইন্টারনেট ব্যবহার, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা সব বিষয়েই ঐতিহাসিকভাবে সর্বক্ষণের নজরদারি চালিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। কর্তৃপক্ষের এই মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করার আরও এক ঘটনার সাক্ষীই থাকল প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী অভিনন্দা ঘটক জানাচ্ছেন, “ডিসিপ্লিনারি কমিটির আলোচনায় কর্তৃপক্ষ বারবার টেনে এনেছেন বেশি রাতে মেয়েদের হস্টেলে ফেরা কতটা অনুচিত সেই প্রসঙ্গ। সেখানেই, আমরা জানতে চাই ছেলেদের হস্টেল থেকে বেরনো বা হস্টেলে ফেরার সময় নিয়ে আপত্তি না থাকলে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন ওঠে কীভাবে?” ডিসিপ্লিনারি কমিটির আলোচনার মধ্যেই পড়ুয়ারা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। “তখনি হস্টেল সুপার, ডঃ পারমিতা সাহা এক ছাত্রের হাত থেকে ক্যামরা ফেলে দিতে চান। আমাকে মারতেও উদ্যত হন”, এমনটাই দাবি করছেন অভিনন্দা। তাঁর কথাতেই, “ক্যাম্পাসের মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ডিসিপ্লিনারি কমিটির বৈঠক হয়, সেখানে শুনানি হয়। অথচ, ক্যাম্পাসে যখন কোনও শিক্ষক বা কর্মীদের দ্বারা সেক্সসুয়াল হ্যারাসমেন্টের ঘটনা ঘটে তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোন উদ্বেগ দেখা যায় না।”

 

ঠিক এ কারণেই আর একটু গভীরভাবে আমাদের ঘুরে তাকাতে হয়, ‘পিঞ্জরা তোড় (পিঞ্জরা তোড় : ব্রেক দ্য হস্টেল লক’-র মতো উদ্যোগের দিকে। ২০১৫-য় দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের রাত ৮টার পর হস্টেলের বাইরে থাকা নিষিদ্ধ করা হয়। এ হেন চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধ দিল্লির বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে। সেখান থেকেই তৈরি হয় ‘পিঞ্জরা তোড়’ এর উদ্যোগ। ছাত্রীরা পিতৃতান্ত্রিকতার নিয়ম-কানুন ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার দাবি জানান। বলা হয়, ছাত্রীদের স্বাধীনভাবে চলাফেরায় হস্তক্ষেপ করে তাঁদের সুরক্ষা দেওয়া যায় না। বরং, বৃহত্তর সমাজে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার মত পরিকাঠামো তৈরি করা এবং সেই জায়গায় সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। এই দাবিতেই সোচ্চার হন তাঁরা। দিল্লির পাশাপাশি, কলকাতা, এলাহাবাদ, পুণে, বেঙ্গালুরু, চণ্ডীগড়ের মতো শহরের ছাত্রীরাও একে একে এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন।

 

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুম্নিমা তামাং সাহার কথায়, “২০১৯ এ ‘পিঞ্জরা তোড়’ আন্দোলন চলাকালীন আমরা হস্টেলের মেয়েরা, হস্টেলে ফেরার সময় নিয়ে বিধিনিষেধ ভাঙি। কিন্তু, তারপরেও হস্টেলে ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা বাজলে হস্টেল সুপারের প্রশ্ন জেরবার হতে হয়। স্লাট সেমিং পর্যন্ত করা হয়। গত বছর অক্টোবর মাসে, আমি বিশেষ একটি কারণে একদিন রাত দুটোয় হস্টেলে ফিরি, তখন আমার বাবা-মার কাছে খবর দেওয়া হয়। গত কয়েক মাসে হস্টেলের নেপালি কমিউনিটির মেয়েদের অনেকেরই বাড়িতে চিঠি যায়, তাঁরা দেরি করে হস্টেলে ফিরছে এই অভিযোগ জানিয়ে। এত আন্দোলনের পরেও হস্টেল কর্তৃপক্ষ কিন্তু বিভিন্ন সময় অভিভাবকদের কাছে এই ধরনের অভিযোগ করেই চলেছেন। সেখান থেকেই ডিসিপ্লিনারি কমিটির বৈঠক বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ।” যে নতুন বিধিনিষেধ চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, তা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হস্টেলের ভিতরে পিতৃতান্ত্রিকতার পরিবেশ আরও প্রগাঢ় হবে, এমনটিই স্বাভাবিক।

 

মঙ্গলবার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, ন্যাকের প্রতিনিধি এবং পড়ুয়া প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক বসে। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ পড়ুয়াদের দু’টি দাবি মেনে নিয়েছে বলে দাবি করছেন পড়ুয়ারাই। প্রথমত, প্রেসিডেন্সিতে পড়ুয়াদের নিয়ে আর কোনও ডিসিপ্লিনারি কমিটির বৈঠক বসবে না। দ্বিতীয়ত, পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিন রক্ষা না করা সংক্রান্ত সব অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও, আগামী সাধারণ সভা পর্যন্ত নতুন আচরণবিধি স্থগিত রাখা হয়েছে।

 

একদিকে যেমন এটি আশার কথা যে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক মহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত পরিকাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে, যার ফলে এই নিয়মাবলী এখনও পর্যন্ত লাগু হতে পারেনি; তেমনি এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে গত দশ বছরে ‘পিঞ্জরা তোড়’-এর মতো খাঁচা ভাঙার আন্দোলন-সহ ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্যাম্পাসে যেটুকু সীমিত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো গিয়েছিল, এই প্রস্তাব সেই পরিবর্তনের পরিমণ্ডলকে প্রায় গোটাটাই নাকচ করে দিয়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক আবহকেই পিছু হটতে বাধ্য করেছে। এক্ষেত্রে, কর্নাটকে সম্প্রতি কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরিপ্রেক্ষিতে, বেঙ্গালুরুর আইএসএসসি -র ঘটনাটি প্রমাণ করে যে বিজেপি ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির শাসকদল হিসেবে উপস্থিতিও এই অগণতান্ত্রিকতাকে রোধ করতে সক্ষম নয়। প্রয়োজন, জোরদার ছাত্রছাত্রী আন্দোলন। শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী ও ক্ষেত্রবিশেষে অভিভাবকদের মিলিত আন্দোলন।

 

ছবি : সৌজন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীরা।

 

Share this
Leave a Comment