বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ বছরে ছ’মাস


  • January 12, 2023
  • (0 Comments)
  • 1082 Views

জলবায়ু পরিবর্তনে  ভারত বিপন্নতম অঞ্চলগুলির অন্যতম আসামের ধেমাজি। চেনা নদী অচেনা হয়ে উঠেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে। সরেজমিনে দেখলেন অন্বেষা সরকার

 

“গত তিন বছরে পাঁচবার ঘর বানিয়েছি। ঘর বানানোর জিনিসপত্র জোগাড় করতে করতেই ফের ঘর ভেসে যায়।” কথাগুলো বলছিলেন বিজয় পাইট। মিসিং জনজাতির এই যুবকের বাস আসামের ধেমাজি জেলায়। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে বন্যার গতিপ্রকৃতি। আসামে ধেমাজি, মাজুলি, লখিমপুর অঞ্চলের বন্যা হয়ে উঠেছে বিধ্বংসী, দীর্ঘস্থায়ী। এক-দু’সপ্তাহ নয়, এমনকি এক-দু’মাসও নয়, দীর্ঘ তিন মাসেও বন্যার জল নামে না ঘর থেকে। বাড়তে থাকে খাদ্যাভাব, নানা অসুখ, কঠিন থেকে কঠিনতর হয় জীবনযুদ্ধ। গবাদি পশু, শিশু, বয়স্ক, প্রসূতি, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, সকলে একত্রে ঠাঁই নেয় ত্রাণ শিবিরে। ঘরে ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত, জীবিকা অর্জনের পথ নেই, বন্ধ পড়াশোনা, চিকিৎসা। চেনা নদী অচেনা ঠেকে বছর বছর। কেবল বর্ষায় নয়, নভেম্বর বা মার্চেও জল ঢুকে পড়ে গ্রামে। ধেমাজির বাসিন্দারা জানালেন, এখন বন্যা হয় বছরে সব মিলিয়ে প্রায় ছ’মাস। বিজয় বললেন, “আমাদের বস্তিতে কখনও কখনও দু-তিনবার ঘর ভাঙতে হয়। যত জমি ছিল সব বন্যার পরে বালিতে ভরে গেছে।

 

গুয়াহাটি থেকে ৪৩০ কিলোমিটার দূরে, অসমের পূর্ব প্রান্তে ধেমাজি জেলা। উত্তরে ও পূর্ব সীমান্তে অরুণাচল প্রদেশ। দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদী ও ডিব্রুগড় জেলা, পূর্বে ডিব্রুগড় ও তিনসুকিয়া জেলা এবং পশ্চিমে লখিমপুর জেলা পরিবেষ্টিত। গুয়াহাটি থেকে রাতের ট্রেন ধরে সকালে নামতে হয় ধেমাজি শহরে, সেখান থেকে যাত্রা শুরু গ্রামের পথে। গ্রামের বাড়ি দেখলেই আন্দাজ হয়, জলই এখানে স্থাপত্য ঠিক করে দেয়। পাকা বাড়িগুলি ৬-৮ ফিট উঁচু থামের উপরে তৈরি। বাঁশের, কাঠের আর মাটির বাড়িগুলি বাঁশের উপরে, বা কাঠের থামের উপরে তৈরি। এগুলিকে ‘চাংঘর’ বলে। বন্যা আর বৃষ্টির জল বহু দিন দাঁড়িয়ে থাকলেও বাসস্থল যাতে ছেড়ে যেতে না হয়, সেই পরিকল্পনা মতো বাড়ি বানানো। বেশ কিছু বাড়ির সামনে নৌকো রাখা আছে। গ্রামের মধ্যে অনেকটা উঁচু একটা চাতাল তৈরি করা আছে, সেখানে রয়েছে টিউবয়েল আর শৌচাগারও। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সাধারণ সময়ের বাস্তু পরিকল্পনার সঙ্গে গ্রামের মধ্যে দ্বিতীয় একটি বাস্তু পরিকল্পনাও রয়েছে, যা বন্যার সময়ে কাজে লাগে।

 

‘ধেমাজি’ নামেও রয়েছে বন্যার দ্যোতনা। জিয়াধল এবং গাই নদীর প্রবল স্রোত এই অঞ্চলের জলের সঙ্গে খেলা করে বা ‘ধেয়ালি’ করে, সেই শব্দ থেকে ‘ধেমাজি’ জেলার নাম। ধেমাজিতে ২৬টি নদী পথ বিস্তার করে আছে। ১৯৮৪ সাল থেকে প্রতি বছর বন্যা হচ্ছে। ১৯৮৯ সালে, লখিমপুর জেলাকে বর্তমান লখিমপুর এবং ধেমাজি এই দুই জেলায় ভাগ করা হয়। জেলার মানুষের মুখ্য জীবিকা কৃষি। প্রধান শিল্প হল মুগা রেশম শিল্প ও ধান উৎপাদন। গত দু’দশকে ধেমাজির ভৌগোলিক অবস্থান এর বিপন্নতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসম চিরকালই বন্যাপ্রবণ রাজ্য। ‘বানপানি’-র সঙ্গে যুঝে জীবনসংগ্রাম এখানকার মানুষের আজীবনের অভ্যাস। এই অবস্থার সঙ্গে অভিযোজিত হতে হতেই টিকে থাকা আর শিখে শিখে, পালটে পালটে চলার জীবনশৈলী তাঁদের। উচ্ছেদ আর অভিবাসী হয়ে আসছেন এই এলাকার মানুষ বারবার। তবে যে রীতিতে নদীর সঙ্গে সহবাস ছিল এত দিন ধেমাজির মানুষদের, এখন তা থেকে পরিস্থিতি বদলে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমুখী প্রকোপ — ভাঙন, সার্বিক সুরক্ষাহীনতা, বালি জমে ওঠা, আর এর সঙ্গে খরা — এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

 

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ভারতের সবচেয়ে ঝুঁকি-প্রবণ অঞ্চলগুলির একটি। এখানকার ৪০ শতাংশ জমি বন্যা এবং ভাঙনের কবলে। প্রতি বছর আসামের রাজ্যের ২৩টি জেলার মধ্যে ২১টি প্লাবিত হয়। গ্রাম, জীবন, সম্পত্তি এবং জীবিকা সব ভেসে যায়। এর জন্য দায়ী করা যায় অরণ্য ধবংস, উন্নয়নের দোহাই দিয়ে অপরিকল্পিত ভাবে জমি ব্যবহার, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিকল্পনার অভাব ইত্যাদিকে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মে থেকে আগস্ট মাসে প্রতি বছর বন্যা হয়। ২০২২ সালে জুন মাস থেকে ধেমাজিতে বন্যা শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক হারের চাইতে ৬৩% বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে মার্চ-এপ্রিলেই, ভারতে যেখানে বর্ষা শুরু হয় জুন মাসে। ১৯৫৪ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে আসাম বারোটি বড় বন্যার সম্মুখীন হয়েছিল, প্রতিবেশী নেপাল, বাংলাদেশ এবং ভুটানেও একই অবস্থা। বিশ্ব উষ্ণায়ন, হিমবাহের গলন এবং ভারী বৃষ্টিপাতের প্রভাব মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরের চলে গেছে।

 

পরিবেশ নিয়ে কর্মরত একটি অসরকারি ভারতীয় সংস্থা কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার-এর রিপোর্ট (২০২১) অনুযায়ী, পরিবেশের কারণে বিপন্ন (‘ক্লাইমেট ভালনারেবেল’) জেলাগুলির শীর্ষে রয়েছে ধেমাজি জেলা। এর ভৌগোলিক অবস্থান অদ্ভুত, ব্রহ্মপুত্র নদী অরুনাচল প্রদেশের পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এখানে হরপা বান হয়। নদী-বাহিত বালি জমা হয়ে তৈরি হয় ‘চাপরি’ — অনুর্বর, চাষের অযোগ্য সাদা বালির চর। ২০১৪ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ইউএনডিপি আসাম মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে চাপরি অঞ্চলগুলির অনুন্নয়নের কারণ হিসাবে দেখিয়েছে যোগাযোগের ঘাটতি, প্রাথমিকের শিক্ষার স্তরে পর্যাপ্ত বিদ্যালয়ের সুবিধার অভাব, বাল্যবিবাহ, দারিদ্র এবং নিরক্ষরতা। চাপরিগুলি অপ্রশস্ত হওয়ায় বন্যার সময়ে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছনো কঠিন হয়।

 

ধেমাজি জেলার আজারবাড়ি এমনই এক বন্যাকবলিত গ্রাম। মিসিং, হাজং, আকাজাং, নেপালি, উদ্বাস্তু বাঙালি বসবাস করেন। বন্যা, ক্ষয়প্রবণতা ও খরার প্রকোপে চরের জনসংখ্যার ৮০% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। মুক্তিয়ার গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট পরমানন্দ পেগু জানান, “উদ্বাস্তু, বন্যা পীড়িত, প্রান্তিক জনজাতি হল হাজং, তাদের মধ্যে নারীর প্রান্তিকতা আরও বেশি।”

 

ইউনিসেফ এই অঞ্চলে সরকারের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, স্থানীয় অসরকারি সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বন্যার প্রস্তুতিতে সাহায্য করে, রিলিফ ক্যাম্প পরিচালনায় সহায়তা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, বিকল্প জীবিকা প্রভৃতি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে। “শিশু-অনুকূল পরিসর বা ‘চাইল্ড ফ্রেণ্ডলি স্পেস’ তৈরি করা হয়েছে ২০১৪ সাল থেকে। উঁচু চাতালে শিশুরা আশা কর্মী ও অঙ্গনয়াড়ি কর্মীদের তত্ত্বাবধানে থাকে। স্কুলের শিক্ষকেরাও এসে পড়ান,” বললেন ইউনিসেফ-এর সহযোগী স্থানীয় সংস্থা, রুরাল ভলান্টিয়র সেন্টার-এর পরিচালক লোহিত গোস্বামী।

 

প্রভাবতী হাজং এলাকার অঙ্গনয়াড়ি কর্মী। “বাচ্চা যাতে দূষিত জল পান না করে, কাটা ছেঁড়া হলে যেন জানায়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হয়। শিশু খেলতে খেলতে জলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, চোখে চোখে রাখতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, প্রাণচঞ্চল শিশুরা অল্প পরিধিতে আটকে পড়ে, তাদের মন ভাল রাখার কথাটাও ভাবতে হয়।” প্রভাবতী শিশুদের নানা কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন। শিশুদের গান শোনান, গান বাঁধেন। “সকাল ৮টা থেকে বেলা ১২টা অঙ্গনওয়াড়িদের কাজের নির্ধারিত সময় হলেও, আমরা বন্যার সময় সারা দিন এখানেই থাকি। ডাল-ভাত ছাড়াও শিশুরা ছাতু, ডিম, কলা, সুজি পায়।” এ সব ব্যবস্থা সত্ত্বেও, বন্যার সময়ে পরিবারে তীব্র অভাবের সুযোগে শিশু পাচার চলে। প্রধানত গার্হস্থ্য শ্রমের জন্য দরিদ্র শিশুদের নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। তেইশ বছরের কুশল হাজং এই গ্রামের বিএ পাশ করা যুবক। তিনি জানালেন, অভাবী শিশুদের কাজ দেবার কথা বলে শিশু পাচার হয়ে যেতে দেখেছেন। “এখন পাচার বিষয়ে শিশু-কিশোর ও তাদের পরিবার অনেক সচেতন হয়েছে। মোবাইল ফোনের সুবাদে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে। আগের তুলনায় সংগঠিত ভাবে পাচার প্রতিরোধ উদ্যোগ বেড়েছে।”

 

বন্যাকে ঘিরে এখানে স্থির হয় সমাজ-সংসারের সব কাজ। ফাল্গুন-মাঘে বিয়ে সারা হয়, উঁচু চাতালে গর্ভবতীর ‘সাধ’ দেওয়া হয়। কঠিন পরিস্থিতিতে বাস করেও দুঃখ-সুখের আদানপ্রদান হয়। বাইরের জগতের কাছে যা ত্রাণশিবির, ধেমাজির মতো জায়গায় তা দৈনন্দিন জীবনের আশ্রয়। সেখানে জীবনের উদযাপন চলে অর্ধেক বছর।

 

Share this
Leave a Comment