টালা সেতু সংস্কার শেষের পথে, এখনও ‘জতুগৃহ’-এ ১৩৯ পরিবার


  • June 25, 2022
  • (0 Comments)
  • 611 Views

একটি গ্রাউন্ডজিরো রিপোর্ট

 

২০১৯ সালে শুরু হয়েছিল টালা সেতু সংস্কারের কাজ। ওই সময় সেতুর নীচে ৬০-৭০ বছর ধরে বসবাসকারী ১৩৯ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। পুনর্বাসনের দাবিতে বার বার স্থানীয় পুরপিতা এবং কলকাতা পুরসভার মেয়রের কাছে দাবি জানালেও অভিযোগ তাঁরা সে কথায় কান দেননি উপরন্তু উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের অপমানিত হতে হয়েছে। পরবর্তীতে ‘বস্তিবাসী শ্রমহীবী অধিকার রক্ষা কমিটি’-র ব্যানারে তাঁরা হাই কোর্ট-এ আবেদন জানালে আদালত বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেয়।

 

বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি-র অভিযোগ, হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পর সরকার অত্যন্ত দায়সারাভাবে পিকে মুখার্জি রোড, ৯১ নম্বর বাস স্ট্যান্ড, কলকাতা স্টেশন, গৌরীবাড়ি সংলগ্ন খাল পাড়ে এবং টালা রেল ইয়ার্ডের পাশে অস্থায়ী প্লাস্টিকের ঘর বানিয়ে দেয়। টালা থেকে উচ্ছেদের শিকার হওয়া বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই ঘরগুলি বসবাসের অযোগ্য অতিদাহ্য প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি, এবং বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে পানীয় জল কোনও নাগরিক সুবিধাই তাঁরা ঠিকমতো পান না।

 

কলকাতা শহর এবং পশ্চিমবঙ্গে জুড়েই কোনও সঠিক পুনর্বাসন আইনের রুপরেখা না থাকায় উচ্ছেদের শিকার হওয়া বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষকে কোনরকম নাগরিক অধিকার ছাড়াই দশ ফুট বাই দশ ফুটের ‘জতুগৃহ’-এ বসবাস করতে বাধ্য হতে হয়।

 

২৩ শে জুন, বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি — টালার পক্ষ থেকে, টালা-সহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে উচ্ছেদ হওয়া বস্তিবাসীদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের দাবিতে, শহরের বস্তিবাসীদের বাসস্থানের অধিকার সুনিশ্চিত করা তথা উপযুক্ত পুনর্বাসনের জন্য এবং শহরে বসবাসকারী বিপুল শ্রমজীবী মানুষের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের গ্যারান্টির জন্য আইন প্রণয়ন; শহরের বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের জন্য উপযুক্ত মজুরি; কর্মস্থলে সুরক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা; বস্তিবাসী মানুষদের জন্য জল, বিদ্যুৎ, শৌচাগার, সান্ধ্যকালীন সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা; স্বল্পমূল্যের ক্যান্টিন-সহ অন্যান্য নাগরিক পরিষেবার সুব্যবস্থার দাবিতে শ্যামবাজার মেট্রোর ১ নং গেট সংলগ্ন রাস্তা প্রায় ৫ ঘণ্টা সভা করে।

 

বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটির অন্যতম সংগঠক ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক বিশ্বজিৎ হালদার বলেন, আর্থসামাজিক শোষণ, কৃষি সংকট, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে গ্রামে কাজ হারিয়ে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে শহরে আসতে বাধ্য হন হাজার হাজার মানুষ। তাঁরা শহরে বিভিন্ন শ্রমসাধ্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু, এই পেশাগুলিতে না আছে উপযুক্ত ন্যূনতম বেতন, না আছে সম্মান, না স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার। তিনি স্পষ্ট জানান, “গ্রাম থেকে মানুষেরা শহরে যখন আসেন, তাঁদের কাজ হয় শহরকেন্দ্রিক। কেউ দিনমজুরের কাজ করেন, কেউ হকারি করেন, কেউ ধনী লোকেদের বড় বড় বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করেন। এই শ্রমের বিনিময়ে যা উপার্জন হয় তাতে এই শহরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা সম্ভব নয়, তাই দীর্ঘ বছর ধরে খালপাড় বা রেল লাইনের ধারে বস্তি গড়ে ওঠে।”

 

তিনি এও বলেন যে, প্রত্যেকটি সংসদীয় রাজনৈতিক দল ভোটের আগে যথেচ্ছভাবে শ্রমজীবী মানুষকে ব্যবহার করলেও ভোট মিটলেই কোথাও বস্তিতে থাকা, কোথাও ব্রিজের তলায় থাকা মানুষেরা হয়ে যান বেআইনি, অথচ তাদের গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন কোনও শাসক দলকেই ভাবিয়ে তোলে না এবং গ্রামে একশো দিনের কাজে শাসক দলের লোকের প্রাধান্য পায় এবং যথেচ্ছ দুর্নীতি করে।

 

ওয়েল্ডিং শ্রমিক ও টালার বাসিন্দা শিকদারি প্রসাদ জানান, “আমাদের দাবি যদি না মানা হয়, আমরা মিছিল করে কর্পোরেশন হেড অফিস ঘেরাও করব। আমরা যখনই অভিযোগ জানাই, চিঠি দিই তখনই কিছু লোককে ম্যাপিঙের কাজে পাঠানো হয়, আজ তিন বছর পার হলেও উপযুক্ত বাসস্থান আমরা পাইনি। “টালার উচ্ছেদ হওয়া মহিলা শ্রমিকেরা বেহাল স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ উগরে দিয়ে জানান, যদি পুনর্বাসন না পাই তবে টালা ব্রিজ-এর উদ্বোধন করতে দেব না।” দরকার হলে জান দিয়ে দেব”, সোচ্চার কণ্ঠে বলে ওঠেন এক মহিলা শ্রমিক।

 

বাসন্তী কলোনির গৃহশ্রমিক চণ্ডী সরকার নিজের অসুস্থতা সত্ত্বেও গতকাল জমায়তে সামিল ছিলেন। তিনিও গৃহ শ্রমিকদের কাজের যথাযথ মর্যাদা ও উপযুক্ত বেতন কাঠামোর দাবি করে বলেন, আজকে আমরা খাটি বলেই বড়লোকেরা ওদের ছেলেপুলেদের খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমাদের উপর ছেড়ে দিয়ে বাইরে গিয়ে রোজগার করে। বস্তিবাসীর শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটির অন্যতম সংগঠক রুবি হরি দি জানান, তাদের জীবনটাই রোজ সংঘর্ষের, রোজ হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরেও জোটে না অতিরিক্ত কাজের অতিরিক্ত বেতন।

 

কলকাতা শহরে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নথিভুক্তভাবে বস্তিতে বসবাস করেন এবং অনথিভুক্ত বস্তির সংখ্যা ধরলে বস্তিবাসীর সংখ্যা হবে আরও বেশি কিন্তু বাসস্থানের অধিকার-সহ কর্মসংস্থানের অধিকার, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষার পর্যাপ্ত আইন নেই এই রাজ্যে।

 

Share this
Leave a Comment