ডুয়ার্স : বনগ্রামের একাল ও সেকাল (পর্ব-১)


  • March 31, 2023
  • (0 Comments)
  • 862 Views

ডুয়ার্সের বনগ্রামে বসবাসকারী অরণ্যনির্ভর জনজাতি শিশুদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চ এক ক্ষেত্রসমীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম দফায়, ২০২১ সালের  ৮ অগস্ট  থেকে ১৮ অগস্ট, চিলাপাতা ও বক্সা টাইগার রিজার্ভের বনগ্রামের আর্থ-সামাজিক ও  সাংস্কৃতিক জীবন  জানা-বোঝার এই প্রক্রিয়া চলে। এই রচনাটি সেই প্রথম পর্বের সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি। এখানে প্রধানত  বেগারপ্রথা, জীবন-জীবিকা, খাদ্যাভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। তবে তা ওই অঞ্চলের জীবন-জীবিকা-খাদ্যাভ্যাসের সামগ্রিক চিত্র নয়— লেখক দেবাশিস আইচ

        

(এক)

 

মহেন্দ্রর হাতে সবসময়ই একটা লম্বা দা। এই ঘর থেকে বেরিয়ে ধানখেতে যাচ্ছেন, পরনে খাটো ধুতি আর গেঞ্জি—হাতে দা। রাতে পাশের ঘরে শুতে এলেন, একই ধরনের পোশাক—হাতে দা। কাঠের হাতল নিয়ে যা প্রায় ফুট দুয়েক লম্বা। ফলাটা চওড়ায় প্রায় ইঞ্চি দুই হবে। মাথার দিকটা বাঁকানো। রাভা ভাষায় এই দা-কে বলে গোগো। সারাদিন এমন দা নিয়ে ঘোরা কেন? তার কোনও বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাইনি। ছেলেরা বলেছিলেন—এটা বাবার অভ্যেস।

      

মনে মনে ভেবে নিই—আজ না হয় ছেলেরা শিক্ষিত। কেউ স্কুল মাস্টার, কেউ-বা পারিবারিক জমিতে  হোম-স্টে বানিয়েছেন। তাঁরা বিবাহিত। নাতি-পুতি নিয়ে সংসার। এক বউমা স্বামীর সঙ্গে হোম-স্টের দেখভাল করেন। আরেক বউমা বাড়িতেই গ্রামের কচিকাঁচাদের টিউশন পড়ান। মহেন্দ্রেরও খুব ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করবেন। কিন্তু, অভাবের তাড়নায় তা হয়নি। মহেন্দ্র কেন, তাঁর আগের তো বটেই, তাঁর জেনারেশনের অনেকেরই স্কুল পাশ করা হয়নি। মহেন্দ্রের ভাষায়—অনেকে অন্যের বাড়িতে গিয়ে গরু-মোষ চড়ায়ে বড় হইছে। আমি তো তাই হইছি। এখন জমিজমা-চাষবাস রয়েছে। কিন্তু, বছর তিপান্নর এই বেঁটেখাটো শক্তসমর্থ রাভা জনজাতির মানুষটার মনে যেন বনটা রয়েই গিয়েছে। সেই  কবে সকাল হলেই বনে যাওয়া, জমি সাফ করে বিছন লাগানো, ঝুরনি করা—দা-কোদাল তো লাগতই। এই ঝুরনি করা বা আগাছা-ঝোপঝাড় সাফাই করতে তো এই দা লাগে। রাভায় এই ঝুরনি করাকে বলে ‘কিতির গোগরাই’। দা বুনো পশুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করতেও কাজে  লাগে। কিন্তু, এখন তো চাষবাস। বনে তো যেতে হয় না। তবু মহেন্দ্র গোগো হাতেই টো টো করে ঘুরে বেড়ান।  

 

ওই তো বন। একদম বাড়ির হাতায় না হলেও, ধানজমিটুকু পেরিয়েই। খুব স্পষ্ট না হলেও মহেন্দ্রর   বাড়ি থেকেই দিনের আলোয় দেখা যায় বন আর খেতের সীমানায় ময়ূরেরা ইতস্তত চড়ে বেড়ায়। ধান  খেতে উড়ে আসে, সব্জির খেতে ঠুকুর ঠুকুর করে কচিপাতা, পোকামাকড় খায়। রাতে হাতি নামে। বড়  বড় টর্চের আলো বন খেত আকাশে এলোমেলো ছুটে বেড়ায়। চিৎকার-পটকার আওয়াজ জানান দেয় হাতি নেমেছে। দেখা যায় না। মানে, ওই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার ভেদ করে অতিথির দৃষ্টি পৌঁছায় না। চিতা  আসে বাড়ির দাওয়াতেই। মওকা পেলে শুয়োরের বাচ্চা, হাঁস, মুরগি যা পায় নিয়ে যায়। তবে, গোয়ালে ঢুকে গরু মারে না। মারে, তবে সেটা বনে। বনের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে গরু চরে। একটা কেউ একটু গভীরে গেলেই মরার সম্ভাবনা। ঝোপের আড়ালে চিতা ওঁত পেতে বসে থাকে। বাগে পেলেই লাফিয়ে উঠে গলা ধরে ঝুলে পড়ে। শ্বাসনালী-খাদ্যনালীতে গভীর দাঁত বসিয়ে দেয়। গরু দাপায়, কতক্ষণ আর! 

 

চিলাপাতা বনাঞ্চলের আন্দু বনগ্রামের রাস্তায় বন দফতরের বিরাট এক হোর্ডিং চোখে পড়ল। মানুষ  আর প্রাণীর দ্বন্দ্ব সামলাতে এক, দুই করে বেশ কয়েক দফা নির্দেশ ও পরামর্শ লেখা রয়েছে। কাজের কথা সবই। কিন্তু, সব  নির্দেশ, সব পরামর্শ সবসময় কাজে লাগে না। সন্ধের অবসরে মহেন্দ্রকে ধরেকরে  বসানো গেল। হাতের দা-টা রাখলেন টেবিলের উপর। বললাম, ফরেস্টের একটা মস্ত হোর্ডিং দেখলাম।  লেখা আছে—ধানের বদলে লংকা করুন, আদা করুন…তাহলে আর হাতি জমিতে নামবে না। মহেন্দ্র  ঠান্ডা গলায় বলেন, লংকা করুক, যাই করুক হরিণ খাবে, ময়ূর খাবে, বানর তো আছেই। বানর এখন বেশি মাত্রায় হয়ে গেছে। এই অবধি ঢুকা আসে। সব্জি চাষ করে না এই কারণে—বাঁচাতে পারে না।  আলু চাষ করলে ভাল হয়, কিন্তু বাঁচাতে পারে না। যখন আলু হয়, তখন হাতি করবে কী—এইভাবে  ঘেঁষটা দিয়া (পা দিয়ে মাটিতে ঠোকর মারার ভঙ্গিমা করেন)…আলু বের হয়ে গেল, কিছু খাইয়ে দিল, কিছু পাড়া দিল। খায় ১০০ গ্রাম, ক্ষতি হয় ১০ গুণ। আমি তো করেছিলাম এই মূলাশাক, রাইশাক…গাজা উঠল…ময়ুর…কত আর তাড়া দেব, কত আর পাহাড়া দেব? সব্জির আশা নিয়ে সারাদিন যদি ওখানে পড়ে থাকি তবে তো আমার সংসার চলবে না। ধানই চাষ করেন মহেন্দ্র। যা ধান হয় তা খাওয়ার জন্যই। তবে তেমন খদ্দের পেলে কিছু বেচেনও। আর হাতি খেল তো গেল।  

 

আন্দু বনবস্তির নোরাই রাভা চাষবাস করেন, সুপুরি বেচেন। সাধারণ সময়ে ৩৫ টাকা কিলো দরে বছরে একবার, ওই এপ্রিল-মে মাসে পাইকাররা এসে সুপুরি নিয়ে যান। এরপরও তাঁর রুজিরোজগারের লড়াই শেষ হয় না। পরের জমিতে কামলার কাজ করতে হয়। তবে, সে নিজের গাঁয়ে নয়। বনবস্তির মেয়েপুরুষ ‘দেশি বাঙালি’ (রাজবংশী) কিংবা মুসলমান চাষিদের জমিতে দিনমজুরি খাটতে যায়।  নোরাইয়ের স্ত্রী কিংবা ৬৩ বছরের মা কামলার কাজে যান। 

 

একটা দোতলা কাঠের বাড়ি। বোধহয় ব্রিটিশ আমলের। বহুদিন রং চাপানো হয়নি। উল্টোদিকে দু’টি ঘরের একতলা একটা বাড়ি। মাটির উঠোন জুড়ে চরে বেড়ানো মুরগি ও ছানারা খুঁটে খুঁটে খেয়েই চলেছে। উঠোনের একপাশে রাশি করা ছাইপাঁশের পাশে একটা বড় গামলা ভরতি ভাতের ফ্যান। কোথা থেকে একটা গরু এসে চপাস চপাস আওয়াজ তুলে ফ্যান খেতে লাগল। পিছল মাটির উঠোন পা টিপে টিপে পার হয়ে এল কয়েকটা কচিকাঁচা। চটি জোড়া ছেড়ে উঠে গেল দোতলার বারান্দায়। ওরা টিউশন পরতে এসেছে নোরাইয়ে মেয়ে লীলার কাছে। ২১ বছরের মেয়ে ১২ ক্লাস পাস করে  ডিইএলএড (ডিপ্লোমা ইন এলিমেন্টারি এডুকেশন) পাশ করেছেন। খরচা হয়েছে দেড় লক্ষ টাকা।  এখন কোচবিহার মহিলা কলেজের আওতায় নেতাজি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে পড়ছেন। বছর তেইশের ছেলে কৃষ্ণ গ্র্যাজুয়েট। ১০০ দিনের কাজে সুপারভাইজারের কাজ করেন। বাবার হিসাবে বছরে দুই খেপে হাজার ১২ টাকা পান। আর বন্ধুর বাইকে চেপে নিয়মিত আলিপুরদুয়ার শহরে যান  চাকরির পরীক্ষার কোচিং ক্লাস করতে।  

 

কে যেন ডাক দেয়। নোরাই উঠে গিয়ে নিজের তিনটে গরুকে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আসেন। গরুগুলো এখন জঙ্গলের আশেপাশে ঘাস, লতাপাতা খাবে। সারাদিন পর অন্ধকার নামার আগেই সব দল বেঁধে যে যার ঘরে ফেরে। যদি না ফেরে তবে বুঝতে হবে বাঘে মেরেছে। রাখাল-বাগাল রেখে গরু চরানোর চল নেই। থাকবেই বা কী করে? নিজেদের কিছু না কিছু পেটের ধান্দায় থাকতে হয়। ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আছে। বাগাল রাখার সামর্থ্য চার-পাঁচ বিঘার প্রান্তিক চাষি, একইসঙ্গে  খেত মজুরের থাকে না। নোরাই ফিরে এসে ফের শুরু করল, “চাকরিবাকরি তো নাই। এমনে জমি অল্প কিছু আছে। চার-পাঁচ বিঘা। তিন বিঘা ধান গাড়া আছে। বাদবাকি তো ধান গাড়া যায় না। জঙ্গল সাইড।“ ধান গাড়া, কাটা, ঝাড়াই-মাড়াই সব পারিবারিক শ্রম। বাড়ির গরুর গোবরই মূল সার। সেচ বলতে বৃষ্টি আর বানিয়া নদীর জল। সব্জি করলে বাঁদর, হরিণ, ময়ুর খায়। মহেন্দ্রর মতোই নোরাই বলেন, “বাঁদর লুটপাট করে দেয় লংকাগুলা। আলু হাতির খুব প্রিয়। পা দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে আলু  তুলে ফেলে।“ সব্জি চাষে সময় না দিয়ে কামলা খাটাই লাভ, মত নোরাইয়ের। নিজের ধামরা (বলদ) থাকায়  ২০১৯-এও নিজেই হাল দিয়েছিলেন। ২০২০-তে অল্প সময়ের মধ্যে দুটো ধামরাকেই চিতায় নিয়েছে। তাই ট্রাক্টর ভাড়া করতে হয়েছিল। নির্বিকার চিত্তে ধামরা মরার কথা বলেন নোরাই। আবার গরুকে বনেও পাঠান। মানুষ বা গরু, বনের মধ্যে হাতি মারুক বা বাঘ—ক্ষতিপূরণ মিলবে না। নোরাইরা জানেন। হাতি, বাইসন ফসল খেলে, ঘর ভাঙলে বন দফতর থেকে ক্ষতিপূরণ মেলে, তাতে  যে ক্ষতি তার পূরণ হয় না। তাও পেতে পেতে বছর ঘুরে যায়। বনের নিয়মকানুন এমনই।  

    

(দুই) 

দিনক্ষণ হিসাব করে যদি বলি, ব্রিটিশ ভারতে ৮২ বছর (১৮৬৫-১৯৪৭)  এবং স্বাধীন ভারতে ২৪ বছর (১৯৪৭১৯৭১) প্রকৃত অর্থেই এই  ১০৬ বছর শাসকের দাস ছিলেন ডুয়ার্সের এই আরণ্যক জনজাতি সম্প্রদায়। তারপরেও স্বাধীন দেশের বনদপ্তরের আধা দাস পর্যায় কেটেছে আরও সাড়ে তিন দশকের   বেশি। আজও নানা কিসিমের সরকার, বন দফতর, বনবালিপাথরপর্যটন মাফিয়াদের চক্রব্যুহে মার  খেতে খেতে, মরতে মরতেও যাঁরা অভিমন্যু নয়ঘুরে দাঁড়ায়, অধিকার দাবি করে, বনের ভাগিদারি চায়, সাবেক পঞ্চায়েত নয় বনগ্রামসভা প্রতিষ্ঠা করেতা আজও সংগ্রামী ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে উঠল  না। যেমন হয়েছে উত্তরবঙ্গের চাশ্রমিক কিংবা নীলচাষীদের ইতিহাস। অরণ্যবাসী জনজাতিদের উপর  ঔপনিবেশিক শোষণ, বঞ্চনা ও অত্যাচার চা শ্রমিক ও নীলচাষিদের তুলনায় কিছু কম ছিল না। ভেবে আশ্চর্য হতে হয়, ১৯৬৮-’৬৯ সালে যখন ঔপনিবেশিক বেগারি প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়েছে, প্রায় সমসময়ে ঘটে গিয়েছে নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ। ১৯৭১ সালে অরণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গোঁসাইগাঁওয়ে মারা যান পাঁচ অরণ্যবাসীরাভাওঁরাওনেপালি। নকশালবাড়িতে পুলিশের গুলিতেও নিহতদের প্রত্যেকেই তো জনজাতি সম্প্রদায়ের। কৃষক আন্দোলনের সেই ঢেউ, নকশালবাড়ির, তরাইয়ের সেই উত্তাপ, আগুনের ওম দূরে থাক, ধোঁয়াটুকুও দেখা যায়নি ডুয়ার্সের এই আরণ্যক আকাশে। 

        

১৮৬৫ সালে ভারতীয় বন আইন তৈরির মধ্য দিয়ে সারা দেশের বনভূমির আইনি দখল নিল ব্রিটিশ রাজ। ১৮৭৮-এর আইন বলবৎ এর সঙ্গে সঙ্গেই এবং পরবর্তী একের পর এক সংশোধনী ও নতুন আইনের (১৯২৭) কবলে পড়ে অরণ্যের যাবতীয় অধিকার হারাতে শুরু করল জনজাতি সম্প্রদায়।  ক্রমে আদিবাসীদের বনে ঢোকা, বন থেকে জ্বালানি এবং অন্যান্য বনজসম্পদ সংগ্রহ বন্ধ হয়ে গেল। পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে জুম চাষও বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ শাসক ও  বনবিভাগের কর্তারা মনে করতেন, ভারতীয়রা বন সংরক্ষণ বোঝে না। এ বিষয়ে তাঁদের কোনও জ্ঞান নেই। আর আদিবাসীরা তো আরও জানেন না। তাঁরা বনের ঝোপঝাড়ে ছেঁটেকেটে, আগুন লাগিয়ে চাষআবাদ করে। এটা সংরক্ষণ বিরোধী অতএব বন্ধ করো।   

 

মধ্যভারতের বিশেষ করে মধ্যপ্রদেশের এক আদিবাসীগোষ্ঠী বাইগা। ভেরিয়ার এল্যুইন তাঁর  আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “বাইগাদের মধ্যে থাকাটা যেন এক রূপকথার দেশে থাকা। যত আদিবাসীদের কথা আমি জানি তার মধ্যে বাইগারাই সর্বাধিক পৌরাণিক কাহিনীতে সংবদ্ধ, বলা যায় আচ্ছন্ন।…মানুষখেকো কোনো বাঘকে বশ মানাতে যখন কোনো বাইগাকে আদেশ করা হয়, সে তখন এই বিপজ্জনক কাজটির মুখোমুখি হয় আরো বেশি সাহসের সঙ্গে; কারণ সে জানে এই কর্তব্যের দায় সে বহন করে এসেছে সেই আদিকাল থেকেই। গোণ্ড চাষীদের হয়ে সে যখন জাদুক্রিয়া করে তখন সে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিলীলার বর্ণনা করে, সে তার শ্রোতাদের শুনিয়ে দেয় তার গোষ্ঠীর কি অসাধারণ ভূমিকা  এক্ষেত্রে ছিল।“ [১]

 

এহেন বাইগাদের বিশ্বাস ছিল, ধরিত্রী মায়ের জঠর থেকেই তাঁদের জন্ম, তাই লাঙল দিয়ে চাষ করা মানে মায়ের বুক ক্ষতবিক্ষত করা। তাঁদের আরও এক বিশ্বাস তাঁরাই ‘পশুপতি’। অরণ্যে শিকার করার অবাধ স্বাধীনতা তাঁদের রয়েছে। ব্রিটিশ বনবিভাগের অফিসাররা ‘কুঠান নিড়ানি চাষের পরিবর্তে লাঙ্গল চাষ’ করার জন্য তাঁদের উপর অবিরাম চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করল। ১৮৬৭ থেকে ওই শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত, প্রায় তিন দশক ধরে চলেছিল বনবিভাগের এই গাজোয়ারি। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ হল শিকার। শুধু তাই নয়, বাধ্য করা হয়েছিল তাঁদের তির-ধনুক এক জায়গায় জড়ো করে পুড়িয়ে  দিতে। বাইগারা প্রথমে বনের এক অংশ কেটেছেঁটে সাফ করে নিত, এরপর ঝোপঝাড়, মাটি শুকিয়ে গেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিত। আর ওই পোড়া ছাইয়ের ওপর ছড়িয়ে দিত ফসলের বীজ। বেশ কিছু সময় ওই জমিতে চাষ করে ফের তাঁরা অন্য বনাঞ্চল খুঁজে নিত। ভেরিয়ার জানাচ্ছেন, অন্তত বছর বিশেকের ব্যবধানে তাঁরা এক বন থেকে অন্য বনে যেত। মাগুলা ও বালাঘাটে কয়েক শতাব্দী ধরে এভাবেই চাষবাদ করে চলেছে। তার মধ্যেই ফিরে আসত নতুন বন।

  

এর পরিণতি বোঝাতে গিয়ে ভেরিয়ার লিখছেন, “…ফলে তারা অনেকেই আরো নিঃস্ব হয়ে গেল; কারণ এই অপবিত্র ব্যবস্থাকে তারা ঘৃণা করত—সকলেই মনের গভীরে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকটে ভুগতে লাগল। তারা আজ নামতে নামতে নিঃস্বতম চাষী, ব্যর্থ চাষীর অবস্থানে এসে ঠেকেছে। তীর-ধ্নুক তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর তারা আর আজ পশুপতি নয়, অরণ্যের রাজা নয়—অতীতের মতো কুশলী শিকারিও তারা আর নয়। জীবনে সুখকর ও উপভোগের যা কিছু ছিল সবই আজ তারা খুইয়ে ফেলেছে।“[২] 

       

সাহেবরা বন দখল করেছিল কাঠের জন্য। সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য বাণিজ্যের বিস্তার লাগে। দ্রুত চলাচলের জন্য রেল লাগে। রেলের লাইন পাততে হলে কাঠের স্লিপার লাগে। ব্রিটিশ নৌবহরের জন্যও কাঠ লাগে। সেনাবাহিনীর ব্যারাক হোক কিংবা সাহেবের বাংলো বাড়ি, আসবাব সবেতেই কাঠ চাই। অতএব বন উজার করে শুরু হল ঔপনিবেশিক উন্নয়ন। কাঠের ব্যবসা করতে বহিরাগত ঠিকাদার, ব্যবসায়ী এল। তাদের জন্য গ্রামপত্তন হল। সে গ্রামের নাম হল এফডি ভিলেজ (ফিক্সড ডিমান্ড হোল্ডিং)। সে উন্নয়নের ধাঁচাটা আজও রয়ে গিয়েছে বটে তবে, আজ তা কাঠের চেয়ে বেশি জমির    জন্য, খনির জন্য। বৃটিশ আমলেও কারখানা ও খনির জন্য বন-পাহাড় উচ্ছেদ হয়েছে। বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সিংভূমের জামশেদপুরে টাটাদের কারখানা তার অন্যতম  উদাহরণ। তবে, তার  ব্যাপকতা ছিল কম।  

 

বাণিজ্যিক গাছ বলতে মূলত শাল, টিক। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হতে শুরু হল। পুরো মনোযোগটাই গেল  শাল-টিকগাছের দিকে। গাছ তো কাটা হল, কিন্তু ফের শালগাছ তো লাগাতে হবে। জমি তৈরি করতে  হবে, বীজ থেকে চারা করতে হবে, চারা পুঁততে হবে। দেখভাল করতে হবে—যেন সোজা, লম্বা, ঋজু আকার নেয় শালগাছ। দেখা গেল তেমন হচ্ছে না। সাহেব বনবাবু, ঠিকাদার, বহিরাগত শ্রমিকরা পড়ল  আতান্তরে। বন নির্ভর, জুম নির্ভর ডুয়ার্স-তরাইয়ের মেচ, রাভা, গারো, ধীমাল আবার পাহাড়ের লেপচা, রাই, লিম্বু, দুকপা, ভোটে জনজাতিদের তো বন থেকে একরকম তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর বনের কাজে নিয়ে আসা হয়েছিল চা বাগানে কাজ করতে আসা ঝাড়খণ্ডী আদিবাসী এবং নেপাল থেকে  আসা দরিদ্র, ভূমিহীন দিনমজুরদের। এই বহিরাগত শ্রমিকদের জন্য প্রথম তৈরি হল বনবস্তি। বেগার কাজ, সাহেব আর সর্দারদের অত্যাচার আবার প্ল্যান্টেশন করার ব্যর্থতা—সব মিলিয়ে এই বনবস্তি বেশিদিন টিকিয়ে রাখা গেল না। প্রথম পর্বের এই বনবস্তি বা আদি বনবস্তির সময়কাল ছিল ১৮৯০-১৯১০ সাল। 

 

এবার ফের ডাকতে হল জুমিয়াদের। বলা হল, তোমরা বাড়ি বানিয়ে থাকতে পারবে, যেভাবে জুম চাষ করতে—জঙ্গল পরিষ্কার করে, আগুনে পুড়িয়ে, পোড়া ছাইয়ের উপর বীজ ছড়িয়ে—তাও করতে পারবে। চাষের জন্য জমি মিলবে। তার বদলে, বনবাবু আর গ্রামের মণ্ডলদের হকুম মতো গাছ লাগানো, দেখভালের কাজ করতে হবে। এ কথাও জানিয়ে দেওয়া হল, কাজের জন্য কোনও মজুরি জুটবে না। তবে, মানুষগুলো খাবে, পড়বে কী? ওই যে জমি দেওয়া হল সে জমিতে চাষ  করো আর খাও। বন থেকে জ্বালানি জোগাড় করো। শাকপাতা, ফলমূল নিয়ে যাও। নদী থেকে মাছ ধরো। এর সঙ্গে যা জুড়ে থাকল তা হল, বন দফতরের হুকুম মাফিক কাজ করলেই একমাত্র গ্রামে থাকতে  পারবে। গ্রাম, বাড়ি, জমি কিছুই তোমার নয়। বনের মতো, বনগ্রামের মালিক বন দফতর। এইভাবে ক্রমে তৈরি হল স্থায়ী বনগ্রাম। এই জুমচাষ ও জুমিয়াদের সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল টঙ্গিয়া গ্রাম। 

 

(তিন)

 

অরণ্যবাসীদের বয়ানে ফিরি। কেমন ছিল অতীতের দিনগুলো। 

 

প্রেমপ্রসাদ গৌতম (৮০), গারোবস্তি, রাজাভাতখাওয়া, বক্সা টাইগার রিজার্ভ, আলিপুরদুয়ার  

 

এই বেগারিটা আমাদের, আপনি ধরুন ২৪ ঘণ্টা বেগার ছিলাম আমরা। ২৪ ঘণ্টাই কাজ করতে হত। যদি জঙ্গলে আগুন লাগল তবে রাত্রি ১২টা হলেও আমাদের যাইতে হইত। অসুস্থ বলে বলতে পারতাম  না। যেতেই হত আমাদের। যে কোনো ভাবেই হোক। না হইলে তাড়িয়ে দেবে। এক একর প্ল্যান্টেশন আমাকে তিন মাসের মধ্যে কমপ্লিট করতেই হবে। ক্লিনিং করা, আগুন দেওয়া, পোড়ানো, পরিষ্কার করা, লাইন ইয়ে করা, বিছন দেওয়া—তিন মাসের মধ্যে কমপ্লিট করতেই হত। যদি না করলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। তালা মেরে দিত। এইরকম করত। তা বাধ্য হয়ে করতেই হত। তখন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোথায় যাইব?  

 

টুনু রাভা (৭৮), আন্দুবস্তি, চিলাপাতা, আলিপুরদুয়ার। 

 

১৯১৭ সালে আমাদের কাজকর্ম শুরু হল। এখানে জংলি কাজ করার জন্য। খেতবাড়ি কাজ করার  জন্য। জঙ্গল ভাঙিয়া কাজ করল, রোপন করল, আমরা ফসল পাই  না। হাতি খায়। তাও আমরা করতেই আছি। তারপরে হইছে কি ব্রিটিশ আমাদের দিছে যে… [জমি, থাকার বাড়ি], কাজ করে খাবে তো ভাল, না কাজ কর তো হাটায়ে দিবে বলছিল। তারপর আমরা কী করলামডিপার্টমেন্ট প্ল্যান্টিং করল, কাজ করল, তিন একরআমরা কাজ করে খাইভাদাই মারে, ভাদাইটাদাই করে [এক জাতীয় ধানচাষ। বীজ জমিতে ছড়িয়ে এই চাষ করা হত।] ডিপার্ট্মেন্ট গাছ বিক্রি করে। আমরা চাষিএই জন্য ১৫ [বিঘা] করে জমি দিয়েছে  ডিপার্টমেন্ট আমাদের রাখছে। ব্রিটিশ আমল থেকে আমরা এইখানে ছিলাম।     

 

জঙ্গলে ফুল ফুটছে। এই  ভাদর মাসে ফুল ফুটবে। তারপর গাছ নিয়ে আসা ঝাড়ুগাছ, নিমগাছ আর কী  গাছ। এই কাজেই লাগছিলাম আগে। বাবুরা কী বলে দেখোহাল মারলে হবে না, বেগার যেতে হবে। ব্রিটিশরা নিয়ে আসছে এই ভাবে। এই কাজ। বেগারির কাজ। সাত বছর হতে হতে তো কাজে লাগিয়ে দিল। অনেক করেছি আমি। ব্রিটিশ এমন ঠকাইছে আমাদের, কষ্ট করাইছে। সেই জন্য আমরা ধর্মটর্ম বাদ দিয়া বেগারি খাটাই [খেটেছি]। 

   

১৫/১৬টা গাছে এক লাখ, দেড় লাখ নিত ডিপার্টমেন্ট (বিক্রির দাম)। গাছটা  মার্কিং দিলাম। গাছটা  ছাড়ল। তার পর নম্বর লিখল। দেখল, গোড়া মাপল, কত লং, তারপর মার্কিং করল।  মার্চেন্টরা ১০টা, ২০টা নিত। সেই যুগ থেকে আমি আছি। স্কুল ছেড়ে দিয়েই তো আমি এই কাজ করছি। ডিপার্টমেন্টের  জঙ্গল কাটিয়া খেত করত…খেতি…জমিন করত আমরা…ডিপার্টমেন্ট কী বলত—তোমরা জমিনটা পরিষ্কার করে ধান গাড়ো। ১৯১৮ সালে শুরু হল। চাকরবাকর রাখবে…কুলির মতন রাখবে বলিয়া ডিপার্টমেন্ট নিয়ে আসছে। রাভা, মদেসিয়া বিনা পয়সায় রাখছে। জমা (জমায়েত করেছে গ্রামে) করছে। তার আগে হয় নাই। এক একর করে সিএফসি কাটত তার ভিতর সাফা হলে আমাদের লেবাররা ওখানে তুলা বোনে…ধান, ভুট্টা, বেগুন, সব্জি, মকাই বোনে…আমরা বীজ কুড়াই…পুরানো গাছ থেকে বীজ আনিয়া পুলি (ছিটিয়ে বোনা) করতাম। এক একর করে ভাগা নিছি। গাছ তোলার জন্য। এক একর। ওটা কাটা হল। আবার রোপন…আবার কাটা…১৫ বিঘা জমি দিয়েছে হাজিরা নাই…নার্সারি করতাম…(বীজ) কুড়িয়ে নিতাম। তখন গাড়া ফসলের মধ্যে ছিল রসুন, পেঁয়াজ, আলু…। এছাড়াও পুঁই শাক, ডাটা, করলা, শসা, ভেন্ডি, খরমুজ চাষ হত। 

 

সাক্ষী লাকড়া (৫৫), কোদালবস্তি, দক্ষিণ বড়ঝাড় ফরেস্ট, আলিপুরদুয়ার

 

 —বেগারির কাজ কী কী করতেন কীভাবে করতেন?

—সেই কোদাল নিয়ে যাইতে হইত। এক্কেবারে আয়নার মতো ছুইলে পরিষ্কার…কোদাল দিয়ে ছুইলে পরিষ্কার করে তারপরে গাছটা লাগান হইত। 

—এই গাছটা কোথায় পেতেন?

—এইখান থেকে শালগাছগুলা গাড়া হত তো তখন মানে গাছ থেকে শালের বীজ পাই—ওই বীজটাকে কালেকশন করে তারপর প্ল্যান্টেশনে নিয়ে গিয়ে লাগাতে, গাড়তে হইত।  

—বীজ সংগ্রহ আপনারা করতেন। শুধু শাল না আরও কী কী করতেন?

—এখানে গাছের অনেক নাম আছে। পানিশাল আছে, জারুল আছে, চাপ আছে, গামারি আছে, টিক আছে, কাইজল আছে, চিলনি আছে, পারারি, মান্দানি, শিমূল – এক একটা রেঞ্জ অফিসার, বিট অফিসার গাছের নাম জানত না আমাদের কাছে জিজ্ঞাস করত, ‘এইটা কী গাছ?’ আমরা বলতাম, ‘এইটা অমুক গাছ।‘ 

—জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে এই বীজ সংগ্রহ করা হত। কী ছিল জঙ্গলে কাজের পদ্ধতি? সকাল আট-ন’টা নাগাদ ভাতটাত খেয়ে সকলে জঙ্গলে চলে যেতেন।

—তখন এমন সিস্টেম ছিল নিজের একটা ভাগা দিতে ছিল…বেগারির…বিনামূল্যে কাজ করা হইত। মনে করেন আমার ভাগটাকে আমি যত খাটনি করে কাজ করব বা একটু দেরি করে কাজ করব যাতে কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হয় এইরকম করে একটা চুক্তি হিসেবে ছিল একটা লাইন। 

—সাধারণভাবে দিনে কত গাছ লাগানো যেত?  

—ডেলি পরিষ্কার করো, ডেইলি লাগাও।  

—খুব জঙ্গল ছিল তখন…খুব জঙ্গল…ওই একশো মিটার দৈর্ঘ্য এবং ছ’ফুট চওড়া লাইন লাগানো যেত। 

 

গাছ অনুযায়ী লাইন তৈরি করতে হয়। লাঠির ডগায় একটি লোহার শলাকা দিয়ে মাটিতে ইঞ্চি দেড়েক  গর্ত করে তার মধ্যে বীজ ফেলা হত, ছ’ইঞ্চি-আট ইঞ্চি দূরে দূরে। চারা হলে “ওইটা পরিষ্কার করা হত।  এখন তো প্ল্যান্টেশন সেরকম পরিষ্কার করা হয় না।“ চারাগুলি বড় হলে থিনিং করা হবে থিনিং মানে কাটা হবে [দুর্বল গাছগুলো কেটে ফেলে সবল গাছগুলোর হাত-পা ছড়িয়ে বড় হওয়ার জায়গা করে  দেওয়া হল থিনিং করা]। যখন চারাগুলো একটু বড় হয় তখন “অর্ধেক গাছ কাটা যাবে। ভাল ভালগুলা রাইখা দেওয়া যাবে। ছ’ইঞ্চি-আট ইঞ্চি কেন দেওয়া হচ্ছে…কোন গাছটা মরল, অনেক গাছতো মরে যাবে তো বীজটা ওই জন্যই ছ’ইঞ্চি আট ইঞ্চি দূরে দূরে বীজ লাগানো হত। তখন যেটা খুব ভাল সবল সেটাকে রাখা দিলে।  

—১০টা গাছ লাগালে তার মধ্যে কটা থাকত? 

—ওই দশটার মধ্যে যদি সেরকম লাইন থাকে সেই লাইনের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা করে ‘থিনিং’ করা হবে। থিনিং করে বাকি গাছগুলা বড় হইল। আবার মানে ‘ঝুরনি’ করল ঝুরনি…থিনিংয়ের গাছের মধ্যে থেকে  ‘চেলি’ [চ্যালা কাঠ] বানাবে তখন ওই গাছগুলা কেটে কেটে ফায়ার উড বানাবে। ১২ ফুট ১৫ ফুট দূরে দূরে রাখবে তা… (শেষ পর্যন্ত প্রতিটি সবল গাছের মধ্যে দূরত্ব হবে ১২ থেকে ১৫ ফুট।)

  

মহেন্দ্র রাভা, কুরমাইবস্তি, চিলাপাতা, আলিপুরদুয়ার

 

আগে যখন আমরা ছোট ছিলাম, আমাদের বাবা-মা, ঠাকুরদা ওরা ছিল। অনেক সিনিয়র সিটিজেন লোক ছিল। তখন আমরা ছোট ছিলাম, তখন আমাদের ফরেস্টের সঙ্গে ছিল …আমরা দেখিনি, আমাদের বাবা-মা, ঠাকুরদারা বলতেন—আমাদের যে ভাবে শাসন করে আসছে সেটাই আমি বলতে চাইছি। আমাদের ফরেস্ট ভিলেজকে বিনা পয়সায় বিগারি খাটাইত। খাটতে হত। এই যে জমি আছে  বর্তমানে, যেটা আমরা চাষ আবাদি করি চলছে, জীবন-জীবিকা করতেছি, যেটা আগের দিনে আমাদের বাবা-মা বা অনেক আমাদের যেটা জেনারেশন আছে তাদেরকে বলত তোরা এই প্ল্যান্টেশন  ২০ হেক্টর বা ৩০ হেক্টর কর। হ্যাঁ, গাছগুলাকে ফেলিং করতে হত, ফেলিং করে যে ওটা ক্লিনিং করত মানে পরিষ্কার করত, পরিষ্কার করে আগুন ধরাতে হত, তারপরে ‘স্টেকিং’ [স্ট্যাগিং বা লাট করা)  করত, হুঁ,…, আগে তো শাল ইত্যাদি ভাল ভাল দামি দামি কাঠ লাগাত, যেটা মানে মানুষের যে কোনও কাজে ফার্নিচার বা ঘরের কাজের জন্য লাগে, এই ধরনের কাঠ [গাছ] লাগাইত আরকি।  তখনকার দিনে এটা বলত নাকি যে, তুমি এই এরিয়া, তুমি এই এরিয়া ভাগ করে দিত—যেমন এটা এক একটা লাইন, এটা একটা লাইন, এভাবে লাইন (টেবিলের উপর আঙুল টেনে টেনে দেখালেন) এই একটা গার্জেনকে, ফ্যামিলিতে দিত যে তোমার এই ১০টা লাইন। এটা মনে করো এই ১০টা লাইন ২০ হেক্টর—এই টেবিলের একটা উদাহরণ করলাম। এই ১০টা লাইন তোমাকে পরিষ্কার করে, চারা লাগিয়ে  গাছ তুলে দিতে হবে। যদি তুমি ঠিক ইসে করতে পারো তবে এই যে জমিন আছে এই জমিন চাষাবাদ করবা আর জীবন-জীবিকা করবা আর তোমাকে দাঁড় করাইতে হবে গাছ। যদি পার তবে তুমি এইখানে থাকবা। যদি না পার তালে তোমাকে এখানে রাখা হবে না। এই ধরনের বলতো।  

 

আর আমাদের গ্রামে গাঁওবুড়া থাকে, যাকে বলে মণ্ডল, এখন তো মণ্ডল উঠে গেছে এখন পঞ্চায়েতের আওতায়। তখনকার দিনে গাঁওবুড়া বলত, আর মণ্ডল যেটাই বলবে সেটা মেনে চলত। তা ওইভাবে অনেক লোকই খাটতে পারত। যারা খাটতে পারে নাই মনে করো বাচ্চা আছে, ছোট বাচ্চা, বাচ্চাকে নিয়ে দুই স্বামী-স্ত্রী গিয়ে প্ল্যান্টেশনে পরিষ্কার কইরা, আগুন ধরাইয়া, গাছ লাগাইতে হত, গাছ লাগার পরে আবার সেটা পরিষ্কার করতে হবে যাতে জঙ্গল না হয় … শাল, জারুল বিভিন্ন ধরনের ভাল ভাল গাছ এইগুলা লাগাতো আর কি। এটা কিন্তু আগের কথা। দেখেন এটা শোনা কথা বাপ-ঠাকুরদারা বলত আমাদের কাহিনি। কাহিনি বলতে বাস্তব এটা।

 

যারা পারত না, তাদেরকে তাড়াইয়া দিত। তাদের ভাগতে হচ্ছে। তাদের রাখেনি এখানে। এই মনে  করো এখন বাচ্চা আছে, ছোট বাচ্চা, বাড়িতে ছাইরা রেখে গেলে কে দেখবে? ওটাই তো ঠিক গাছ তুলতে হবে, যদি না পারে তাহলে আমাকে তাড়াইয়া দিবে। ওই বাচ্চাকে নিয়ে জঙ্গলে যেত। তখনকার  দিনে তো বাঘ বা ভালুক—এখন তো ভালুক নাই, তখনকার দিনে নাকি ভালুক প্রচুর ছিল। হাতি ছিল, তবে কম ছিল। এখনকার দিনে যে অত্যাচার করে মানুষকে এ অত্যাচার করত না হাতি। তখনকার দিনে ভালুকের অত্যাচার, বাঘের অত্যাচার ছিল। এর পরে এরা… তিন-চার বছর, পাঁচ বছর প্রত্যেক বছর তো প্ল্যান্টেশন, নতুন নতুন হয় এটাও করতে হবে, ওটাকেও আবার ঝুরনি করতে হবে। লতা যে চড়তে আছে গাছে, ওগুলো পরিষ্কার করতে হবে। নীচের ডালগুলো ছাঁটতে হবে তবে গাছ ফিনিশিং    হবে। উঠবে গাছ। তবে তো নরম ওকে [গাছের কাণ্ডকে] ভাঁজ করে দেবে, বেন্ড করে দেবে। দাঁড়াইতে  পারবে না। এই ধরে নাও অনেক কষ্ট। তখন কোনও হাজিরা ছিল না, বেগারি ছিল।

 

(৪)

 

এই বয়ানের সবটাই ঔপনিবেশিক সময়ের নয়। সে আমলের কথা তাঁদের বাপ-ঠাকুরদার কাছ থেকে শোনা-জানা। কিন্তু, এর মধ্যেই মিশে রয়েছে স্বাধীনতা উত্তর সময়ের, বিশেষভাবে প্রথম আড়াই দশকের কথাও। ব্রিটিশ বনশাসন পদ্ধতি, বনের উপর সরকারের একচেটিয়া অধিকার জাহির করা, আদিবাসী ও বননির্ভর মানুষকে বনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে চরম অনীহা, বনকে বাণিজ্যিক মুনাফার জন্য ব্যবহার এবং বনগ্রামের আদিবাসীদের বেগার খাটানো—এই সব  ব্রিটিশ জুলুম স্বাধীনত্তোর ভারতীয় বন-আমলারা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়ে এসেছিল। ব্রিটিশ বন-আমলাদের থেকে ভারতীয় বন-আমলারা কিছু কম সাহেব ছিলেন না। নাহলে ২০০৬ সালের বন আইনের কেন নাম রাখা হবে—”‘তফসিলি জনজাতি এবং অন্যান্য পরম্পরাগত বনবাসীদের (বনাধিকার স্বীকার) আইন?” আদিবাসী ও অন্যান্যদের যে বনের উপর অধিকার ছিল, যে অধিকার বিদেশি শাসক কেড়ে নিয়েছিল এবং দেশি শাসকরাও ফিরিয়ে দেয়নি—সে অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হল বনাধিকার আইনের নামকরণের মধ্য দিয়েই। প্রস্তাবনায় এও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এর ফলে এক ‘ঐতিহাসিক অন্যায়’ করা হয়েছে। স্বাধীন ভারতে বনাধিকারিকদের ঔদ্ধত্য কেমন ছিল তার একটি গা শিউরে ওঠা কাহিনি শুনিয়েছিলেন গৌতমবাজে। রাস্তা পার হচ্ছিল একটা মোষ। এক ডিএফও সে রাস্তাতেই  যাচ্ছিলেন। মোষের জন্য আটকে যায় তাঁর গাড়ি। তারপর? আমরা গৌতমবাজের বয়ানেই কাহিনিটি পড়ব : 

                

কুচবিহারের ডিএফও ছিল সুভাষ দে। বড়ডাবরিটা কুচবিহার ডিভিশনের মধ্যে পড়ে। তা আসার সময় রাস্তার মধ্যে দাঁড়ায়ে ছিল মইষ। সোজা গুলি করে দিয়ে চলে আসছে। ঘরের মইষ, পোষা মইষ। রাস্তার মধ্যে চড়তেছিল, খেতে ছিল ঘাস, সে জায়গায় গুলি করে মারছে। তারপরে আসছে হাসিমারা দিয়ে ওইখান থেকে ফোন করছে, এই এই ব্যাপার। ইএম কুজুরের বাড়ির সামনের ঘটনা। কুজুর ওইখান থেকে ফোন করল সিয়ারামের গদিতে ওইখানে—ডিএফও আসছে ওই রাস্তায়, আপনারা চিন্তাভাবনা করে দেখুন। তারপর আমরা রেলগেটটা বন্ধ করে রাখি দিলাম। ডিএফও আসতিছিল ওখানেই আটকে দিলাম। আটকাইয়া নিয়া গিয়া ওই নেতাজির মূর্তি আছে ওইখানে, সেই জায়গায় একটা বড় পাথর ছিল—ওই পাথরের মধ্যে দাঁড়া। চারটে থেকে রাত্রি দুটো অবধি করেছি। ডিএফও আসছে, এসডিও আসছে, জলপাইগুড়ি থেকে ডিসি আসছে…ডিসি আসল তারপর স্বীকার করল। তারপরে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দুটোর সময় ছেড়ে দিয়েছি। রাতে নয়টার সময় পুলিশ সাহেব কাপড় পাঠাইছিল। মানে জ্যাকেট-ফ্যাকেট সব কিছু পাঠাইছিল, ঠান্ডার জন্য—আমরা মানে ইয়েকে পড়তে দিব? ভলেন্টিয়ার দিকে আমরা দিয়ে দিলাম (জোরে জোরে হাসি)।

 

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্ল্যান্টেশন না করতে পারলে স্বাধীন ভারতেও বনবাবুদের অত্যাচারী চেহারাটা প্রেমপ্রসাদের বয়ানেই আরও একটু জেনে নিই :

 

আদিবাসী লাইনটায় প্ল্যান্টেশন করতে পারেনি সে বছর। প্রচণ্ড বৃষ্টি। ডেইলি বৃষ্টি, ডেইলি বৃষ্টি। জঙ্গল না  শুকোলে কী করে করাবে? ক্ষমতা নাই। যারা একটু দু’চারটে পয়সা ছিল তারা মানে কামলাটামলা নিয়ে মানে কমপ্লিট করছে। যেমন আমরা করেছি। তো এই ৩০-৪০টা বাড়ি [আদিবাসী লাইনের] মানে করতে পারে নাই। ওদেরকে নোটিশ হইল, “তোমরা যদি এক সপ্তাহের মধ্যে প্ল্যান্টেশন কমপ্লিট করলে করো, যদি না করো তাইলে ঘর খালি করো। আষাঢ় মাসের দিন কোথায় যাবে? তারপরে আমি যোগাযোগ করে এই লাইনে মিটিং করে পরের দিন ডিএফওকে…” আমরা মানে এই এই জন্য প্ল্যান্টেশন করতে পারিনি। তা আমাদেরকে তাড়াইয়া দিবেন? বৃষ্টিটা আটকাইতে পারলাম না কী করব আমরা? বৃষ্টি পড়ছে ডেইলি।“ তখন পোল্লেসাব বলল, “একটু রোদ্র হইলে করবে।“ তার মানে এখন তালা মারবে না। তারপরে আমাদের বেগার নিয়ে আন্দোলন শুরু হল।

 

এই যে ‘বেগার নিয়ে আন্দোলন’-এর কথা উঠে এল, এই সময়টা মোটামুটি ১৯৬৭-৬৮ সাল। এ বিষয়ে আমরা আবার আলোচনা করব। এখন কথা বলা যাক খাওয়াপরা নিয়ে।

    

ক্রমশঃ 

 

[প্রবন্ধটি আয়নানগর, সপ্তম সংখ্যা, ২০২৩-এ প্রথম প্রকাশিত হয়।]

Share this
Leave a Comment