দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় মৃত্যুমিছিল – দুর্ঘটনার প্রধান শিকার ঠিকা শ্রমিকরা 


  • December 6, 2022
  • (9 Comments)
  • 1207 Views

স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা আজ আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুপুরী। এই কারখানায় দুর্ঘটনা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়মিত তালিকার সাম্প্রতিক উদাহরণ ১ ডিসেম্বর (২০২২) নাইটি শিফটে কারখানায় কাজ করতে গিয়ে সিনিয়র টেকনিশিয়ান আশুতোষ ঘোষালের অকালমৃত্যু। একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে আদৌ কি কিছু নেই? এখানে কর্মক্ষেত্রে ‘সেফটি রুলস’ কি শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ? একই সঙ্গে একথাও উঠছে, একাধিক শ্রমিক ইউনিয়নের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও, এই মৃত্যুমিছিল রোধ করার মতো কোনও কার্যকরী আন্দোলন কেন গড়ে উঠছে না? উত্তরগুলো জানার জন্য দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন সুমন কল্যাণ মৌলিক। এই প্রতিবেদন সেই অনুসন্ধানেরই ফলশ্রুতি।

 

স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা আজ আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুপুরী। সাধারণভাবে কারখানায় কখনো কখনো দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু এই কারখানায় দুর্ঘটনা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়মিত তালিকার সাম্প্রতিক উদাহরণ ১ ডিসেম্বর (২০২২) নাইটি শিফটে কারখানায় কাজ করতে গিয়ে সিনিয়র টেকনিশিয়ান আশুতোষ ঘোষালের অকালমৃত্যু। আশুতোষবাবুর মেটেরিয়াল হ্যান্ডেলিং প্ল্যান্ট-এর হাইলাইনে অপারেশন উপবিভাগের স্থায়ী কর্মী ছিলেন। ঘটনার তীব্রতা এতটাই ছিল যে তার শরীর দু’টুকরো হয়ে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ঘটনাস্থল থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে পড়েছিল। আশুতোষবাবু কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ঐ দিনই কন্ট্রোল ফিউজ সুইচ (সিএফএস) ফেটে এক জন গুরুতর জখম হন। ২০ নভেম্বর (২০২২) তরল গলিত লোহায় ঝলসে যান বেশ কিছু শ্রমিক। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় এক জনের, পরে এক বেসরকারি হাসপাতালে আরো দু’জন মারা যান। এক জন প্রায় ৭০ শতাংশ দঘদ আবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। গত দশ বছরে একাধিক বার গ্যাস লিক হয়েছে, বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর আহতের সংখ্যার তো কোনও হিসাব নেই। এই দুর্ঘটনাগুলিতে হতাহতের বেশিটাই ঠিকা শ্রমিক কিন্তু স্থায়ী বা ঠিকা শ্রমিক–আতঙ্কে আছেন প্রায় সবাই। এক্ষেত্রে একটা কথা পরিষ্কার ভাবে বলে দেওয়া ভালো যে প্রযুক্তি গত উন্নয়নের কারণে পৃথিবীর কোথাও ইস্পাত শিল্পকে বিপজ্জনক আখ্যা দেওয়া হয় না। অবশ্যই ইস্পাত উৎপাদন এক জটিল বহুমুখী প্রক্রিয়া কিন্তু সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলে এত দুর্ঘটনা হওয়ার কথা নয়। এর আগের দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি, আশুতোষবাবুর ক্ষেত্রে আলাদা কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম। ঘটনা ঘটবার পর প্রাথমিক হইচই, মিডিয়াতে ‘চাঞ্চল্য’, ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের প্রতিবাদ, ম্যানেজমেন্টের আশ্বাসবাণী ও ‘তদন্ত কমিটি’ গঠন। যদিও এর আগের তদন্ত কমিটিগুলির কী পরিণতি হয়েছে তা সবার অজানা। এই প্রত্যেকটা দুর্ঘটনা আমাদের কিছু জ্বলন্ত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে আদৌ কি কিছু নেই? এখানে কর্মক্ষেত্রে ‘সেফটি রুলস’ কি শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ? এক্ষেত্রে পরিকাঠামো ও উন্নত নিরাপদ প্রযুক্তির ব্যবহার কি হচ্ছে না? শ্রমিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত চেতনার মান কি কম না কি ম্যানেজমেন্টের গাফিলতি প্রধানত দায়ী? ঠিকা শ্রমিকরা আজকাল কারখানার সর্বত্র কাজ করছেন, এদের কি দক্ষতার অভাব রয়েছে না কি কোনোরকম প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা কবচ ছাড়াই তাঁদের কাজ করতে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে? আধুনিক প্রযুক্তির অভাবের মধ্যে দাঁড়িয়ে যে কোনও মূল্যে অধিক উৎপাদন করার পরিকল্পনা কি বুমেরাং হচ্ছে? একই সঙ্গে একথাও উঠছে একাধিক শ্রমিক ইউনিয়নের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও এই মৃত্যুমিছিল রোধ করার মতো কোনও কার্যকরী আন্দোলন কেন গড়ে উঠছে না? গত ৪৮ ঘণ্টায় আমরা কারখানার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি উত্তরগুলো জানার জন্য, এই প্রতিবেদন সেই অনুসন্ধানেরই ফলশ্রুতি।

দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার সিনিয়র টেকনিশিয়ান আশুতোষ ঘোষাল

শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময় থেকে যখন শ্রমিকরা সংগঠিত হতে শুরু করে তখন থেকেই কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে থেকেছে। আই এল ও পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিভিন্ন সনদ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। আমাদের দেশে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চারটি আইন আছে – ফ্যাক্টরিস অ্যাক্ট (১৯৪), মাইনস অ্যাক্ট (১৯৫২), ইএস আই অ্যাক্ট (১৯৪) এবং এমপ্লয়িজ কম্পেনশন অ্যাক্ট (১৯২৩)। বর্তমানে এই আইনগুলি দু’টি শ্রমকোডের মধ্যে সমাহিত। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই খাতায়-কলমে আইন যাই থাকুক না কেন বাস্তবত অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং বেসরকারি শিল্প কারখানাগুলোতে এই আইনের যথাবিহিত প্রয়োগ এক আকাশকুসুম কল্পনা। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে অবস্থাটা তুলনামূলক ভালো। সাধারণ ভাবে শিল্প পরিচালকরা নিরাপত্তা (SAFETY) সংক্রান্ত যে ধারণা প্রচার করেন তাতে তিনটি ‘ই’ ( Engineering, Enforcement, Education) খুবই জরুরি। একটু নজর করলে বোঝা যাবে প্রথম দু’টি ‘ই’ অর্থাৎ প্রযুক্তি ও প্রয়োগের দায়িত্ব ম্যানেজমেন্টের। শিক্ষার প্রশ্নটিতে শ্রমিককে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি এই ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব সক্রিয় হবে এটাই প্রত্যাশিত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি যেমন আধুনিক প্রযুক্তিকে নিশ্চিত করে, তেমনি সেই সুবিধা শ্রমিক পাবে, এটাই কাম্য। আমরা যদি এবার দুর্গাপুরের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব এখানে ‘জলজ্যান্ত’ সেফটি ডিপার্টমেন্টের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তার প্রশ্নটি দারুণভাবে অবহেলিত। আমরা যদি আশুতোষ বাবুর মৃত্যুর ঘটনাটাকে দেখি তাহলে দেখব আশুতোষবাবু পুরানো সাইটে কাজ করছিলেন যা ১৯৬০ সাল থেকে একইভাবে কাজ করছে। আশুতোষ সেখানে একটি রিক্লেমার যন্ত্রে কাজ করছিলেন। যন্ত্রটি চালু থাকলে লৌহ আকরিক সেখান থেকে গিয়ে পড়ে পাঁচ-ছয় ফুট নীচে কনভেয়ার বেল্টে এবং এগিয়ে যায় অন্যপ্রান্তে। পুরনো সাইটে বার বার অপারেটরকে বিষয়টি নিজে গিয়ে দেখতে হয়। কারণ কোনও কারণে বেল্ট বন্ধ হওয়ার পরেও রিক্লেমার যন্ত্র চালু থাকলে লৌহ আকরিক নীচে পড়ে জমতে থাকে। তা সরাতে হয়। তা না হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। তাই উপরে যিনি রিক্লেমার যন্ত্র চালান, তিনিই মাঝে মাঝে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখেন কনভেয়ার বেল্ট চালু রয়েছে কি না। রাতে কেবিনের কাঁচ দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় না কারণ দৃশ্যমানতা কম থাকে। তাই কেবিন থেকে বেরিয়ে ঝুঁকে দেখতে হয়। এই দেখার জায়গাটাতে রেলিং নেই, চারিদিকে ঝোপঝাড় এবং আলো কম। প্ল্যাটফর্মে তেল, গ্রিজ পড়ে থাকে ফলে পেছল। এখন এই প্রতিকূল অবস্থায় কাজ করতে গিয়ে আশুতোষবাবু ঠিক কীভাবে কনভেয়র বেল্টে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারালেন তা হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না। কিন্তু এই সাইটটা যদি আধুনিক হত, তাতে ক্যামেরা থাকত, যথেষ্ট আলোর ব্যবস্থা থাকত তাহলে এই দুর্ঘটনা হয়ত ঘটত না। একথা কে না জানে যে প্রযুক্তি যত আধুনিক হয় তত ‘হিউম্যান এরর’ এর সম্ভাবনা কমে যায়। তাই যেভাবেই দেখা হোক না কেন কারখানার এই দুর্ঘটনাগুলোতে মূলত দায় ম্যানেজমেন্টের।

 

এখন এই গাফিলতি বা অপদার্থতা কি ইচ্ছাকৃত না কি আজ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসংক্রান্ত সরকারি পলিসির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমরা কথা বলেছিলাম বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত এক শ্রমিক নেতার সঙ্গে। তার মতে পরিকল্পিত অর্থনীতির নিয়ম মেনে প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় এদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের যে যাত্রা শুরু হয় তার এক গুণগত পরিবর্তন হয় নব্বই এর দশকে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও ও অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর অধিনায়কত্বে এবং বিশ্বব্যাঙ্ক-আইএমএফ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নী সংস্থার নির্দেশে ‘উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-ভুবনায়নের’ যে কর্মসূচি ভারতে শুরু হয় তার অনিবার্য ফল হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প তার গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। একদিকে নতুন বিনিয়োগের অভাব, অন্যদিকে বাজার অর্থনীতির নিয়ম মেনে প্রতিযোগিতা যে কোনও মূল্যে কোম্পানিগুলোকে উৎপাদন বাড়াতে প্ররোচিত করে। নতুন স্থায়ী নিয়োগ কমতে শুরু করে,বাড়তে থাকে ঠিকা শ্রমিক। এই অবস্থায় শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি গুরুত্ব হারায়। যদি আমরা নির্দিষ্ট করে দুর্গাপুরের অভিজ্ঞতা দেখি তাহলে এখানে শেষবারের মত বড়ো আধুনিকীকরণের কাজ হয়েছিল আজ থেকে ২৫ বছর আগে। পরবর্তীতে ২৩০০ কোটি টাকা খরচ করে এমএসএম (মিডিয়াম স্ট্রাকচার মিল) এ আধুনিকীকরণ হয়েছে যা অসম্পূর্ণ ও ফলদায়ক নয়। এই অবস্থায় মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ১.১০.২০২২ এর হিসাব অনুযায়ী এই ইস্পাত কারখানায় স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ৮০৭৪ জন (১১৫৩ এক্সিকিউটিভ এবং ৬৯২১ নন এক্সিকিউটিভ)। এই সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম। অন্যদিকে ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা ৫হাজারের বেশি এবং সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান। নয়া উদারনীতির নিয়ম মেনে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলিকে বিলগ্নীকরণ, কর্পোরেটকরণ বা নিখাদ বেসরকারি হাতে বিক্রি করে দিচ্ছে। এই বিষয়টাও শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করছে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তার অভাব সত্ত্বেও তাঁরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এই নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারত ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক সেফটি কমিটি ও তার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালনা।কিন্তু শ্রমিক নেতৃত্ব থেকে সাধারণ শ্রমিকর–সবার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি বাস্তবে এই সেফটি কমিটিগুলি নিস্ক্রিয় ও বহুক্ষেত্রে অস্তিত্বহীন।গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করা তো দূরের কথা, শ্রমিকরা তাঁদের সমস্যার কথা বলবার পর্যন্ত সুযোগ পান না। দুর্গাপুর কারখানায় বহু ডিপার্টমেন্ট সেফটি কমিটিকে সমন্বিত করে একটা কমিটি করা হয়েছে। অথচ আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা আলাদা আলাদা।

 

দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় একের পর এক দুর্ঘটনার প্রধান শিকার অবশ্যই ঠিকা শ্রমিকরা। এক সচেতন শ্রমিকের কথায় অনিয়ন্ত্রিত ঠিকেদারি প্রথা, অদক্ষ ঠিকা শ্রমিক, প্রশিক্ষণের অভাব পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক কনট্রাকটারের বয়ানে আমরা পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করব। ধরা যাক ক-বাবু একটা কাজের টেন্ডার পেলেন যাতে ৫০ জন শ্রমিক লাগবে এবং কাজটা দু’ধরণের এবং দুটো ডিপার্টমেন্টে কাজ। এই শ্রমিকদের সেফটি অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে অফিসাররা এক সাধারণ ট্রেনিং দেবেন। তাঁদের সেফটি বেল্ট পড়তে, ওয়েল্ডিং-এর কাজ থাকলে চোখে উপযুক্ত সুরক্ষা নেওয়া, কাজের জায়গায় বুট পরার উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দেবেন। যেখানে এই ঠিকা শ্রমিকরা কাজ করবেন সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে শেখাবার কোনও প্রশ্ন নেই। আরো বড় কথা হল ইস্পাত কারখানার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে (ব্লাস্ট ফার্নেস, মেল্টিং শপ, ইলেকট্রিকাল, মেশিন শপ, মেটেরিয়াল প্রসেসিং ইত্যাদি) আলাদা আলাদা দক্ষতার প্রয়োজন হয় কিন্তু ঠিকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ডিপার্টমেন্ট নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই। আর সেই কনট্রাকটরের অধীনে কাজ করা ঠিকা শ্রমিকদের কথায় তাঁদের কাজের  ক্ষেত্রে কী ধরণের প্রতিকূলতার সন্মুখীন তাঁদের হতে হয়। সেফটি অফিসাররা ঠিকা শ্রমিকরা কী কী কাজ করবেন না বলে দেন কিন্তু কাজের জায়গায় দেখা গেল ম্যানেজমেন্ট তাঁকে গ্রিজিং এরিয়াতে কাজ করতে বাধ্য করল। ওভারহেড ক্রেন বিলেট (লোহার টুকরো) নিয়ে যাচ্ছে, তার নীচে কাজ করছে্ন ঠিকা শ্রমিক। স্টিল মেল্টিং শপ থেকে গরম গলিত লোহা ভর্তি টাব যে ট্র্যাক ধরে যাচ্ছে সেখানে কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে টাব উল্টে গলিত লোহা ঝলসে দিল কোনও শ্রমিককে। কারখানায় বহু পুরাতন কাঠামো আছে, দীর্ঘদিন যার কোনও সংস্কার হয়নি। তাতে চড়ে কাজ করতে গিয়ে ঠিকা শ্রমিকরা দুর্ঘটনায় পড়ছে। আরো চিন্তার কথা হল কোনও ঠিকা শ্রমিক হয়ত দশ দিন বয়লারে কাজ করলেন, কিছুটা কাজের সঙ্গে সড়গড় হল, তারপর কনট্রাকটারের কাজ অনুযায়ী তাঁকে পাঠানো হল মেশিন শপে কাজ করতে। এইভাবে অদক্ষ ঠিকা শ্রমিকরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবেও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। অবশ্য এটা শুধু দুর্গাপুরের ঘটনা নয়, নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আগ্রাসন যত তীব্র হচ্ছে তত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইস্পাত শিল্পে ঠিকে প্রথা।

 

একই সঙ্গে এই প্রশ্নটাও উঠছে দুর্গাপুরের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ কারখানা যেখানে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যেখানে একাধিক সর্বভারতীয় মূলধারার শ্রমিক সংগঠন সক্রিয়, সেখানে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে এই গাফিলতি ম্যানেজমেন্ট চালাতে পারছে কীভাবে! উত্তরটা সহজ নয়, আর বিষয়টা শুধু দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানারও নয়। এই নিবন্ধকারের মতে আজ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে শ্রমিক সংগঠন তথা শ্রমিকদের হতোদ্যম অবস্থার আদর্শ প্রতিফলন ঘটছে দুর্গাপুরে। একথা অনস্বীকার্য যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের জন্মলগ্ন থেকে ট্রেড ইউনিয়নগুলি শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে সক্রিয় থেকেছে এবং বহু মাত্রায় সফল হয়েছে। কিন্তু যতদিন গেছে আন্দোলন হয়ে উঠেছে আর্থিক দাবিদাওয়া ভিত্তিক ও শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি পেছনের সারিতে চলে গেছে। ট্রেড ইউনিয়ন হয়ে উঠেছে এক সফল বারগেনিং এজেন্ট। কিন্তু এর ফল ইউনিয়নের জন্য ভালো হয়নি। আজ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা এতোটাই ভালো যে তাঁদের অনায়াসে হোয়াইট কলার কর্মীর তকমা দেওয়া যেতে পারে। এই অবস্থায় যখন নয়া আর্থিক সংস্কারের আগ্রাসী নীতি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তুলল তখন সেই আক্রমণ রুখে দেওয়ার মত অবস্থা আর শ্রমিক সংগঠনগুলির ছিল না। ৯০’ পরবর্তী সময়েও আমরা দেখলাম ইউনিয়ন একদিকে যেমন তুলনায় ভালো বেতনকাঠামো আনতে পেরেছে তেমনি সে মালিকের বিভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ যেমন যথেচ্ছ ঠিকাপ্রথা, বিলগ্নীকরণ, কর্মসংস্থান বন্ধকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। রেল, টেলিকম, কোল, ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম–সব জায়গায় শ্রমিকরা আজ ছত্রভঙ্গ। বিশেষ করে বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে (কয়েকটি নির্দিষ্ট শিল্প বাদে) উঠিয়ে দেবার যে রোডম্যাপ তৈরি করেছেন তাতে অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়েছে। আর একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হল ঠিকা শ্রমিকদের সংগঠিত করার প্রশ্নে, তাদের উপর সীমাহীন শোষণ ও বঞ্চনাকে লাঘব করার ক্ষেত্রে মূল ধারার ট্রেড ইউনিয়নগুলির পর্বত প্রমাণ ব্যর্থতা। ভারতে আজ এটাই বাস্তবতা যে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ ও সুবিধাভোগী স্থায়ী শ্রমিকরা ঠিকা শ্রমিকদের প্রশ্নে উদাসীন। এই অবস্থায় দুর্ঘটনা ও মৃত্যুমিছিল রোধ করতে হলে স্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিকদের তাদের নিজেদের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে এক হতে হবে। সুরক্ষার প্রশ্নে আপোষ করলে আরও দুর্ঘটনা ঘটবে একথা বলছেন শ্রমিক নেতৃত্ব। এই মৃত্যুমিছিল রোধ করার লড়াইটা আজকেই শুরু করতে হবে। সেই লড়াইতে যেমন ম্যানেজমেন্টকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করতে হবে তেমনি শ্রমিকদের সচেতন করার লড়াইকে খাটো করলে চলবে না।

Share this
Recent Comments
9
  • comments
    By: Partha pratim Acharyya on December 6, 2022

    অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক রচনা। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গাফিলতি থাকার জন্য এই মৃত্যু। উৎপাদন করতে গিয়ে নিরাপত্তার দিকটি অবহেলা করা হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। মান্ধাতা আমলের কৃৎকৌশল এবং নিম্নমানের নিরাপত্তা সামগ্রী নিয়ে, একেবারে প্রথমে থাকা শ্রমিকদের মৃত্যুর বিনিময়ে, প্রতিযোগিতার বাজারে আর কতদিন সুস্থ ভাবে দৌড়ানো যাবে?

  • গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন।ঘটনার সঠিক বিশ্লেষণ।

  • রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো এই ভাবেই চলতে থাকে। দূর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট বন্ধ করে দেয়ার চক্রান্ত চলছে। কোন্ দিন শুনবো আদানিদের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোর শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে ম্যানেজমেন্টের সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে। সাময়িক কিছু সুবিধে পাওয়ার জন্য আসলে শ্রমিকদের ক্ষতি হচ্ছে সেটা বুঝতে পারে না। ক্ষতি হল সেই শ্রমিকের পরিবারের, আর কারোর না!

  • প্রতিবেদন যথার্থ , কিন্তু মুশকিল হলো যাদের এটা পড়া দরকার তারাই এটা পড়েন না।আর আমরা যারা এটা পড়ি তারা শুধু পড়িই।আর কিছু করি না।এই প্রতিবেদন টি কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প নিরাপত্তা মন্ত্রকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলে ভালো হতো।

  • অসাধারণ এবং শ্রমসাধ্য একটি প্রতিবেদন। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে অত্যন্ত যত্নে নির্মিত এই প্রতিবেদন ইংরেজিতে অনুবাদ হোক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। ছত্রহীন যে ব্যবস্থা চলছে তাতে ঠিকা শ্রমিকদের, স্থায়ী শ্রমিকদের ইউনিয়নের ছাতার তলায় এনে লড়াই করতে হবে। বলতে চাইছি হোয়াইট কলারদের আওয়াজ তোলাটাও জরুরী। আমরা

  • comments
    By: Tanmoy Chattopadhyay on December 6, 2022

    অসাধারণ এবং শ্রমসাধ্য একটি প্রতিবেদন। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে অত্যন্ত যত্নে নির্মিত এই প্রতিবেদন ইংরেজিতে অনুবাদ হোক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। ছত্রহীন যে ব্যবস্থা চলছে তাতে ঠিকা শ্রমিকদের সঙ্গে স্থায়ী শ্রমিকদের ইউনিয়নের ছাতার তলায় এনে লড়াই করতে হবে । বলতে চাইছি হোয়াইট কলারদের আওয়াজ তোলাটাও জরুরী।

  • comments
    By: Sarmistha Roy on December 6, 2022

    গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন।

  • comments
    By: Sandipan Mitra on December 6, 2022

    খুবই কার্যকরী লেখা।
    খুল্লামখুল্লা বাজার অর্থনীতিতে শ্রমিকদের ন্যুনতম নিরাপত্তাও থাকছে না।ট্রেড ইউনিয়নের চরম নিষ্ক্রিয়তা শ্রমিকদের বিপন্নতাকে যে বাড়িয়ে তুলেছে তা প্রতিবেদনেও ধরা পড়েছে।লেখাটিকে লিফলেটের আকারে এডিট করে শিল্পাঞ্চলে প্রচার করলে ভালো হয়।

  • কর্মসূত্রে বিভিন্ন বেসরকারি স্টিল প্ল্যান্টে দেখা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ফার্নেসের গ্যাস বের করে দেওয়ার জন্য হাই ভোল্টেজ মোটর দিয়ে গ্যাস টেনে নিয়ে এসে ESP (Electro Static Precipitator এর মধ্যে দিয়ে ধুলো ময়লা টেনে মাটিতে জমা করে বাকি গ্যাসটা চিমনি দিয়ে আকাশে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা কতখানি পরিবেশ বান্ধব তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই ব্যবস্থা যদি কেউ install করে তাহলে সরকার তাকে কিছু benefit দেয়। সকলেই এই system install করে সুবিধা নেওয়ার জন্য, কিন্তু মোটর চালায় না। কারণ বিদ্যুৎ খরচ বাঁচায়। Factory inspector এলে তার জন্য বন্দোবস্ত আছে। Consultancy করতে গিয়ে এটা আমার অভিজ্ঞতা।

Leave a Comment