হিংস্র দাম্ভিকতার সজোর ঘোষণা 


  • November 3, 2022
  • (0 Comments)
  • 557 Views

চিন্তন শিবিরের প্রথম দিনেই অমিত শাহ জানিয়ে দিয়েছেন ২০২৪ সালের মধ্যে সব রাজ্যে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি বা এনআইএ-র দফতর খোলা হবে। সংবিধানকে এড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বানচাল করতে এক দেশ, এক পুলিশি ব্যবস্থার দিকে চলেছে কেন্দ্র। তারই সুরে সুর মিলিয়ে সব রাজ্যেই পুলিশের এক রং, এক নকশা, একই ধাঁচের উর্দির প্রস্তাব রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির তোয়াক্কা না করে রাজ্যগুলির উপর একতরফাভাবেই নানা নীতি ও প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া চলছেই। এ এক চরম কর্তৃত্ববাদ। এবার দেশের আইন-শৃঙ্খলা, সংহতি, সন্ত্রাসদমনের নামে পুলিশি রাষ্ট্রের লক্ষ্যেই কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এই চিন্তন শিবির? লিখছেন দেবাশিস আইচ। 

 

বাচিক হিংসার আর এক নজির তৈরি করলেন মোদী। তাঁর এবারের লক্ষ্য ‘কলমওয়ালা’। কেবল কলমওয়ালা বললে তাঁর বক্তব্য বিকৃত করা হবে। তিনি বলেছেন, “নকশালবাদ, সমস্ত ধরনের নকাশালবাদকে আমাদের পরাজিত করতে হবে। বন্দুকওয়ালাও আছে, আর কলমওয়ালা নকশালবাদও আছে। আমাদের এদের সবাইকে উপড়ে ফেলতে হবে।” হরিয়ানার সূরজকুণ্ডে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিন্তন শিবির তো দেশের সাধুসন্তদের ধর্মসভা নয়, আর মোদীও কোনও ধর্মগুরু নন যে, মুসলিম গণহত্যার ডাক দেওয়ার মতো বন্দুকওয়ালাদের পাশাপাশি কলমওয়ালা নকশালপন্থীদেরও গণহত্যার ডাক দেবেন। কিংবা স্লোগান তুলবেন “গোলি মারো নকশালকো।” এসব ভক্তরা বলবে, ট্রোল ব্রিগেড বলবে। মোদী নীরব থেকে তার সমর্থন জুগিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রী, তাঁকে রয়েসয়ে  বলতে হয়ে। তবু কিছু কম বলেননি—“হম ইনে সভী কা কাট নিকালনা পড়েগা।” প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই উক্তির মধ্যে রয়েছে এক তীব্র ঘৃণা। এই উক্তিকে ‘হেট স্পিচ’ বললে বোধহয় অতিশয়োক্তি হবে না। ক্রোধ, ঘৃণা থেকেই এই হিংসার উৎপত্তি। দার্শনিকরা বলেন, মহাভারতে যে হিংসাকে সব থেকে ভয়ানক বলা হয়েছে তা হল বাচিক হিংসা। সন্দেহ নেই, বিগত আট বছরে মোদী ও তাঁর ট্রোল ব্রিগেড এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে প্রশ্নাতীতভাবে চূড়ান্তভাবে সফল।

 

চিন্তন শিবিরে মোদী এখানেই থেমে যাননি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দু’দিনের এই শিবিরে উপস্থিত বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লেফটেন্যান্ট গভর্নর, কেন্দ্র ও রাজ্যের উচ্চপদাধিকারী পুলিশকর্তাদের প্রধানমন্ত্রী  কলমওয়ালাদের চেহারা-চরিত্রেরও এক ছবি তুলে ধরেছেন। মোদী বলছেন, “এরা আন্তর্জাতিক সাহায্য পেয়ে থাকেন। ‘চেহারা-মোহরা’ সাত্ত্বিক। এরা আইন ও সংবিধানের ভাষায় কথা বলেন।” একই নিঃশ্বাসে তিনি এরপরই বলবেন, “দুধ আর পানি আলাদা করার দক্ষতা নিরাপত্তাকর্মীদের থাকা দরকার। এর আগেই তিনি বলেছেন, ‘বুদ্ধি দিয়ে, বুঝেসুঝে দমন’ করার কথা।

 

শুধু এমনটি নয়, বন্দুকওয়ালাদের পাশাপাশি কলমওয়ালাদের কেটে উপড়ে ফেলার এ এক নতুন রাষ্ট্রীয় অভিযান শুরুর সদম্ভ ঘোষণা। এমনও নয় যে, শুধুমাত্র নকশালপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী, কিংবা সহমর্মী, দরদী লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরাই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত লক্ষ্য। মোদী কথিত বন্দুকওয়ালাদের বিরুদ্ধে উপড়ে ফেলার অভিযান সেই কবে থেকে তো চলছেই। আর নকশালপন্থী দাগিয়ে দিয়ে মোদী কথিত কলমওয়ালাদের উৎখাত করার সব থেকে বড় উদাহরণ হল, ভীমা কোরেগাঁও এলগার পরিষদ মামলা। গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক পথে দলিত, আদিবাসীদের সংগঠিত করার অপরাধে, তাদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের দায়ে, আদর্শগত ও তাত্ত্বিক লেখালেখির, গান গাওয়া, কবিতা লেখার জন্য ‘বুদ্ধি দিয়ে, বুঝেসুঝে’, ‘দুধ আর পানিকে আলাদা করার দক্ষতা’ মোদী-শাহরাজ তো সেই তখনই দেখিয়েছে। দেশে যদি আইন থাকত, আইনের শাসন থাকত, বেআইনের আইন যদি  বলবৎ না থাকত? ন্যায়বিচারের ন্যূনতম শর্ত যদি আদালত মানত, ‘জেল নয় বেল’ যদি বিচারকের কাছে ন্যায়বিচারের প্রাকশর্ত হত, তবে তিন-চার বছর ধরে বিনাবিচারে জেলবন্দি হয়ে থাকা তো দূরে থাক, গ্রেফতারই হতেন না এঁরা। কেন এমন সব ক্ষেত্রে আদালতকে দুর্বল, নড়বড়ে, দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়? কেন কথা ওঠে আদালত শাসকের মুখাপেক্ষী ও প্রসাদভিক্ষুক হয়ে উঠেছে?

 

‘আইন ও সংবিধানের ভাষায় কথা’ বলা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বা ইউরোপ-আমেরিকার বিদ্বজ্জন ও নাগরিক সমাজের কাছে যাঁরা তাঁদের বিদ্যা, বৈদগ্ধ, গবেষণা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সুপরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন সেই, সুধা ভরদ্বাজ, আনন্দ তেলতুম্বে, ভারভারা রাও, স্ট্যান স্বামী, গৌতম নাভালখা, সোমা সেন, ভার্নন গঞ্জালভেজ, হানি বাবু, রোনা উইলসন, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, সুধীর ধাওয়ালে, মহেশ রাউত, অরুণ ফেরেইরা এবং কবীর কলামঞ্চের সাগর গোর্খে, রমেশ ঘাইচোর ও জ্যোতি জগতপ দুই থেকে চার বছর বিনাবিচারে জেলবন্দি। এঁদের মধ্যে অশীতিপর স্ট্যান স্বামীকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিচারবিভাগীয় হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মৃত্যুকে বিচারবিভাগীয় হত্যাকাণ্ড বললে অত্যুক্তি হবে না। সুধা ভরদ্বাজ জামিন পেয়েছেন, নানা  টানাপড়েনের পর। মৃত্যুমুখী ভারভারা রাও অসুস্থতার কারণে আপাতত জামিনে মুক্ত। ভারভারা রাওকে জামিন দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ প্রশ্ন তুলেছিল এই ব্যক্তিদের বিচার কবে শুরু হবে?

 

এই মামলার খোঁজখবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন, কোনও অপরাধের বিচারের জন্য নয়, স্রেফ কেন্দ্রীয় সরকারের মারণনীতিগুলির ধারাবাহিক প্রতিবাদ করার জন্যই ইউএপিএ ধারায় এঁদের বন্দি করে রাখা হয়েছে। দিনের পর দিন বিনাবিচারে কারাবন্দি করে রাখাটাই আসলে শাস্তি দেওয়া। এখানেই শেষ নয়। অভিযুক্ত রোনা উইলসনের কম্পিউটার ঘেঁটে তদন্তকারীরা পেলেন এক মাওবাদী নেতার চিঠি। সে চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে খুনের চক্রান্তের কথা আছে। স্পাইওয়ারের সাহায্যে অভিযুক্তদের কারও কারও কম্পিউটার হ্যাক করে এমন মেল ঢোকানো হয়েছে বলে পালটা অভিযোগ উঠল। তার কিছু তথ্যপ্রমাণ মিলল কিন্তু, বিচারপ্রক্রিয়া শুরু না হলে এ সবই কাকস্য পরিবেদনা। শুধু তাই নয়, সেই ইজরায়েলি পেগাসাস স্পাইওয়ার নিয়ে এক পৃথক মামলায় শীর্ষ আদালতের প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বুদ্ধি দিয়ে দমন করার এ এক প্রকৃষ্ট উদাহরণই বটে। একইসঙ্গে হেফাজতে স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু এবং অসুস্থ ভারভারা রাও, গঞ্জালভেজ, নাভালখা, সোমাদের প্রকৃত চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া প্রমাণ করে—কেন্দ্রীয় সরকার কতদূর পর্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ ও নৃশংস হতে পারে।

 

মাওবাদী সংযোগ থাকার অভিযোগে ইউএপিএ আইনে কারাদণ্ড প্রাপ্ত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, ৯০ শতাংশ পঙ্গু, হুইলচেয়ার-বন্দি জিএন সাইবাবার মুক্তি সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের অতি দ্রুততার সঙ্গে ছুটির দিনে মামলা তালিকাভুক্ত করা, বেঞ্চ নির্বাচন, একদিনের মধ্যে বম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের রায়ে সাময়িক স্থগিতাদেশ এবং অন্যতম বিচারক এমআর শাহের উক্তি প্রমাণ করে—শীর্ষ আদালতও ‘ইউএপিএ, মাওবাদী, দেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার পক্ষে বিপজ্জনক’ জাতীয় শাসকীয় রীতিসিদ্ধ, শব্দ, শব্দগুচ্ছের সামনে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার, সাংবিধানিক অধিকারের পাঠ ভুলে যায়। ইউএপিএ এমন এক বেআইনের আইন যার জাল ছিন্ন করা বিচারব্যবস্থার পক্ষেও বহু সময় কঠিন হয়ে পড়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু, শীর্ষ আদালতে সওয়াল জবাবের সময় এক ডিভিশন বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি এমআর শাহ যখন বলে ওঠেন— “সো ফার অ্যাজ টেররিস্ট অর মাওয়িস্ট ইজ কনসার্নড, দ্য ব্রেন ইজ মোর ডেঞ্জারাস। ডিরেক্ট ইনভলমেন্ট ইজ নট নেসেসারি।” প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্যের সঙ্গে ভাবনাগতভাবে কী আশ্চর্য মিল!

আশ্চর্য হবেন না যদি মনে পড়ে, ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি শাহ গুজরাত হাই কোর্টের স্বর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দিন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই তাঁর প্রশংসা করে বলেছিলেন, “…আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয়, আদরণীয়, কর্মচঞ্চল ও দূরদর্শী নেতা।” এবং এই প্রথম নয়। এর আগেও ২০১৭ সালে তিনি যখন পাটনা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হন, তখন এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাকে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও অমিত শাহের (তৎকালীন বিজেপি সভাপতি) কাছের লোক বলা হয় কেন? বিচারপতি শাহ উত্তরে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী একজন, “মডেল ও হিরো।”

 

আরেক চরমতম উদাহরণ শাহিন বাগের এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকারী জামিয়া মিলিয়া ও জেএনইউ বিশ্ববিদ্যায়ের প্রাক্তন ও বর্তমান গবেষক ছাত্র-ছাত্রীদের দিল্লির মুসলিম বিরোধী দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ইউএপিএ ধারায় দীর্ঘ দু’বছর ধরে বিনাবিচারে আটক রাখা। মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে এক জনসভায় ‘ইনকিলাব’ ও ‘রেভুলুশন’ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে জেএনইউ-র প্রাক্তন ছাত্রনেতা, স্কলার উমর খালিদ দিল্লিতে হিংসা ছড়ানোয় মদত দিয়েছিলেন—সম্প্রতি এই যুক্তিতে দু’বছর বিনাবিচারে জেলবন্দি উমরের জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট। এই বিষয়ে স্ক্রোলে ‘উমর খালিদ’স রিয়েল ক্রাইম? চ্যালেঞ্জিং দ্য গভর্নমেন্ট অ্যাজ এ মুসলিম’ (২৮ অক্টোবর ২০২২) একটি গুরুত্বপূর্ণ, অবশ্যপাঠ্য প্রবন্ধ লিখেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ।

 

মোদীতে ফিরি। নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণে দাবি করছেন, বিগত আট বছরে নকশালদের প্রভাবিত জেলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে। এবং, তার মতে ইউএপিএ-র মতো কড়া আইন দমন ব্যবস্থাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ে শক্তি জুগিয়েছে। তাঁর আরও দাবি, দ্রুততার সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীর ও উত্তরপূর্ব স্থায়ী শান্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এরপরও তবে কলমওয়ালাদের বিরুদ্ধে এই বিশেষ বিষোদ্গার কেন? সে প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজব। তার আগে এই সেপ্টেম্বর মাসে গুজরাতের একতা নগরে কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রীদের ‘এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে নেব। এই সেই একতা নগর যা মেধা পাটকরের নমর্দা বাঁচাও আন্দোলনের এক প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি দেখেছি পরিবেশগত ছাড়পত্রের নামে কীভাবে আধুনিক পরিকাঠামো স্থাপনে বাধা দেওয়া হয়েছে। আপনারা আজ যেখানে আছেন, এই একতা নগর তার চোখ খুলে দেওয়ার মতো উদাহরণ—কেমন করে উন্নয়ন বিরোধী আরবান নকশালরা সর্দার সরোবর বাঁধের মতো একটা বৃহৎ প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছিল।” এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। শুধু দেশের নয়, তাঁর অভিযোগ এর পিছনে বিদেশি চক্রান্তও ছিল। এই উন্নয়ন বিরোধীরা শীর্ষ বিচারকমণ্ডলী ও বিশ্বব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করেছে বলে অভিযোগ তুলে মোদী বলেন, “ভারতে উন্নয়ন আটকাতে বিশ্বের বহু প্রতিষ্ঠান, ফাউন্ডেশন এই ইস্যুতে হুড়কো দিয়ে বসছিল। এবং আরবান নকশালদের সঙ্গে একযোগে বিতর্ক তৈরি করে এবং আমাদের প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়।” একইসঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, “আমাদের চেষ্টা হবে আমরা কখনই পরিবেশ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় অজুহাতকে ব্যবহার করে সাবলীল জীবন ও বাধাহীন ব্যবসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করব না।”

 

একটু তলিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারব, মহারাষ্ট্রের পুনের ভীমা কোরেগাঁও হিংসার সঙ্গে যোগ রয়েছে মহারাষ্ট্রের আকরিক সম্পদে ভরপুর গড়চিরোলি ও সুরজাগড়ের সঙ্গে। আকরিক সম্পদের একচেটিয়া লুট, আদিবাসী উচ্ছেদ, বনধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তীব্র হলে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে। ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে ৪০ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার যে নাগরিক তদন্ত হয় এবং যে তদন্তে উঠে আসে মাওবাদী বিরোধী অভিযানের নামে বহু নিরীহ আদিবাসীদের ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। এই তদন্ত দলে ছিলেন, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, সোমা সেন, মহেশ রাউত। এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যখন গ্রামসভাগুলির সহায়তায় আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য শলা-পরামর্শ চলছিল ঠিক সেই সময় পুণে পুলিশ সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, সুধীর ধাওয়ালে, রোনা উইলসন, মহেশ রাউত, সোমা সেনদের গ্রেপ্তার করে। কারণ স্পষ্ট। ‘বাধাহীন ব্যবসা’ বা ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’-এ তাঁরা বাধা সৃষ্টি করেছিল। ফাদার স্ট্যান স্বামী ও সুধা ভরদ্বাজের গ্রেপ্তারের কারণও একই। তাঁদের কর্মস্থল ছিল যথাক্রমে আদিবাসী প্রধান ঝাড়খণ্ড এবং অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী প্রধান জঙ্গলমহল। এই সেই অঞ্চল যা শাসকের ভাষায় ‘রেড করিডর’ বা মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চল। আসলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভারতের সমৃদ্ধতম মিনারেল করিডর। মাওবাদী দমনের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরোধিতায় যাঁরাই তদন্ত কমিটি গড়ে, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট লিখে, মিডিয়া থেকে আদালতের দরজায় ছুটে বেড়াচ্ছিলেন—পুণের ভীমা কোরেগাঁও মামলার সঙ্গে জুতে দেওয়া হল সেই ব্যক্তিদেরই। তাঁরা অনেকেই মহারাষ্ট্রের বটে, আবার তার সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হল ঝাড়খণ্ড, দিল্লি, অন্ধ্র, কেরালার প্রতিবাদী মানুষদেরও।

 

পরিবেশ মন্ত্রকের সম্মেলন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিন্তন শিবির—বার্তা একটাই। কেন্দ্রীয় সরকারের মত ও পথের বিরোধিতাই হল ‘নকশালবাদ’। মোদী-শাহের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই যে কেউ নকশালবাদী মাওবাদী, দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী—সে জন সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান হোন কিংবা মহম্মদ জুবের, তিস্তা শেতলবাদ হোন কিংবা মেধা পাটকর। সে জন সাংবাদিক হোন বা আইনজীবী; ছাত্র বা শিক্ষক; সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মী হোন বা পরিবেশ ও বিজ্ঞান কর্মী; আদিবাসী বা দলিত আন্দোলনের মুখ; শ্রমিক ও কৃষক দরদী। অর্থাৎ, যে কোনও ভিন্নমত, ভিন্নস্বর, যে কোনও সমালোচনা, যে কোনও বিরোধিতা, আন্দোলনকে সমূলে উচ্ছেদ করাই মোদী-শাহের এক ও একমাত্র লক্ষ্য। মুসলমান বিদ্বেষ দিয়ে যার শুরু হয়েছিল। সংসদে ক্রূর সংখ্যাধিক্যের জোরে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ; সুপ্রিম কোর্টের লজ্জাজনক হিন্দুত্ব বিশ্বাসের জেরে রামমন্দির গঠনের রায়; যে কোনও ছুতোয় পিটিয়ে কিংবা সাজানো সংঘর্ষে মুসলিম হত্যা; ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, একের পর এক ঐতিহাসিক সৌধ, প্রার্থনাস্থলের দখলের জন্য মিথ্যা মামলা; বিনা বাধায়, বলা ভাল সরকারের নীরব প্রশয়ে পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতেই সভায় সভায় ধারাবাহিকভাবে মুসলমান নারীদের খুন-ধর্ষণের হুমকি, এমনকি হিন্দু ধর্মসভা থেকে গণহত্যার ডাক দিয়েও পার পেয়ে যাওয়া—প্রমাণ করে হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের দিকে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে মোদী-শাহের ভারত। কেন্দ্র তো বটেই, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, আসাম, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি এ পথে অগ্রণী রাজ্য।

 

তবুও অনেকখানি পথ বাকি। মোদীর পরম সাগরেদ কর্পোরেট দুনিয়া এখনও যথেষ্ট খুশি নয়। খুশি নন মোদীও। পরিবেশ সম্মেলনে তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, রাজ্যে রাজ্যে ৬০০০ প্রকল্পের পরিবেশ ছাড়পত্র, ৬৫০০ প্রকল্পের বন বিভাগের ছাড়পত্র আটকে আছে। মোদীর পথে সংবিধান আজও এক বড় বাধা। আইন-আদালত এখনও পুরোপুরি বিকিয়ে যায়নি। কলমওয়ালারা বারবার মোদী-মিথ্যা ফাঁস করে দিচ্ছেন। প্রশ্ন তুলছেন। নির্বাচন কমিশন-ইডি-সিবিআই কাজে লাগিয়ে, জলের স্রোতের মতো অর্থ খরচ করে বিধায়ক কিনেও দখল করা যায়নি এক ডজন বড় রাজ্য। দখল করা গেলেও গোয়া ও উত্তরপূর্বের জনজাতি প্রধান রাজ্যগুলিতে হিন্দুত্ববাদকে মনের মতো করে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। কাশ্মীরকে ভারতের প্যালেস্তাইন করে তোলা গেছে বটে, কিন্তু খোদ হিন্দু ও শিখ প্রধান জম্মুর মানুষ মাত্র এক বছরের আবাসিক অকাশ্মীরিদের ভোটাধিকারের অধিকার দেওয়ার কেন্দ্রীয় ছক নাকচ করে দিয়েছে। তাহলে কর্তব্য কী? কর্তব্য পথই বা কী? তার নীলনকশার হদিশ মিলবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই চিন্তন শিবিরে। রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে তাদের মন্ত্রী-সান্ত্রী-আমলাদের সেই মন্ত্রণাই দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

 

কী সেই শকুনিসুলভ মন্ত্রণা? প্রথমত ও মুখ্যত রাজ্যগুলির আইনশৃঙ্খলার দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীর কুক্ষিগত করা। চিন্তন শিবিরের প্রথম দিনেই অমিত শাহ জানিয়ে দিয়েছেন ২০২৪ সালের মধ্যে সব রাজ্যে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি বা এনআইএ-র দফতর খোলা হবে। সন্ত্রাস, মাদক, দেশবিরোধী কার্যকলাপ, সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে কেন্দ্র যে এনআইএ-র মাধ্যমে রাজ্যে রাজ্যে হস্তক্ষেপ করবে—শাহের ভাষণে তা স্পষ্ট। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত এবং প্রতিটি রাজ্য সরকারেরই এ জাতীয় আইনশৃঙ্খলার সমস্যার মোকাবিলায় নিজস্ব দপ্তর রয়েছে। তথাপি, রাজ্যের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ—শাহের ভাষায় সহযোগিতা—করতে বিধিবদ্ধ আইন আনতেও পিছপা নয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। সংবিধানকে এড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বানচাল করতে এক দেশ, এক পুলিশি ব্যবস্থার দিকে চলেছে কেন্দ্র। তারই সুরে সুর মিলিয়ে সব রাজ্যেই পুলিশের এক রং, এক নকশা, একই ধাঁচের উর্দির প্রস্তাব রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির তোয়াক্কা না করে রাজ্যগুলির উপর একতরফাভাবেই নানা নীতি ও প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া চলছেই। আলাপ-আলোচনা, বিতর্কের কোনও অবকাশই নেই। নীতিআয়োগ কিংবা বিভিন্ন মন্ত্রক সিদ্ধান্ত হচ্ছে এবং তা রাজগুলিকে ডেকে স্রেফ ঘোষণা করছেন প্রধানমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীরা। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনায় হাজির হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে প্রশ্ন করা যায় না। দেশের প্রধান বিরোধীদলের নেতা-নেত্রী তো বটেই মায় মুখ্যমন্ত্রীদের তলব করে চলেছে ইডি, সিবিআই। এ এক চরম কর্তৃত্ববাদ। এবার দেশের আইন-শৃঙ্খলা, সংহতি, সন্ত্রাসদমনের নামে পুলিশি রাষ্ট্রের লক্ষ্যেই কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এই চিন্তন শিবির?

মোদী-শাহ জুটি সুরজকুণ্ডের চিন্তন শিবির থেকে কি শেষ পর্যন্ত কি এই বার্তাই দিলেন—এক দেশ এক দল এক ভাষা এক ধর্মের কর্পোরেট বন্ধু হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত ভারত গড়ে তুলতে এনআইএ-কে নাজি জার্মানির গোয়েন্দা বাহিনী গেস্টাপোর আকারেই গড়ে তুলতে হবে। আর মুসোলিনির ব্ল্যাক শার্ট ফাসিস্ত বাহিনীর আদলেই গড়ে তোলা হবে দেশজোড়া একই রং ও নকশার, একই ধাঁচের উর্দিধারী এক পুলিশবাহিনী?

ইতিহাস যেন আমরা ভুলে না যাই। দেওয়াল লিখন পড়তে আর যেন ভুল না করি।

 

তথ্যসূত্র :

১। ‘Naxalism with gun or pen must be uprooted’ : PM Modi in his address to MHA’s Chitan Shibir, Opindia.com, 28 October 2022.

২। Supreme Court stays release of Prof. GN Saibaba and others in UAPA case, suspends Bombay HC’s acquittal order, Sohini Chowdhury, livelaw.in, 15 October 2022.

৩। Why SC Justice MR Shah calling PM Modi ‘vibrant and visionary leader’ comes as no surprise, Apurva Mandhani, the print.in 11 February 2021.

৪। Urban Naxals and some global bodies blocking infra : Modi, The Indian Express, 24 September 2022.

৫। The Bhima Koregaon arrests and the resistance in India, Saroj Giri, monthlyreview.org, April 1 2022.

 

Share this
Leave a Comment