মিড ডে মিল-এর বরাদ্দ স্থায়ীভাবে বাড়ানো এবং ন্যূনতম মজুরি স্থির করার দাবিতে সোচ্চার মিড ডে মিল কর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন


  • January 26, 2023
  • (0 Comments)
  • 1055 Views

অর্থনৈতিক দূর্নীতি, খাবারের খারাপ মান, বিপন্ন শৈশব, স্কুলছুট হওয়ার আশংকা, অভিযোগের চাপান-উতোর, সংখ্যাতত্ত্বের উদাহরণ এই সব সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার মাঝে এ রাজ্যে মিড ডে মিল প্রকল্পের কর্মীদের বক্তব্যগুলিই কেমনভাবে যেন রয়ে যায় পরিসরের বাইরে। এক বিরাট সংখ্যক মহিলা অথচ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত, যুক্ত বহু স্বনির্ভর গোষ্ঠী। যে টাকাটা সাম্মানিক হিসাবে তাদের দেওয়া হয় তা কোনও সরকারি প্রকল্পের কাজে দেওয়া লজ্জাজনক। দীর্ঘ আন্দোলনেও পরিস্থিতি বদলায় না। কিন্তু আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যখন শিশুদের মিড ডে মিল-এর বরাদ্দ বাড়িয়ে রাজনীতি করা হয় তখন তারাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হন। কী বলছেন এ রাজ্যের মিড ডে মিল কর্মীরা, কর্মীদের সংগঠন – শুনলেন সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

ভোটের রাজনীতি। স্পষ্টত এভাবেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে মাথায় রেখে মিড-ডে মিল-এ শিশুখাদ্যের বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে। ভোটব্যাঙ্ককে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে এই মুহূর্তে হাতিয়ার খুদে স্কুল পড়ুয়াদের মিড ডে মিল। এই মিড ডে মিল প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগে ইতিমধ্যেই অভিযুক্ত রাজ্য সরকার। এমন অভিযোগও উঠেছে মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফরের খরচ যে বিভিন্ন খাত থেকে খরচ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে মিড ডে মিল-এর খাতের এক বড় অংশের টাকাও। কেন্দ্রের তদন্তকারী দল মিড ডে মিল দূর্নীতির তদন্তে রাজ্যে আসছে এমনটাও শোনা যাচ্ছে।

 

সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন, শিশুদের পুষ্টি-অপুষ্টির কথা মাথায় রেখেই তড়িঘড়ি মিড ডে মিল-এ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এই চার মাস প্রত্যেক শিশুর জন্য সপ্তাহে ২০ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। বলা হয়েছে প্রতিদিনের পিএম পোষনে যে খাবার দেওয়া হয় এই অতিরিক্ত বরাদ্দ থেকে তার সঙ্গে সাপ্তাহিকভাবে মাংস বা ডিম বা মরশুমি ফল দেওয়ার কথা। হিসাব করে খরচ করলে এই টাকায় প্রতিটি শিশুকে চার দিন ডিমও দেওয়া যেতে পারে। সরকারি নোটিস-এ দেখা যাচ্ছে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এই চার মাসের জন্য স্কুল স্তরে পিএম-পোষন প্রকল্পের অধীনে মোট ৩৭১,৯০,৭৮,৪০০ (তিনশ একাত্তর কোটি নব্বই লক্ষ আটাত্তর হাজার চারশ) টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ করে রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য এই নোটিসে ভোটের কথা উল্লেখ করা নেই।

 

গত বিধানসভা নির্বাচনের আগেও মিড ডে মিল-এ শুকনো খাবারে বরাদ্দ বাড়িয়ে ভোট বাড়ানোর পন্থা নিয়েছিল শাসক দল। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই শিশুদের পুষ্টির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে দাবার বোড়ে বানিয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে চাওয়ায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরেই। তবে সমস্যা হল মিড ডে মিল-এ গুণগতভাবে খারাপ মানের খাবার দেওয়া, নানা দূর্নীতি ইত্যাদি যতটা সামনে আসে, ততটা আসে না সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পুষ্টি নিয়ে এই রাজনীতির কথা। নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ শিক্ষার অধিকার আইনের অন্তর্গত শিশুদের পুষ্টিকর খবার নিয়মিত ও স্থায়ীভাবে পাওয়ার বিষয়টি লঙ্ঘিত হচ্ছে তা নিয়ে যেন কিছুটা উদাসীনই।

 

এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ঝক্কি সামলাতে হয় মিড ডে মিল কর্মীদের। যাবতীয় অভিযোগের তীর প্রথমেই ওঠে তাদের দিকে। অভিভাবকদের রোষের মুখে পড়তে হয় প্রাথমিকভাবে তাদেরই। অথচ তারা সব সময়েই এই কাজটিকে নিজেদের ও সমাজের বুনিয়াদি দায়িত্ব মনে করে পালন করে চলেছেন। এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মিড ডে মিল কর্মীরা এমনকি ন্যূনতম মজুরি থেকেও বঞ্চিত। মাসে ১৫০০ টাকার বিনিময়ে তারা কাজ করে থাকেন, যাক বেতন না বলে সাম্মানিক বলা হয়ে থাকে। গত দশ বছরে এই সাম্মানিকও বাড়েনি। তাছাড়া সরকারি প্রকল্পে সরকারি কর্মীদের মতো কাজ করেও তারা সরকারী কর্মীদের মতো মাইনে পান না। গ্রীষ্মের ছুটি ও পুজোর ছুটিতে দু’মাস স্কুল বন্ধ থাকার কথা বলে তাদের ১০ মাসের সাম্মানিক দেওয়া হয়ে থাকে। মিড ডে মিল কর্মীরা দিনে ৫০ টাকা হিসাবে টাকা পেয়ে থাকেন, যা অনেক সময়েই ভাগ করে নিলে (অনেক স্কুলেই স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের এই দায়িত্ব দেওয়া থাকে) মাথা পিছু দিনে ১০ থেকে ১‌৫ টাকায় দাঁড়ায়, যা এক কথায় অকল্পনীয়। অন্যদিকে ত্রিপুরায় রাজ্য সরকার মিড ডে মিল কর্মীদের মজুরি মাসে ১৫০০ থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করেছে। পন্ডিচেরিতে এই মজুরি মাসে ২১,০০০ টাকা ও তামিলনাড়ুতে মাসে ১২,০০০ টাকা।

 

মিড ডে মিল-এর বরাদ্দ স্থায়ীভাবে বাড়ানো এবং মিড ডে মিল কর্মীদের সরকারী কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে ন্যূনতম মজুরি আইন অনুযায়ী তাদের মজুরি স্থির করা নিয়ে লাগাতার আন্দোলন করছে ও দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হচ্ছে মিড ডে মিল কর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন।

 

এআইইউটিইউসি কর্তৃক স্বীকৃত সারা বাংলা মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন-এর সদস্য সংখ্যা সারা রাজ্যে এক লক্ষ। সংগঠনের উপদেষ্টা ইসমত আরা খাতুন এই বরাদ্দ বৃদ্ধি নিয়ে বললেন, “সরকারি ক্ষমতায় থাকা দল মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা হারায় তাদের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতি প্রণয়নের জন্য। ভোটের আগে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনকে কিছু দান খয়রাতি করে তুষ্ট করতে চায়, সান্ত্বনা দিতে চায় রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীন দলগুলি। কারওর বুঝতে অসুবিধা নেই মিড ডে মিল-এ বরাদ্দ বৃদ্ধি স্রেফ ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দেওয়া যা প্রতারণার সামিল।” তিনি মিড ডে মিল কে কেন্দ্র করে যে নানাবিধ অভিযোগ খাবারের মান থেকে দূর্নীতি সবটাকেই ‘সিস্টেম-এর গলদ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বললেন, “এই ঘোষণা যাদের জন্য করা হচ্ছে বাস্তবে সেই বরাদ্দ সঠিক জায়গা পর্যন্ত আদৌ পৌঁছবে না। এই খাবার, বরাদ্দ অর্থ নানা হাত ঘুরে যায়, ফলে কোন্‌ হাত থেকে কত দূর পর্যন্ত যাবে তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই। এই টাকা ভোটের ফান্ডে চলে যাবে। ভোটের পরে এগুলো সব উশুল করা হবে।” ইসমত আরা সরাসরিই বললেন, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে মিড ডে মিল কর্মীদের বেতন যথেষ্ঠ ভালো, সেখানে লক্ষ্মীর ভান্ডার ও নানাবিধ সরকারি প্রকল্পে দান খয়রাতি করলেও মিড ডে মিল কর্মীদের ক্ষেত্রে এই বঞ্চনা এক ধরনের অপরাধের সামিল। এই ইউনিয়ন-এর তরফ থেকে দাবি তোলা হয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার উভয়কেই শিশুদের সুষম পুষ্টিকর খাদ্যের বরাদ্দ স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি করতে হবে, মিড ডে মিল কর্মীদের সরকারি স্বীকৃতি ও সেই অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে ও ন্যূনতম বেতন ২১০০০ টাকা করতে হবে, প্রশাসনিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে।” অভিযোগ শিক্ষকদের কাছেও পৌঁছনোর আগে এই বরাদ্দ দলীয় কর্মীদের বহু হাত ঘুরে নষ্ট হয়, এর ফলেই খাবারের গুণমান ক্রমশ নীচে নামছে, সরকারি গুদামজাত যে চাল মিড ডে মিল-এ সরবরাহ হয় তা শিশুখাদ্য হিসাবে অত্যন্ত নিম্ন মানের। “সবচেয়ে স্বল্প বেতনের কর্মী যারা দায়িত্ব নিয়ে রান্নার জোগাড়, রান্না, খাওয়ানো, থালাবাসন পরিস্কারের যাবতীয় কাজ সামলান সেই মিড ডে মিল কর্মীদের উপরেই সমস্ত অপবাদ, অভিযোগ, ঝক্কি উপর মহলের চাপিয়ে দেওয়াটা সহজ হয়। জলের অভাবে রান্নায় সমস্যা, রান্নায় পোকামাকড়, বাজে গন্ধওলা চাল, কোনও বাচ্চা পড়ে গিয়ে আহত হওয়া সবের দায় এসে পড়ে তাদের ঘাড়ে। তাদেরই রাজনৈতিক রোষের মুখে পড়তে হয়,” জানালেন ইসমত। অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সই সংগ্রহ করে রাজ্যপালের কাছে জমা দেওয়া হয় এই ইউনিয়ন-এর পক্ষ থেকে। কেন্দ্রের কাছে অনলাইন-এ দাবি সম্বলিত ডেপুটেশ জমা দেওয়া হয়েছে। গত নভেম্বর মাসে রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরে কয়েক হাজার মিড ডে মিল কর্মী ডেপুটেশন দেন। সাম্প্রতিক ঘোষনাকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ইউনিয়ন-এর পক্ষ থেকে জেলাশাসকের কাছে, বিডিও-র কাছে ডেপুটেশন দেওয়া চলছে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রাজ্যব্যাপী বৃহত্তর কর্মসূচীর বিষয়ে।

 

অ্যাসোসিয়েনশন অফ মিড ডে মিল অ্যাসিসটেন্টস বা আম্মা যে দাবিগুলি তুলেছে –

  • জানুয়ারি থেকে এপ্রিল নয়, স্থায়ীভাবে মিড ডে মিল-এর বরাদ্দ বাড়াতে হবে
  • সব বাচ্চাদের মিড ডে মিল দিতে হবে। ক্লাস এইট পর্যন্ত নয়, ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত এই খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে
  • মিড ডে মিল কর্মীদের বারো মাস সরকার নির্দ্ধারিত ন্যূনতম মজুরি, মজুরি নিয়মিত করা, সরকারি স্বীকৃতি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি, প্রভিডেন্ট ভান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন ইত্যাদি দিতে হবে।

 

আম্মা – নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুর – পশ্চিমবঙ্গের এই পাঁচটি জেলায় কাজ করে। কথা হচ্ছিল সংগঠনের পক্ষে জুবি সাহার সঙ্গে। বললেন, “ভোটের আগে যারা ভোটার নয়, সেই বাচ্চাদের মুখের খাবারটা হয়ে গেল ইস্যু। সরকারের তরফে নির্লজ্জের মতো শিক্ষামন্ত্রী বলেওছেন যে ভোটের পরেও করতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু এটা ভোট পর্যন্তই থাকবে। অত্যন্ত নিন্দনীয় এই পদক্ষেপ।” গত সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে আম্মা-র মিড ডে মিল কর্মীরা যখন জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশন দেন তখন তাতে সবার আগেই ছিল বাচ্চাদের খাবারের বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি। দাবি ছিল প্রত্যেক দিন বাচ্চাদের প্লেটে একটা গোটা ডিম ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। ডিসেম্বরে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার জেলা সম্মেলনেও এই দাবিটি ছিল। এর আগে নদীয়াতেও একই দাবি উঠেছিল। জুবি বললেন, “মিড ডে মিল কর্মীরা যে সাম্মানিক পান হিসেব করে দেখা গেছে তা ঘন্টায় দুই থেকে তিন টাকা যেখানে এ রাজ্যে ন্যূনতম মজরি ঘন্টায় ৪০ টাকা ২৫ পয়সা। সেই মিড ডে মিল কর্মীরা নিজেদের বঞ্চনার কথা আগে না এনে শিশুদের পুষ্টিকর খাবারের বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবিটিকে জোরালো ভাবে আগে রাখছেন। এর ফলেই এখন তাদের সঙ্গে অভিভাবকদের একটা সংঘবদ্ধ ভাব তৈরি হচ্ছে স্থানীয়ভাবে, যা আন্দোলনেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমরা মনে করছি।” তবে আচমকা সাময়িকভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধির এই ঘোষণা এমন আশঙ্কাও তৈরি করছে যে সরকার চাইছে না মিড ডে মিল কর্মী ও অভিভাবকদের মধ্যে এই যৌথতা তৈরি হোক। আম্মা-র সঙ্গে যুক্ত মিড ডে মিল কর্মীরা ভোটের আগে এই সাময়িক বরাদ্দ বৃদ্ধির ঘোষণা নিয়ে ইতিমধ্যেই অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা, তাদের সই সংগ্রহ ইত্যাদি শুরু করে দিয়েছেন। দাবি তোলা হয়েছে ভোটের চার মাস নয় এই বরাদ্দ সারা বছরের জন্য ঘোষণা করা হোক। “শুরুর দিন থেকে এই অতিরিক্ত বরাদ্দ নিয়ে কথায় ও কাজে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। অফিশিয়াল নোটিসে বাচ্চাদের পুষ্টির কথা বলা হয়েছে। আর প্রথম দিন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী বলছেন এটা ভোটের আগে আমরা করলাম, আরও করতে পারলে ভালো হত, কিন্তু আমাদের কাছে টাকা নেই। যদি ধরে নিই সত্যিই সরকারের কাছে টাকা নেই, তাহলে যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে তা সারা বছর জুড়ে অল্প অল্প করে করা যেত, যেমন এখন সপ্তাহে তিন দিন একটা করে ডিম দেওয়া হবে। সেটা সপ্তাহে এক দিন করে ডিম বারো মাস দেওয়া যেত,” বললেন জুবি।

 

আম্মা-র সঙ্গে যুক্ত মিড ডে মিল কর্মীরা অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর রাজ্যব্যাপী আন্দোলনের দিকে যাওয়ার কথা ভাবছেন। সরকারি চিন্তাভাবনা নেই লকডাউনের পর বিভিন্ন স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা কমে যাওয়ায় মিড ডে মিল কর্মীদের সাম্মানিক কমে যাওয়া নিয়ে কারণ তাদের সাম্মানিক নির্ভর করে ছাত্রসংখ্যার উপরে। তাছাড়া স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া ও শ্রমিক শিশুদের পড়ানোর স্কুলগুলিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলেও কাজ হারিয়েছেন বহু মিড ডে মিল কর্মী, সরকার উদাসীন সে বিষয়েও।

 

মিড ডে মিল কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে স্পষ্ট হয়ে যায় বাস্তবে পরিস্থিতি কতটা মারাত্মক আর এই চার মাসের বরাদ্দ বৃদ্ধি তাদের উপর কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করতে চলেছে। নদীয়া জেলায় সাত-আট বছর ধরে মিড ডে মিল কর্মী হিসাবে কাজ করা ঝুমা বসাকের কাছে জানতে চাইলাম এই সাময়িক বরাদ্দ বৃদ্ধিতে কী সমস্যা বাড়বে? উত্তরে বললেন, “এখন তো আমরা ডিম বা মাংস দিতে পারছি। এরপর চার মাস পরে যখন এটা বন্ধ হয়ে যাবে তখন আমাদের আবার সেই আলুর ঝোল দিতে হবে। বাচ্চারা তো ডিম, মাংস খেতে চাইবে। তাই যাতে প্রতিদিন বাচ্চাদের একটা করে ডিম অন্তত দিতে পারি, সেই হিসাবে বরাদ্দটা স্থায়ীভাবে সরকারের বাড়ানো দরকার। তাতে বাচ্চারা খুশিও হবে আর পুষ্টিও বাড়বে।” ঝুমা জানালেন, যখন আলুর ঝোলই প্রতিদিন দিতে বাধ্য হন তারা তখন বাচ্চাদের মায়েরা এসে তাদেরই প্রশ্ন করতে থাকেন। আবার কোনও সময় বেঁচে যাওয়া ভাত যদি সামান্য নেন তখন শুনতে হয় তারা চুরি করছেন। “যতদিন পর্যন্ত না সরকার আমাদের দাবি মানছে আমরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমাদের প্রথম দাবি শিশুদের পুষ্টির জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি। তারসঙ্গে আমাদের মাইনে বৃদ্ধি, সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি এগুলো তো আছেই,” বললেন ঝুমা।

 

নদীয়া জেলারই আরেক মিড ডে মিল কর্মী দেবিকা বসু গত ১৭-১৮ বছর মিড ডে মিল কর্মী হিসাবে কাজ করছেন। বললেন সন্তানস্নেহে বাচ্চাদের রান্না করে খাওয়ান তারা, সমস্তটুকু মনোযোগ দিয়ে নিজেদের কাজ করেন। স্পষ্টই বললেন, “এতদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি মাঝেমাঝেই আমাদের নানা বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না কারণ মাস্টারদের চাপ আছে, পাড়ার নেতাদের চাপ আছে, বিডিও-র চাপ আছে। যেমন ধরুন টিচার-রা আমাদের যা মেপেজুপে দেন আমরা তো সেই অনুযায়ীই রান্না করে খাওয়াই। কিছু স্কুল আছে যেখানে যারা রান্না করে তাদের খেতেও দেওয়া হয় না। অনেক জায়গায় টিচার-রা দুর্ব্যবহার করেন। তাছাড়া ধরুন বিডিও, নেতারা আর টিচার-রা একসঙ্গে বসে মিটিং করে আমাদের কাজে নিযুক্ত করেছেন। তাই যদি আমাদের সামান্য ভুল-ত্রুটিও হয় চাকরি কেড়ে নেওয়ার, কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। তাদের কথা আমাদের শুনতেই হবে, নাহলেই হুমকি আসে। আমাদের উপরে কিন্তু জোর করে অনেক দায়িত্ব চাপিয়েও দেওয়া হয়, যেগুলো আমাদের কাজ নয়, সেগুলোও আমরা মুখ বুজে করি। যেমন – পায়খানা-বাথরুম পরিস্কার করানো, ঘর ঝাড় দেওয়া-পরিস্কার করা, পুরো স্কুল পরিস্কার করা।” খাবারের গুণমান নিয়ে অভিযোগের প্রাথমিক তীর তাদের দিকেই আসে। অথচ সরকারি গুদাম থেকে আসা চাল হয় টিচার-রাই মেপে দেন বা তাদের তত্ত্বাবধানে মিড ডে মিল কর্মীরা নেন। সব্জি-তেল-মশলা স্কুলের টিচার-রা বা অশিক্ষক কর্মীরা বাজার করে আনেন, তার দায় কোনওভাবেই মিড ডে মিল কর্মীদের উপর বর্তায় না। “আমাদের প্রথম ও প্রধান দাবী খাবারের বরাদ্দ বাড়ানো হোক। যে টাকা সরকার দিচ্ছে তা দিয়ে কোনওভাবেই একটি বাচ্চার সম্পূর্ণ আহার বা পুষ্টিকর আহার সম্ভব নয়। আম্মা-র সদস্য হিসাবে আমরা ভাবছি এই বরাদ্দ চার মাসের নয় ১২ মাস করার দাবিতে আমরা নবান্নে একটা আন্দোলন করব। বলুন না, আজকে দৈনিক ৫০ টাকায়, স্বনির্ভর গোষ্ঠী হলে মাথা পিছু ১০-১৫ টাকায় আমাদের মতো পরিশ্রম কারা করে? সকাল ৯-১০টা থেকে তিনটে, হাইস্কুল হলে ৪-৫টা পর্যন্ত আমরা খাটি। সরকার কি এটা দেখছে না? তাদের অর্ডারেই তো সব হয়,” বললেন দেবিকা।

 

উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হাড়োয়ার মিড ডে মিল কর্মী আখতারউন্নেসার বক্তব্য, “যেহেতু আমরা সমাজের নীচের স্তরে থাকি, আমাদের মায়েরা অনেক সময়ে মাঠে কাজ করতে যায়, বাচ্চাটাকে বাড়ি রেখে যায়। কিন্তু স্কুলে যদি খাওয়া-দাওয়াটা ঠিক করে হয় তাহলে সে স্কুলমুখী হবে, খাওয়াটা ভালো পাবে, সঙ্গে অক্ষরটাও শিখবে। কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন সেটা ঘুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের নিত্যদিনের লড়াইয়ে ওরা মাত্র ৪ মাসের জন্য এই বরাদ্দটা বাড়াল। আমাদের যে বরাদ্দটা রেখেছে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা, ৬ টাকাই যদি ধরি, তাতে কি কিছু খাওয়া হয়? এই বরাদ্দ থেকে আমরা রান্না করতে বাধ্য হই, উল্টে আমাদেরই চোর অপবাদ শুনতে হয়, অনেক জায়গায় এমনকি গা-ও চেক করে। এতকিছুর পরেও মিড ডে মিল চালু রইল। আমাদের কিম্তু সম্মানটা রইল না। পশ্চিমবঙ্গে বড় মুখ করে বলে নিরক্ষরতা দূরীকরণ হচ্ছে। এইভাবে চললে বাচ্চারা কি স্কুলমুখী হতে পারে?”

 

উত্তর ২৪ পরগণার বাদুরিয়ার মিড ডে মিল কর্মী সঞ্চিতা সরকার। বললেন, “সরকার যে টাকাটা দেয় তাতে আলুর ঝোল ছাড়া কিছু হয় না। এখন যে বরাদ্দটা বাড়াল এটা ১২ মাস থাকুক। এটা শুধু আমরা নয়, গার্জেনরাও যেন ভাবেন। কেন চার মাস? চার মাস পরে কি বাচ্চাদের পুষ্টি ঠিক হয়ে যাবে? নির্বাচনের জন্য কেন বাচ্চাদের ব্যবহার করা হচ্ছে? আমাদের পাশে যেন অভিভাবকেরা থাকেন। সমস্ত সরকারি স্কুল চলে দুই ধরনের মানুষের জন্য – এক হল শিক্ষক আর আরেক মিড ডে মিল কর্মী। তাহলে আমাদের সঙ্গে এই বৈষম্য কেন? আমাদের উপর সব অপবাদ এসে পড়বে কেন? আমরা চাই সব মানুষের মুখে মুখে যেন আমাদের দাবিগুলো উঠে আসে, তাহলে আমাদের লড়াই নিয়ে আমরা আরও আশাবাদী হতে পারি।”

 

Share this
Leave a Comment