সরকারি কর্মীর মর্যাদা, ন্যায্য বেতন চান অঙ্গনওয়াড়ি ও মিড ডে মিল কর্মীরা


  • May 15, 2023
  • (0 Comments)
  • 1304 Views

সরকারি প্রকল্প-কর্মীদের অধিকার-বঞ্চনা: সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা

একটি আলোচনা সভা

 

গ্রাউন্ডজিরো-র পঞ্চম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে, ৬ মে ২০২৩, আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকানন্দ হল-এ এ রাজ্যের প্রকল্প-কর্মীদের নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলাম। এই আলোচনা সভায় মূল লক্ষ্য ছিল, অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড ডে মিল ও ১০০ দিনের কাজের মতো গুরত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলির কর্মী, সহায়িকা, শ্রমিকদের কথা মুখোমুখি বসে শোনা, জানা। সভা শেষে আমাদের সকলেরই অনুভূতি এই যে এই প্রকল্প-কর্মীদের যে দায়-দায়িত্ব, হাড়ভাঙা খাটুনি তার তুলনায় তাঁদের ভাতা/ মজুরি অতি সামান্য। এবং এক জন কর্মী/ শ্রমিকের মর্যাদা ও স্বীকৃতিটুকুও তাঁদের নেই। একইসঙ্গে আমাদের লক্ষ্য ছিল, তাঁদের  যে দীর্ঘকালের দাবি—তা তাঁদের নিজেদের মুখ থেকে শোনা। পাশাপাশি, এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাই বা কী তা বুঝে নেওয়াটাও আর একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

 

এই আলোচনা সভায় বক্তারা ছিলেন, আশা কর্মী ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদিকা ইসমত আরা খাতুন; ওয়েস্ট বেঙ্গল অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কার্স অ্যান্ড হেলপারস ইউনিয়নের সম্পাদিকা মাধবী পণ্ডিত; অ্যাসোসিয়েশন অব মিড ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস (আম্মা)-র উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রিনা নায়েক, পশ্চিমবঙ্গ খেত মজুর সমিতির অম্বরীশ সোরেন ও প্রতিমা সর্দার এবং প্রবীণ সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। গ্রাউন্ডজিরো-র পক্ষ থেকে আলোচনার সূত্রপাত করেন দেবাশিস আইচ।

 

আমরা এই সভার বক্তব্যগুলি আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনুষ্ঠানে বক্তাদের ক্রম অনুসারে তিনটি কিস্তিতে তা প্রকাশিত হবে। আজ দ্বিতীয় কিস্তি

 

মাধবী পণ্ডিত

সম্পাদিকা, অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কার্স অ্যান্ড হেলপারস ইউনিয়ন

আজ গ্রাউন্ডজিরোর পক্ষ থেকে যারা এখানে আছেন… মঞ্চে উপস্থিত আর সামনে বসে আছেন যাঁরা সকলকেই আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। ওয়েস্ট বেঙ্গল অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কার্স অ্যান্ড হেলপারস ইউনিয়ন-এর পক্ষ থেকে আমিও কিছু বলতে চাই। ইসমত আরাদি আগেই বলে গেছেন “আশা” নিয়ে। তিনি আশা কর্মী ইউনিয়ন এর রাজ্য সম্পাদিকা এবং আশা মিড ডে মিল ও স্বাস্থ্য কর্মী অল ইন্ডিয়া সম্পাদিকা।

 

যাই হোক, এই যে অঙ্গনওয়াড়ি, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন এর শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২অক্টোবর। ১৯৭৫-এ তৈরি হওয়া এই স্কিম ২০২৩-এ এসে প্রায় ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। শুরু হয়েছিল খুবই অল্প পয়সা দিয়ে মা এবং শিশুদের নিয়ে। জিরো থেকে ছ’বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের দায়-দায়িত্ব নেওয়া, গর্ভবতী প্রসুতি, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এইসব। ১৯৭৫ সালের কথা বলছি, তখনও কিন্তু আশা আসেনি। অঙ্গনওয়াড়িদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং শিক্ষা তিনটেই দেখতে হত। কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়ের স্কিম হিসেবেই শুরু হয়েছিল ৭৫ টাকা দিয়ে। যারা দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং সহকারী দিদিরা, এখন তাঁদের নূন্যতম বেতন ৮২৫০ টাকা কর্মীদের এবং সহায়িকা দিদিদের ৬৩০০টাকা। এটা খুব যৎসামান্য। ২০ [২০২০] সাল থেকে এটুকু টাকা আমরা পাই, তার আগে পর্যন্ত অনেক কম ছিল। উত্তরোত্তর কাজ কিন্তু প্রচুর বেড়ে গেছে।

 

সরকার বলেন যে, আমাদের ৪ ঘণ্টা অফিস মানে সেন্টার এর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। রান্না, শিশু, মা-দের খাওয়ানো, ৩-৬ বছরের শিশুদের পড়াশুনা শেখাতে হয়। এরপরও আমদের ফিল্ডে বেরিয়ে বাড়িতে বাড়িতে যেতে হয় এবং বাড়িতে এসেও খাতার কাজ করতে হয়। যেখানে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাইরা ৪ কি ৬ঘণ্টা কাজ করে এসে বাড়িতে নির্বিবাদে ঘুমায়, আর আমরা অঙ্গনওয়াড়ি বাড়িতে এসে তাদের নিশ্বাস পড়ে না। কোথায় তাদের ছেলেমেয়ে থাকে তারা জানে না। উত্তরোত্তর প্রতিদিন খাতার কাজ। খাতার কাজ করলে পয়েন্ট মানে সরকার যখন পয়সা দেন পয়েন্ট-এ পয়সা দেন। সেই পয়েন্ট হিসেব করতে করতে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। পরিষেবা বেড়ে ৬ ঘণ্টা থেকে ৮ ঘণ্টা এমনকি ২৪ ঘন্টাও চলে যায়।আপনারা অনেকেই জানেন যে কেন্দ্রীয় সরকার পোষণ ট্র‍্যাকার অ্যাপ বলে একটা অ্যাপ এনেছে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের জন্য। প্রতিদিন এই অ্যাপ-এর কাজ করতে হয়। যখনই ২০২২ সালে এই পোষণ ট্র‍্যাকার অ্যাপ-এর কথাটা এল, আমরা বারবার আন্দোলন করেছি। শুধু ২০২২ সালের আন্দোলনটা নয়, তার আগে নানাভাবে আমরা সরকারি স্বীকৃতি চাওয়া, নূন্যতম মজুরি দেওয়া, পিএফ, পেনশন এসব নিয়ে আন্দোলন করেছি।

 

যাঁরা আগের নিয়মে ১৯৭৫ সালে আইসিডিএস-এ ঢুকেছিলেন তাঁদের বলা হয়েছিল যে যতদিন কর্মদক্ষতা থাকবে সে ততদিন কাজ করবে। কিন্তু ২০১৪ সালে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার হঠাৎ করেই একদিনের একটি নোটিশে আমাদের ৩৫,০০০ অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকাদের বসিয়ে দিলেন। ফলে ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল তাঁদের মাথায় বাজ পড়ার মতো হয় আচমকা শুনে, অনেক দিদিরা মারা গেছেন। যখনই শুনেছেন আজ থেকে আপনাকে আর কাজে আসতে হবে না, আপনার এখানেই সমাপ্তি, আপনি বাড়ি চলে যান, মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। আমাদের প্রতিদিন শিশুদের ডিম খাওয়াতে হয়। বাচ্চারা বলেছে, মা আমাদের তো দেখনি, পরের ছেলেদের খাইয়েছ। সত্যিকারের! অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বাড়ির বাচ্চারা কোথায় গ্রামের বাড়িতে কর্দমাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কেউ দেখার নেই। এরকম একটা অবস্থায় তাঁদের কাজটা চলে গেল। তখন থেকে আমরা দাবি তুলেছিলাম যে আমাদের আর শূন্য হাতে বসানো যাবে না। এই নিয়ে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের কাছে আমরা লাগাতার দাবি তুলেছে যে, অঙ্গনওয়াড়িদের বসিয়ে দেওয়ার সময় নূন্যতম ৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে। এখনও লড়াইটা চলছে।

 

কিন্তু এই যে লকডাউনের কথা এসে গেল,আশা কর্মী দিদিরা যেভাবে কাজ করেছেন পাশাপাশি অঙ্গনওয়াড়ি দিদিদেরও একইভাবে কাজ করতে হয়েছে। আমার আশা দিদিরা যেমন কোভিড আক্রান্ত হয়েছিল তেমনি অঙ্গনওয়াড়ি দিদিরাও বাড়ি বাড়ি ঘুরে কে [পরিযায়ী শ্রমিক] কোন জেলা [রাজ্য] থেকে এসেছে, জ্বর এসেছে কিনা এই কাজগুলো করেছিল। ওই করোনা পরিস্থিতিতে তাঁদের একটি টাকাও দেওয়া হয়নি। আমরা কিন্তু এখনও সেটা নিয়ে লড়াই চালিয়েছি। কিন্তু আপনারা দেখবেন খবর, পেপার এর মাধ্যমে এই খবর চলে না। যাই হোক এইভাবে আন্দোলন চলছে। এখনও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

 

অনেক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী যারা আট পাশ, মাধ্যমিক পাশ-এ ঢুকেছিলেন অনেকেই পোষণ ট্র‍্যাকার অ্যাপ-এর কাজটা করতে পারেননি। কিন্তু আমরা বলেছিলাম, এই অ্যাপ-এর কাজটা করতে গেলে সরকারকে আগে আমাদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল দিতে হবে, না হলে কোনোভাবে আমরা কাজটা করতে পারব না।এখানে বিকাশ ভবনে প্রায় মাসে একবার করে আমরা যে নারী শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা মহাশয় তার কাছে এই দাবিগুলো আমরা বারবার তুলে ধরছি। সরকার দেবেন বলে এখনও পর্যন্ত মোবাইল দিলেন না কিন্তু কাজ আমাদের করতে হচ্ছে। বলছে তোমার বাড়ির পাশে যদি কেউ থাকে তার ফোন নিয়ে কাজ করবে। ছেলেমেয়ের যদি অ্যান্ড্রয়েড ফোন থেকেও থাকে সে তো পড়াশুনার কাজে নিয়ে চলে যাবে। এ তো ২৪ ঘণ্টাই এই পোষণ ট্র‍্যাকার অ্যাপ নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। দেবেন বলে যে টাকা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকার ৮০০০ টাকা সেই টাকাতে মোবাইল কিন্তু হবে না। কিন্তু আমরা কিন্তু ছাড়ছি না, মোবাইল দিতে হবে তারপর আমরা এই কাজটি করব।এই পোষণ ট্র‍্যাকার অ্যাপ-এর কাজ করতে গিয়ে আমার অনেক দিদিরা হার্টফেল করেছে, তারা মারা গেছে, হঠাৎ অফিসে পরেই স্ট্রোক হয়ে গেছে। তাহলে এই যে একটি কর্মী মারা গেলেন, তার পরিবারটিকে কে দেখবে? আমরা দাবি তুলেছিলাম এই অ্যাপ-এর কারণে বা কর্মরত অবস্থায় যে দিদিরা মারা যাচ্ছে তাদের ৩ লক্ষ করে টাকা দিতে হবে অথবা পরিবারে কোনো মহিলা থাকলে তাকে চাকরিটা দিতে হবে কিন্তু সেই দাবিটা এখনো সরকার মানেননি। আবার পরিবারে মহিলা না থাকলে, শিশু থাকলে কি হবে? এই অবস্থায় কিন্তু লড়াইটা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।

 

এছাড়াও আবাস যোজনার কথাটা এখানে উঠে এসেছে। আশা এবং আইসিডিএস দু’জনকেই আবাস যোজনার দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। আমরা কেন আবাস যোজনার দায়িত্বটা নেব আপনারা বলুন তো! গ্রামে পঞ্চায়েত আছে, তারা ৫ বছর ধরে পঞ্চায়েত চালিয়েছেন, তাঁরা আবাস যোজনার দায়িত্বটা নিতে পারলেন না আর আমাদের দায়িত্বটা দিয়ে দিল। তার মানে মার খায় খাক আশা, আইসিডিএস-ই খাক,আমরা আমাদের পিঠ বাঁচিয়ে নেব। যাদের ঘর হওয়ার কথা হয়েছে, যাদের হওয়ার নয় তাদের আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন। যখন আমাদেরকে সার্ভে করতে পাঠাচ্ছেন তখনই বলছেন ওই আশা, আইসিডিএসরাই তোমাদের নামটা কেটে দিয়েছে। এরকম অবস্থায় আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন উত্তর ২৪ পরগনার রেবা বিশ্বাস মারা গেলেন। সে যখন সার্ভে করে বাড়ি ফিরে এসেছেন তার বাড়িতে এসে বারবার তাকে শাসানো হয়েছে — তুমি যদি আমার বাড়িটা না দাও, তুমি যদি আমার কথাটা না শোনো তাহলে তুমি এবং তোমার পরিবারের সবাইকে পিষে মেরে দেব। তাইতো রেবা বিশ্বাস মারা গেলেন।

 

তাহলে এরকম একটা অবস্থায় সরকার এই স্কিমগুলো নিয়ে কী ভাবছেন? ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে কিন্তু এতটুকু তিনি কিন্তু ভাবছেন না। এছাড়াও আপনারা সরকারের মাধ্যমে শুনেছেন, অঙ্গনওয়াড়ির ভিতরেও ওয়ান-টু’র ছেলেমেয়েদের ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, তাদেরকে পড়াতে হবে। নিশ্চয়ই আমাদের কর্মীরা পড়ানোর যোগ্যতা রাখে কিন্তু আমরাও দাবি তুলেছি আমাদের কর্মীদের শিক্ষকের মর্যাদা দিতে হবে। বর্তমান যা পরিস্থিতি আপনারা বুঝতেই পারছেন সরকার শিক্ষক নিয়োগ করতে পারছেন না। এই অঙ্গনওয়াড়িদের মাধ্যমেই সমস্ত কিছু কাজটা করিয়ে নেবেন। দিনের পর দিন এই সরকার আমাদের এইভবে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন, চোখে ঘুম থাকে না। কখনো রাত ৩টের সময় পোষণ ট্র‍্যাকার অ্যাপটা খোলে, তখন রাত জেগে আমাদের বসে থাকতে হয়।

 

তাহলে ভাবুন সরকার যে স্কিমটা এনেছেন লক্ষ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী যুক্ত আছেন, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১ লক্ষ ২৮ হাজার, তাঁদের নূন্যতম মজুরি দেওয়া হয় না। তাঁরা কিন্তু পড়াতে পারে, নার্সের ডিউটি করতে পারত, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারত কিন্তু পারেনি কেন, কারণ তখন ঢুকে পড়েছে, কাজ নেই এমন পরিস্থিতিতে। অঙ্গনওয়াড়ি স্কিমের ভিতর প্রত্যেক জায়গায় একটা করে সিডিপিও প্রয়োজন ছিল, কিন্তু নেই। প্রত্যেক জায়গায় ১০-১২ জন করে সুপাভাইজার প্রয়োজন ছিল সেখানে মাত্র ১-২ জন। এক জন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে ২-৩টে সেন্টারের চার্জ নিতে হয় ৫০ টাকার বিনিময়ে,ভাবতে পারেন! ৫০ টাকা একটা জায়গার গাড়ি খরচাতেই লেগে যায়। তাহলে এরকম অবস্থায় কেনো রিক্রুটমেন্ট নেই, রিক্রুটমেন্ট হোক। সহায়িকা দিদিরা নেই। ৮০০০ টাকার পরিবর্তে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদেরই টাকা দিয়ে রান্না করাতে হয়, হয় কারণ শিশু এবং মাদের খাদ্যের পরিষেবা যেটা আছে, সেটা তো দিতেই হবে। জ্বালানির উত্তরোত্তর কী দাম! সেখানে মাত্র ২৩ টাকা দেওয়া হয়। সরকার স্কিম তৈরি করেছেন,নকাজ দিয়েছেন কিন্তু তার কোনো সুষ্ঠু পরিষেবা দেননি। আর যাঁরা কর্মী তাঁদের পরিবারগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অসুস্থ হয়ে পড়ছে। দিদি বললেন আশা দিদিরা যেভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তেমনি করে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন,অনেকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে, অনেকে মারাও যাচ্ছেন। এরকম অবস্থায় কর্মরত কর্মীরা মারা গেলে আমরা দাবি তুলেছিলাম ৩ লক্ষ টাকা দেওয়া হোক। এখন রিটায়ার এর পর ৩ লক্ষ টাকার একটা ঘোষণা হয়েছে ২০২০র পরে, সেটা দিচ্ছেন কিন্তু এখন ৩ লক্ষ টাকার কোনো মূল্য নেই। আমরা চাইছি আমাদের সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হোক, সাথে পিএফ পেনশন, সাথে ২৬০০০ টাকাও [বেতন] দেওয়া হোক।

 

আমরা এই আন্দোলনটা চালিয়ে যাচ্ছি, শুধু এখানে নয়, সারা রাজ্যে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এই লড়াইটা চলছে। বিভিন্ন রাজ্যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা কিন্তু লড়াই করে তাদের দাবি আদায় করেছে। হরিয়ানা, দিল্লিতে রাজ্য সরকার বেশি টাকা দেয়, কেন্দ্রীয় সরকার সমান দেয়। ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার টাকা বাড়িয়েছিল, তারপর এই ২৩-সাল হল, একটি পয়সাও বাড়ায়নি। তাহলে এরকম একটা অবস্থায় লড়াই আন্দোলন ছাড়া আমাদের দাবি আদায় হবে না। সমস্ত জায়গায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের এই লড়াই আন্দোলনে যুক্ত হতে হবে। আজকে আপনারা যে আমাদের ডেকেছেন, খুবই ভালো লেগেছে। বাস্তবে এইভাবেই প্রতিদিন আমরা বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছি, পঞ্চায়েতে যারা মেম্বার আছে তারাও আমাদের হেনস্থা করছে। এছাড়াও এখানে যারা সাংবাদিকরা আছেন তাদের বলব আমরাও সংবাদমাধ্যমে লকডাউনের সময় বলি যখন রান্না বন্ধ হয়ে গেছিল। আমরাও সাংবাদিকদের জানাই একমাত্র রান্না করা গরম খাওয়ার চালু না হলে মা এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের পরিষেবা ঠিক রাখা যাবে না। তখন রান্না চালু হয়। সংবাদমাধ্যম আমাদের অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন তবুও বলব, যদি অঙ্গনওয়াড়ি স্কিম ওয়ার্কার্সদের কথা আরো একটু বেশি করে ভাবেন আরো ভালো হয়। আপনারাও ভাববেন,এরকম প্রোগ্রাম যদি ওনারা করেন, আমরা যোগ দিতে পারি, বিশেষভাবে আমাদের যে বঞ্চনার কথা তা সবার সামনে আসে, সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে যদি আলোচনা হয় তাহলে খুবই উপকৃত হব। সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে এই বলে আমার ছোট্ট বক্তব্য এখানেই শেষ করলাম।

 

রিনা নায়েক

উ: ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, আম্মা

নমস্কার, আমার নাম রিনা নায়েক। আমি আম্মা সংগঠন, দেগঙ্গা ব্লক থেকে আসছি। আমি মিড ডে মিল কর্মী। আমাদের মিড ডে মিলের কাজ চালু হয়েছিল ২০০৪ সালে। তখন খুবই কম মজুরি পেতাম। গাছতলায় খবরের কাগজ টাঙিয়ে রান্না শুরু করেছিলাম। এত কষ্ট করে কাজ করার পরও আমাদের চোর অপবাদ শুনতে হয়। আমরাই নাকি সব খাবার খেয়ে নিই, সঙ্গে করে নিয়ে চলে যাই! এই ধরনের নানান কটুকথা আমাদের শুনতে হয়েছে। গ্রামে এমন একটা পরিস্থিতিতে রান্না করছি দেখে অনেকেই এসে থালা বাজিয়েছে, ক্যান বাজিয়েছে, সেই সময় অত্যাচার সহ্য করার পরেও কাজটা করে গেছি। বাচ্চারা পটি করে ফেলত, প্রস্রাব করে ফেলত সেসবও আমাদের দায়িত্ব! ঝাড়ু দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার করার দায়িত্বও আমাদের দেওয়া হয়েছে! এই প্রবল গরমের মধ্যে আমাদের কাঠ জোগাড় করে কাঠের উনুনে রান্না করতে হয়। মিড ডে মিলে যে চাল দেওয়া হয় সেই চালের ভাত গলে হালুয়া হয়ে যায়, আবার একটু শক্ত রাখলেও বদনাম!

 

এইভাবেই কি আমাদের দিন যাবে? কোনও উন্নতিই কি হবে না? তখনই দাদা-দিদিরা [সমাজকর্মী] আমাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে। আমরা এর আগে তেমন কিছুই জানতাম না। আমাদের ব্লকে কতগুলি পঞ্চায়েত আছে তাও জানতাম না। ওরা আমাদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। তখন আমরা নিজেরা নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচা করে মিড ডে মিল কর্মীরা এক জায়গায় মিলিত হয়ে এই সংগঠনে যুক্ত হই। আমরা এরপর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মিড ডে মিল কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে এই আন্দোলনটা করছি। আমরা আমাদের যতটুকু সামর্থ্য কেউ দশ টাকা কেউ কুড়ি টাকা চাঁদা দিয়ে আপাতত এই আন্দোলনটা চালানোর চেষ্টা করছি। আমাদের কথাগুলো অটো, টোটো করে গিয়ে বিভিন্ন এলাকায় আমরা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। বারাসাত বিডিও অফিসে আমরা প্রচুর মিড ডে মিল কর্মীরা জড়ো হই, আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমরা সঠিক ভাবেই আন্দোলন করছি, সঠিক জায়গায় আঘাত করতে সক্ষম হয়েছি। বারবার কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো সত্ত্বেও আমরা জোটবদ্ধ হওয়া থেকে পিছিয়ে আসিনি। আমরা রবীন্দ্র ভবনে আলোচনা সভা করে আমাদের দাবি সনদ প্রস্তুত করি।

 

প্রথমত আমাদের বাচ্চাদের খাদ্যের জন্য বরাদ্দ অর্থ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত আমাদের কাজের তো কোনো স্বীকৃতি নেই, আমাদের কাজের স্বীকৃতি চাই, সম্মান চাই। বারো মাস কাজ করে দশ মাসের বেতন পাই, কখনও দশ টাকা কখনও পনেরো টাকা রোজে কাজ করি। একশো বাচ্চা পিছু দেড় হাজার টাকা! কোথাও একটু বেশি হলে তিন হাজার। আমরা এই কম বেতনেই কাজ করি। অনেক সময়ই মনে হয় ছেড়ে দিই, কিন্তু ভেবে দেখি আমাদের গ্রামেরই বাচ্চা সব, তাদের ছেড়ে চলে যাব! কাজ করতে করতে মায়া পড়ে গেছে। বেতন দেয় না বলে ছেড়ে চলে যাই না আমরা। এখন আমরা জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করছি। আগে আমাদের বেতন আমাদের নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া হত, কবে ও কীভাবে শিক্ষকদের অ্যাকাউন্টে চলে গেল, তা আমরা নিজেরাও জানি না। কত বেতন ঢুকছে, কবে বেতন ঢুকছে ইত্যাদি সমস্ত তথ্যও আমাদের কাছে অজানা। শিক্ষকরা যখন জানাবেন তখনই আমরা জানতে পারব।

 

আমরা আজকের সভায় সকলে আসতে পারিনি। আমি, কাকলি এবং খাদিজা আসতে পেরেছি আমাদের বাড়িটা স্টেশনের কাছাকাছি। বাকি আমাদের আরও অনেক মেয়েরা আছে, আমরা একসাথে আন্দোলন করি। আমরা বসিরহাটে বিডিও অফিসে ডেপুটেশন দিয়েছি। বাদুরিয়ায় ডেপুটেশন দিতে গিয়েছিলাম, সেখানে অফিসের কর্মীরা তালা মেরে দিয়েছিলেন। কীসের ভয় জানি না, আমাদের শক্তি দেখে হয়তো… হাড়োয়া ব্লকে আমাদের বলা হয়েছে, “তোমরা সাধারণ লোক, আমরা তোমাদের কথা শুনব না। আমরা কোনো চিঠি নেব না, বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমরা অন্য উপায় দেখে নেব”… এইসব বলে আমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও আমরা হাল ছাড়িনি। আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়েই লড়াই চালিয়ে যাব।

 

বাচ্চাদের খাবার দেওয়া হয় আলুর ঝোল আর গলা ভাত। আমরা খাওয়াতে পারি না। কোন বাচ্চা বলুন তো রোজ এই খাবার খাবে? আমরা চাই বাচ্চারা যাতে পুষ্টিকর খাবার পাক। অভিভাবকরা তো জানেন না, কীভাবে আমাদের খাওয়াতে হয়, সরকার কত কম টাকা দেয় খাওয়ানোর জন্য। আমরা বাচ্চাদের অভিভাবকদেরও বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা বাচ্চাদের খাদ্যের জন্য যেভাবে লড়াই করছি, আপনারাও আমাদের বেতনের জন্য লড়াইয়ে সামিল হন। অবশেষে আমরা আগামী ৩০ মে, কলকাতায় অভিভাবক এবং মিড ডে মিল কর্মীরা একত্রিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দিতে যাব।আমরা এটুকুই চাই যে বাচ্চাদের খাদ্য বরাদ্দ বাড়ুক, কুড়ি টাকার উপরে হলে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো যায়। সরকার সেটুকুই করুক। আমাদের বারো মাসের বেতনটা যেন আমরা পাই। যে বেতনে আমাদের সংসার ঠিকমতো চলতে পারে, সেই ন্যায্য বেতনটাই চাই। আপনাদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি আপনারাও সহযোগিতা করুন, আপনাদের সহযোগিতা পেলে আমরাও উৎসাহিত হব।

Share this
Leave a Comment