এইচ এম টিঃ ফেলে আসা সময়ের নষ্ট কথা


  • July 13, 2022
  • (0 Comments)
  • 1449 Views

সরকারি সংস্থাগুলি আসলে জনগণের করের টাকায় তৈরি সাদা হাতি, প্রতিযোগিতাহীন বাজারেই তাদের যত মাতুব্বর, যা কিছু ব্যক্তিগত তাই পবিত্র  – এই ধরণের যে ন্যারেটিভ ৯০ এর দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা লগ্নে থেকে প্রতিনিয়ত বপন করা হচ্ছে, এইচ এম টির হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়া কি তার এক সফল উদাহরণ? না কি আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, ভুল পরিকল্পনা এবং নতুন প্রযুক্তি ও বাজারকে বুঝতে না পারার জন্য ঘড়ির বাজারে এইচ এম টির পতন! সুমন কল্যাণ মৌলিক এই নিবন্ধে সেই ফেলে আসা সময়ের আলোকে এই প্রশ্নগুলোকে দেখবার প্রয়াস করেছেন।

 

 

সময়টা ছিল আশির দশকের প্রথমার্ধ। মাধ্যমিকে ভালোভাবে পাশ করার খবর জানতে পেরে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি ফিরে এসে বাবাকে তার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলাম। হ্যাঁ,এবার আমি ঘড়ি পাব। সে সময় বাড়ির বাচ্চাদের নিয়মিত ভালোমন্দ জিনিস কিনে দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়িতে। ঘড়ি হোক বা প্যাডেলে ভর দিয়ে দিকশূন্যপুরে চলে যাওয়ার জন্য সাইকেল, সবটাই অর্জন করতে হত। কয়েকদিন পরে বাবার সঙ্গে গেলাম বাজারে, কেনা হল আমার জীবনের প্রথম হাতঘড়ি। এইচ এম টি কোম্পানি তৈরি, মডেলের নাম সম্ভবত বিজয়। তখনও মানুষ হাতঘড়ি বলতে এইচ এম টিকেই বুঝত। অলউইন বলে আরেকটি কোম্পানির ঘড়ি কয়েকজনের হাতে দেখা যেত বটে, তবে তা ছিল নেহাৎই ব্যতিক্রম। এছাড়া ছিল দামি ঘড়ি, বিদেশ থেকে চোরাপথে ভারতে আসত। আমার এক পিসতুতো দিদির বিয়েতে পাত্রপক্ষের ‘আবদার’ ছিল রোলেক্স ঘড়ির। মনে আছে বেশ কয়েকবার কলকাতা গিয়েও চড়া দামের কারণে তা কেনা যায় নি পরিবর্তে টি শট বলে আরেকটি বিদেশি ঘড়ির ব্যবস্থা করা গেছিল। সেই সময়কার একটা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বিদেশি ঘড়ি ও অলউইনের মত দু একটা ছোট খাটো কোম্পানির হাতে ছিল ঘড়িবাজারের মাত্র দশ শতাংশ। আর বাকি নব্বই শতাংশের দখলদারি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ঘড়ি সংস্থা এইচ এম টির। সুলভ মূল্য ও অসাধারণ গুণমানের (তবে মডেলের বৈচিত্র্য খুব একটা বেশি ছিল না) ফলে ব্র্যান্ড হিসাবে এইচ এম টি ছিল ক্রেতাদের এক নম্বর পছন্দের। কোম্পানির বিজ্ঞাপনের দুই জনপ্রিয় ট্যাগলাইন ‘দেশ কি ধড়কন’ এবং “Timekeeper of the Nation” ছিল সব অর্থেই ঘড়ি নির্মাতা হিসাবে এইচ এম টির অসাধারণ সাফল্যের দ্যোতক। কিন্তু নব্বই এর দশক থেকে এইচ এম টি ঘড়ি বিক্রির বাজার নব তারকা টাইটান (টাটার মালিকানা) এর কাছে হারাতে লাগল যার অন্তিম পরিণতি ২০১৪ সালে এইচ এম টির চূড়ান্ত ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। সরকারি সংস্থাগুলি আসলে জনগণের করের টাকায় তৈরি সাদা হাতি, প্রতিযোগিতাহীন বাজারেই তাদের যত মাতুব্বর, যা কিছু ব্যক্তিগত তাই পবিত্র  – এই ধরণের যে ন্যারেটিভ ৯০ এর দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা লগ্নে থেকে প্রতিনিয়ত বপন করা হচ্ছে, এইচ এম টির হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়া কি তার এক সফল উদাহরণ? না কি আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, ভুল পরিকল্পনা এবং নতুন প্রযুক্তি ও বাজারকে বুঝতে না পারার জন্য ঘড়ির বাজারে এইচ এম টির পতন! বর্তমান নিবন্ধে সেই ফেলে আসা সময়ের আলোকে এই প্রশ্নগুলোকে দেখবার প্রয়াস রাখা হয়েছে।

 

সময়টা ৫০’ এর দশকের প্রথম ভাগ। দেশ স্বপ্ন দেখছে এক স্বনির্ভর ভারতবর্ষের। ১৯৫৩ সালে ভারি যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠিত হল হিন্দুস্তান মেশিন টুলস (এইচ এম টি)। নতুন যুগের দাবি মেনে বিষয়টা আর ভারি যন্ত্রপাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। সিদ্ধান্ত হল ট্র্যাক্টর, প্রিন্টিং মেশিনারি ও ঘড়ি তৈরি করা হবে। কিন্তু ঘড়ি তৈরির উপযুক্ত প্রযুক্তি তখন দেশে নেই তাই গাঁটছড়া বাঁধা হল জাপানের ঘড়ি সংস্থা সিটিজেন কোম্পানির। ১৯৬১ সালে শুরু হল ঘড়ি কোম্পানি হিসাবে এইচ এম টির পথচলা। কোম্পানির প্রথম ঘড়ির মডেলের নাম জনতা, উদ্বোধন করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। প্রথম ঘড়ির কারখানা ব্যাঙ্গালোরে।তারপার থেকে দীর্ঘদিন শুধু সাফল্যের গল্প। তরুণ, নূতন, প্রিয়া, নিশান, কোহিনূর  – একের পর এক মডেল বাজারে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করল। এক প্রবীণ ঘড়ি সংগ্রাহকের মতে বাজারে সবচেয়ে চাহিদা ছিল কাঞ্চন মডেলটির, তখনকার দিনে দ্বিগুন মূল্যে কালোবাজারে এই ঘড়িটি বিক্রির নজির আছে। দক্ষ কর্মীদের সৌজন্যে হাত ঘড়ির প্রযুক্তিগত উন্নতিও কম হলো না।দম দেওয়া ঘড়ি, অটোমেটিক, কোয়ার্টজ, ঘড়িতে দিন ও মাস দেখার ব্যাবস্থা, ব্রেইল ওয়াচ  – সব কিছুতেই এইচ এম টি ঘড়ি তখন এক নম্বরে। বাজারের চাহিদা মেটাতে শ্রীনগর, টুমকুর, উত্তরাখণ্ডে নতুন কারখানা তৈরি হল। তাতেও কিন্তু প্রথমে ক্রেতারা দোকানে গেলেই ঘড়ি পেত না, অপেক্ষা করতে হত। জন্মদিন, বিয়েবাড়ির প্রীতি উপহার বা ফেয়ারওয়েলের অনুষ্ঠান এইচ এম টির ঘড়ি ছাড়া সম্পূর্ণই হত না।

 

পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল নব্বই এর দশকের শুরুতে। সাধারণ ভাবে একটা কথা বলা হয় কোয়ার্টজ ঘড়ি চলে আসার কারণে এইচ এম টি তার বাজার হারায়। অনেকে বলেন ঘড়ির বাজারে প্রথমবার প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েই এইচ এম টি তার ছন্দ হারিয়ে ফেলে। বিষয়টা এত সরল নয়। কোয়ার্টজ প্রযুক্তি ঘড়ির দুনিয়ায় আসে সত্তরের দশকে। ঘড়ির সময় দেখানোর ব্যাপারে এই প্রযুক্তি ছিল প্রচলিত যান্ত্রিক ঘড়ির চেয়ে ৫০০ শতাংশ নিখুঁত। কিন্তু সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এই প্রযুক্তি সে সময়ে সারা পৃথিবীর কোথাও সেভাবে জনপ্রিয় হয় নি। খুব কম লোকই একথা জানেন ভারতে প্রথম কোয়ার্টজ ঘড়ি তৈরি করে এইচ এম টি ১৯৭০ সালে (মডেলের নাম সোনা, বিজয়)। তবে তা ক্রেতাদের আনুকূল্য লাভ করে নি।

 

সমস্যা হল এইচ এম টির নীতিনির্ধারকরা কোয়ার্টজ ঘড়ির প্রাথমিক ব্যার্থতাকে চূড়ান্ত ধরে নিয়ে পুরো মনোযোগ মেকানিকাল ও অটোমেটিক ঘড়িতে মনোনিবেশ করে। কিন্তু আশির দশকের শুরু থেকে পৃথিবীতে কোয়ার্টজ ঘড়ি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এক্ষেত্রে ডিজাইনও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ঘড়ি পড়ার সংস্কৃতিতেও একটা পরিবর্তন আসে। ঘড়ি শুধু আর সময় দেখার প্রয়োজনীয় যন্ত্র হিসাবে থাকে না, তা হয়ে ওঠে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। একাধিক বাজার সমীক্ষায় তখন কথাটা বারবার বলা হতে থাকে। নানান মডেলের কোয়ার্টজ ঘড়ি তৈরি করার একাধিক প্রস্তাব এইচ এম টির আধিকারিকরা জমা দেন কিন্তু আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের কারণে প্রকল্প রূপায়িত হয় নি। এই পরিস্থিতিতে টাটা ও তামিলনাড়ু ইনডাসট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন (টিডকো) যৌথ উদ্যোগে টাইটান বাজারে আসে। একথা মনে রাখা দরকার টাইটান কোম্পানিটা শুরু হয় যে প্রযুক্তিবিদ ও কর্মীদের দ্বারা তাদের বেশিটাই ছিল এইচ এম টির কর্মী (সংখ্যাটা ছিল ৩৯৬)। টাইটান বহু আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয় তারা শুধু কোয়ার্টজ ঘড়িই তৈরি করবে। ফলে নতুন বাজার তারা দখল করল। মেকানিকাল ঘড়ি নতুন প্রজন্মের ভারতীয়দের আর প্রথম পছন্দ থাকল না। বিপদ উপলব্ধি করে এইচ এম টি কোয়ার্টজ ঘড়ি উৎপাদনে ফিরলো ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে নয়া অর্থনৈতির সংস্কার পর্ব চালু হয়ে গেছে। একের পর এক বিদেশি কোম্পানি ভারতের বাজারে তাদের ঘড়ি বিক্রি করতে শুরু হয়ে গেছে। এইচ এম টির আরেকটি আর্থিক বিপর্যয় ঘটল যখন শ্রীনগর ইউনিটের উৎপাদন রাজনৈতিক সহ বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেল। সেখানকার ৫০০ জন শ্রমিককে দীর্ঘ সময় ধরে বসিয়ে মাইনে দিতে হল। একদা লাভজনক কোম্পানিতে ক্ষতির বোঝা বাড়তে লাগল। যে কোম্পানি ২০০৬ পর্যন্ত ১১৫ মিলিয়ন ঘড়ি তৈরি করেছিল তার ক্ষতির পরিমাণ ২০১৩-১৪ সালে ২৫০ কোটি টাকা।

 

খুব সংক্ষেপে এই হল দেশের ধড়কন এইচ এম টির ইতিহাস। ঘড়ি নির্মাতা হিসাবে তার দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত, বাজারের সমস্যা ছিল না কিন্তু পরিবর্তিত বাজারে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যার্থতা তাকে পিছিয়ে দিল। এক্ষেত্রে তাকে পুনরায় চাঙ্গা করার বিষয়ে সরকারের আর কোন আগ্রহ অবশিষ্ট ছিল না কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে জলের দরে কর্পোরেটদের কাছে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত তখন ভারত রাষ্ট্র চূড়ান্ত করে ফেলেছে।

 

Share this
Leave a Comment