মহিলা কুস্তিগীরদের লড়াই এবার পিতৃতান্ত্রিক মনুবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে


  • May 28, 2023
  • (0 Comments)
  • 1179 Views

“এটা আসলে এখন দু’পক্ষের লড়াই হয়ে গেছে। একদল যাঁরা চান যে এই দেশ মনুস্মৃতির আদর্শে চলবে না। আরেক দল যারা মনুস্মৃতি অনুযায়ী মহিলাদের পায়ের জুতো, গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। আমরা যেহেতু দ্বিতীয় দলের বিরুদ্ধে তাই আমাদের তো এই মেয়েদের পাশে দাঁড়াতেই হবে।” – কৃষক আন্দোলনের নেতা।

 

গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন | সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

রবিবার, ২৮ মে সন্ধ্যা ৭টা ৪৫। ফোনের অপর প্রান্তে অল ইন্ডিয়া ডেমোক্র্যাটিক উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশন-এর জেনারেল সেক্রেটারি জগমতী সাংওয়া। বললেন, “আমরা এই মাত্র পুলিশের হেফাজত থেকে ছাড়া পেলাম। দিল্লির বসন্তকুঞ্জ থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মহিলা কুস্তিগীররা আর আমরা (বিভিন্ন সংগঠনের মহিলা আন্দোলনকারীরা) ছাড়া পেয়েছি। পুরুষদের এখনও ছাড়া হয়নি। আমরা বারবার বলছিলাম, যাতে তাড়াতাড়ি সবাইকে ছড়া হয়, বিশেষত মহিলাদের, যারা হরিয়াণার দূর-দূরান্তের বিভিন্ন জেলার গ্রাম থেকে এসেছেন। তাঁরা এত রাতে কীভাবে, কোথায় ফিরবেন?”

 

জগমতী বললেন, “ভারতের নাগরিকদের প্রতিবাদের অধিকারের উপরে আজ চূড়ান্ত হামলা হয়েছে, সব রকমভাবে তা উলঙ্ঘন করা হয়েছে। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও নিয়ম মেনে করতে চাওয়া ‘মহিলা সম্মান পঞ্চায়েত’-কে আজ হিংসায় পরিণত করার চেষ্টা করেছে পুলিশ ও সরকার। মহিলাদের উপর আক্রমণ করেছে পুরুষ পুলিশ। এবং আজ সংসদ ভবন উদ্বোধনের যে অনুষ্ঠান ছিল তা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন একুশ শতক নয়, ষোড়শ শতকের কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে।” তিনি মনে করিয়ে দেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে সংসদ ভবন উদ্বোধনে বাদ রাখা থেকে মহিলাদের ‘সম্মান পঞ্চায়েত’ না হতে দেওয়া সবটাই অর্থবহ, যেভাবে হিংসা ছড়ানো হচ্ছে তাও নজরে রাখতে হবে, একইসঙ্গে আইনের কোনও পরোয়াই করা হচ্ছে না, ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর বিরুদ্ধে পকসো আইনে অভিযোগ থাকলেও তা গ্রাহ্য হচ্ছে না। জগমতী স্পষ্ট বলেন, “আজ এদের যে পিতৃতান্ত্রিক, বর্ণবৈষম্যবাদী মনোভাব তা সকলের সামনে চলে এসেছে। আপনি নিশ্চয়ই এটা মেনে নিতে পারেন না যে, দেশের মহিলারা যখন নিজেদের কোনও দাবি জানাচ্ছেন, অভিযোগ করছেন, তখন তাঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, ধাক্কা মারা ও টানাহেঁচড়া করা হচ্ছে।”

 

তিনি আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী হিসাবে জানালেন, “এই আন্দোলনকে এবার আমাদের আরও তৃণমূলস্তরে নিয়ে যেতে হবে। কৃষক আন্দোলনে আমরা যে পন্থা নিয়েছিলাম টোল বন্ধ করে দেওয়ার, গ্রামে বিজেপি নেতাদের ঢুকতে না দেওয়ার, ওরা তো সমস্ত বর্ডার বন্ধ করে দিয়েছিল যাতে আমরা দিল্লিতে না ঢুকতে পারি, তাই তখন আমরাও নেতাদের গ্রামে ঢুকতে দিইনি। এভাবেই কুস্তিগীরদের আন্দোলনকেও গ্রামের গভীরে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।”

 

ভারতের ইতিহাসে ২৮ মে তারিখটা লেখা হয়ে রইল হিন্দু রাষ্ট্রের ধ্বজাধারীদের আস্ফালন ও তারই অ্যাজেন্ডা হিসাবে পিতৃতান্ত্রিকতা কতটা লাগামছাড়া হতে পারে তারই উদাহরণ হিসাবে। নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন নিয়ে যে ধরনের উত্তেজনা, প্রচার চালানো হয়েছে এবং ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিয়ে এক নতুন ভারতের পরিচিতি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে তাতে কেন্দ্রের মোদী সরকারের হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপন করার অ্যাজেন্ডা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল। আর তার সঙ্গে দেখা দিল এই দেশে নারীদের অবস্থান এই মুহূর্তে কতটা বিপন্ন। গত পঁয়ত্রিশ দিন ধরে দেশের পদকজয়ী কুস্তিগিরেরা যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে দিল্লির যন্তর মন্তর-এ অবস্থান বিক্ষোভে বসেছেন। হ্যাঁ, সামান্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও (সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে এফআইআর) আসলে কুস্তি ফেডারেশন-এর প্রেসিডেন্ট ও বিজেপি নেতা ব্রিজভূষণ শরণ সিং-কে গ্রেফতারের জন্য কোনও কিছুই করেনি প্রশাসন ও সরকার। আর রবিবার যা ঘটল তাতে সারা দেশ সাক্ষী রইল এই দেশে হিন্দুত্ববাদী, পিতৃতান্ত্রিক সরকারের সামনে দেশের মহিলাদের সম্মান, দাবি, তাঁদের নিরাপত্তা কোনও গুরুত্ব রাখে না।

 

সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগত, গীতা ফোগত-রা জাতীয়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় যখন পদক জিতে আসেন, তখন তাঁদের দেশের ‘বেটি’ বলে প্রধানমন্ত্রীকে ক্যমেরার সামনে উল্লাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু তার সরকারই সেই ‘বেটি’দের শুধু অমানবিক নয়, অসাংবিধানিক, আইনবিরুদ্ধভাবে ন্যায় বঞ্চিত করে রেখেছে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনা সত্ত্বেও এবং তাঁদের শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপরে আজ যেভাবে দিল্লি পুলিশি সন্ত্রাস নামিয়ে আনাল, তা লজ্জাজনক শুধু নয়, ভারতবর্ষে এই মুহূর্তে যেকোনও অবস্থানের নারীরাই যে কতটা নিরাপত্তাহীন, অসুরক্ষিত তা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দলিত, আদিবাসী, শ্রমজীবী, প্রান্তিক যৌন ও লিঙ্গ পরিচিতি, সংখ্যালঘু ইত্যাদি নানা পরিচয়ের নারীরা যেমন রাষ্ট্রীয় শোষন ও সন্ত্রাসের শিকার, তেমনি প্রথম সারির ক্রীড়াবিদ ও তথাকথিতভাবে দেশের সম্মানের পতাকাবাহী নারীরাও রাষ্ট্রের বেরিয়ে পড়া নখ-দাঁতের সামনে বিপন্ন, অসম্মানিত।

 

এই পুরো বিষয়টিকে শুধুমাত্র আবেগের দিক থেকে বিচার করলে ভুল হবে। এখন দিল্লির মসনদে বসে থাকা বিজেপি সরকার যে সুনিপুনভাবে বিরুদ্ধ স্বরগুলিকে দমিয়ে রাখতে চাইছে এবং মনুবাদী ধারণাকে তুলে ধরে সমস্ত বয়সী নারীদের সনাতন ভারতীয় নারীর বাক্সে বন্দী করে রাখতে চাইছে তা কুস্তিগীরদের চলমান আন্দোলনের প্রতি তাদের উপেক্ষা ও তাকে অদেখা করে রাখার পন্থা থেকে স্পষ্ট। আশ্চর্যের বিষয় হল দেশের কৃষক, শ্রমিক, তৃণমূল স্তরের নারীবাদী সংগঠনগুলি এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকলেও বৃহত্তর ভারতীয় সমাজ এই আন্দোলনের সঙ্গে এখনও সংযুক্ত নয় – যেন ‘যা হচ্ছে ওঁদের সঙ্গে হচ্ছে, আমাদের কীই বা করার আছে’ – মানসিকতারই প্রতিফলন। আর এই বিযুক্তিই রাষ্ট্রকে সুযোগ করে দেয় যৌন হেনস্থায় অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ না নিতে, উপরন্তু সেই অভিযুক্ত বাহুবলি নেতা জোর গলায় বলতে পারে ‘পকসো’ আইন সরকারের উপর চাপ তৈরি করে বদলে দেবে।

অভিযুক্ত বিজেপি নেতা ব্রীজ ভূষণ

নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী যখন গণতন্ত্র নিয়ে বড়সড় ভাষণ দিচ্ছেন তখন টেনেহিঁচড়ে শান্তিপূর্ণ মিছিলকারী কুস্তিগীরদের প্রিজন ভ্যান-এ তুলছে পুলিস, জাতীয় পতাকা হাতে ভারতের নারী ভুলুন্ঠিত হচ্ছেন, বিধ্বস্ত অথচ দৃঢ়, ঋজু কুস্তিগীরদের ছবি ছড়িয়ে পড়ছে মিডিয়ায়, ন্যায়ের জন্য তাঁদের গলা ফাটানো চিৎকার ছাপিয়ে যাচ্ছে অন্তঃসারহীন ভাষণের বুলি।

 

সাভারকর-এর জন্মদিনে, হিন্দু ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে যেভাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সাংবিধানিকভাবে এখনো গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতন্ত্রের নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করল এবং তার নেতৃত্ব দিলেন প্রধানমন্ত্রী, তা আবারও দেখাল ২০২৪-এর সংসদীয় নির্বাচনের আগে হিন্দুত্বের প্রচার-প্রসারই এই সরকারের লক্ষ্য এবং তারজন্য আইন, বিচার, পুলিশ, প্রশাসন সবকিছুকেই তারা পকেটস্থ করে রাখছে ও সেখানে নারীদের অবস্থান বিপন্ন, বিপর্যস্ত।

 

আশার কথা আজ নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিনে ‘মহিলা সম্মান পঞ্চায়েত’-এর আয়োজন করার যে উদ্যোগ তাঁরা নিয়েছিলেন তা আটকে প্রতিবাদীদের আটক করে পুলিশ, কিন্তু তাঁদের মনোবল ভেঙে দিতে পারেনি। তাঁদের সাহস আর প্রতিবাদী স্বর কেড়ে নিতে পারেনি। বরং সঙ্গী, সমর্থক, পাশে থাকা সংগঠকদের নিয়ে তাঁরা প্রাপ্য ন্যায় পাবেন ও সারা দেশের সামনে প্রতিবাদের নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবেন, আজকের ঘটনাপ্রবাহ অন্তত সেদিকেই নির্দেশ করে। এ কথা বাস্তব যে আন্দোলনরত কুস্তিগীরদের মধ্যে অনেকেই বিজেপি-আরএসএস সমর্থক, বিজেপি-র টিকিটে ভোটেও দাঁড়িয়েছেন, সরকারের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থনও ছিল। কিন্তু রাজনীতি কখনও একপাক্ষিক, একস্তরীয় হয় না। এই কুস্তিগীরদের মধ্যে থেকে হয়তো কৃষক আন্দোলনের সময়ে সমর্থন উঠে আসেনি, কিন্তু দেশের পদকজয়ী ক্রীড়াবিদ তথা দেশের মহিলাদের সম্মানের সমর্থনে কৃষক আন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠন বিরাট সংখ্যায় তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যেমন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা, ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (একতা উগ্রাহান), ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (দাকোন্দা) আজ তাঁদের সঙ্গে ছিল। আজই বিকেইউ উগ্রাহান-এর নারী শাখা কুস্তিগীরদের সমর্থনে ও তাঁদের উপর নজিরবিহীন আক্রমণের প্রতিবাদে এক প্রতিবাদ সভার ডাক দিয়েছিল।

 

গ্রাউন্ডজিরো-র এই প্রতিবেদকের দিন দুয়েক আগেই কথা হয় ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন দাকোন্দা-র বরিষ্ঠ নেতা হারনেক সিং-এর সঙ্গে। কৃষক আন্দোলনের সময়ে কুস্তিগীরদের সমর্থন না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, “এ কথা ঠিক কোনও কুস্তি ফেডারেশন, কোনও আখড়া থেকে আমরা কৃষক আন্দোলনের সময়ে সেভাবে সমর্থন পাইনি। কিন্তু এই মেয়েরা বেশিরভাগই কিসান বা মজদুরদের মেয়ে। সেভাবে দেখলে এই মেয়েদের বাবা, কাকা, ভাইদেরই কেউ না কেউ কিসান, মজদুরদের মধ্যে থেকে সমর্থন করেছেন কৃষক আন্দোলনকে। আমরা বুঝি যে সিস্টেম-এ আমরা বাস করি, সেখানে খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাঁরা কোন্‌ বিষয়ে কথা বলবেন বা বলবেন না। নিশ্চয়ই এই মেয়েদের উপরেও কোনও না কোনও চাপ ছিল সে সময়ে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, যে তাঁরা সে সময়ে প্রতিবাদ করেছিলেন কি না। আমাদের মনে হচ্ছে এখন আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত, তাই আমরা করছি।” বিকেইউ একতা, দাকোন্দা প্রথম দিন থেকেই এই আন্দোলনের সঙ্গে আছে। একবার ১২০০ জনের জাঠ্ঠা নিয়েও তাঁরা পৌঁছেছিলেন যন্তর মন্তর। বিশেষত তাঁদের মহিলা শাখা উপস্থিত থাকছে অন্যান্যদের সঙ্গে।

 

তাঁদের কাছে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কেন বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “এটি আমাদের কাছে শুধুমাত্র পহেলওয়ান মেয়েদের হেনস্থার ইস্যু নয়। বিজেপি যে আদর্শ অনুসরণ করছে, তা মনুস্মৃতির আদর্শ। আজকে ব্রিজভূষণ হোক বা চিন্ময়ানন্দ, বিজেপি খোলাখুলি এই কুকর্মগুলো করতে না পারলেও, এগুলো সমর্থন করে তারা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তাদের পরিকল্পনা হল, মেয়েদের যেকোনও প্রকারে আটকে দেওয়া। আজকে যে তারা ব্রিজভূষণকে বাঁচাচ্ছে, তা আসলে তাদের মনুস্মৃতির আদর্শকে বাঁচানোর লড়াই। এটা আসলে এখন দু’পক্ষের লড়াই হয়ে গেছে। একদল যাঁরা চান যে এই দেশ মনুস্মৃতির আদর্শে চলবে না। আরেক দল যারা মনুস্মৃতি অনুযায়ী মহিলাদের পায়ের জুতো, গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। আমরা যেহেতু দ্বিতীয় দলের বিরুদ্ধে তাই আমাদের তো এই মেয়েদের পাশে দাঁড়াতেই হবে।”

 

এইখানেই যৌন হেনস্থার সার্ভাইভার এই ক্রীড়াবিদেরা ভারতের নারীদের মুখ হয়ে ওঠেন, ন্যায় পাওয়ার এই দাবী হয়তো তাঁদের নিজেদের দাবী, কিন্তু তা ধ্বনিত হয় উত্তর প্রদেশের সেই পুড়ে যাওয়া দলিত কিশোরীর চিতায়, সারা ভারতের সেই সমস্ত মেয়েদের পরিবারের গুমরোতে থাকা পাঁজরের শব্দে যাঁদের মেয়েদের ধর্ষকদের সমর্থনে থাকে হিন্দুত্ববাদী, মনুবাদী সরকার, প্রশাসন।

 

Share this
Leave a Comment