আরএসএস-বিজেপি’র ‘হিন্দু বাঙালিয়ানা’, গৌড়রাজ শশাঙ্কের নামে বঙ্গাব্দের বিকৃতি 


  • April 14, 2023
  • (0 Comments)
  • 1150 Views

বঙ্গাব্দ নিয়ে শুরু হয়েছে আরও এক বিতর্ক। যেখানে সাংগঠনিক ভাবে প্রধান ভূমিকা নিয়ে চলেছে  ‘বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ’। … ২০১৯ সাল থেকেই ‘বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ’ এই মত প্রচার ও প্রসারে বেশ তৈরি হয়ে নেমেছে। তারা নিজেদের আরএসএস-এর অনুসারী সংগঠন বলেই দাবি করে। হতেই পারে যে, বিক্রম সংবৎ বা হিন্দু নববর্ষ হালে পানি না পাওয়ায় আরএসএস বাংলায় আরও একটি শাখা খুলেছে। যার লক্ষ্য হবে ‘হিন্দুত্ববাদী বাঙালিয়ানা’কে তুলে ধরা। বাংলায় ইতিমধ্যেই আরএসএস-বিজেপি তাদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাড়াবাড়ি রকমের হিন্দি-গুজরাতি-মারাঠি প্রভাব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে ঘরে-বাইরে সমালোচিত হচ্ছে। তাই-কি বাঙালিয়ানার ভেক ধরতে এবং সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে এই সংস্কৃতি পরিষদের উদ্ভব? প্রশ্ন তুললেন দেবাশিস আইচ

 

এই তো বছর ছয়েক আগে শোনা গেল আরএসএস ‘নববর্ষ’ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গেও বিক্রম সংবৎ অনুসারে ‘হিন্দু নববর্ষ’ পালন করছে। এবং তাদের দাবি অনুসারে চার-পাঁচ বছর আগে থেকেই এ রাজ্যে ‘হিন্দুত্ববাদী’ শিবির এই কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। আরও জানা গেল, ২০১৮ সাল থেকে নাকি এই বিক্রম সংবৎ পালনে বাঙালির আগ্রহ বেড়েছে। তার প্রত্যক্ষ ছাপও দেখা গেল মারোয়ারি-গুজরাতি অধ্যুষিত লেকটাউন-ভিআইপি মোড়ের ফুটপাতের রেলিংয়ে। ছোট ছোট বোর্ডে—‘স্বাগত বিক্রমাব্দ-২০১৫’ ছাপা পোস্টার ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গেই রয়েছে রামনবমী পালনের আবেদনও। এটা ২০১৮ সালের কথা।

 

এই সেই সময় আরএসএস বাংলার আকাশে তার শিকারি ডানা সম্পূর্ণ ভাবে মেলে ধরেছে। পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়ে গিয়েছে ‘মিশন বেঙ্গল’। ২০১৭ সালে রামনবমীর দিন সারা রাজ্যকে চমকে দিল আরএসএস-এর শাখা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল, হিন্দ জাগরণ মঞ্চের মতো সংগঠনগুলি। সারা রাজ্য জুড়ে প্রতিটি জেলা শহরে লাঠিসোঁটা তো বটেই, খোলা তলোয়ার, ত্রিশূল, রাম দায়ের মতো শাণিত অস্ত্র নিয়ে সে এক মহাতাণ্ডব মিছিল। বাইক বাহিনী, পদাতিক বাহিনী, রথারূঢ় দেবতা বাহিনী, উন্মাদ নাচ আর বিজাতীয় গান-স্লোগানে আকাশ-বাতাস ফাটানো ডিজে বাহিনী বিশেষ ভাবে দখল নিয়ে নিল রাজ্যের সমস্ত শিল্পাঞ্চল এবং শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ, মালদহ, বহরমপুর, শ্রীরামপুর, চন্দননগরের মতো শহর এবং অবশ্যই মহানগরী কলকাতা। এমন রামনবমী বাংলা ও বাঙালি কস্মিনকালেও দেখেনি। ২০১৮ সালে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো হবে আসানসোলে, ভাটপাড়ায়। ২০১৭ সালেও সীমিত আকারে হলেও এমন হিংসা ছড়িয়েছিল পাণ্ডবেশ্বরে। যদিও ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে নিয়মিত সাম্প্রদায়িক হিংসা, ঘরবাড়ি, দোকান-পাট ভাঙচুর, লুঠপাট, আগুন লাগানো একরকম বাৎসরিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। ২০২২ সালেও তার পুনরাবৃত্তি হয় হাওড়া, বাঁকুড়ায়। ২০২৩ সালে সেই ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে ফের আরও একবার সাম্প্রদায়িক হিংসায় জ্বলে উঠল পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৭-১৮ সালের এই ঘৃণার যাত্রাপথের প্রধান লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। কেননা ২০১৮ সালে যেমন ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০১৯ সালে ছিল লোকসভার নির্বাচন। আর কে না জানে দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হিংসার মতো আর কোনও কিছুই অতি দ্রততার সঙ্গে রাম-রহিমে মধ্যে চূড়ান্ত মেরুকরণ ঘটাতে পারে না। এবারও সামনে নির্বাচন।

 

২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি মাত্র ৪% ভোট পেয়েছিল। ২০১৬ সালে পেয়েছিল ৩টি আসন। ২০১৭ সালে আরএসএস-এর ‘মিশন বেঙ্গল’-এর লক্ষ্য ছিল ২০১৯ সালে এ রাজ্য থেকে যথাসম্ভব বেশি লোকসভার আসন ছিনিয়ে নেওয়া। বিজেপি-র ঘোষিত লক্ষ্য ছিল—উনিশে হাফ, একুশে সাফ। আর এই লক্ষ্যেই যাবতীয় শাখা সংগঠনকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল আরএসএস। লোকসভায় সে বার ১৮টি আসন ও ৪০% ভোট পেয়েছিল বিজেপি। রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী যদি আরএসএস-এর জঙ্গি কার্যকলাপের অংশ হয় তবে বৌদ্ধিক- সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের অংশ হল—বাঙালির ধর্মীয়, সামাজিক সংস্কৃতির শিকড় ধরে টান মারো। তাদের আচার-বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলো, ঘেঁটে দাও। প্রভাব খাটাও রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ভারত সেবাশ্রমের মতো বাঙালি প্রধান মঠ-মিশনে। পাড়ায় পাড়ায়, ফুটপাতের মন্দিরগুলোকেও ছাড় নয়। মার্বেল পাথর বা টাইলস দিয়ে সেগুলি সাজিয়ে-গুছিয়ে দাও। বিনিময়ে ফুটপাথে বা বট বা অশত্থতলা, হাসপাতালের গেটে, রাস্তার মোড়ে গজিয়ে ওঠা শিব-শনি-শেতলার সঙ্গে যেন বিরাজ করে রাম-হনুমানের মূর্তি বা ছবি। আর যেন উড়তে থাকে যুদ্ধংদেহী রাম কিংবা হনুমানের ক্রূর মুখের ছবি আঁকা গেরুয়া ধ্বজা। আদিবাসী অঞ্চলে অন্য ছবি। একে তো হিন্দুত্ববাদীদের বয়ানে বলা হয় বনবাসী—আদিবাসীদের আদিবাসিন্দা মানলে আর্যরাই যে আদি সেই তত্ত্ব ঘেঁটে যায়—তো ‘বনবাসী’দের ধর্মস্থানগুলোতে, ‘সেক্রিড গ্রোভ’ বা পবিত্র কুঞ্জবনে এই-সেই মূর্তি বসিয়ে তারা যে হিন্দু তা প্রমাণ কর। দুর্গাপুজোর সময় কেন মুরগি-মাটন খাওয়া হবে, কেন রোল বা বিরিয়ানি এই নিয়ে লাগাও দ্বন্দ্ব। পুজো সাহিত্যের প্রচ্ছদে কেন দুর্গার ছবি তেমন দেবীসুলভ নয়, কেন মুসলমান আঁকবে দুর্গাপ্রতিমার চিত্র—তা নিয়ে শোর মাচিয়ে দাও সমাজমাধ্যমে।

 

বিগত কয়েক বছর ধরেই হিন্দুত্ববাদীদের টার্গেট ১ বৈশাখ বা বাঙালির নববর্ষ। সারা দেশের ক্ষেত্রেই আরএসএস রাজা বিক্রমাদিত্য প্রবর্তিত চান্দ্র অব্দ বিক্রম সংবৎ-কে ‘হিন্দু নববর্ষ’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। এ রাজ্যেও তার প্রচার রয়েছে। তবে বিক্রম সংবৎ বাঙালি তেমন খায়নি বলেই মনে হয়। ২০২১ সালে তৎকালীন বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ সে বছর (১৪২৭ বঙ্গাব্দ) বাংলা নববর্ষের দিন সমাজমাধ্যমে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে লিখলেন, “সকলকে জানাই হিন্দু নববর্ষের শুভেচ্ছা।” এই নিয়ে নববর্ষকে হিন্দু-মুসলমানে সাম্প্রদায়িক ভাগ বাঁটোয়ারা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠতেই দিলীপ ঘোষ তার উত্তরে জানান, “আমি বিক্রম সংবৎ অনুসারে হিন্দু নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছি। বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাইনি। সেই জন্যই বিক্রম সংবৎ অনুসারে হিন্দু নববর্ষের দিন ১৩ এপ্রিল পোস্ট করেছি।” এই বিতর্ক চাপা পড়লেও বঙ্গাব্দ নিয়ে শুরু হয়েছে আরও এক বিতর্ক। যেখানে সাংগঠনিক ভাবে প্রধান ভূমিকা নিয়ে চলেছে ‘বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ’। তাদের দাবি, “আকবর  বা তার প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহি নয়, বঙ্গাব্দের প্রবর্তক গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক”— যদিও এমন একটি প্রচার, ক্ষুদ্র হলেও একটি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বেশ কিছুকাল করে আসছে। হিন্দুত্ববাদীদের রমরমার এই যুগে বিগত সাত-আট বছর সমাজমাধ্যমে, অনলাইন পোর্টালে এই মত প্রচারের জন্য রাতারাতি কিছু ঐতিহাসিক, পুরাণবিদেরও উদ্ভব হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকেই ‘বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ’ এই মত প্রচার ও প্রসারে বেশ তৈরি হয়ে নেমেছে। হতেই পারে বিক্রম সংবৎ বা হিন্দু নববর্ষ হালে পানি না পাওয়ায় আরএসএস বাংলায় আরও একটি শাখা খুলেছে। যার লক্ষ্য হবে ‘হিন্দুত্ববাদী বাঙালিয়ানা’কে তুলে ধরা। বাংলায় ইতিমধ্যে আরএসএস-বিজেপি তাদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাড়াবাড়ি রকমের হিন্দি-গুজরাতি-মারাঠি প্রভাব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে ঘরে-বাইরে সমালোচিত হচ্ছে। তাই-কি বাঙালিয়ানার ভেক ধরতে এবং সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে এই সংস্কৃতি পরিষদের উদ্ভব?

 

বিগত কয়েক বছর, বিশেষ ভাবে ২০১৭ সাল থেকে রামনবমীকে কেন্দ্র করে হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি আস্ফালন এবং মোল্লতন্ত্রের প্রভাবে ধূলাগড়-চন্দননগর-হাজিনগর (২০১৬), কালিয়াচক (২০১৬), বসিরহাট-বাদুড়িয়ায় (২০১৭) সাম্প্রদায়িক হিংসা; আসানসোল-ভাটপাড়ায় (২০১৮) রামনবমীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা, দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। এবং হিংসা প্রতিরোধ ও প্রশমনে রাজ্য সরকার ও শাসক দলের শুধু ব্যর্থতাই নয়, কার্যত আত্মসমর্পণ নাগরিক সমাজকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল। তারই প্রত্যুত্তরে, প্রতিস্পর্ধী এক বয়ান তৈরি  করতে ১ বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ ঘিরে গড়ে ওঠা ধর্মনিরপেক্ষ সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেছিল নাগরিক সমাজ। যদিও, বঙ্গাব্দের চতুর্দশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ১৪০০ সালে নববর্ষ পালন, ভাষা শহিদ বেদী স্থাপনের মধ্যে দিয়ে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযানের শুরু হয়। সেই সময়ের প্রেক্ষিত ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংস, দেশ জোড়া দাঙ্গা। যার অনেকটা রেশ ধরে রেখেছে ‘ভাষা ও চেতনা সমিতি’র বৈশাখী শোভাযাত্রা। ২৫ বছর ধরে সমিতি এই নববর্ষ উৎসব পালন করে চলেছে। দক্ষিণ কলকাতার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ও এই লক্ষ্যে আরও এক উল্লেখযোগ্য আয়োজন। পাশাপাশি, রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলা নববর্ষ পালন এক উৎসবের চেহারা নিয়েছে। বিগত তিন বছর ধরে ‘বাংলা ভাবনা পরিক্রমা’ জোড়াসাঁকো থেকে ১ বৈশাখ এমনই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে চলেছে।

 

বসে নেই হিন্দুত্ববাদীরাও তারা এ বছর খোদ কলকাতায়, কলকাতার অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র অ্যাকাদেমি অব ফাইন আর্টস’ চত্বরেই পয়লা বৈশাখ পালন করতে চলেছে। যাদের শোভাযাত্রায় থাকবে শশাঙ্ক নামাঙ্কিত ট্যাবলো। ২০২২ সালে নববর্ষ উপলক্ষ্যে অর্থাৎ ১৪২৮ বঙ্গাব্দে, পরিষদ কলকাতার সল্টলেকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংস্কৃতিক শাখা আইসিসিআর-এ ‘শশাঙ্ক থেকে বর্তমান’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। এবার তারা শোভাযাত্রা নিয়ে পথে নামছে। কিন্তু, যে স্থানে তারা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে বলে জানিয়েছে, অর্থাৎ অ্যাকাদেমি অব ফাইন আর্টস চত্বর ও রাণুচ্ছায়া মঞ্চ, সেখানেই তো গত প্রায় দু’দশক ধরে সকাল থেকে সন্ধে নববর্ষ পালন করে আসছে ‘ভাষা ও চেতনা সমিতি। প্রশ্ন উঠছে এই অনুমতি পরিষদ পেল কী করে? এও কি আরও এক ধর্মীয় তোষণ?

 

শশাঙ্কের বঙ্গাব্দের প্রবর্তনা বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রাক্তন অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানান, “তিনি [শশাঙ্ক] যদি অব্দ জারি করেই থাকবেন তা হলে তো এই দানে [তাম্রশাসনে অন্তত পাঁচটি নিষ্কর ভূমিদানের উল্লেখ] সেই অব্দের উল্লেখ থাকত। কিন্তু কোথাও তা নেই। এমনকি তাঁর অধীনস্থ রাজাদের ভূসম্পদ দানের ক্ষেত্রেও গুপ্তাব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার থেকে শুরু করে কোনও পেশাদার ইতিহাসবিদ শশাঙ্কের সময় থেকে বঙ্গাব্দের সূচনার কথা লেখেননি। তবুও, অনেক দিন থেকে কেউ কেউ এটা বলার চেষ্টা করছেন। ওঁরা সূর্যসিদ্ধান্ত নামে এক প্রাচীন গ্রন্থের ভিত্তিতে এই দাবি করার চেষ্টা করেন। কিন্ত, শশাঙ্কের রাজত্বকালের সঙ্গে সূর্যসিদ্ধান্ত বইটির সময়কালের মিল নেই। সুতরাং এই দাবি অমূলক।” (বঙ্গাব্দ তুমি কার, হিন্দুত্বের নয়া তাস, অগ্নি রায়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ এপ্রিল  ২০২৩।)

 

এখন আমরা বাংলা সন, সাল, তারিখের হিসাবটা দেখে নিতে পারি। এর সঙ্গে সঙ্গে এ তথ্যটুকুও জেনে নেওয়া যাক, সাল শব্দটি এসেছে ফারসি থেকে। সন শব্দটি আরবি এবং তারিখ শব্দটিও এসেছে আরবি থেকে।

 

মোঘল আমলে বাদশাহদের ধর্ম অনুসারে চালু হয়েছিল হিজরি সন। আবার ভারতের বিভিন্ন প্রধান প্রধান জাতি-গোষ্ঠীগুলির ছিল নিজস্ব ক্যালেন্ডার, সংবৎ বা দিনক্ষণ, বছর গণনার নিজস্ব বর্ষপঞ্জিকা। হিজরির সঙ্গে তা মেলে না। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণও তার সঙ্গে খাপ খায় না। বাদশা জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবরও লক্ষ করলেন হিজরি সন অনুযায়ী দেশ শাসন চলে না। ঋতু মেলে না, ফসল ফলা, ফসল তোলার সময় মেলে না। ফলত রাজস্ব আদায়, শুল্ক আদায়ে বেজায় গোলমাল বাঁধে। এমন সঙ্কটে ডাক পড়ল মোঘল দরবারের রাজ জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ শিরাজির। হিজরি আর শকাব্দের সংমিশ্রণে সৌরভিত্তিক এক বর্ষগণনা পদ্ধতি তিনি তৈরি করেন। সেটিই আজ বঙ্গাব্দ। আকবর যেমন ভারতের নানা ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধাবশত এক সমন্বয়ী ও সমান্তরাল ধর্ম দীন-ই-ইলাহি প্রবর্তন করেছিলেন, সেই ট্র্যাডিশন অনুসারেই তাঁর আমলে প্রবর্তিত হয় তারিখ-ই-ইলাহি বা আল্লাহ্‌র দিনপঞ্জি (সেন, আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান)। এই দিনপঞ্জি প্রবর্তন করার পিছনে আকবরকে ধর্ম বা ধর্মীয় তন্ত্রের চেয়ে ঢের বেশি প্রভাবিত করেছিল অন্য আর এক মস্ত চাহিদা। সেটি হল—কর আদায় অর্থাৎ অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং দায়দায়িত্ব (কুণাল চক্রবর্তী ও শুভ্রা চক্রবর্তী, হিস্টরিকাল ডিকশনারি অব বেঙ্গলিজ)।

 

তো শিরাজির চান্দ্র-সৌর সমন্বয়ী সনের হিসাবটি সরল করে বলা যাক। আকবরের সিংহাসন আরোহণ করেছিলেন ৯৬৩ হিজরি সনে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ। এই অভিষেকের বছর ধরেই বর্ষ শুরু হয়েছিল। অঙ্কটা এরকম, আকবরের সিহাংসনে আরোহণের ইসলামি বছর (৯৬৩)+বর্তমান সৌর বছর (২০২৩)-আকবরের অভিষেকের সৌর বছর (১৫৫৬) = ১৪৩০। বর্তমান বাংলা সন বা নববর্ষ।

 

সংবৎ, সাল, অব্দ রাজা-বাদশার সিংহাসনে আরোহণ, যুদ্ধজয় করে ক্ষমতা দখল মতো ঘটনাকে ভিত্তি করেই সাধারণত প্রবর্তিত হয়ে এসেছে। হিজরি বা ইসলামি বর্ষ বা অব্দ গণনার শুরু হজরত মহম্মদের মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গমনের দিন থেকে। এই হিজরি শব্দটি এসেছে হিজরত থেকে। যার অর্থ ধর্মরক্ষা বা প্রচারের জন্য দেশত্যাগ। হজরত মহম্মদ ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলে তৎকালীন মক্কাবাসীদের প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হন। মক্কাবাসীরা তাদের প্রাচীন ধর্ম রক্ষা করার জন্য মহম্মদ এবং তাঁর অনুরাগীদের উপর নানা অত্যাচার শুরু করে। তাঁর প্রাণ সংশয় দেখা দিলে ৬২২ খিস্টাব্দে তিনি সপরিবারে ও সদলে মক্কা ত্যাগ করেন এবং মদিনায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই যাত্রাকেই বলে হিজরত।

 

১৯৯৮ সালের ২০ অগস্ট অধ্যাপক অমর্ত্য সেন নয়া দিল্লিতে ‘দি অ্যাসেসমেন্ট অব দ্য মিলেনিয়াম’ শীর্ষক এক সেমিনারে দেশের সমন্বয়ী সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন, “এক জন বাঙালি হিন্দু যখন বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করছেন, তখন তিনি বোধহয় পুরোপুরি জানেনও না যে, হিন্দু আচার অনুশীলনের প্রার্থিত ওই তারিখটির সঙ্গে মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাওয়ার স্মৃতি একই তারে বাঁধা আছে। যদিও তা এক চান্দ্র-সৌর মিশ্রিত প্রতিরূপ।”

 

হিন্দু-মুসলমানের এই মিশ্র সংস্কৃতি, এই যুক্ত সাধনা এক ধর্ম, এক দেশ, এক ভাষার প্রবক্তা হিন্দুত্ববাদীদের দু’চোখের বিষ। তারা দেশ জুড়ে এই বিষ ছড়িয়ে চলেছে। সে কখনও রামের নামে তো কখনও হনুমানবৃত্তিতে। কখনও ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে মোঘল সাম্রাজ্য থেকে মহাত্মা গান্ধীর নাম মুছে দিয়ে। আবার কখনও বা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হিসাবে শৈব রাজা শশাঙ্ককে আমদানি করে। লক্ষ্য একটাই ভারতে একটি সংখ্যাগুরুবাদী, সর্বগ্রাসী হিন্দু ধর্মীয় ফ্যাসিস্তরাজ প্রতিষ্ঠা করা।

 

ঋণস্বীকার : শশাঙ্কের তাম্রশাসনের চিত্র সুধীর রঞ্জন দাস, কর্ণসুবর্ণ-মহানগরী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষৎ, ১৯৯২ গ্রন্থটি থেকে গৃহীত।

 

Share this
Leave a Comment