শত শত মেয়ে, যাঁরা দেশের বিভিন্ন শহরের নানা জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন, কেউ কারখানায়, কেউ রাস্তা নির্মাণকর্মী রূপে, কেউ ফ্লাইওভার নির্মাণ-শ্রমিক হিসাবে, তাঁদের বহুজনকেই শৌচাগারের অপ্রতুলতায় অসুবিধা ভোগ করতে হয়। পিরিয়ড চলাকালীন জল না থাকায় অনেকে শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন না। এমনকি, কর্মস্থলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতের সময়েও শৌচাগার না থাকায় সমস্যায় পড়েন পরিযায়ী মহিলা শ্রমিকেরা। ন্যূনতম স্যানিটারি ন্যাপকিনের জোগানটুকুও কর্মস্থল থেকে দেওয়া হয় না। যেখানে-সেখানে প্রস্রাব-পায়খানা করায় বিকোলাইয়ের মতো সংক্রমণ জনিত রোগে ভোগেন মেয়ে শ্রমিকেরা। এই সব রোগ প্রতিরোধে কোনও সরকারি সচেতনতা মূলক শিবির বা নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষারও ব্যবস্থা নেই। উদাসীন কেন্দ্র-রাজ্য। এই বিষয়ে কয়েক জন মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকের দিনলিপি তুলে ধরার প্রয়াস করলেন চৈতালি বিশ্বাস।
২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনাহীন লকডাউনে বহু পরিযায়ী শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন। করোনা অতিমারির সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসস্থান, খাদ্য, স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা ছাড়াই যেভাবে তাঁদের কর্মস্থলে আটকে রেখে লকডাউন জারি করা হয়, তা ভয়াবহ আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে। কাজ এবং মজুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকেরা ভিন রাজ্যে বাড়ি ফেরার চেষ্টা শুরু করে। ট্রেন, বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পায়ে হেঁটে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেন মানুষগুলি। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি, ঘুমহীন দিন-রাত পেরিয়ে রাজপথ দিয়ে হেঁটে চলে কঙ্কালসার কিছু মানুষ। যাঁদের দায় নিতে অস্বীকার করে তুঘলকি শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী রাষ্ট্র।
অন্যদিকে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে পড়ে কয়েকটি পরিযায়ী স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে পা রাখতে প্রয়োজন হয় করোনা নেগেটিভ রিপোর্টের। সেই পরীক্ষার খরচ বহন করা তো দূরস্থান, মানুষগুলির কাছে তখন ট্রেনের টিকিটের ভাড়া মেটানোর মতো পয়সাটুকুও নেই। লকডাউনের সেই ভয়াবহ দিন থেকে বেঁচে ফেরা এক পরিযায়ী শ্রমিকের কথায়, ‘‘আমরা তখন কোনওমতে বাড়ি ফিরতে চাইছি। জমানো টাকা সব শেষ। জানি, দেশের বাড়ি ফিরতে পারলে অন্তত চাষবাস করে দু’বেলা খাবারটুকু জুটবে। এর মধ্যে হাজার টাকা খরচ করে করোনা পরীক্ষা করার মতো অবস্থা কোথায় আমাদের? ট্রেনের টিকিটের ঝামেলায় না গিয়ে তাই পায়ে হেঁটেই বাড়ির দিকে রওনা দিই। প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে ফেরার তাগিদে আমাদের মতো শ’য়ে শ’য়ে মানুষ তাই করেন।’’
সেই সময়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেয়েদের ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা। এমনিতেই এই দেশে মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে আলোচনা, ধারণা অত্যন্ত কম। যে দেশে মেয়েদের গর্ভে আসার পরে লিঙ্গ নির্ধারণের অবৈধ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে লড়াই করে বেঁচে জন্ম নিতে হয়, সেখানে যে ঋতুকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা উপেক্ষিত হবে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। লকডাউনের সরকারি নির্দেশ এবং করোনার ভয় উপেক্ষা করে মহারাষ্ট্র, দিল্লির পথে দেখা মেলে বহু অন্তঃসত্ত্বা মহিলার। তাঁদের প্রসূতিকালীন পুষ্টি, বিশ্রাম ব্যাহত হয়। পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে অনেকেও মৃত্যুও ঘটে। তার পরেও দেশের সরকারকে কোনও সুসংহত নীতি গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। লকডাউনের সময়ে মৃত্যু ঘটে জামলো মকদম নামে এক কিশোরীর। যে টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে দূরের এক শহরে লংকা খেতে কাজ করতে গিয়েছিল। কিশোরীবেলার স্কুলের ক্লাসরুম, বন্ধু, খেলাঘর ফেলে সে নিতান্তই পরিণত হয় শিশুশ্রমিকে। কিন্তু তার পরেও দেশের নীতি-নির্ধারকদের অপরিকল্পিত লকডাউন তার সেই রোজগারের শেষ সুযোগটুকুও কেড়ে নেয়। ক্লান্ত শরীরে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করতে থাকে মেয়েটি। কিন্তু ঘরের থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে এসে সে প্রাণ হারায়। এই জামলো মাকদম আমাদের দেশের সংবিধান নির্ধারিত নাগরিক অধিকারের ব্যর্থতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এই মেয়েটিকেই মডেল ধরে সমাজবিজ্ঞানের ধারণায় কয়েকটি যৌক্তিক প্রশ্ন উঠে আসে। পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে কত শতাংশ শিশুশ্রমিক অবৈধভাবে এই দেশে করোনাকালে কাজ করে চলছিল? তার কোনও হিসাব কি এই দেশের সরকারের কাছে ছিল? না থাকলে কেন নেই? থাকলে তা বন্ধ করার জন্য প্রশাসন কেন কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করল না?
দ্বিতীয়ত, প্রসূতি পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কেন বিশেষ কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করল না? বিশেষত, করোনার মতো সংক্রমণ জারিত রোগের থেকে মা এবং সদ্যোজাত শিশুকে রক্ষা করা যখন সবিশেষভাবে জরুরি ছিল।
তৃতীয়ত, মেয়েদের দীর্ঘ পথ হেঁটে বাড়ি ফেরার সময়ে ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি কতখানি উপেক্ষিত হয়েছিল? যেখানে এই দেশের নিম্নবিত্ত বর্গের মেয়েরা এখনও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ নয়, তাঁরা এখনও প্রাচীনভাবে পুরনো কাপড় ব্যবহারে অভ্যস্ত, লকডাউনের সময়ে রাস্তায় তাঁরা কীভাবে ঋতুকালীন দিনগুলি অতিক্রান্ত করল? পর্যাপ্ত জল, শৌচালয় ছাড়াই?
শত শত মেয়ে, যাঁরা দেশের বিভিন্ন শহরের নানা জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন, কেউ কারখানায়, কেউ রাস্তা নির্মাণকর্মী রূপে, কেউ ফ্লাইওভার নির্মাণ-শ্রমিক হিসাবে, তাঁদের বহুজনকেই শৌচাগারের অপ্রতুলতায় অসুবিধা ভোগ করতে হয়। পিরিয়ড চলাকালীন জল না থাকায় অনেকে শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন না। এমনকি, কর্মস্থলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতের সময়েও শৌচাগার না থাকায় সমস্যায় পড়েন পরিযায়ী মহিলা শ্রমিকেরা। ন্যূনতম স্যানিটারি ন্যাপকিনের জোগানটুকুও কর্মস্থল থেকে দেওয়া হয় না। যেখানে-সেখানে প্রস্রাব-পায়খানা করায় বিকোলাইয়ের মতো সংক্রমণ জনিত রোগে ভোগেন মেয়ে শ্রমিকেরা। এই সব রোগ প্রতিরোধে কোনও সরকারি সচেতনতা মূলক শিবির বা নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষারও ব্যবস্থা নেই। উদাসীন কেন্দ্র-রাজ্য।
এই বিষয়ে কয়েক জন মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকের দিনলিপি তুলে ধরার প্রয়াস থাকল।
শ্রমিকের কথা ১
তাঁর নাম কল্পনা দাস। বয়েস ৪৫ বছর। পরিচয় পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়ি নদিয়া জেলার পলাশির সুগারমিল এলাকায়। যেখানে পৌঁছাতে পশ্চিমবাংলার কলকাতা থেকে মোটামুটি সাড়ে চার ঘণ্টার ট্রেন জার্নি করতে হয়। কল্পনা বিবাহিত। সন্তান, স্বামী নিয়ে সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। কিন্তু বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝে অনেকটাই ফারাক। তাই গ্রামের ঘরে থেকে দিনমজুরি করে পরিবারের তেমন আয় হয় না। বড় ছেলে থেকে যায় গ্রামেই, অন্যের চাষের জমিতে জোগাড়ের কাজ করেন। ছোট ছেলে আর স্বামীর সঙ্গে কয়েক বছর আগে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন কল্পনা। অর্থ উপার্জনের কাজ করতে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন দিল্লির গুরগাঁও সীমান্তে, চক্রপুর নামের এক ঘিঞ্জি এলাকায়।
কল্পনা বর্তমানে সেখানেই রয়েছেন। গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন দিল্লির বিত্তশালী এলাকার নানান হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে বসবাসকারী উচ্চবিত্ত সোসাইটির চারটি বাড়িতে। কল্পনার বাস্তবের মাটি থেকে আকাশের উচ্চতা আর তাঁর গৃহকর্ত্রীদের বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদ থেকে আকাশের উচ্চতার বিস্তর ফারাক। তাই কোন পরিসর থেকে উঠে এসে কল্পনা সাধারণ একজন গৃহবধূর জীবন থেকে পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন বেছে নেন স্বেচ্ছায়, তা তাঁর গৃহকর্ত্রীরা কল্পনাও করতে পারেন না। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে কুণ্ঠিত গলায় কল্পনা বলেন, ‘‘দিদি, আমি তো বেশি কিছু বুঝি না, পড়াশোনাও জানি না। আমার কথা জানতে হলে আমার ছেলের কাছ থেকে জানুন। আমি কী বলতে কী বলব, ভুলভাল হবে, তাঁর চেয়ে আমার ছেলের থেকে আমার কাজ নিয়ে জেনে নেওয়াই ভাল হবে।’’ প্রসঙ্গত লক্ষণীয়, কল্পনা জানেন, পড়াশোনা জানার মূল্য কতটা! তাই তাঁর সাক্ষরজ্ঞান না থাকা নিয়ে এতটা সংকোচ। কে বলতে পারে, হয়তো উপযুক্ত আর্থিক ও সামাজিক পরিবেশ পেলে কল্পনাও পড়াশোনা শিখে ওই বহুতল বাড়িগুলির কোনও একটির বাসিন্দা হতে পারতেন!
কল্পনা বলেন, ‘‘লোকের বাড়ি বাসন ধোয়া, ঝাড়ুপোঁছা, কাপড় কাচার কাজ করি। ছোট ছেলের বিয়ে হয়েছে, ছেলের বৌয়ের ক’দিন আগেই বাচ্চা হয়েছে। ও ঘর থেকে বেরতে পারে না। অথচ, পেটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাই আমায় এখন আরও লোকের বাড়ি কাজ নিতে হয়েছে।’’
কল্পনায় থেকে জানা গেল, তিনি চার বাড়ির যাবতীয় গৃহকাজ করেও মাসে উপার্জন করেন মাত্র আট হাজার টাকা। আর তাঁর সেই উপার্জনেরর টাকা ঘরভাড়া দিতেই শেষ হয়ে যায়। বাকি সংসার, খাওয়া খরচ পরিযায়ী শ্রমিক বাবা আর ছেলের মাসভর শরীরপাত করা পরিশ্রমের টাকায় জোটে।
কাজের বাড়িতে খুব একটা অবসর মেলে না তাঁর। ঘড়ি ধরে একের পর এক কাজ এসে জমা হয় হাতের কাছে। শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাটঘরের গৃহ-সহায়িকা হলেও গরম রান্নাঘরেই ঘামতে ঘামতে বাসন মাজার কাজ করেন তিনি। কখনও দারুণ দহন দিনে রোদের মধ্যে পায়ে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার অন্তর কাজের বাড়ি পৌঁছতে হয়। রোদ-ঝড়-জল কোনও কিছুতেই কল্পনার ছুটি নেই। প্রথমে বাসন মাজা, তার পর ঘর মোছা, তার পরে কাপড় কাচার মতো পরিশ্রমসুলভ কাজ অভ্যস্ত হাতে দক্ষতার সঙ্গে সামলান কল্পনা। তার পর ফের পরের কাজের বাড়ি গন্তব্য তাঁর।
জানা গেল, মাসের তিন থেকে চার দিন মেনস্ট্রুয়েশন চলাকালীন পেটের ব্যথায় কাজ করতে সমস্যা হয় ওই মহিলার। কিন্তু সেভাবে ছুটি মেলে না। কারণ এই দেশের সরকারি বা বেসরকারি সংগঠিত কর্মক্ষেত্রে এখনও পিরিয়ডের কারণে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত কোনও ছুটির চল নেই। সেক্ষেত্রে পরিযায়ী শ্রমিকের মতো অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য মেনস্ট্রুয়াল লিভ আশা করাও বাতুলতা। কল্পনা এত জানেন না, তিনি জানেন, বেশি ছুটি চাইলে কাজের বাড়ি থেকে পরিচারিকা ও গৃহ-সহায়িকাদের ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে মালকিনদের রাগ করাকে সংগত হলেই মনে করেন ওই পরিযায়ী শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘‘মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হলে ছুটি নিই। কিন্তু দাদা-বৌদিরাও তো অফিসে চাকরি করেন। আমি কাজে না গেলে সমস্যায় পড়েন। তাই বেশি কামাই কেউ-ই পছন্দ করেন না। ওঁদের দোষ দেব কী করে?’’
পিরিয়ড হলে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে হয় কল্পনাকে। তাতে মাসে অনেকটা খরচ পড়ে। কিন্তু আগের মতো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করতে চান না কল্পনা। একবার ভয়াবহ সংক্রমণে ভুগে ওই অপরিষ্কার কাপড়, ন্যাকড়া ব্যবহারের অভ্যাস বদলে ফেলেন কল্পনা। কল্পনা দিল্লির বাড়ি থেকে ফোনে বলেন, ‘‘আমাদের মতো গরিব মেয়েদের যদি সরকার থেকে বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হয়, তা হলে খুব উপকার হয়। সারা মাসে যেটুকু রোজগার করি, পুরোটাই প্রায় চলে যায় ঘরভাড়া, ইলেকট্রিকের বিলে। তারপরে স্বামী আর ছেলের কাছে হাত পাততে হয়। এ দিকে, মাসিক হলে নিজের জন্য মাসে এক প্যাকেট আর ছেলের বৌমার জন্য আরেক প্যাকেট স্যানিটারি প্যাড কিনতে হয় ওষুধের দোকান থেকে। খুব গায়ে লাগে।’’
তবে মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন সম্পর্কে কল্পনার কোনও স্বচ্ছ ধারণা নেই, কথায় কথায় বোঝা যায় তা। প্রতি মাসে মাসিকে পেট ব্যথা বেড়ে যাওয়া কিংবা ব্যক্তি বিশেষে রক্তক্ষরণ কম-বেশি হওয়ার প্রভাবে যে শারীরিক অসুবিধা বা ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়েও কখনও কোনও সচেতনতা শিবির বা স্বাস্থ্য শিবিরে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই কল্পনার।
জানতে চাওয়া হল কাজের বাড়ি গিয়ে কখনও মেনস্ট্রুয়েশন হলে কী করেন কল্পনা?
উত্তরে কল্পনা বলেন, ‘‘বাড়ির বৌদিদের থেকে প্যাড চেয়ে নিই। অনেকে দেন। অনেক বছর যে বাড়িতে কাজ করছি, সেখানে খুব একটা অসুবিধা হয় না। কিন্তু নতুন নতুন কাজে ঢুকে স্যানিটারি ন্যাপকিন চাইতে লজ্জা লাগে। ভাবি, যদি কিছু মনে করে। তখন দোকান থেকে কিনে এনেই ব্যবহার করি।’’
আর একটা গুরুতর সমস্যা হয় পরিযায়ী মহিলা শ্রমিকদের শৌচাগার ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কল্পনা জানালেন, তাঁর কাজের বাড়ির মালকিনেরা খুবই ভাল। তাঁকে শৌচাগার ব্যবহার করতে দেন। কারণ, তিনি যে বহুতল আবাসনে গৃহ-পরিচারিকা কাজ করেন, সেখানে গৃহ সহায়িকাদের জন্য আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট করা শৌচাগার রয়েছে। কিন্তু তাঁর মতো আরও অনেক পরিচারিকা যাঁরা শহরের ছোট ছোট বাড়িতে কর্মরতা, তাঁদের প্রস্রাব চেপে থাকতে হয় দীর্ঘক্ষণ। অতীতে কাজের বাড়িতে গিয়ে সে অভিজ্ঞতাও হয়েছে কল্পনার।
তবে রোগ-কষ্ট-যন্ত্রণার চেয়েও খিদের কাছে এসে নতজানু হয়েছে ওই পরিযায়ী শ্রমিক। তাই শরীর নিয়ে বেশি না ভেবে রোজ কাজে যান ওই পরিযায়ী শ্রমিক। প্রয়োজনে প্রস্রাব চেপে রেখে কাজ শেষ করেন।
এটি কর্মস্থলে মহিলা শ্রমিকের স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিঘ্নিত হওয়ার বিবরণ। কিন্তু বাড়িতেও তাঁদের অবস্থা একই রকম খারাপ। যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন ওই মহিলা পরিযায়ী শ্রমিক, সেখানেও প্রতিনিয়ত শৌচকর্মের সমস্যায় পড়তে হয় তাঁকে। দিল্লির ওই জনবহুল এলাকায় মূলত পরিযায়ী শ্রমিকদের বসবাস। দূর দেশ থেকে টাকা রোজগারের জন্য আসা মানুষগুলো কাজ থেকে ফিরে রাতটুকু কোনও মাথা গোঁজে ওই সব ভাড়াবাড়িতে। ছোট ছোট দেশলাই বাক্সের মতো খোপে এক একটি পরিবার বাস করে। মূলত কলোনি এলাকা। একটি ঘরে চার-পাঁচ জন মানুষের বাস। তবে ভাড়ার তিনটি ঘরের জন্য একটি শৌচালয় বরাদ্দ। কল্পনার কাছে জানা গেল, সকালে কাজে বেরনোর আগে দীর্ঘ লাইন পড়ে শৌচাগারের সামনে। পুরুষের বাইরে মূত্রত্যাগ করতে পারলেও মহিলাদের সেই সুবিধা নেই। বাধ্য হয়ে বেগ চেপে বসে থাকতে হয়, শৌচাগার ফাঁকা হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয়। মেনস্ট্রুয়েশনের দিনগুলিতে ন্যাপকিন বদলেও সমস্যায় পড়তে হয়। দীর্ঘ সময় একটি ন্যাপকিন ব্যবহারের কারণে অনেক সময়েই ঋতুস্রাব জমাজনিত রক্ত থেকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটে। তলপেটে ব্যথা, ঘন ঘন মূত্রত্যাগের সমস্যার মতো নানা মহিলাজনিত সমস্যায় ভোগেন মেয়েরা। তাছাড়া, শৌচাগারের অপ্রতুলতার কারণে মহিলাদের মূত্রত্যাগ বিলম্বিত হয়। রেচনতন্ত্রের উপরে চাপ পড়ে। যা থেকে পরবর্তী সময়ে কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। অথচ, এই সকল বিষয়ে কোনও সরকারি স্তরে প্রচার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা মেয়ে শ্রমিকদের সচেতন করার প্রকল্প নেওয়া হয় না।
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে, মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে সরকার আরও জোরালো প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করছে না কেন? বিশেষত, যেখানে এই দেশে একটা বড় অংশের মহিলারা জরায়ু মুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন বা মারা যাচ্ছেন, সেখানে পরিযায়ী মহিলা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টি এত অবহেলিত কেন?
শ্রমিক কথা ২
নাম সীমা পাল (নাম পরিবর্তিত)। বাড়ি মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামে। বয়েস পঞ্চান্নের কাছাকাছি। বর্তমানে থাকেন কেরলে। সেখানে গৃহনির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন সীমা।
কথায় কথায় জানালেন, এখন আর ভারী কাজ করতে পারেন না সীমা। শরীর দেয় না। তিনি জানান, এক সময়ে যখন নতুন নতুন বিয়ে হয়ে সংসারে আসেন, কখনও বাড়ির কাজে কোনও পুরুষের সাহায্য চাইতেন না। নিজেই ভারী ভারী চাষের জিনিস বয়ে নিয়ে যেতেন ধানখেতে, কাজের জায়গায়। কিন্তু বয়েস যত বেড়েছে, পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমেছে কল্পনার। হাতে-পায়ের জোর কমেছে। তবে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুরক্ষিত উপার্জন আয়ত্তে আসেনি। যত বয়েস বেড়েছে, ঠিকা কাজ যাওয়ার ভয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিক ওই মহিলার। এক ঠিকাদার থেকে আরেক ঠিকাদার, কাজের বরাত পাওয়ার জন্য সকলের পায়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন। যেটুকু মজুরি জোটে, তাতেই খুশি থাকতে হয়। বেশি টাকার দাবি মানেই ছাঁটাইয়ের ভয়। অতএব, শ্রম দিয়েও স্বস্তি নেই।
একাধিক বার সাক্ষাৎ ও কথোপকথনে জানা গেল, কল্পনার কল্পজগতের সীমাহীন অন্ধকারময়তার কথাও। জানা গেল, বয়স যখন অল্প ছিল আর নতুন নতুন শহরের অচেনা রাস্তায়, অলিতেগতিতে কিংবা শ্রমিক হিসাবে নতুন কাজে যোগ দিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। কিছু কিছু সাইটে পুরুষদের মধ্যে মেয়েমানুষ হয়ে রাত-দিন থেকে কাজ করতে ভয় পেতেন। কখনও রাত বেশি হলে ফাঁকা এলাকা দিয়ে হেঁটে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরতে বুকের ভিতরে ভয় জমাট বাঁধত। কিন্তু পেটের তাগিদে আবারও পরের দিন রাতে জনমানবশূন্য রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে যেতেন ভিন রাজ্যের বাসিন্দা পরিযায়ী শ্রমিক মেয়েটি। স্বামীকে কাজের জায়গা থেকে বস্তির নিজের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলার বিলাসিতা তাঁর পোষায় না, জানতেন সীমা। শ্রমিক স্বামী যে তখন আরও দুটো ঘণ্টা বেশি খাটছেন ওভারটাইমের টাকা রোজগারের তাগিদে। তখন একা মেয়ের বাড়ি ফেরার চিন্তা নিয়ে কেউ ভাবিত ছিলেন না। যেমন ইট-কাঠ-পাথর মাথায় করে বয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে তার ভারে যখন গর্ভপাত হয়ে যায় মেয়েটির, তখনও তাঁর পাশে কেউ ছিলেন না। একাই রক্তপাত বন্ধ করার তাগিদে পৌঁছে গিয়েছিলেন সরকারি হাসপাতালে। পরে আর কখনও সন্তান গর্ভে নেননি। স্বামী চাননি সীমার সন্তান হোক। কারণ, সন্তান পেটে ধরলে নির্মাণ শ্রমিক স্ত্রীয়ের মাস কয়েকের রোজগার বন্ধ হবে যে। সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রের চেয়ে টাকা রোজগারের যন্ত্রের মূল্য বেশি, এমনটাই মনে করেছিলেন সীমার কর্মক্ষেত্রের ঠিকাদার থেকে তাঁর স্বামীও।
ফেরা যাক বর্তমান সময়ে। সীমা এখন একাই দেশ-দেশান্তরে শ্রমিকের কাজ করে বেরান। স্বামী দুই বছর হল, মারা গিয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে কোনও পিছুটান নেই তাঁর। কিংবা থাকলেও টাকা রোজগারের তাগিদে পড়ে রয়েছেন কেরলে। জানালেন, যে দিন থেকে নির্মাণশ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন, হাতে-পায়ের চামড়া শক্ত হয়ে গিয়েছে। ঘাড়ে, কোমরে অসহ্য ব্যথা। তবু কাজে কমতি নেই। কোনও দিন কোনও ঠিকাদার মালিক বা সংস্থার মালিকপক্ষের তরফে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়নি। লকডাউনের সময়ে যে ক’ মাস কাজ বন্ধ ছিল, মাইনে পাননি। ফলে, খাবারও জোটেনি। বাধ্য হয়ে দেশের বাড়ি মুর্শিদাবাদে ফিরেছিলেন। করোনার প্রকোপ কমতে ফের কাজে যোগ দিতে কেরলে চলে গিয়েছেন। করোনায় ভুগে স্বামী মারা গিয়েছেন। করোনা হয়েছিল সীমারও। শ্বাসকষ্টের সমস্যা এখনও রয়েছে। তবে চিকিৎসা করানোর মতো পয়সা নেই। যতদিন বাঁচবেন, এই ভাবে ধুঁকে ধুঁকে শ্বাস টেনেই কাজ করে যাবেন। ইট বইবেন। পাথর বইবেন। সিমেন্ট-বালি বইবেন। সীমার শরীরের শেষ শক্তিটুকু খরচ করে গড়ে উঠবে কংক্রিটের মজবুত ঘর। কিন্তু সীমার বিষণ্ণ শরীর-মনের খবর, ক্ষয়ে যাওয়া ফুসফুসের খবর কেউ পাবেন না।
শ্রমিকের কথা ৩
২০২০ সালের দেশজোড়া লকডাউনে একুশ দিনের ছেলে নিয়ে ভিন্ রাজ্যে আটকে পড়েছিল এক পরিযায়ী শ্রমিক পরিবার। অনেক সংগ্রাম আর পরিশ্রম করে সদ্যপ্রসূতি মহিলা তাঁর সন্তানকে নিয়ে পশ্চিমবাংলায় ফেরেন। কিন্তু তাঁর মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা পুরোপুরি বিঘ্নিত হয়।
সেই সময়ে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় প্রসূতির স্বামীর সঙ্গে। সদ্যোজাত শিশুর জন্য সামান্য হরলিক্সের আবেদন রেখেছিলেন অসহায় বাবা। জলে গুলে শিশুকে খাওয়াবেন, কারণ দুধ কেনার টাকা নেই শ্রমিক পরিবারটির কাছে।
২০২০ সালের জুলাই মাসে যোগাযোগ হলে জানা যায়, সাড়ে তিন মাস ধরে তারকেশ্বর গয়েশপুর গ্রামের বাসিন্দা হাসান মল্লিক আটকে ছিলেন দিল্লির মাণ্ডিগাঁওয়ে। তাঁর সঙ্গে আটকে ছিলেন স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন, এগারো বছরের এক ছেলে এবং একুশ দিনের এক সদ্যোজাত। সৌজন্যে লকডাউন এবং দেশের আর্থ-সামাজিক শ্রমিকনীতি।
হাসান বাংলা থেকে দিল্লিতে রুজির সন্ধানে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক, তিনি এত বছর ধরে এমব্রডারির কাজ করে পরিবারের অন্নসংস্থান করেছেন। কিন্তু ওই বছর মার্চ মাস থেকে তাঁর রোজগার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পাহাড়ের উপরে যে বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন, সেখানে লকডাউনের দুই মাস ভাড়া মকুব করে দিয়েছিলেন বাড়িওয়ালা। কিন্তু আনলক পর্ব শুরু হতেই বাড়িভাড়া চেয়ে এসেছে তাগাদা। এমনকি, এ-ও শুনতে হয়েছে এখনকার বাড়িভাড়া না দিলে সদ্যোজাতকে সমেত ঘর থেকে বের করে দেওয়া হবে পরিবারটিকে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বাড়ি মালিকের নামে অভিযোগ করতেও পারেননি হাসান, কারণ তিনি ধর্মে আবার মুসলিম! ওই হিন্দু বাড়ির মালিকই তার স্থানীয় অভিভাবক, সামাজিক রক্ষাকর্তা। দিল্লি হিংসার পর থেকে প্রাণভয়ে ভীত মুসলিম মানুষটি নিজের পরিবার নিয়ে আরও কোনও নতুন ঝামেলায় জড়াতে চাননি। ফলে, পেটে দেওয়ার মতো খাবারের টাকা হাতে না সত্ত্বেও, ধার-বাকিতে ১৫০০ টাকা জোগাড় করে আগে বাড়িভাড়া মিটিয়েছেন হাসান।
সমস্যার শুরু লকডাউন ঘোষণার সময় থেকে। তার পর থেকে সমস্যার কোনও শেষ দেখতে পায়নি পরিবারটি। হাসান জানান, এমব্রয়ডারির কাজ করতে দিল্লিতে যাতায়াত রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। মাঝে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরই মধ্যে লকডাউন হলে তাঁরা সেখানে আটকে পড়েন। রোজগারহীন অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর শরীরের যত্ন দূরের কথা, ন্যূনতম ডাল-ভাত জোটাবেন কী ভাবে, সে দুশ্চিন্তায় ঘুম উড়ে যায়।
সেই সময়ে কলকাতার ‘কোয়রান্টিনড স্টুডেন্ট ইয়ুথ নেটওয়ার্ক’ নামে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা তরুণদের সংস্থার সদস্য দেবজিৎ ঠাকুরের সঙ্গে হাসানের যোগাযোগ হয়। তিনিই প্রাথমিকভাবে পরিবারটির রেশনের বন্দোবস্ত করেন। নিজের হাজারো সমস্যা সত্ত্বেও হাসান স্বার্থপর হননি। ভোলেননি বাকি পরিযায়ী শ্রমিকদের অসহায়ত্বের কথা। দেবজিতেরা যখন তাঁকে টাকা পাঠান, তিনি লজ্জিত হয়ে বলেন, ‘‘লোকে চাল-ডাল পাচ্ছে না, আমি হরলিক্স আর ফলের জন্য আব্দার করছি! কিছু মনে করবেন না দাদা। বউটাকে দেখভাল করতে পারছি না ভাল করে।’’
এর পর ১৫ জুনের শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে বাড়ি ফেরার টিকিট কাটেন হাসান। কিন্তু ফেরার ঠিক আগের রাতে স্ত্রী সাবিনার প্রসববেদনা ওঠে এবং হাসপাতালে ছেলের জন্ম দেন। এর পরে ওই সদ্যোজাত এবং শারীরিক ভাবে অশক্ত স্ত্রীকে নিয়ে রাজ্যে ফেরার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয় তাঁকে। কিন্তু সদ্যোজাতের দুধের বোতল কেনার মতো টাকাটুকুও ছিল না তাঁর হাতে। ফের দেবজিৎদের সহযোগিতায় জোগাড় হয় সদ্যোজাতের মশারি, জামাকাপড়।
এদিকে, দিল্লিতে যে সংস্থার হয়ে হাসান এবং তাঁদের এমব্রয়ডারি কারখানার কনট্রাকটর কাজ করতেন, সেই সংস্থার অফিসে এক ব্যক্তির করোনা সংক্রমণের জেরে গোটা অফিস বন্ধ হয়ে যায়। বাকিরা চলে যান নিভৃতবাসে। ফলে কারখানা চালানোর টাকা কনট্রাকটরের হাতে আসা বন্ধ হয়ে যায়, এমব্রয়ডারি কারখানার ঘরভাড়া বাবদ ষাট হাজার টাকা বাকি পড়ে গিয়েছে। এর মধ্যে বাজার থেকে টাকা না পেয়ে, ধার-বাকি রেখে কনট্রাকটরও এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে হাসানকে আশ্বাস দেন সংস্থার অফিস থেকে টাকা মিললে ফের কারখানা খুলবেন। শ্রমিকদের কাজ আবার শুরু হবে। কিন্তু সেটা ঠিক কবে, জানতেন না হাসান, জানতেন না কেউই।
হাসান জানিয়েছিলে, তিনিও কুড়ি হাজার সাতশো টাকা পান ওই কনট্রাকটরের কাছ থেকে। কিন্তু সেই টাকা প্রাপ্তির কোনও আশা নেই। এদিকে, সেই সময়ে সদ্যোজাতের শরীর খারাপ, ঠান্ডা-সর্দি-কাশি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা নেই। করোনা সংক্রমণের ভয়ে ঘরেই বসে ছিলেন একুশ দিনের অসুস্থ শিশুকে নিয়ে। তিনি ফোনে দিল্লি থেকে কাতর গলায় বলেছিলেন ‘‘দিদি, একটু দেখুন। আমি তো আর টানতে পারছি না। আমাদের কি কোনও ব্যবস্থা হবে না!’’
এত কষ্টের মধ্যেও ছেলের জন্মের খবর দিতে ভুল হয়নি হাসানের। কৃতজ্ঞতা থেকে ১৪ জুন রাতে হরলিক্স পাঠানো ছেলেটিকে ফোন করে জানিয়েছিলেন — ‘‘আমার বেটা হয়েছে। জসিমুদ্দিন মল্লিক নাম রেখেছি। আমি বাড়ির লোককেও এখনও জানাইনি, আপনাকেই প্রথম ফোন করলাম।’’
হাসানের স্ত্রী সাবিনা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কিংবা সদ্যপ্রসূতি অবস্থায় যে নির্মম অসহায়তা আর অযত্নের শিকার হয়, তা নিয়ে এই দেশে কোনও আলোচনা হয় না। অতীতে হয়নি। বর্তমানেও হবে বলে আশা করা যায় না। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে প্রশ্ন উঠতেই পারে, মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের কিংবা পুরুষ পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবারের মহিলাদের জন্য কেন কোনও রাষ্ট্রীয় সুসংহত নীতি থাকবে না? কেন কোনও প্রসূতি মাকে সন্তান কোলে নিয়ে অশক্ত শরীরে পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে হবে? কেন তাঁর খাদ্যের, স্বাস্থ্যের, বাসস্থানের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা হবে না?
শ্রমিকের কথা ৪
কথা বলা গেল হরিয়ানার সেক্টর ফাইভে বসবাস করা এক পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে। চার জনের পরিবার, যার মধ্যে দুই সদস্যই অপ্রাপ্তবয়স্ক। একজন বারো বছরের ছেলে আর একটি ছয় বছরের মেয়ে। মা, বাবা দু’জনেই পরিযায়ী শ্রমিক। দুই সন্তানের মুখে খাবার জোগাতে নিজের দেশের বাড়়ি ছেড়়ে ওই দম্পতি পাড়়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা তাঁরা। রেশন কার্ড সেখানকারই। তাই মাসের রেশন তুলে নিয়ে খরচ করে শ্রমিক দম্পতির গ্রামের বাড়ির পরিবার। তা-ও আঙুলের ছাপ না আধার ওর রেশন কার্ডের মধ্যে লিংক করাতে পারায় দুটো রেশন কার্ড বন্ধ হয়ে পড়়ে রয়েছে। তাতে মাসের রেশন তোলা যায় না। পরিবারের প্রধান সদস্যের নাম মফিজুর শেখ। বয়স ৩৫-এর কাছাকাছি। মফিজুর কালীপুজোর দিন বিশেক আগে পর্যন্ত একটি বিনোদন পার্কে ঝরনা সাফ-সাফাইয়ের কাজ করতেন। কিন্তু বিধি বাম। সম্প্রতি ডেঙ্গি-আক্রান্ত হওয়ায় ছুটির প্রয়োজন পড়়ে। ফলে, পরিযায়ী শ্রমিকের চাকরিটাও খোয়া যায়। বিছানায় শুয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে মফিজুর জানান, তাঁর অসুখের চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ বড্ড বেশি। বেকার-অসুস্থ স্বামী হয়ে গিয়ে তিনি রীতিমতো বিপদে ফেলেছেন নিজের স্ত্রী পাকিরা বিবিকে।
এবার পরিচয় করা যায় পাকিরা বিবির সঙ্গে। পাকিরা পঁচিশ বছরের এক ক্ষয়াটে-রুগ্ণ চেহারার তরুণী। যাঁকে ‘আপনি কেমন আছেন’ জানতে চাইলে চটজলদি জবাব আসে, ‘‘আমি ভালই আছি।’’ পাকিরা পশ্চিমবঙ্গের অন্য এক জেলার বাসিন্দা। স্কুলের পাঠ অসমাপ্ত রেখে নাবালিকা বয়সেই পাকিরা বিয়ে হয়ে চলে আসেন গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে স্বামী মজুরের কাজ করে খুব সামান্য দু’পয়সা রোজগার করলেও পাকিরাকে ঘরের বাইরে কাজে যেতে হত না। ঘরের কাজ সেরে, দুটো চাল ফুটিয়ে খেয়ে, সন্তান কোলেপিঠে মানুষ করে সংসারে সময় কেটে যেত ছেলেমানুষ পাকিরার। পুতুল খেলার বয়সে যাকে কোলে তুলে নিতে হয়েছিল সন্তান। কিন্তু তবু পাকিরা সুখী ছিলেন। স্বামীর শ্রমের মজুরি দিয়ে তাঁর অভাবের সংসারে ছাউনি ছিল। কিন্তু একে একে সংসারে পেট বাড়ে। বাড়তে থাকে খিদে। মফিজুরের ভাই-বোন, তাঁদের ছেলেপুলে, বৃদ্ধ মা-বাবা, তার উপরে আবার নিজের ভরন্ত সংসার। ওই গেঁয়ো যোগী হয়ে গ্রামে মজুরিগিরি করে আর সংসারের খরচ টানা সম্ভব হয় না। ফলে, একদিন সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পাড়ি দেন ভিন রাজ্যে। কাজের খোঁজে ওঁরা দেশের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা, নিশ্চয়তাহীন এক গন্তব্যের দিকে। হরিয়ানায় এসে বস্তি এলাকায় সস্তার ভাড়ার ঘর খুঁজে নেওয়া। তার পর মফিজুরের ওই বিনোদন পার্কে শ্রমিক হিসাবে কাজে যোগ দেওয়া। খুব বেশি দিন নয়, এসব বছরখানেক আগের ঘটনা। মাসে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে কাজ জুটে যায় মফিজুরের। কিন্তু তাতে বিদেশ-বিভুঁইয়ে সংসার চলে না। ঘরভাড়া দিতেই মাসের শুরুতে বেরিয়ে যায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। তার উপরে বিদ্যুৎ, জলের খরচ আলাদা। এর উপরে রয়েছে মাসকাবারি তেল-নুন-চাল, গ্যাস, পোশাকের খরচ। ফলে, ভিন রাজ্যে মফিজুরের স্ত্রী পাকিরাকেও পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত করে। ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে এ বার রাস্তায় নামেন পাকিরা।
তাঁর জীবন বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, কী ভাবে রাষ্ট্রের উদাসীনতায় পরিবারে সামাজিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে এক গ্রামীণ, নাবালিকা মেয়ে ক্রমশ পরিযায়ী শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়।
বর্তমানে পাকিরা একাই নিজের রোজগারে ওই সংসার টেনে নিয়ে চলেছেন। তিনি দু’টি বাড়িতে বাসনমাজা, ঘর মোছা, রান্নার কাজ করে মাসে মোট পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন।
ওই মহিলা শ্রমিকের কথায়, ‘‘রোজ তিরিশ মিনিটের পথ হেঁটে কাজে যেতে হয়। আবার, তিরিশ মিনিটের পথ হেঁটে কাজ থেকে বাড়ি ফিরি। ওই অতটা রাস্তা হাঁটাই খুব কষ্টের। বাকি আর কিছু তেমন অসুবিধা নেই, দিদি।’’
কেন হেঁটে কর্মস্থলে যেতে হয় পাকিরাকে? জবাবে জানা গেল, ওই রাস্তায় বাস নেই। তবে অটো চলে। তাতে এক পিঠের ভাড়া পড়ে পঞ্চাশ টাকা। দুই পিঠে অটোয় যাতায়াত করলে দিনে মোট খরচ দাঁড়াবে একশো টাকায়। তাতে মাসের শেষে যা মাইনে পাবেন মেয়েটি, তার কাছাকাছি পথখরচ পৌঁছে যাবে। আয়ে-ব্যয়ে ভারসাম্য থাকবে না। তাই পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়া। বছরের ৩৬৫ দিন। শরীরে দিক বা না দিক, এ ছাড়া পাকিরার কাজে যাওয়ার দ্বিতীয় উপায় নেই।
শরীর খারাপ থাকলে বা মাসিকের দিনগুলিতে কী ভাবে সামাল দেন ওই মহিলা শ্রমিক? জানা গেল, পিরিয়ডে খুব ব্যথা হলে প্রথম দিন কাজ থেকে শরীর খারাপ বলে ছুটি নেন পাকিরা। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে ‘হেভি ফ্লো’ বা ব্যথা হলেও কাজে যেতেই হয়। কারণ, এক দিনের বেশি ছুটি নেওয়া মঞ্জুর নয়। তা হলে বহুতলে আবাসন থেকে কাজ চলে যাবে। অন্য কোনও মেয়েকে কাজে নেওয়া হবে। যেহেতু, এই এলাকায় মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকের কোনও অভাব নেই! তাই এখানে শ্রমের মূল্যও খুব কম। সামান্য এ দিক-এ দিক দেখলেই গৃহ-সহায়িকার কাজ চলে যায়। আগের জনের চেয়ে কম মাইনেয় কাজ করার মেয়ে চটজলদি পাওয়া যায়।
অন্য দিকে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিপ্রণেতারা এখনও সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে যে সব শ্রম অধিকারের কথা আলোচনা করেন, তা সংগঠিত ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রম অধিকারের কথা শুধুমাত্র সোসিওলজি পাঠ্যপুস্তকেই রয়েছে। বাস্তবে তার কোনও প্রয়োগ নেই। তাই যেখানে বেশি দিনের ‘সিক লিভ’-এরই অনুমতি নেই, সেখানে যে আলাদা করে মেয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কোনও ‘পিরিয়ড লিভ’ নামক জিনিসটি নেই, আর ভবিষ্যতেও যে শ্রেণিবৈষম্যের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য তা প্রবেশের অনুমতি পাবে না, তাতে আর নতুন কী!
তবে পাকিরা আশাবাদী। তিনি মনে করেন, আর দুটো নতুন বাড়িতে কাজ জুটলেই তিনি ব্যাপারটা সামাল দিতে পারতেন। অটো করে অসুস্থতার দিনে কাজে যেতে পারতেন, দুটো পয়সা বেশি রোজগার হলে। হয়তো পরিশ্রম একটু বেশি হত, কিন্তু পায়ে হেঁটে অতটা পথ শরীর খারাপের মধ্যে যেতে হত না। যদি না, পরিস্থিতি দিন-কুড়ি আগের হত। যদি না, আচমকা মফিজুরের চাকরিটাও চলে যেত। যদি না মফিজুরের কঠিন অসুখ ডেঙ্গি হত। যদি না তাঁদের দুটো ছোট ছোট সন্তান থাকত। যদি না, পাকিরা রোজ কর্মস্থলে যেতে মাত্র কয়েক মাইল পথ হেঁটেই ক্লান্ত হয়ে পড়ত।
পাকিরা জানালেন, তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় থাকতেন, গর্ভবতী থাকাকালীন সময়ে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে ডিমসেদ্ধ পেতেন রোজ। তবে আধখানা ডিম। সন্তান হওয়ার পরেও পেয়েছিলেন বেশ কিছু দিন। তবে বরাদ্দ ছিল আধখানা ডিমই। বাকি আধখানা ডিম আর এক গর্ভবতী মহিলা পেতেন। সরকারি বরাদ্দের হিসাবের খাতায় এক জন পূর্ণবয়স্ক গর্ভবতী মায়ের জন্য এতটাই পুষ্টি জোগানো সম্ভব হত। সদ্যোজাত শিশুর পুষ্টি যেখানে মাতৃদুগ্ধের উপরে নির্ভরশীল, সেখানে প্রসূতি মায়ের খাদ্যের পুষ্টিই চরম অবহেলিত।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের বিচার-বিবেচনায় গর্ভবতী মহিলা এবং শিশুর পুষ্টি বিষয়টি এত কম প্রাধান্য পাবে কেন? গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষায় আরও বেশি করে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প আনার ভাবনা-চিন্তা করা হবে না কেন? বিশেষত, সেই সব মহিলা যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন, যাঁদের কায়িক শ্রম অনেক বেশি। তুলনায় তাঁদের খাদ্যে পুষ্টির নিয়মিত জোগান নেই। কারণটা খুব সহজ। অর্থনৈতিক সামর্থ্যের অভাব। অথচ, বুকের দুধটুকুই যে অভাবী মায়ের পক্ষে শিশুর ছয় মাস পর্যন্ত খাবার হিসাবে জোগানো সম্ভব হচ্ছে, সেই শিশুও তো প্রতিনিয়ত খাদ্যগুণ ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ, স্তন্যদাত্রী মায়ের নিজেরই পুষ্টি অধরা।
পাকিরা বলছেন, ‘‘ তবু তো দিদি, বাংলায় বাড়ি বলে ওখানে থাকলে সরকারি খাতায়-কলমে হাফ ডিমটুকু জুটত। এই ভিন রাজ্যে এসে তো সেটাও মেলে না। এখানে থাকলে কিছু সুবিধাই পেতাম না। বাচ্চা হওয়ার সময়ে আশাকর্মী দিদিরা এসে ওইটুকু দিয়ে যেত।’’
গর্ভবতী, মহিলা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কোনও বিশেষ নীতি প্রণয়নের কথা কি সরকার ভেবেছে? তাঁদের মাতৃত্বকালীন পুষ্টির আপসের বিষয়টি আর কত দিন আলোচনার বাইরে থাকবে?
জরায়ুমুখ ক্যানসার বিষয়েও কোনও ধারণা নেই পাকিরা বিবির। তা নিয়ে বাড়িতে, পরিবারে, চারপাশে, গ্রামে, ভিন রাজ্যে কখনও কোনও আলোচনাও শুনতে পাননি তিনি। তাই স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানোর ভাবনাও মাথায় আসেনি। দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে নর্ম্যাল ডেলিভারিতে। জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের টিকা দেওয়ার কথাও কেউ তাঁকে বলেননি। বললেও হয়তো তাঁর পক্ষে টিকা কিনে নেওয়া সম্ভব নয়। এই দেশে করোনা টিকা নিয়ে যতখানি আলোচনা হয়, জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের টিকা নিয়ে ততখানি আলোচনা শোনা যায় না।
পাকিরাদের শ্রমের দামই শুধু কম নয়, জীবনের দামও বড়ই কম।
(চৈতালি বিশ্বাস, সমাজকর্মী ও সাংবাদিক। লেখাটি ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ (সিআরজি)অধীনে পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা প্রোজেক্ট পেপারের বাংলা অনুবাদ)