নয়া অরণ্য সংরক্ষণ বিধি: আদিবাসীদের অধিকার হরণই মূল লক্ষ্য 


  • July 18, 2022
  • (1 Comments)
  • 1943 Views

২৮ জুন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রক এক বিজ্ঞপ্তি মারফত ফরেস্ট কনজারভেশন রুল, ২০২২জারি করেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, বেসরকারি সংস্থা বনবাসীদের অনুমতি ছাড়াই বন কেটে ফেলতে পারবে। তার অর্থ বনাধিকার আইনের এক মুখ্য ধারাকেই নস্যাৎ করে দেওয়া হল। ১৮ জুলাই শুরু সংসদের বর্ষা অধিবেশন। এই বেআইনি বিধি সংসদে পেশ করার সম্ভাবনা প্রবল। কৃষি, শ্রমকোড-সহ অন্যান্য বিলের মতোই কি এই বিধিকেও সংসদে গাজোয়ারি করে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে? যদি হয়, তবে রাস্তাই প্রতিবাদের একমাত্র পথ। লিখেছেন দেবাশিস আইচ

 

পারলে আমূল উপড়ে ফেলত বনাধিকার আইন। পারলে অরণ্য নির্ভর সব আদিবাসী ও অন্যান্য জাতির মানুষদের বনছাড়া করে ছাড়ত। তবে, খুব সহজেই গড়গড়িয়ে গড়াতে পারত ‘উন্নয়নের রথের চাকা’। বন থাকত ওই কিছুটা গভীর ঘন জঙ্গল, ঘেরাটোপে ঘেরা। ‘ফরট্রেস কনজারভেশন’ যাকে বলে। মানুষ হঠিয়ে যেখানে কিছু বাঘ থাকবে, কিছু হাতি, গণ্ডার আরও কিছু কিছু এই প্রাণী, ওই প্রাণী। যারা মূলত উন্নয়ন উদ্বাস্তু। বুলডোজার, আর্থমুভার, পে লোডার, বৈদ্যুতিক করাতের উন্নয়নের হাত থেকে কোনও ক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে এসে ঢুকে পড়েছে এক শেষ আশ্রয়স্থলে। যেখানে অতি সঙ্কটাপন্ন সম্পূর্ণ অরণ্য-নির্ভর বাইগা আদিবাসীদের গ্রাম উচ্ছেদ করে গড়ে তোলা হবে আরণ্যক অতিথিশালা। আদিবাসী মানুষের নয়, এই বননীতির কেন্দ্রে রয়েছে পর্যটক ও পর্যটন বাণিজ্য। খনি, জলবিদ্যুৎ, পাম্প স্টোরেজ, জাতীয়, আন্তর্জাতিক হাইওয়ে, ভঙ্গুর হিমালয়ের শিরায় শিরায় এবং কোল-কাঁখ বেয়ে ধর্মসড়ক, রেলপথ, পাহাড়ের কোলে নগর নির্মাণ, জঙ্গল সাফ করে আবাসন—এই ‘উন্নয়নের জেরে’ হিমাদ্রী থেকে শিবালিক, পূর্ব ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, মধ্য, পূর্ব, উত্তরপূর্ব ভারতের পাহাড়, জঙ্গল, নদী আজ লন্ডভন্ড।

 

বণিকের লোভের অন্ত নেই, রাজনীতিকদেরও। এমনই নানা তথাকথিত উন্নয়নের জেরে ফি বছর পাহাড়ে-সমতলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসার পরও শেষ বনটুকু, বনের গভীরে জলের উৎস ভরা পাহাড়টুকু; পাহাড়-জল-জঙ্গল ভরা অসীম জীববৈচিত্র, আদিবাসী মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকার শেষ আশ্রয়টুকুও আর ছাড়তে রাজি নয় বণিকের, রাজনীতিকের ক্ষমতা ও অর্থের অশ্লীল, বর্বর, নগ্ন লোভ। তাই আজ এই অর্ডিন্যান্স, কাল ওই রুল বদল, পরশু আর এক বেআইনের আইন।

 

তফসিলি আদিবাসী এবং অন্যান্য পারম্পরিক বনবাসী (বনাধিকার স্বীকার) আইন সংক্ষেপে বনাধিকার আইন ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংসদে পাশ হয়। এই দিকনির্দেশক আইনের মাধমে ব্রিটিশ আমলে তো বটেই ভারতীয় বন আইনের আমলেও ঐতিহাসিক অবিচারের প্রতিকার করতে চাওয়া হয়েছে। এই আইনে ভারতের বনাঞ্চলে বাস করা বিশাল সংখ্যক মানুষের বাসভূমি এবং কৃষিজমির অধিকার-সহ বিভিন্ন অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বনপ্রশাসনের গণতান্ত্রীকরণের একটি কাঠামো তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের তত্ত্বাবধানেই কীভাবে বন সংরক্ষণ করা যায় তার হদিশও দেওয়া হয়। এই আইন গোষ্ঠীস্তরে মানুষের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত অধিকার স্বীকার করে। যেমন, বাস্তুজমি ও কৃষিজমি থাকা ব্যক্তিগত অধিকার আবার মাছধরা গোষ্ঠী বা সমষ্টির অধিকার। স্বীকার করা হয়েছে কাঠ ছাড়া বনের যাবতীয় ক্ষুদ্র বনজদ্রব্য আহরণ, ব্যবহার, বিক্রির যাবতীয় অধিকার অরণ্যবাসীদের।

 

বনাধিকার আইন অনুযায়ী, আরণ্যক গ্রামবাসীদের গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া বনের জমির চরিত্র বদল করা যাবে না। ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রক এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছিল, এখন থেকে ফরেস্ট (কনজারভেশন) অ্যাক্ট, ১৯৮০ বা বন (সংরক্ষণ) আইন অনুযায়ী ছাড়পত্র (অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য জমির চরিত্র বদল) দেওয়া যাবে একমাত্র বনাধিকার আইন, ২০০৬ সম্পূর্ণভাবে বলবৎ করার পরই। ওড়িশা সরকার কালাহান্দি ও রায়গড় জেলায় নিয়মগিরি পাহাড় এবং সংলগ্ন বনভূমিতে এই আইন বলবৎ না করায় ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রক ওড়িশা মাইনিং করপোরেশন লিমিটেড (ওএমসিএল)-কে দেওয়া স্টেজ-২ ছাড়পত্র বাতিল করে দেয়। পরিবেশমন্ত্রকের যুক্তি ছিল নিয়মগিরিতে ওএমসিএল বনাধিকার আইন, ২০০৬-এর শর্ত লঙ্ঘন করেছে। রাজ্য সরকারের এই কোম্পানির দায়িত্ব ছিল বেদান্তের লাঞ্জিগড় শোধনাগারে বক্সাইট সরবরাহ করা। বাধা পেয়ে ওএমসিএল ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানায়। ২০১৩ সালের ১৮ এপ্রিল শীর্ষ আদালত তার রায়ে বলে, বনাধিকার আইন অনুযায়ী গ্রামসভা শুধু মাইনিং করপোরেশনের এই নতুন দাবি সম্পর্কেই নয়, মাইনিং-এর ফলে অরণ্যবাসীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কি না সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই থেকে ১৯ অগস্ট দীর্ঘ শুনানির পর নিয়মগিরির বিশেষভাবে সঙ্কটাপন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী (পিভিটিজি) তালিকার অন্তর্ভুক্ত ডোঙরিয়া কন্ধ ও কুটিয়া কন্ধ এবং পারম্পরিক বনবাসী দলিত গোষ্ঠীর গৌড়া ও হরিজনদের ১২০টি গ্রামের মানুষ সর্বসম্মতি ক্রমে সিদ্ধান্ত নেন—তাঁদের আরণ্যক পাহাড়ি বাসভূমিতে, তাঁদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় মাতৃভূমিতে বক্সাইটের খনি করা যাবে না। তাঁরা এমন ভাষায় বলেননি অবশ্য। কুনাকাড়ু গ্রামসভায় কুটিয়া কন্ধ টুঙগুরু মাঝি বলেছিলেন, “ঝরনা, পানি, পবন, পাতা সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তোমরা এখনই চলে না গেলে আমরা বিরসা মুন্ডা, রিন্ডো মাঝির মতো মরব। আমরা মুর্খ জাতি, আমরা কোনওদিন তোমাদের কথা শুনব না।” কেশরপাড়ি ডোঙরিয়া টোলার কন্ধ পুরোহিত বেজুনি বলেছিলেন, “তোমাদের মন্দির ইট-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। আমাদের দেবতা এই পাহাড়, বন, গাছের পাতা, ঝরনা। তোমরা যদি খোঁড়াখুঁড়ি করো তবে আমরা আমাদের ভগবানের সঙ্গেই মরে যাব। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা যেমন ভগবান জগন্নাথকে পুজো করে, আমরাও তেমনি নিয়মরাজাকে পুজো করি।” পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল অ্যালুমিনিয়াম দানব বেদান্তকে। যত সহজে বলা গেল ঘটনাটা তত সহজ ছিল না। এর পিছনে ছিল ওড়িশা সরকার এবং তার সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী, প্রভূত আর্থিক শক্তিধর বেদান্ত, আইন-আদালত, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনদপ্তরের বিরুদ্ধে আদিবাসী ও দলিত মানুষের প্রায় এক দশকের জীবনমরণ লড়াই।

 

এই রক্ষকবচটিই কেড়ে নিতে এবার নয়াবিধি আনল কেন্দ্রীয় সরকার। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ বেদান্তদের হাতে বনের অধিকার তুলে দেওয়া। নিয়মরাজা, মারাংবুরুর পুজো উপাসনা ধ্বংস করে দেওয়া। কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, নানা জটিল আইনি মারপ্যাঁচ, ধাপে ধাপে ছাড়পত্র, বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সময়সাধ্য ফাইল চালাচালির হাত থেকে মুক্তি পেতে এই নতুন বিধি আনার উদ্দেশ্য হল, ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’। অর্থাৎ, ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে সহজসাধ্য হয়। ভুক্তভোগীরা অবশ্য এই নয়া বিধিকে ‘ইজ অব স্ন্যাচিং ফরেস্ট’ বা অরণ্য কেড়ে নেওয়ার সহজ পদ্ধতি বলে সমালোচনা করছেন। ২৮ জুন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রক ফরেস্ট (কনজারভেন) অ্যাক্ট মোতাবেক এক বিজ্ঞপ্তি মারফত ফরেস্ট কনজারভেশন রুল, ২০২২ জারি করেছে। যেখানে বলা হচ্ছে, বেসরকারি সংস্থা বনবাসীদের অনুমতি ছাড়াই বন কেটে ফেলতে পারবে। তার অর্থ বনাধিকার আইনের এক মুখ্য ধারাকেই নস্যাৎ করে দেওয়া হল। বিধি অনুযায়ী, অরণ্যবাসীদের অনুমতি ছাড়াই অরণ্যভূমিতে বেসরকারি প্রকল্পের অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। চিরাচরিত বনভূমি হস্তান্তরের বিষয়ে সম্মকভাবে ওয়াকিবহাল হয়ে স্বাধীনভাবে অরণ্যবাসীদের প্রাক-সম্মতি দেওয়ার কিংবা না দেওয়ার এবং তাঁদের অধিকার খর্ব হচ্ছে কি না তা বিচার বিবেচনা করার নিয়মটিই তুলে দেওয়া হল। এই বিধি সংসদে অনুমতি পেলে আর কোনও ঝক্কির প্রয়োজন হবে না। শুধু তাই নয়, বনাধিকার আইন মানা হচ্ছে কি না তা দেখার ‘ঝুটঝামেলা’র মধ্যেও যাবে না কেন্দ্রীয় সরকার। আদিবাসীদের চিরাচরিত বনভূমির উপর তাঁদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার দায় ঝেড়ে ফেলে কেন্দ্র সে দায়িত্ব তুলে দিতে চাইছে রাজ্যগুলির উপর। কেন্দ্র বন উচ্ছেদের অনুমতি দিয়ে দেবে আর রাজ্যগুলিকে দেখতে হবে, বন সাফাই করার আগে বেসরকারি সংস্থাগুলি আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকারকে স্বীকার করে নিচ্ছে এবং বনকাটাইয়ের আগে আদিবাসীদের সম্মতিও নিচ্ছে। বিধিতে বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার ব্যবহারকারী সংস্থার হাতে বনের জমি হস্তান্তর করার বিজ্ঞপ্তি জারির আগে দেখে নেবে বনাধিকার আইন মান্য করা হয়েছে কি না। এ আসলে বলার জন্য বলা। কেননা যে বনভূমি কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রক টাকা-পয়সা মানে এনপিভি নিয়ে খনি-খাদান, কল-কারখানা বা অন্য কোনও প্রকল্পের জন্য ব্যবসায়িক সংস্থার হাতে একবার তুলে দিয়েছে, তা একজন সরকারি আধিকারিক (২০০৬-এর আইন অনুযায়ী জেলাশাসক সংশ্লিষ্ট জেলার বনাধিকার কমিটির চেয়ারম্যান) কী করেই বা তার বিরোধিতা করবে। আর রাজ্য সরকারই বা তা হতে দেবে কেন?

 

আমরা যদি বেদান্ত ও অন্যান্য প্রকল্পে ওড়িশা সরকার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড সরকারের ভূমিকা খতিয়ে দেখি—তবে দেখতে পাব এই সুবিশাল মিনারেল করিডোর, আদিম অরণ্য,পাহাড় দখল করে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বিরামহীন সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমন কেন্দ্রীয় বিধি যে, রাজ্য সরকারগুলি লুফে নেবে তার সম্ভাবনা নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না। এই রাজ্যে সেবক-সিকিম রেললাইন, পুরুলিয়ায় পাম্প স্টোরেজ প্রকল্প, দেউচা-পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্প এবং সম্প্রতি মুর্শিদাবাদে আদানি গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য হাই-টেনশন লাইনের টাওয়ার বসানোকে কেন্দ্র করে সরকারের ভূমিকা প্রমাণ করে যে, অরণ্যের অধিকার চুলোয় দিয়ে কর্পোরেটের জন্য লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখাই রয়েছে। যা ঘটবে তা তো ‘উন্নয়নের দোহাই’ দিয়ে ঘটানো হবে। আগে যেখানে ব্যবসায়িক কাজে বনের জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোট আয়তন অনুসারে হয় পরিবেশ দপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় অথবা রাজ্য সরকার সব প্রস্তাব খতিয়ে দেখত। এর পর কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এই সমস্ত প্রস্তাব বিচারবিবেচনা করে পরামর্শ দেওয়ার জন্য কমিটি গঠন করত। এমন কমিটিগুলিতে যেমন পরিবেশবিদরা থাকতেন তেমনই থাকতেন আদিবাসী ও অরণ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। বাহুল্যবোধে এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনাটাই নতু্ন বিধিতে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। আর প্রকল্পের যোগ্যতা-পরীক্ষা, আঞ্চলিক কার্যালয়গুলির সমন্বয়সাধন, নির্দিষ্ট ও অল্পসংখক আধিকারিক নিয়োগ, এবং মন্ত্রকের অধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি সবই থাকবে কেন্দ্রীয় বন-আমলাদের নিয়ন্ত্রণে। এক শ্রেণির বন-আমলারা যে মানসিকভাবে আজও ১৮৭৮ কিংবা ১৯২৭ সালের ঔপনিবেশিক বন আইনের সাক্ষাৎ প্রতিভূ। এবং কর্পোরেট, কর্পোরেট-সেবী তাবড় রাজনৈতিক দল, মানুষহীন বন সংরক্ষণের উদগাতা এক শ্রেণির এনজিও-র মতোই এই আমলারাও বনাধিকার আইনের প্রবল বিরোধী।

 

নতুন বন সংরক্ষণ বিধি ৬(খ)(২)-এ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, পরিবেশ মন্ত্রকের বনের চরিত্র বদলের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বনাধিকার আইন অনুসারে কোনও অনুমতিরই আর প্রয়োজন হবে না। কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন বা ক্ষতিপূরণস্বরূপ বনসৃজন আইন অনুযায়ী কেটে, পুড়িয়ে, ধ্বংস করে ফেলা বন ও বাস্তুতন্ত্রের সার্বিক পরিবেশ মূল্য হিসেবে নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু (এনপিভি) বা মূল্য ধরে দিলেই অনুমতিতে সিলমোহর পড়ে যাবে। একটি প্রাকৃতিক অরণ্য, তার উপর আর্থিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়ভাবে নির্ভরশীল অরণ্যবাসী, তাঁদের বাস্তু ও চাষজমি, লতাগুল্ম-ওষধি থেকে হাজারো মহীরুহ, কীট-পতঙ্গ, পাখি থেকে বৃহৎ তৃণভোজী ও মাংসাশী প্রাণী যাদের অনেকই লুপ্তপ্রায় কিংবা সঙ্কটাপন্ন—সেই সামগ্রিক জীববৈচিত্র ধ্বংসের মূল্য বা এনপিভি হচ্ছে হেক্টর প্রতি ৪ লক্ষ থেকে ১০.৪৩ লক্ষ টাকা। ২০০৯ সাল থেকে এমনই রেট চলে আসছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তা সামান্য বেড়ে হয়েছে হেক্টর প্রতি ১০.৬৯ লক্ষ থেকে ১৫.৯৫ লক্ষ টাকা। দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মতো এই অর্থে বাধ্যতামূলকভাবে বনসৃজন হবে। একটি একশো, দুশো বা হাজার বছরের বনভূমি ধ্বংস করে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বনসৃজন করলেও এক অঞ্চলের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্র, সেই অঞ্চলের জলবায়ুর উপর তার কুপ্রভাবের কোনও ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাব, ২০০৮ সাল থেকে—যখন বনাধিকার আইনের রুলগুলি বিজ্ঞাপিত হয়েছে— ২০১৯ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ইউপিএ ২ আমলের প্রায় শেষ ছ’বছর এবং মোদী জমানার পাঁচ বছরে ২৫৩,১৭৯ হেক্টর বনভূমি অ-আরণ্যক প্রকল্পে বদল ঘটানো হয়েছে। আর এই তথাকথিত বনসৃজন হয়েছে ৪৭,৫০০ হেক্টরের মতো পতিত অরণ্যভূমিতে। অর্থাৎ, এক বিপুল পরিমাণ অর্থ বনদপ্তর না বনসৃজনে, না অরণ্যবাসীদের কল্যাণে খরচ করেছে। আসলে এই তথাকথিত ক্ষতিপূরণ দিয়ে বনকাটাইয়ের আইন-কানুন স্রেফ অরণ্যবাসী নিকেশ করারই আর এক সুচতুর কৌশল ছাড়া কিছু নয়। এই সবই হচ্ছে শীর্ষ আদালত এবং শীর্ষ নেতৃত্বের মহৎ পরিকল্পনার ফলাফল।

 

এমনটা তো নয় যে, এই প্রথম কোনও সরকার ‘আদিবাসী তাড়াও, বন কাটো, উন্নয়ন করো’ নীতি গ্রহণ করল কোনও। ঐতিহাসিক বনাধিকারের দৌলতে স্বাধীন ভারতে প্রথম এক কর্পোরেট দানব আর তাদের বশংবদ সরকারকে রুখতে নিয়মগিরির আদিম অরণ্যে আদিবাসী ও দলিত মানুষ একসুরে না বলেছিলেন। দেশের ইতিহাসে সে যেন ছিল প্রথম ‘এনভায়রনমেন্ট রেফারেন্ডাম’। এক ঐতিহাসিক ক্ষণ। কিন্তু, এই সময় থেকেই আবার কর্পোরেটকে খুশি রাখতে বনাধিকার আইনকে দুর্বল করার যাবতীয় প্রচেষ্টাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। মোদী এবং তাঁর পুঁজিপতি বন্ধুদের বোধহয় চোখের পাতা নেই, কাটা গেছে দুটো কানই। তাই নির্লজ্জ, বেহায়ার মতো দেশের অরণ্যসম্পদ বেচে খাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এর বহু নিদর্শন রয়েছে। ২০১৯ সালে ওই কতিপয় ‘সংরক্ষণ-পন্থী’ এনজিও, প্রাক্তন বনআমলাদের এক মামলায় সুপ্রিম কোর্টের এক ‘কর্পোরেট-বন্ধু’ বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ১৬টি রাজ্যের ১১.৮ লক্ষ ‘বেআইনিভাবে বসবাসকারী’ অরণ্যবাসীকে তাঁদের বাস্তুভিটে, চাষজমি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। আমাদের রাজ্যে সংখ্যাটি ছিল ৮৬,১৪৬ জন। এই তথাকথিত ‘বেআইনি’ অরণ্যবাসীদের তালিকা সরবরাহ করেছিল রাজ্যগুলি। রাজ্যগুলির হিম্মত হয়নি এই নির্দেশ পালন করার। তবে, এমন একাধিক রায়ের কারণেই অবসরের পর ভিন দায়িত্বে পুনর্বাসিত হয়েছেন তিনি। আবার এই ২০১৯ সালেই ১৯২৭ সালের ঔপনিবেশিক ভারতীয় অরণ্য আইন নয়া মোড়কে চালু করার উদ্দেশ্যে খসড়াও প্রস্তুত করে ফেলা হয়েছিল। দুটি প্রচেষ্টাই প্রবল বিরোধিতার জেরে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু, মোদী-শাহরা যে বদ্ধপরিকর নয়াবিধি তারই প্রমাণ।

 

এই রাষ্ট্রীয় নীতি কীভাবে আদিবাসীদের উপর প্রভাব ফেলেছে তার তথ্য মেলে ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ গঠিত এক আদিবাসী বিষয়ক এক হাই লেভেল কমিটির রিপোর্টে। অধ্যাপক ভার্জিনিয়াস খাখা-র নেতৃত্ত্বে গঠিত এই ‘হাই লেভেল কমিটি অন সোশ্যাল-ইকনমিক, হেলথ অ্যান্ড এডুকেশনাল স্টেটাস অব ট্রাইবাল কমিউনিটিজ অফ ইন্ডিয়া’ (২০১৪) রিপোর্টে তথাকথিত উন্নয়নের কারণে দেশের আদিবাসীদের ধারাবাহিকভাবে উচ্ছেদ প্রসঙ্গে বলছে, দেশ গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে আদিবাসী এলাকায় ব্যাপক আকারে খনিশিল্প, রাস্তা, রেলপথের মতো পরিকাঠামোগত প্রকল্প, বাঁধ ও সেচ ব্যবস্থার মতো জলশক্তি প্রকল্পের প্রসার ঘটছে। এরই সঙ্গে হাত ধরে চলেছে নগরায়ন প্রক্রিয়া। সামগ্রিক ভাবে আদিবাসীদের উপর এই উন্নয়নের যে প্রভাব পড়েছে তা হল, জীবন-জীবিকা হারানো, ব্যাপক হারে উৎখাত হওয়া এবং দেশান্তরী হতে বাধ্য হওয়া। কেমন করে চলেছে এই ‘উন্নয়ন-রাজ’? তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হাই লেভেল কমিটির রিপোর্ট জানাচ্ছে, আদিবাসীদের রক্ষা করার জন্য যে আইনি বিধি, বিধান রয়েছে, তা নিয়ম করে চতুর কৌশলে লঙ্ঘন করা হচ্ছে এবং কর্পোরেট স্বার্থের খাতিরে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়েছে। আদিবাসীদের ক্ষেত্রে যার সামগ্রিক ফল হল, অত্যন্ত গুরুতর জাগতিক ও সামাজিক বঞ্চনা এবং সম্পদ-সঙ্গতির এক আগ্রাসী বিচ্ছিন্নকরণ।

 

প্রাকৃতিক সম্পদ এবং রাষ্ট্র-নাগরিক দ্বন্দ্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সি আর বিজয় সাম্প্রতিক বিধি বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এক নিবন্ধে বলেছেন, বনাধিকার আইন, ২০০৬ এর ফলে অরণ্য (সংরক্ষণ) আইন, ১৯৮০ গ্রাহ্য নয়। এবং বিধি কখনও একটি আইনকে অগ্রাহ্য করতে কিংবা খারিজ করতে পারে না। এই কারণেই বিধি ৬(বি)(২) আইন বিরোধী। এবং এই বিধি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। ১৮ জুলাই শুরু সংসদের বর্ষা অধিবেশন। এই বেআইনি বিধি সংসদে পেশ করার সম্ভাবনা প্রবল। কৃষি, শ্রমকোড-সহ অন্যান্য বিলের মতোই কি এই বিধিকেও সংসদে গাজোয়ারি করে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে? যদি হয়, তবে রাস্তাই প্রতিবাদের একমাত্র পথ।

 

সৌজন্য:

(১) Niyamgiri Answers, People veto bauxite mining, but Vedanta is unlikely to let go of the bounty, Sayantan Bera, Down To Earth, 31 August 2013

(২) Environment Ministry’s new forest diversion rules are bad news for forest rights, C.R. Bijoy, The Wire, July 10 2022.

 

 

 

Share this
Recent Comments
1
Leave a Comment