১৫ মাসের মজুরি বকেয়া : বাংলার দিনমজুরদের কি ভাতে মারতে চায় কেন্দ্র?


  • March 28, 2023
  • (0 Comments)
  • 3070 Views

‘চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে’ বলে কেন্দ্রীয় সরকার ঝাঁপ দিয়ে পড়তেই পারে, কিন্তু ১৫ মাস ধরে টাকা আটকে রাখার নামে দেশের দরিদ্রতম মানুষগুলিকেই মোদী সরকার একরকম পণবন্দি করে ফেলেছে। মজুরির এই ২,৭৪৪ কোটি টাকা বা পুরুলিয়ার ছ’টি ব্লকের ১১৭ কোটি টাকা মঞ্জুর না হওয়ায় শুধুমাত্র যে মনরেগা শ্রমিকদের পেটে লাথি মারা হল তাই নয়, গ্রামীণ অর্থনীতির আর্থিক রক্তাল্পতাও গুরুতর ভাবে বাড়িয়ে তোলা হল। লিখলেন দেবাশিস আইচ

 

আত্মঘাতী হয়েছেন বাঁকুড়ার বড়জোড়া ভৈরবপুরের দিলীপ বাগদি (২৫)। সেও প্রায় মাস পাঁচেক হল। গত বছর ২৫ অক্টোবর গ্রামের এক গাছে খেত মজুর দিলীপের ঝুলন্ত দেহ দেখতে পেয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। বাসি খবর সন্দেহ নেই। আর দিলীপেরাই বা দিলীপের মতো খেত মজুর, দিনমজুরাই যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আত্মঘাতী হন, তাতো কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানই বলছে। এইতো গত ১৪ ফেব্রুয়ারি লোকসভায় কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব এমনটাই জানালেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকডর্স ব্যুরো (এনসিআরবি)-র দেওয়া তথ্য দিয়ে তিনি জানালেন, ২০১৯-২০২১—এই তিন বছরে ১.১২ লক্ষ দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। যা এই তিন বছরে মোট আত্মঘাতীর ২৫ শতাংশ। এবং এনসিআরবি-র ঝুলি উপুড় করে তিনি আরও জানিয়েছেন চাষিদের মধ্যে আত্মহত্যার পরিমাণ কিছুটা কমলেও কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে তা বাড়ছে। ২০১৯ সালে ৪,৩২৪ থেকে ২০২০ সালে ৫,০৯৮ এবং ২০২১ সালে আত্মঘাতী কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৫,৫৬৩ জন।

 

দিলীপ বাগদি যেমন খেত মজুর আবার দিনমজুরও। ১০০ দিনের কাজ করেছিলেন কিন্তু মজুরি মেলেনি। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতেন সেও ঠিকমতো মেলেনি। তাঁর বাবা খোকন বাগদি সামান্য জমি ভাগে নিয়ে শসা, করলা লাগিয়েছিলেন তাও জমিতেই নষ্ট হয়েছে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে আসানসোলের এক মাইক্রোফিন্যান্স সংস্থার কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ করেছিলেন। কাজ নেই, রোজগার নে্‌ই মাথার উপর ঋণের বোঝা। শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হলেন দিলীপ বাগদি। এর সঙ্গে যোগ করা যাক, সিএমআইই-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে গিয়ে ৭.৭৭ শতাংশে পৌঁছেছিল। যেখানে গ্রামীণ বেকারত্বের হার ছিল ৮.০৪% এবং শহরের হার ছিল ৭.২১ শতাংশ।

 

পাঁচ মাস আগের একটি আত্মহত্যার খবর কিংবা তিন বছরের আত্মঘাতের পরিসংখ্যান ফিরে পড়া, বেকারত্বের হার ফিরে দেখা জরুরি হয়ে পড়ল আরও এক সাম্প্রতিক খবর জেনে। ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষেও পশ্চিমবঙ্গের জন্য মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পে (এমজিএনআরইজিএস) বা ১০০ দিনের কাজের বাজেট বরাদ্দ করল না কেন্দ্র। আতঙ্কিত হওয়ার মতো সংবাদ সন্দেহ নেই।

 

এই মুহূর্তে ১০০ দিনের প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজ্যের প্রাপ্য ৭,৫০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে মজুরি বাবদ প্রাপ্য অর্থের পরিমান ২,৭৪৪ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষের বাজেটও বরাদ্দ করা হয়নি। ফলত, ১০০ দিনের কোনও কাজই প্রকৃতপক্ষে হয়নি। সন্দেহ নেই, এমন এক পরিস্থিতিতে প্রায় দেড় কোটি মনরেগা শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারগুলির খাওয়া-পরাটাই এখন গভীর প্রশ্নের মুখে।

 

কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই জাতীয় গ্রামীণ রোজগার আইনের ২৭ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে একশো দিনের টাকা আটকে দেয়। এই প্রথম তা করা হল। এই ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, প্রকল্প রূপায়ণে কেন্দ্র রাজ্যকে যেমন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারবে, তেমনই আর্থিক দুর্নীতি বা অপব্যবহারের অভিযোগ মিললে তদন্তও করতে পারে। পারে প্রয়োজনে অর্থ মঞ্জুর বন্ধ করতে।

 

বিগত ১৫ মাস ধরে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের আধিকারিকরা দফায় দফায় এ রাজ্যের ১৫টি জেলায় ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা প্রকল্পর মতো সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের তদন্ত করে। নানা সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত রিপোর্ট, আদালতের রায় থেকেই স্পষ্ট, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প থেকে নানা স্তরে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে চরম দুর্নীতি ঘটেছে। এই আর্থিক দুর্নীতিতে ভর করে পঞ্চায়েত থেকে নবান্ন স্তরের প্রধান থেকে মন্ত্রী, ‘মাদার’ পার্টির কর্তা থেকে যুবনেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। কিন্তু, প্রশ্ন হল দুর্নীতি যদি হয়েই থাকে তবে তা করেছে ক্ষমতাসীনেরা। তার জন্য হাড়হাভাতে দিনমজুররা শাস্তি পাবেন কেন? কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে ১৬ মার্চ পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন পুরুলিয়া জেলার ছ’টি ব্লকের এনরেগা শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক শুনানির পর মেনে নেয় ২০২১-২২ ও ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে ওই জেলার শ্রমিকদের বকেয়া মজুরির পরিমাণ ১১৭ কোটি টাকা। এবং শ্রমিকরা যে ন্যায্য উপায়ে, নিয়ম মেনেই কাজ করেছিলে তাও স্বীকার করে নেয় প্রশাসন। প্রসঙ্গত, এর আগে পর্যন্ত জেলা প্রশাসন বকেয়া অর্থ নিয়ে টালবাহানা করছিল। পশ্চিমবঙ্গ খেত মজুর সমিতি হাই কোর্টে আবেদন করলে প্রশাসন গণশুনানির আয়োজন করে। তবে, কেন্দ্র অর্থ মঞ্জুর না করলে বকেয়া টাকা এবং বর্তমান অর্থবর্ষে আর কোনও কাজ দেওয়া যাবে না বলেই জানিয়ে দিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক মুফতি শামিম সওকত।

 

দেশে বিশেষভাবে করোনা পরিস্থিতিতে ১০০ দিনের কাজের মূল্য কী ছিল এবং বর্তমানেও গ্রামীণ দরিদ্রের কাছে তার কী গুরুত্ব তা নতুন করে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। নরেন্দ্র মোদী, তাঁর সরকারের ‘থিংক ট্যাঙ্ক’ নীতি আয়োগ এবং বন্ধু পুঁজিপতিদের ঘোর অপছন্দের ১০০ দিনের প্রকল্পকেই, বিশেষভাবে অতিমারীর সময় সাধারণ গ্রামবাসীদের হাতে অর্থের জোগান রাখতে ব্যবহার করেছে কেন্দ্র। বলা ভাল, বাধ্য হয়েছে। এবং ২০২০-’২১ থেকে  ২০২২-’২৩ এই দু’টি অর্থবর্ষেই বরাদ্দের চেয়ে ঢের বেশি খরচ করতে হয়েছে। ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে খরচ হয়েছে ৮৯,০০০ কোটি টাকা। অথচ, ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে ব্যয়বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৩৩% (৩০,০০০ কোটি টাকা)। একই সঙ্গে এই বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি কমানো হয়েছে ৩১%, সারে ২২%, রান্নার গ্যাসে ৭৫%। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের জন্য অর্থ কমিশনের বরাদ্দের পরিমাণ ২০২১-’২২ অর্থবর্ষের প্রকৃত ব্যয়ের তুলনায় এ বছর বহুলাংশে কমেছে। বর্তমানের বাজেটে বরাদ্দ কমেছে ৪২,০০০ কোটি টাকা। অর্থশাস্ত্রীদের মতে, এর ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত ব্যয়ের বেশির ভাগটাই রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপবে। ফলে, রাজ্যগুলির পক্ষে এই ব্যয়নির্বাহ কঠিন হবে এবং উন্নয়ন খাতে খরচ কমবে। (শেষ পর্যন্ত কার লাভ হল, সুরজিৎ দাস, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।)

 

সুতরাং, ‘চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে’ বলে কেন্দ্রীয় সরকার ঝাঁপ দিয়ে পড়তেই পারে, কিন্তু ১৫ মাস ধরে টাকা আটকে রাখার নামে দেশের দরিদ্রতম মানুষগুলিকেই কেন্দ্রীয় সরকার একরকম পণবন্দি করে ফেলেছে। মজুরির এই ২,৭৪৪ কোটি টাকা বা পুরুলিয়ার ছ’টি ব্লকের ১১৭ কোটি টাকা মঞ্জুর না হওয়ায় শুধুমাত্র যে এনরেগা শ্রমিকদের পেটে লাথি মারা হল তাই নয়, গ্রামীণ অর্থনীতির আর্থিক রক্তাল্পতাও গুরুতর ভাবে বাড়িয়ে তোলা হল। একই কথা খাটে আবাস যোজনার ক্ষেত্রেও। এ ক্ষেত্রে পাওনা ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কৃষি ক্ষেত্রে সঙ্কট (যেমন, বর্তমান আলু চাষে), নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বে জর্জর গ্রামীণ অর্থনীতিতে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আর্থিক বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কুপ্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে।

 

সন্দেহ হয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার নামে কেন্দ্রীয় সরকার আসলে গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গকে ভাতে মারার রাজনৈতিক পদক্ষেপ করছে। কেননা, সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। পশ্চিমবঙ্গ খেত মজুর সমিতি দীর্ঘ ১৫ মাস যাবতই এই কেন্দ্রীয় নীতির বিরোধীতা করে আসছে। সমিতি ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে বাজেট বরাদ্দ আটকে দেওয়ার ঘটনার নিন্দা করে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপকে ‘স্বৈরাচারী ও স্বেচ্ছাচারী’ বলে বর্ণনা করেছে। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তারা জানিয়েছে, “কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত রাজ্যের প্রায় দেড় কোটি নরেগার শ্রমিককে এক প্রচণ্ড শাস্তির সম্মুখীন করল, যারা প্রকৃত অর্থেই নিরাপরাধ। যারা নিজেদের রক্ত ও ঘাম ঝরিয়ে সততার সঙ্গে কাজ করলেন, তাদের কপালে বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই জুটল না।” ১৫ মাস ‘ধরে রাজ্য সরকারের দুর্নীতির’ উপযুক্ত তদন্ত করে ‘শাস্তি’র ব্যবস্থা না করতে পারা কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অপদার্থতা’ বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করা হয়েছে।

 

কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ, বকেয়া পাওনার দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী ২৯-৩০ মার্চ দু’দিন কলকাতায় ধর্নায় বসতে চলেছেন একই সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, মন্ত্রীরা জেলায় জেলায় ধর্না কর্মসূচিতে অংশ নেবেন। মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “রাজ্যের মানুষকে আমরা এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কথা জানাব।” একই সঙ্গে দলের বক্তব্য, আইন অনুযায়ী কাজ করার ১৫ দিনের মধ্যে পারিশ্রমিক দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু, ১৫ মাস ধরে রাজ্যের সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা আটকে রাখা হয়েছে। ২৮-৩০ মার্চ বামফ্রন্ট ব্লকস্তর থেকে রাজ্যস্তরে একই ইস্যুতে প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়েছে। সাংবাদিকদের বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “গ্রামের সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্নে ১০০ দিনের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রকল্পের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া এবং কাজের টাকা আটকে দেওয়া জনস্বার্থ বিরোধী।” দুর্নীতির প্রসঙ্গে বিমানবাবু বলেন, “দুর্নীতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হোক। কাজের বিনিময়ে মানুষের যে ন্যায্য পাওনা, তা আটকে থাকবে কেন?”

 

মুখ্যমন্ত্রীর ধর্না, বামফ্রন্টের প্রতিবাদ মিছিল, বিক্ষোভের মধ্য দিয়েই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঢাকে যে কাঠি পড়তে চলেছে সে বিষয়টি পরিষ্কার।

 

Share this
Leave a Comment