ঘৃণার যাত্রাপথ: ধর্মীয় শোভাযাত্রা যখন দাঙ্গা বাঁধানোর অস্ত্র


  • April 7, 2023
  • (0 Comments)
  • 911 Views

“এ রিপোর্ট বাই সিটিজেন অ্যান্ড লইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ, রুটস অফ র‍থ্ (Routes of Wrath), ওয়েপনাইজিং রিলিজিয়াস প্রসেশন, কমিউনাল ভায়োলেন্স ডিউরিং রামনবমী অ্যান্ড হনুমান জয়ন্তী (এপ্রিল ২০২২)” শীর্ষক এই রিপোর্টে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে দাঙ্গা বাঁধে, বলা যাক বাঁধানো হয়; দাঙ্গার নেপথ্যভূমি কী, পুলিশ-প্রশাসনই-বা কী ভূমিকা নেয়, কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি আর মিডিয়াই-বা কী ভূমিকা পালন করে। রিপোর্টটি পড়ে দেখলেন দেবাশিস আইচ

 

রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী— আরএসএস এবং তার হিন্দুত্ববাদী শাখা সংগঠনগুলির উদ্যোগে মুসলমান বিরোধিতার এক ভয়ঙ্কর শাণিত অস্ত্র। মুসলমানদের আক্রমণের লক্ষ্যে এক ঘৃণার শোভাযাত্রা। যে শোভাযাত্রার রঙ গেরুয়া। যে রং আবহমানকাল ধরে ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রতীক। যে রং ভারতের জাতীয় পতাকার অঙ্গ। সেই গেরুয়া আজ ঘৃণা, বিদ্বেষ, ভয়, ধ্বংস, দাঙ্গা, হত্যা, বুলডোজারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে শোভাযাত্রায় তারস্বরে বাজতে থাকে  থকথকে ঘৃণা মেশানো কলি। ঘৃণ্য ভাষণ। ঘৃণ্য স্লোগান। সেই গানের কলি, সেই ভাষণ ও স্লোগানে গলা মেলায়, গলা চড়ায়, ধুয়ো দেয় দলাদলা উন্মত্ত যুবক-যুবতী। উন্মাদ-তাণ্ডব নাচ নাচে। তাদের হাতে হাতে নাচে যুগপৎ ধারালো অস্ত্র ও শস্ত্র, লাঠিসোঁটা, আগ্নেয়াস্ত্রও। শোভাযাত্রায় শুধু ঘৃণার বারুদ ভরা শব্দই মজুত থাকে না জারিকেন ভরা সহজদাহ্য জ্বালানিও থাকে।

 

এ রামের জন্মোৎসব পালন নয়। কোথায় রামনবমীর দিন ধার্মিক হিন্দুদের আদি দেবতা সূর্যকে জলদান? কোথায় অধর্মের বিনাশ আর শুভশক্তির জয় আকাঙ্ক্ষায় রামপুজো, উপবাস, বৈদিক মন্ত্র, রাম কাহিনি পাঠ! কোথায় রামভজন! প্রকৃত ধর্মপ্রাণ হিন্দুও এই ধর্মোন্মাদদের চরম অধর্ম আর অশুভ পরধর্ম বিদ্বেষে শিউরে উঠছে।

 

কোনও সরকার যদি সংবিধানের প্রস্তাবনা মানে, সংবিধানের মৌলিক অধিকার, নাগরিকের কর্তব্য মানে, আইনসভা, আইন মানে; সমঅধিকারে সংখ্যালঘুর বাঁচার, বেঁচে থাকার, ধর্ম পালনের অধিকার মানে তাহলে কোনও ভাবেই এই ঘৃণার শোভাযাত্রার অনুমতি দিতে পারে  না। দেশের আলপথ থেকে রাজপথ, গলিগলা, ঘেটো-ঝুপড়ি-বস্তি, মহল্লার পর মহল্লা তুলে দিতে পারে না আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ আর আরও হরেক কিসিমের হিন্দুত্ববাদী জঙ্গিদের হাতে। এ যদি রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ না হয়, তবে সন্ত্রাসবাদ কী?

 

এ কথাগুলো হাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে বলা নয়। আর এমনটাও নয় যে, এই প্রথম হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি পুলিশ-প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দল বা সরকারের মদতে একের পর এক সংখ্যালঘু বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত করে চলেছে। এ বছরই (মার্চ, ২০২৩), ২০২২ সালে ১৩টি  রাজ্যে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীকে উপলক্ষ্য করে ঘটিয়ে তোলা মুসলমান বিরোধী দাঙ্গাগুলোর উপর একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। যে রিপোর্টের মুখবন্ধ লিখেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রোহিন্টন এফ. নরিম্যান। “এ রিপোর্ট বাই সিটিজেন অ্যান্ড লইয়ার্স  ইনিশিয়েটিভ, রুটস অফ র‍থ্ (Routes of Wrath), ওয়েপনাইজিং রিলিজিয়াস প্রসেশন, কমিউনাল ভায়োলেন্স ডিউরিং রামনবমী অ্যান্ড হনুমান জয়ন্তী (এপ্রিল ২০২২)” শীর্ষক এই রিপোর্টে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে দাঙ্গা বাঁধে, বলা যাক বাঁধানো হয়; দাঙ্গার নেপথ্যভূমি কী, পুলিশ-প্রশাসনই-বা কী ভূমিকা নেয়, কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সব্চেয়ে বেশি আর মিডিয়াই-বা কী ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে চারটি রাজ্যে—গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি ও উত্তরাখণ্ডে—আক্রান্তদের শেষ সম্বলটুকুও ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসন-পুলিশ বুলডোজার নামায়। শুধু ২০২২ নয়, প্রস্তাবনা অংশে রিপোর্টটির সম্পাদক, সিনিয়র অ্যাডভোকেট চন্দর উদয় সিং  অতীতের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে দেখিয়েছেন, বিগত ৭৫ বছরে স্বাধীন ভারতে ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে দাঙ্গা বাঁধানোর অস্ত্র হিসাবে বারবার ব্যবহার করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। ১৭৬ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টটির শেষ পরিচ্ছদ ‘ইনসাইটস’-এ ওই ১৩ রাজ্যের প্রেক্ষিতে দাঙ্গার প্ররোচনার বৈশিষ্ট্য, সংখ্যাগুরু জনতাকে এক জোট করার রণকৌশল এবং আইন-আদালত উপেক্ষা করে দাঙ্গাহাঙ্গামার প্রত্যুত্তরে পুলিশ-প্রশাসন-পুরসভাগুলির যৌথ শাস্তিবিধানের ভূমিকার দিকেও আঙুল তোলা হয়েছে।

 

প্রস্তাবনা

ঔপনিবেশিক সময়ে ১৮৬০ সালে প্রথম ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধি চালু হয়। তার ১৮৮ ধারায় বলা হয়েছে, প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট রাস্তা ছাড়া ধর্মীয় শোভাযাত্রা, মিছিল করলে, এবং তার জন্য যদি দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে, যারা জেনেবুঝে ওই রাস্তায় মিছিল  করেছে তা্রা ঐ ধারা মোতাবেক অপরাধী। ১৫৩ ধারায় বলা হয়েছে, দাঙ্গা ঘটানোর জন্য  প্ররোচনা দেওয়া হলে ৬ মাস জেল এবং সেই প্ররোচনার ফলে দাঙ্গা ঘটলে এক বছরের কারাদণ্ড হবে। অর্থাৎ, আইন প্রবর্তনের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় আমাদের দেশে ধর্মীয় মিছিল থেকে প্ররোচনা ছড়িয়ে দাঙ্গা ঘটানোর কাজটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। স্বাধীনতা উত্তরকালে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন সরকারের আমলে ধর্মীয় মিছিল ঘিরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে সাম্প্রদায়িকভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়া এবং প্ররোচনা বা উস্কানি দেওয়ার কারণেই। সংবেদনশীল এলাকা দিয়ে মিছিলের রাস্তা নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসনের দুর্বলচিত্ততা  বা এমনকি উদ্যোক্তাদের প্রতি তাদের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ও গোপন বোঝাপড়াও কাজ করতে দেখা গেছে। কয়েকটি ঘটনাই তা প্রমাণ করতে সাহায্য করবে।

 

শোলাপুর, ১৯৬৭

 

দক্ষিণ-পশ্চিম মহারাষ্ট্রের শোলাপুর শহরে ধর্মীয় মিছিল ঘিরে একটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়। সেখান থেকে লুঠপাট, আগুন লাগানো, হত্যা কিছুই বাদ যায় না। সেই ঘটনার  তদন্ত করতে একটি ‘কমিশন অফ এনকোয়ারি’ গঠিত হয় (১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৭)। কমিশনের চেয়ারপার্সন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঘুবীর দয়াল। অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন, কর্নেল বি এইচ জাইদি ও অবসরপ্রাপ্ত আমলা এম এম ফিলিপ। কমিশন লক্ষ্য করে, ১৯২৫ ও ১৯২৭ সালে আয়োজিত ‘রথযাত্রা’ ঘিরে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। এবং ‘গণপতি বিসর্জন’ উপলক্ষ্যে ১৯২৭ ও ১৯৬৬ সালে এবং ১৯৩৯ সালে আর্য সমাজের সত্যাগ্রহ চলাকালীন আপত্তিকর স্লোগান ওঠায় ১৮টি ছুরি মারার ঘটনা ঘটে। ১৯৪৭ সালেও গণছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। তবে তার পিছনের কারণ ছিল দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সঙ্কট।

 

ভিওয়ান্দি, জলগাঁও ও মাহাড়, ১৯৭০     

 

১৯৭০ সালের ৭ মে ভিওয়ান্দিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৭৮ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ৫৯ জন মুসলমান ও ১৭ জন হিন্দু, বাকি দু’জনের পরিচয় জানা যায়নি। ৮ মে দাঙ্গা হয় জলগাঁও ও মাহাড়ে। জলগাঁওয়ে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে ৪২ জনই মুসলমান। মাহাড়ের ঘটনায় কোনও প্রাণহানি ঘটেনি।

 

মহারাষ্ট্রের এই তিন শহরের তিনটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন বম্বে হাই কোর্টের কর্মরত  বিচারপতি ডি পি মদন। কমিশনের তদন্তে বলা হয়, এই দাঙ্গা শিবজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ১০,০০০ জনতার এক বিশালকায় শোভাযাত্রা্র সরাসরি ফল। লাঠিসোঁটায় সজ্জিত মিছিলের উদ্যোক্তারা নিজামপুরা জুম্মা মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি শুরু করে। পরের দিনের দুই শহরেও একই পদ্ধতিতে মুসলমান বিরোধী দাঙ্গা সংগঠিত করা হয়।

 

বিচারপতি মদনের পর্যবেক্ষন, ১৯৬৩ সালটি ভিওয়ান্দির সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছর থেকেই হিন্দুরা মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা দিয়ে ধর্মীয় মিছিল করতে শুরু করে এবং মসজিদের সামনে এসে লাগাতার গান-বাজনা করতে থাকে। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, ১৮৬৪ সাল থেকে এটা নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, শিবজয়ন্তীর উদ্যোক্তারা জুমা মসজিদের সামনে এসে মিছিল দাঁড় করিয়ে বাজনা বাজাবে এবং উসকানিমূলক ও মুসলমান বিরোধী স্লোগান দেবে এবং বাড়াবাড়ি রকমের আবির ছুঁড়তে থাকবে। ঘটনাক্রমে, এই সালেই ভারতীয় জনসংঘ তাদের ভিওয়ান্দি শাখা খোলে। ১৯৬৫ সালে এই উসকানি, প্ররোচনা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। প্রথম দাঙ্গা ঘটে ১৯৬৭ সালে।

 

১৯৭০ সালের ঘটনা প্রসঙ্গে কমিশন তার তদন্তে জানায়, জনসঙ্ঘ ও শিবসেনার স্থানীয় নেতৃত্ব ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রীয় উৎসব মণ্ডল গঠন করে। এই মণ্ডল ১৯৭০ সালে শিবজয়ন্তী শোভাযাত্রার আয়োজন করে। বিচারপতি মদনের মতে, “ভিওয়ান্দি হাঙ্গামার প্রত্যক্ষ বা নিকটতম কারণ হল, মুসলমানদের রাগিয়ে দেওয়ার জন্য ৭ মে শিবজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আয়োজিত শোভাযাত্রার অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যমূলক খারাপ ব্যবহার।”

 

জামশেদপুর, ১৯৭৯

 

রামনবমী শোভাযাত্রা ঘিরে দাঙ্গার সূত্রপাত ১৯৭৮ সালে তৎকালীন বিহারের জামশেদপুরে। সে বছর আরএসএস/ বিজেপি প্রশাসনের উপর শোভাযাত্রার চিরাচরিত রুট বদলের জন্য চাপ দিতে থাকে। তারা দাবি করে, অতি ঘিঞ্জি মুসলমান মহল্লা সাবির নগরের মধ্য দিয়ে মিছিল যেতে দিতে হবে। প্রশাসন কয়েকটি ভিন্ন রুটের প্রস্তাব দিলেও সঙ্ঘীরা তা মানতে রাজি হয়নি। সাবির নগর পৌঁছাতে হলে বড় পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তা ও মাঠঘাট, চাষ জমি পেরোতে হয়। প্রশাসন রাজি না হওয়ায় উদ্যোক্তারা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। তারা ঘোষণা করে সে বছর রামনবমী পালন করা হবে না।

 

তৎকালীন বিহারের জনতা দল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুর বিজেপি-র চাপের কাছে শেষ পর্যন্ত মাথা নত করে। একটা ‘ডিল’ হয়। স্থির হয় মূল শোভাযাত্রা বড় রাস্তা দিয়ে চলে যাবে এবং একটি ‘নমুনা শোভাযাত্রা’ সাবির নগরের ভিতর দিয়ে যাবে এবং পরবর্তীতে তা  ফের বড় রাস্তায় উঠে মূল শোভাযাত্রার সঙ্গে মিলে যাবে। এই নমুনা শোভাযাত্রাটিকে স্থানীয়  বয়স্ক মুসলমান বাসিন্দা ও পুলিশ ঘিরে বড় রাস্তায় পৌঁছে দেবে। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ছোট মিছিল মুসলমান মহল্লায় ঢুকতে না ঢুকতেই ১৫ হাজারের মূল মিছিলটিও সেই পথে জোর করে ঢুকে পড়ে। মিছিল সাবির নগর মসজিদে পৌঁছাতেই বিজেপি বিধায়ক দীননাথ পাণ্ডে মিছিল আটকে দাঁড়ান এবং দাবি করতে থাকে্ন যে মিছিলকারীদের হক আছে সেখানে  জমায়েত করার। পাশাপাশি বিধায়ক মুসলমান ও ইসলাম বিরোধী প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করেন।

 

এরপরই ইটপাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। ওই পনেরো হাজার বিশাল দাঙ্গাবাজ জনতা লুটপাট, আগুন ধরানো শুরু করে দেয়। সাবির নগরের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা জামশেদপুরে। ১০৮ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে ৭৯ জন মুসলমান ও ২৫ জন হিন্দু। যেহেতু মুসলমান এলাকা  সাবির নগরে ঘটনার সূত্রপাত, সারা শহরেই মুসলমানদের জীবন-জীবিকা বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পাটনা হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জীতেন্দ্র নারায়ণের সভাপতিত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন দাঙ্গার জন্য আরএসএস ও  বিধায়ক দীননাথ পাণ্ডেকে প্রধানত দায়ী বলে জানায়।

 

কোটা, ১৯৮৯

 

১৯৪৭ সালে কোটা শহরে দাঙ্গা হয়নি। তার পরের পাঁচ দশকেও না। ১৯৮৯ সালে প্রমাণিত হল দাঙ্গা বাঁধানোর লক্ষ্যে ধর্মীয় শোভাযাত্রার মাহাত্ম্য। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ রাজস্থানের এই শান্ত মরুদ্যানে গণপতি বিসর্জনের অনন্ত চতুর্দশী শোভাযাত্রা দাঙ্গা বাঁধাল। সেই এক কাহিনি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ঘিঞ্জি মুসলমান মহল্লা দিয়ে শোভাযাত্রা নিয়ে যাওয়া, ওই এলাকার সবচেয়ে বড় মসজিদের সামনে মিছিল দাঁড় করিয়ে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে চোখাচোখা গালিগালাজ, ঘৃণ্য স্লোগান বর্ষণ। বিপরীতে পাল্টা স্লোগান শুরু হওয়া এবং ইট ছোঁড়াছুড়ির শুরু, শেষ পর্যন্ত মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। দাঙ্গার শেষে হিসেব করে পুলিশ- প্রশাসন জানায়, এই ঘটনায় ১৬ জন মুসলমান এবং চার জন হিন্দুর মৃত্যু হয়েছে। হাজারেরও বেশি মুসলমান হকার ও ব্যবসায়ীর দোকান-পাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালানো হয়েছে মুসলমান এলাকার বাসিন্দাদের ঘরবাড়িও।

 

এই সাম্প্রদায়িক বিপর্যয়ের জোরালো অর্থসমৃদ্ধ সারসংক্ষেপ করেছিলেন এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান রাজস্থান হাই কোর্টের বিচারক এস এন ভার্গব।

 

“৫৩. … …সব মিলিয়ে ২০ জন মারা গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৬ জন মুসলমান ও ৪ জন হিন্দু। … …নথি, প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে স্পষ্ট, হাঙ্গামার শুরু শোভাযাত্রাকারী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে আপত্তিকর ও প্ররোচনামূলক স্লোগান বিনিময়ে্র মধ্য দিয়ে। … … সামগ্রিক ভাবে সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমার মতে, শোভাযাত্রাকারীরাই আপত্তিকর ও প্ররোচনাকর স্লোগান দিতে শুরু করে এবং একমাত্র এই আপত্তিকর স্লোগানের প্ররোচনাতেই মুসলমান সম্প্রদায় পাল্টা একই কাজ করেছে।”

 

ভাগলপুর, ১৯৮৯

 

সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসে ভাগলপুর গণহত্যা এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণকে ঘিরে রাজ্যে রাজ্যে অজস্র রামশিলা যাত্রার প্রায় প্রতিটি পথ রক্তাক্ত হয়েছিল। ভাগলপুর সেই সময়কার হিংস্রতার সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় মুসলমান অধ্যুষিত তাতারপুরের উপর দিয়ে একরকম জোর করেই রামশিলা শোভাযাত্রা নিয়ে যাওয়া হয়। ২৪ অক্টোবর ১৯৮৯ সালে এই ঘটনার উৎস ভাগলপুর শহর লাগোয়া তাতারপুর হলে তা সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল।

 

বিচারক রামনন্দন প্রসাদ, বিচারক রামচন্দ্র প্রসাদ, বিচারক এস শামসুল হাসান, পাটনা হাই কোর্টের এই তিন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিচার বিভাগীয় কমিশনের রিপোর্ট বলছে, ১৯৮৯ সালের রামশিলা শোভাযাত্রার এক বছর আগে থেকেই শিলাযাত্রা ঘিরে ভাগলপুরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল কিন্তু পুলিশ সমস্ত জেনেও চোখ বন্ধ করেছিল। কমিশন এটাও লক্ষ্য করেছে, তাতারপুরের উপর দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও আবেদন করা হয়নি। এবং তাতারপুর দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার কোনও অনুমতিও প্রশাসন দেয়নি। তবুও, “হাজার  হাজার দুষ্কৃতীতে ভরা দাঙ্গাবাজ জনতার” মিছিলকে পুলিশ নির্দিষ্ট রুট বদলে তাতারপুরে ঢুকতে অনুমতি দেয়। এবং সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে আত্মরক্ষায় অক্ষম মুসলমান  জনসাধারণের চরম সর্বনাশ করে।

 

কমিশনের নথিতে লেখা হয়েছে, “ভাগল্পুর ও সন্নিহিত অঞ্চলের মুসলমানদের উপর লুঠেরা দাঙ্গাবাজ এবং জেলা পুলিশের ঘনিষ্ঠ জোটের ভক্তিরোষের শাস্তি নেমে এসেছিল।“ এবং তা  “প্রত্যক্ষগোচর হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত ন’শোর বেশি মৃতদেহ এবং আরও ন’শোরও উপর  হাতকড়া ও শেকল পরনো ব্যক্তিতে”। কমিশন আরও লক্ষ্য করেছে, “যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে কমিশন অফ রায়ট নিযুক্ত হওয়ার এক বছরেরও বেশি আগে, …জেলা প্রশাসন, যা আমাদের জানানো হয়েছে, শাস্তিযোগ্য স্মৃতিলোপ, উদ্দেশ্যমূলক নির্লিপ্ততা, এবং স্পষ্ট সাম্প্রদায়িক পক্ষপাত, দাঙ্গার আগাম আঁচ পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতার অসুখে ভুগছিল। জেলা প্রশাসনের নিরপেক্ষতার অভাব সমস্যা জটিল করে তুলেছিল।”

 

বিচারকত্রয়ীর শাস্তিযোগ্য স্মৃতিলোপের তাৎপর্যময় পর্যবেক্ষণ গ্রাউন্ড হগ ডে চলচ্চিত্রের মতো দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। ৩৩ বছর আগের ভাগলপুর গণহত্যার পরও, রাজ্যের পর রাজ্যে ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে চূড়ান্ত ঘিঞ্জি ও সংবেদনশীল অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স বা অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এই অনুমতিগুলো তখনই দেওয়া হচ্ছে যখন হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ধর্মীয় উৎসব একই সময়ে ঘটছে। যখন সংঘর্ষ বাঁধার সম্ভাবনা যথেষ্ট ভাবে বেড়ে যায়। ২০২২ সালে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী উৎসবে শোভাযাত্রায় খাপ খোলা অস্ত্র, এবং তার সঙ্গে মসজিদের সামনে সুউচ্চ ডেসিবেলের সঙ্গীত সম্মেলনে ব্যবহৃত মিউজিক সিস্টেম ও ডিজে পরিচালিত জঘন্য ও বিদ্বেষ ছেটানো গান বাজানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এই প্ররোচনার ফলে অবিধারিত ভাবে, উদ্যোক্তারা আসলে যা চায়, সেই দাঙ্গা বাঁধে।

 

এখানে আমরা যোগ করতে পারি, ১৯৮৯ সালে রামমন্দির নির্মাণের জন্য যে শিলামিছিল শুরু হয়। এবং সেই এক বছরেই সারা দেশে সরকারি হিসেব মতো ১১৭৪ জন মারা যান। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটি এর কম করে দ্বিগুণ। এক বছর পর আদবানির রথযাত্রার মাশুল দিয়েছিলেন ৬৯৩ জন। দু’বছর বাদে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর নানা রাজ্যে ২২৬টি দাঙ্গায় ১৮০১ জনের মৃত্যু হয়।

 

অতীতের ধর্মীয় শোভাযাত্রা, দাঙ্গা পরিস্থিতি, দাঙ্গার সঙ্গে বর্তমান সময়ে, বিশেষ ভাবে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীতে গত ছ’সাত বছর ধরে ঘটে যাওয়া দাঙ্গাগুলির পার্থক্য কী? সেটা হল ‘প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন’। রুটস অফ রথ-এর সম্পাদক চন্দর উদয় সিং-এর মতে, “আমাদের মহাজাতিত্বের প্রথম সাত দশকে সরকার ও সরকারি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা দাঙ্গা ঘটলে তীব্র খেদ ব্যক্ত করতেন, অথবা দাঙ্গার কারণ  নির্ধারণ করতে তদন্ত কমিশন বসানো হত এবং প্রায়শই দাঙ্গার শিকার ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হত। গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, রাজ্য সরকারগুলি অস্বীকার করা যায়  এমন আপাত অজুহাতের লজ্জার আবরণ্টুকুও ঝেড়ে ফেলেছে। এবং গর্বের সঙ্গে   প্ররোচনাকারীদের উদ্দেশ্যকেই সাগ্রহে গ্রহণ করছে।“ তদন্ত কমিশনের বদলে শোভাযাত্রার পথ ধরেই আসে শ্রেণিবদ্ধ বুলডোজার। মুসলমান মহল্লার যে কোনও কারোর ব্যবসায়িক  প্রতিষ্ঠান, জীবন-জীবিকা, ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এবং ধরেই নেওয়া হয় এরা শোভাযাত্রার পথে বাধা দিয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনই জজ ও জুরির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পোড়াকপালে মানুষগুলোকেই মিছিলে ইট ছোঁড়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। পুলিশ বুলডোজার বাহিনীর সঙ্গে থাকে ফাঁসুড়ের ভূমিকায়। এবং উচ্ছেদ, ধ্বংসাত্মক কাজকে ধামাচাপা দেওয়া এবং লন্ডভন্ড অবস্থা সাফসুতরো করার জন্য, সব কিছু ঘটে যাওয়ার পরে ভেঙে দেওয়া বস্তিগুলো জবরদখল এলাকায় আর ভেঙে ফেলা বাড়ি, দোকান-পাট আসলে বেআইনি নির্মাণ— এ কথা ঘোষণা করতে হাজির হয় পুর কর্তৃপক্ষ।

 

২০২২ সালে রমজান মাসে ১৩টি রাজ্যে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আইনজীবী ও নাগরিকদের রিপোর্ট ‘রুটস অফ র‍থ্’ (Routes of Wrath) বা ঘৃণার যাত্রাপথের এই পর্যবেক্ষণ। পরবর্তী পর্যায়ে রিপোর্টটি থেকে আমরা বিস্তারিত ভাবে যথাসম্ভব তুলে ধরার চেষ্টা করব দাঙ্গার পটভূমি, দাঙ্গাবাজ, পুলিশ-প্রশাসন, সরকার, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা।

 

Share this
Leave a Comment