বিশ্ব বসুন্ধরা দিবস—ইতিহাস ফিরে দেখা


  • April 22, 2023
  • (0 Comments)
  • 1149 Views

২২ এপ্রিল, ২০২৩ ।  অনিমেষ দত্ত

 

আমাদের দেশ-সহ বর্তমানে গোটা পৃথিবীর মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নাজেহাল। ব্যাপক হারে বৃক্ষচ্ছেদন, অরণ্য ধ্বংস, জলাশয় বুজিয়ে ফেলা, বিশ্ব উষ্ণায়ন, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক লুণ্ঠন, যুদ্ধ সব মিলিয়ে প্রকৃতির সাথে মানুষের হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হওয়া আন্তসম্পর্ককে ঘেঁটে দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের থেকেও এখন অনেক বেশি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের কারণেই সমস্যা যত। অতিরিক্ত গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে কেউ নিদান নিচ্ছেন বাড়িতে এসি লাগানোর, কিংবা কেউ আবার বলছেন গাছ লাগান। তা পরিবেশ বইতে আমরা গাছ লাগানোর কথা পড়েছি, কিংবা নীতিকথামালায় গাছ আমাদের বন্ধু, গাছ কী কী করে তার লিস্টি মুখস্থ করেছি। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলছে। সেসব আলোচনা আপাতত তোলা থাক। এখন এই হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যেই আবার একটা ২২ এপ্রিল এসে পড়েছে। আজ ঈদ বটে, আজ রাশিয়ার বিপ্লবের নেতা লেনিনের জন্মদিন বটে, তার পাশাপাশি আজ বিশ্ব বসুন্ধরা দিবসও বটে। সেই বসুন্ধরা দিবসের ইতিহাস ফিরে দেখাই এ লেখার লক্ষ্য। ঠিক ভুলের বিচার কিংবা চুলচেরা বিশ্লেষণ পরে হবে, আপাতত নিপাট ইতিহাসে চোখ থাকুক।

 

বিশ্বের প্রথম বসুন্ধরা দিবস বা আর্থ ডে পালিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২২ এপ্রিল ১৯৭০ সালে।  আয়োজন করেন পরিবেশ কর্মীরা, নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন সেনেটর গেলর্ড নেলসন। বসুন্ধরা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও সুস্থায়ী উন্নয়নের পক্ষে প্রচার করা। প্রতি বছরই এই দিনটিতে বিশ্বব্যাপী একটি থিম থাকে। যেমন কোনও বার জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ুদূষণ, জল সংরক্ষণ, সুস্থায়ী কৃষি, জীববৈচিত্র্য, প্লাস্টিক দূষণ। এইদিন বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগানো হয়। বস্তুর পুনঃব্যবহার (recycling), কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো, এবং আরও নানান ইস্যুতে রাস্তায় নামেন পরিবেশপ্রেমীরা।

 

আমেরিকায় শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই ১৮০০ শতকের গোড়ার দিক থেকেই অরণ্য নিধন শুরু হয়। কয়লা থেকে তাপবিদ্যুৎ হয়ে ওঠে শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস। শুরু হয় দূষণ। এরপর নানান ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে (আপাতত সে আলোচনা মুলতুবি রাখা হচ্ছে) ১৮৯২ সালে জন ম্যুর এবং তার বন্ধুরা মিলে তৈরি করেন সিয়েরা ক্লাব (Sierra Club) যার উদ্দেশ্য ছিল, ‘do something for wildness and make the mountains glad’। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন, এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে আমেরিকায় পরিবেশ রক্ষার যাবতীয় কর্মকাণ্ড চাপা পড়ে যায়। পরিবর্তন আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। উত্তর আমেরিকা একটি কৃষি সমাজ থেকে রূপান্তরিত হয় শিল্পভিত্তিক সমাজে। যার ফল আবারও মাথা তুলে দাঁড়ায় পরিবেশ আন্দোলন।

নিউক্লিয় পরীক্ষা-নীরিক্ষার ফলে উদ্ভুত দূষণ, কারখানা থেকে বাতাসে নির্গত রাসায়নিক এবং ব্যাপক সংখ্যায় গাড়ি তৈরি ও রাস্তায় চলাচলের ফলে উদ্ভুত দূষণ, নদী ও লেকগুলির জল দূষিত হয়ে যাওয়া এবং কৃষিজমি ও অরণ্যের সংখ্যা কমতে থাকা সাধারণ আমেরিকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায়। এমনকি সেসময়ের একাডেমিকদের মধ্যেও দোলাচল সৃষ্টি হয়। জমিতে পেস্টিসাইডের বেপরোয়া ব্যবহারের ফলে পাখি, পতঙ্গ এবং অন্যান্য জীবেদের সংখ্যা কমতে থাকা সমস্ত কিছুই উঠে আসে র‍্যাচেল কার্সেনের লেখা “দ্য সাইলেন্ট স্প্রিং” বইতে। যা পরবর্তীতে জগদ্বিখ্যাত হয় এবং হাজার হাজার আমেরিকাবাসীর যেন চোখ খুলে দেয়! এই বইটির পাশাপাশি পল আরলিচের লেখা “দ্য পপুলেশন বম্ব” বইটিও একই ভাবে সাড়া ফেলে।

 

সেসময় আমেরিকার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। যুদ্ধের অন্যতম ফলাফল দূষণ, তার বিরুদ্ধেও আওয়াজ ওঠা শুরু হয়।  এই সমস্ত কিছুর ফলাফল স্বরূপ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডেমোক্র‍্যাটিক পার্টির কেনেডিও বাধ্য হন নিজেদের পলিসিতে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে। যার ফলাফল এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (EPA)। তৈরি হয় ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল পলিসি অ্যাক্ট (NEPA) যার মাধ্যমে সমস্ত ধরনের প্রকল্পকে Environmental Impact Assessment এর আওতায় আনা হয়। অবশেষে ১৯৬৯ সালে গেয়লর্ড নেলসন ডাক দেন দেশব্যাপী পরিবেশ রক্ষার, একটি বিশেষ দিন ধার্য করা হয় গোটা আমেরিকায় কর্মসূচি গ্রহণের জন্য। নেলসন বলেছিলেন, “The response was electric. It took off like gangbusters.”

 

এরপরে ১৯৭০ সালে ২২ এপ্রিল প্রথমবার বসুন্ধরা দিবস পালিত হয়। সেইদিন গোটা আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে কয়েক হাজার মানুষ মিছিল, সঙ্গীতানুষ্ঠান, বক্তৃতা এমনকি মেলার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার ডাক দেয়। প্রাথমিক ভাবে স্কুল কলেজে “টিচ-ইন” অর্থাৎ পরিবেশ শিক্ষার জায়গা থেকে এই উদ্যোগ শুরু হলেও পরবর্তীতে এই উদ্যোগ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। অনেকের মতে সেদিন প্রায় দু-কোটির কাছাকাছি মানুষ সামিল হয় যা তখনকার আমেরিকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০%। সেইদিনের একটি বক্তৃতায় নেলসন বলেন, “Our goal is an environment of decency, quality, and mutual respect for all other human creatures and for all living creatures.”

 

এই আন্দোলনের ফল ছিল আমেরিকার পরিবেশ সংক্রান্ত নতুন অনেকগুলি আইন প্রণয়ন হওয়া, পুরনো বেশ কিছু আইনের বদল। মার্কিন কংগ্রেসে এর কয়েক বছরের মধ্যেই—The Clean Air Act, The Water Quality Improvement Act, The Water Pollution and Control Act Amendments, The Resource Recovery Act, The Resource Conservation and Recovery Act, The Toxic Substances Control Act, the Occupational Safety and Health Act, The Federal Environmental Pesticide Control Act, The Endangered Species Act, The Safe Drinking Water Act, The Federal Land Policy and Management Act, The Surface Mining Control and Reclamation Act-গুলি বলবৎ করা হয়।

 

এরপর ১৯৯০ সালে বসুন্ধরা দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। প্রায় ১৪০টি দেশের ২০ কোটি মানুষ সামিল হন। এই দিনটিতে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন সেনেটর নেলসনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রদেয় সর্বোচ্চ পুরষ্কার “প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম” প্রদান করেন বসুন্ধরা দিবসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। ধারাবাহিক ভাবে প্রতিবছর এই দিনটিতেই বসুন্ধরা দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্ব বসুন্ধরা সম্মেলন বা আর্থ সামিটের পর একুশ শতকেও একই ভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য সমস্ত দেশেই নানান কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ বর্তমান পৃথিবীর পরিবেশগত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার সমাধান করতে রাষ্ট্র নেতাদের চাপ দেওয়ার কাজ করে চলেছে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, পরিবেশপ্রেমী তথা সাধারণ মানুষেরা। প্রতি বছরই বসুন্ধরা দিবসের কর্মসূচিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন দাবি। যা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব পরবর্তী লেখাগুলিতে।

 

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও বসুন্ধরা দিবস পালন করা হবে বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে। এ বছরের থিম ‘Invest in our Planet।’ বসুন্ধরা দিবস আয়োজক সংস্থা Earth Day Network (বা EDN) গত বছর অক্টোবর মাসে ওয়াশিংটনের দপ্তরে ঘোষণা করে ২০২৩ সালের ২২ এপ্রিল বসুন্ধরা দিবসের থিম। ইডিএন-এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইট EARTHDAY.ORG যার প্রেসিডেন্ট ক্যাথলিন রজার্স গত বছর অক্টোবর মাসে জানিয়েছেন, “In 2023 we must come together again in partnership for the planet. Businesses, governments, and civil society are equally responsible for taking action against the climate crisis and lighting the spark to accelerate change towards a green, prosperous, and equitable future. We must join together in our fight for the green revolution, and for the health of future generations. The time is now to Invest In Our Planet.”

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এই বসুন্ধরা দিবসের উদ্ভব, তার সাথে আজকের বাস্তবতার মিল নেই। আবার কিছু ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংসসাধনের বিপ্রতীপে বর্তমান সময়ের পরিবেশ দর্শন নিজেকে জারিত করতে অনেক কিছু উপাদান পাবে ইতিহাস থেকে। সেই ইতিহাসের চর্চা ব্যতিরেকে আজকের বাস্তবতাকে বোঝা সম্ভব নয়। পরিবেশ প্রকৃতি মার্কিন মুলুকের সীমানা মানে না। সে ছড়িয়ে ছিল নিজের নিয়মেই, আজও আছে। শুধুমাত্র ইতিহাস স্মরণ করিয়ে থেমে গেলে পরিবেশ রক্ষার কাজও থেমে যাবে। তাই প্রয়োজন তুল্যমূল্য আলোচনা। আপাতত গোটা পৃথিবী পালন করছে ধরিত্রী দিবস, অনেক প্রশ্নই উঠবে আজ, কিছু প্রশ্ন ১৯৭০ সালের আজকের দিনটার সঙ্গে মিলে যাবে। অনেক প্রশ্নই নতুন।

 

তথ্যসূত্র : New York Times, Earth Day Network, Times Of India

 

Feature Image Courtesy Sybylla Climate on Unsplash

Share this
Leave a Comment