অমীমাংসিত পথনাটক


  • April 13, 2022
  • (1 Comments)
  • 1500 Views

১২ এপ্রিল ছিল পথনাট্যকার, অভিনেতা সফদার হাসমির জন্মদিন। দিল্লির বুকে পথনাটক করার সময়ই কংগ্রেসি গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়। সফদারকে মনে রেখে পথনাটকের মত ও পথ নিয়ে এক তর্কসম্ভব আলেখ্য রচনা করলেন কোয়েল সাহা

 

সফদার ও পথনাটক অনেকটা পাশাপাশি হেঁটে চলা শব্দহীন প্রতিধ্বনি যা দশকের পর দশক পার করে আজ মহামারী বিধ্বস্ত নগর জীবনে মত ও পথের দিশারী। যে জীবন নগরের বহুতলের কুঠরিতে আটকে পড়া নতুবা ৬ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরে জনা দশেকের সংসার শিকল তুলে আটকে রাখার সরকারি ফরমানের গেঁড়োতে আটকা পড়ে। ফলত সময়টা এমনই যখন নাটক তার প্রথাগত প্রসেনিয়াম নাট্যমঞ্চের ঘেরাটোপে প্রথামাফিক ছন্দে ফিরতে পারছিল না। নাটকের কলাকুশলী, অভিনেতারা অর্থনৈতিক অনটনের মুখোমুখি হচ্ছিলেন। একটা বড় অঙ্কের খরচ, বাণিজ্য, যাবতীয় বিষয় অভাব-অনটনের সামনে নাকাল। নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে একটা অংশের মানুষ অস্তিত্বের কারণেই নাটক নিয়ে পথে নেমে আসেন।

 

নাটকের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে তাঁরা নাটক নিয়ে পথে নেমে এলেও যে প্রশ্নটা প্রবল ভাবে উঁকি দেয়, আর্থিক সঙ্কট কেটে গেলে পথে নেমে আসা নাটক কি তবে আবারও প্রসেনিয়াম ঘেরায় ফিরে যাবে? পথনাটকের অস্তিত্ব কেবল কি আর্থিক অসঙ্গতির সঙ্গে জড়িয়ে?

 

সত্তর দশকে কার্জন পার্কে নাটকের গতিমুখ দেখে এই একই অভিজ্ঞতা ‘পুরোনো কাসুন্দি’-তে লিপিবদ্ধ করে গেছেন বাদল সরকার। যেমন সিলুয়েট নাট্যগোষ্ঠী হল ভাড়া নিয়ে অসুবিধায় পড়লে পথে নেমে আসতেন। আর্থিক অসঙ্গতি এখানে পথে নামার প্রধান শর্ত হিসাবে পালিত হয়েছে। অপর দিকে ভারতে ইমারজেন্সিকালে (১৯৭৫-১৯৭৭) বাদল সরকার থেকে সফদার হাসমি দু”জনাই তাদের বক্তব্য শ্রেণি বিভক্ত সমাজের নিদিষ্ট শ্রেণি-আওতার বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। যে কারণে গ্রাম-শহরের ব্যবধান, রইস-শ্রমজীবী মানুষের ব্যবধান নাটকের বিষয়বস্তু হিসাবে অগ্রাধিকার পেয়েছে। অগ্রাধিকার পেয়েছে শোষণ, বঞ্চনা, লিঙ্গগত বৈষম্য, অধিকারের দাবি। সফদার নারীকে কেন্দ্রে রেখে শ্রমজীবী পরিবারের ঘর বা কারখানার অলিন্দে কীভাবে নারী শোষিত হয়ে থাকেন সেই পরম্পরাকে সামনে নিয়ে আসেন। শোষনের যাঁতা থেকে মুক্তিমন্ত্র হিসেবে উঠে আসে, সিটু সংগঠনের লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে এক বেতন, সমান অধিকারের প্রসঙ্গ। নাটক চরিত্রগত ভাবে ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’। নীতিগতভাবে সিটু ঠিক না বেঠিক সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। সফদারের নাটকে যে বিষয়টি জোরের সঙ্গে প্রকাশ পায় তা হল শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রমজীবী নারীর অধিকার এবং হক প্রতিষ্ঠার আওয়াজ।

 

সফদার স্পষ্টতই জানিয়েছেন ১৯৭১ সালে যখন নাটক শুরু করেন তখন মঞ্চ থিয়েটারের বাইরে আর কোনওরকম থিয়েটারের অস্তিত্ব সম্পর্কেই তাঁর ধারণা ছিল না। এই প্রসঙ্গে একটা কথা স্বীকার করে নিতেই হবে ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে আসা প্রসেনিয়াম থিয়েটার বিশেষ করে শহর অঞ্চলে থিয়েটারের একমাত্র চেহারা — এই রকম একটা মানসিকতা কম বেশি তৈরি করতে সফল হয়েছিল।

 

প্রাচীন ভারতের নাটক সাধারণ মানুষের জন্যই দেবতার প্রতিষ্ঠান তথা রাজসভা-মন্দির চত্বরের ঘেরা অতিক্রম করে পথে নেমে আসে। চারণরাই সেই অর্থে আমাদের দেশের সাধরণ মানুষের জন্য যে নাটক, তার জনক। যাঁরা খোলা আকাশের নীচে দর্শকদের সামনে প্রাচীন বীর পৌরাণিক নায়কদের কীর্তি-কাহিনি বর্ণনা করে গান গাইতেন। অতএব পথনাটকের ধারার সঙ্গে ভারতের নাট্য ইতিহাসের যোগ বহু প্রাচীন ও গভীর। সময়-সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাটককে শাসক তার মতো করে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। যেমন নাটকের জন্য বড় বড় ইমারত, দালান। যা কোনওভাবেই সাধারণের নাগালে নয়। অর্থাৎ সেখানে যে থিয়েটার হয়ে থাকে তা নিদিষ্ট শর্ত সাপেক্ষ। জীবনের মৌলিক চাহিদা মিটে যাবার পর, যে দর্শকের পকেটে বাড়তি রেস্তো থাকবে সেই নিদিষ্ট অঙ্কের টাকায় কেনা টিকিটের বিনিময়ে সেই নাটক দেখার জন্য গণ্য হবেন। যাঁরা এই শর্ত পালন করতে পারবেন না তাঁদের জীবনে প্রসেনিয়াম নাটকের যে কোনও স্থান থাকতে পারে না এ কথা বলাই বাহুল্য। তাই সাধারণ মানুষকে নাটকের সাথে যু্ক্ত করার তাগিদ কোথায় যেন প্রসেনিয়ামের ঘেরা অতিক্রম করার পথ চিহ্নিত করে।

 

ইন্দিরা জমানার জরুরি অবস্থা ছিল মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা। গণতন্ত্রের এক অন্যতম স্তম্ভ মতপ্রকাশের অধিকার, সেই অধিকার কেড়ে নিতে চায় জরুরি অবস্থা। সেই অধিকার পুনঃস্থাপনের প্রচেষ্টা মানুষকে বিকল্প ভাবনার ইন্ধন জুগিয়েছে। সেন্সর সেই সময়ের এক অন্যতম কুকাণ্ড। যেমন রেডিওতে অন্য রকম গান বাজলে তা ছেঁটে দেওয়া হত। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের দেশাত্মবোধক গানও একইভাবে ছাঁটা হত। যেমন ‘আগুনের পরশমণি…’ গানটি ‘আগুন’ শব্দের কারণে বাদ পড়ে। খবরের কাগজের সেন্সর যেমন গণশক্তি বা সত্যযুগ তাদের কাগজের ছেঁটে দেওয়া অংশ ফাঁকা রাখা অবস্থাতেই ছাপতেন। ফলে সেন্সরের কাঁচি কোথায় কোথায় পড়ছে তার সাক্ষ্যবহন করে থাকত। নাটক তার অস্তিত্ব বজায় রাখার কারণেই ফ্লেক্সিবল তথা নমনীয়, বহনীয় স্বল্প খরচের চেহারার খোঁজ শুরু করে। সেই খোঁজ এক অর্থে প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ অতিক্রম করে পথে নামার অনুঘটক হয়ে কাজ করে। জরুরি অবস্থায় অধিকার কেড়ে নেওয়ার রাজনীতিকে স্বীকৃতি না দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি নিয়ে থিয়েটারের পথে নেমে আসা। প্রশ্ন হল রাজনীতির কোন মত-পথ ও চেতনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পথ নাটক তার চলনের যোগসূত্র কোথা থেকে প্রতিষ্ঠা করল:

আমরা বর্তমানে যে ধরণের পথনাটিকা করি তার সূত্রপাত অক্টোবর বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে মস্কোর সিটি স্কোয়ারে মায়ারহোল্ড প্রযোজিত মায়াকভস্কি-র ‘মিষ্টিবুক’ নাটকে। মায়ারহোল্ড সেখানে বিপ্লবী কবিতা, গান, নাচ, মূকাভিনয়, বক্তৃতা ইত্যাদির সমভিব্যাহারে বিভিন্ন আঙ্গিকে হাজার হাজার মানুষের সামনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগমনী গান শোনান।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে লিঙ্গ সমতার প্রশ্ন প্রবল ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে। তারই ইঙ্গিতময় আকাঙ্ক্ষার রেশ দেখতে পাচ্ছি সফদারের নাটকে। জনতার কাছে সমতার বার্তা পৌছে দেবার প্রয়োজনে শ্রমজীবী নারীশোষণের প্রতিদিনের খণ্ডচিত্র নিয়ে নাটক বাঁধলেন ‘অওরাত’ যেখানে সংলাপ হিসাবে উঠে আসছে :

মহিলা : এ লড়াই মজদুরের লড়াই।

পার্বতী : নারী হোক কিংবা পুরুষ। 

 

এ নাটকের আকাঙ্ক্ষা কেবল মাত্র মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত মানুষের নিদিষ্ট কাঠামোয় আটকে না থেকে শ্রমজীবী মহল্লার কাছে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ ভেঙে গেল নাটকের প্রেক্ষাগৃহ অভিমুখী যাতায়াতের অভ্যস্ত সূত্র। নাটকের কাছে মানুষ না গিয়ে নাটক তার নীতি নির্ধারক অবস্থান অনুযায়ী মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছাল। সেই সঙ্গে এই তত্ত্ব প্রকাশ পেল — নাটক পথে নামলেই পথনাটক হিসাবে পরিচিত নাও হতে পারে। প্রাথমিক ভাবে নাটক পথে পৌঁছালে উদ্দেশ্য ও কার্যকরী ভূমিকার উপর নির্ভর করে, পথের নাটক বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত চেহারা পেয়ে থাকে। যেমন উৎপল দত্ত পথনাটক সম্পর্কে  বলছেন :

পথনাটিকা দেখেন একেবারে সাধারণ স্তরের মানুষ। খবর পেলে কিছু অত্যুৎসাহী বুদ্ধিজীবীও আসেন, কিন্তু পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে পড়েন। তাই পথনাটিকাকে নাচ-গান দিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা খুবই প্রয়োজন। যাতে যাঁরা দাঁড়ালেন, তাঁরা যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শেষটুকুও দেখে যেতে পারেন। আমাদের ওপর যদি মানুষের আস্থা থাকে, তাহলে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক আলোচনাকে বিষয় বস্তু করেও নাটক করা যায়। তবে, নাটকে রসবোধ থাকা দরকার, যা যা উপভোগ্য জিনিস, তা চট করে আগের থেকে ভিস্যুয়ালাইজ করে রাখা দরকার। ওই যে মাও সে তুং বলতেন না — ওরা সব পেপার টাইগার্স। কাগুজে বাঘ। মানুষ তো ওদের শ্রদ্ধা করে না — হ্যাঁ, একটা ভয়, আতঙ্ক-মিশ্রিত সম্ভ্রম থাকে। তো সেটাকেই তো কাটাতে হবে।

 

এখানে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিক নিয়মেই আসতে বাধ্য। পথনাটকের দর্শক যদি নাটকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট হয়ে পড়েন তবে শাসক শ্রেণির কার্যকারণ বিভিন্ন পর্যায়, সমালোচনা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে দেখার চেষ্টা করবেন কী করে? তা হলে ব্রেখটের অ্যালিয়েনেশন তত্ত্বের গুরুত্বটা কোথায়। পথনাটক কি তবে মায়াজালে বুঁদ হয়ে চেতনাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে? প্রোপাগান্ডা করা যদি নাটকের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায় আমি কী বলব আর তুমি কী শুনবে তা পূর্ব নির্ধারিত অতএব নতুন করে জানা বোঝার কোনও রাস্তা খোঁজার দরকার নেই। পথনাটক ধ্রুব একরৈখিক মত ও পথের দিশায় বিশেষ ভাবে আস্থাশীল এ ধারণা অঙ্কের হিসাবেই প্রমাণিত। পথ নাটকের প্রোপাগান্ডা চরিত্র, দলীয় রাজনৈতিক মত পথে সোচ্চারিত ঘোষণা।

 

বাদল সরকার তাঁর পথনাটককে তৃতীয় ধারা হিসাবে সূত্রায়িত করেছেন। যে তৃতীয় ধারা চেতনাকে সদা শাণিত রাখার লক্ষে অস্ত্র হিসাবে কাজ করে যাবে। যে ধারা সময় ইতিহাস থেকে সমকালের ব্যক্তি জীবনের পরিসর ছুঁয়ে থাকা রাজনীতি অর্থনীতির প্রতিটি স্তরকে ক্রোমোজোমের জটিল প্যাঁচ কাঠামোয় আটকে না রেখে সহজ সরল স্বাভাবিক প্রশ্নে বিদ্ধ করবে।

 

বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি নাটক পথে নেমে এলেও সাফদার হাসমি বাদল সরকার প্রসঙ্গে সরাসরি অভিযোগ আনছেন :

“Badal Sircar works in Bengal with forces opposed to the left front government. He is working with Church organisations in remote areas of Bengal and Bihar. He  openly mitigates against CPI(M). I would never associate with him.” ৪ 

 

অভিযোগ মূলত দুটি বিষয়কে বিদ্ধ করছে। ১. বাদল বাবুর বাম সরকার তথা সিপিআই (এম) এর বিরোধিতা। ২. বিহার ও বাংলার একেবারে প্রান্তিক অংশের মানুষের কাছে নাটক নিয়ে যাওয়া। যেখানে পৌছানোর ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে চার্চের ৫ সাহচার্য। এই দুই অভিযোগের কারণে সফদার হাসমি বাদল সরকারের সংসর্গ এড়িয়ে গেছেন এবং প্রকাশ্যে জানিয়েছেন। সাংস্কৃতিক আদান- প্রদানের জন্য ভারত সরকারের মনোনীত দুই শিল্পী পাকিস্তানে পৌঁছালে তাঁদের একই ঘরে থাকার বন্দোবস্ত হওয়া সত্ত্বেও বাদল সরকারের সংসর্গ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানে কাটানো সেই ক’টা দিন তিনি আত্মীয়ের আশ্রয়ে চলে যান। সাফদার হাসমি অভিযোগ করেছেন :

“The bourgeois press has given him a lot of publicity and make it sound as if he had caused this revolution in theatre and as if street in India were his invention. It is quite untrue. As far as our troupe is concerned we had never seen any of his works or even heard of him when we started ourstreet theatre.”

 

প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ অতিক্রম করে নাটক প্রচারমুখী চরিত্র নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কারণে সতন্ত্র চলন প্রকাশ পায়। নিরাপত্তার নিশ্চিত বলয় অতিক্রম করার প্রাথমিক শর্ত তার মধ্যে সংক্রামিত এ কথা হলপ করে বলা যায়। লক্ষ করার মত বিষয় হল পথনাটক ঘিরে চিন্তার পরিসরে খোলামলা আলাপ-আলোচনা-সমালোচনার পরিসর গুরুত্ব না পেয়ে, পথে নেমে নাটক করা ব্যক্তি নেতিবাচক ভাবে চর্চার নিশানা হয়ে উঠেছেন। অচিরেই প্রকাশ পেয়েছে তাচ্ছিল্য ও খাটো করার প্রবণতা। সফদার খোলামেলা ভাবেই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি বাদলবাবুর নাটক সম্পর্কে এতটাই কঠোর যে তৃতীয় ৭ ধারার থিয়েটার দেখা থেকেও নিজেদের বিরত রেখেছেন। একই নিদিষ্ট রাজনীতির পক্ষ নিয়ে প্রচার মূলক পথনাটকে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও উৎপল দত্ত সফদারের পথনাটকের বিষয় নিয়ে তীর্যক মনোভাব দেখিয়েছেন। সমালোচনায় এসেছে উপস্থাপনা করার সময় নিদিষ্ট ধারার পোশাকের ব্যবহার প্রসঙ্গ:

“সফদারের কাছে নিশ্চই কিছু শিক্ষালাভ করার আছে। এখানকার দর্শক তো উত্তরপ্রদেশের দর্শক নন। তাঁরা তো বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনেননি। কিসের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে সফদারকে, আমরা বুঝতে পারি তো। কিন্ত এখানকার দর্শক তো এগিয়েই আছেন, তাঁদের আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সব চরিত্র কালো শার্ট কালো প্যান্ট পরলে চলবে কী করে? তাহলে তো দুটো চরিত্রের চরিত্রগত ফারাক থাকবে না। সবাইকে তো ভিন্ন পোশাক পরতে হবে, পৃথকীকরণের জন্য। এতে থিয়েটারের সংযোগক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। অ্যাটিচুডটা এরকম—তুমি বোসো এইখানে, আমি এখানে গান গাইছি, শোনো। আমি কালো শার্ট, কালো প্যান্ট পরেই গেয়ে যাব। দর্শকদের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞা।

 

ভারতবর্ষ একই ভৌগোলিক সীমানায় আটকে থাকা সত্ত্বেও উত্তরভারত বিশেষত বিহার উত্তরপ্রদেশবাসীদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক মান বিষয়ক একটা ভেদাভেদ বেশ ভালো ভাবেই রয়ে গেছে। ফলত এই অঞ্চলে নাটক করার কারণে উৎপল দত্ত সফদারের নাটককে বক্রোক্তি করেছেন। আবার বাদল সরকারের তৃতীয় ধারার নাটককে শারীরিক কসরত বাইরে ভাবতে না পারাতেই থেমে থাকেননি। থার্ড থিয়েটার সম্পর্কে মনোভাব অনেকটা এই রকম :

“কিন্তু বাদল বাবুর থার্ড থিয়েটারে কিছুই তৈরি হবে না। অভিনেতাও না, কলাকুশলীও না। কয়েকজন অভিনেতাকে হাফপ্যান্ট পরিয়ে, উফ, সে একবার স্পার্টাকাস দেখতে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছি উনি আমেরিকান নাটকের দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু তাদের যা পারফরমেন্স, চোখ ফেরানো যায় না। মর্মর মূর্তির মতো সুন্দর নারী-পুরুষ। আর উনি হাফপ্যান্ট পরিয়ে যাদের নামালেন, তারা কুৎসিত, তারা কদর্য। দু’বার তাকানো যায় না। স্পার্টাকাস হয়ে গেল একটা অসুন্দর জিনিস।”

 

ভারতবর্ষের একটা বড় অংশের মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। যে দেশে বেলপাহারি, কালাহান্ডির হাজারো উদাহরণ আছে। সে দেশের মানুষের দৈহিক সৌন্দর্য্য আমেরিকা ইউরোপের সঙ্গে তুলনা টানলে একটা কথাই মনে হয় — পথ নাটকের মধ্যে দিয়ে উনি কোন রাজনীতির প্রচার করতে চান? তাঁর রাজনীতি না খেতে পাওয়া হাড় জিরজিরে মানুষের যন্ত্রনার উপলব্ধিকে কুৎসিত বলে দেগে দিতে পারে? গ্রাম শহরের ব্যবধানকে অগ্রাহ্য করে মানুষের মর্যাদাকে খাটো করে কোন পথ নাটক মানুষের সাথে একাত্ম হতে পারে? চমকে যেতে পারে, বুঁদ হয়ে ঘোর লাগতে পারে! তাতে করে সাধারণ মানুষ যাঁরা অঙ্কের হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ তাঁদের চেতনার তন্ত্রীতে কোনও প্রশ্ন আসে না। পথনাটক শেষ পরিণতিতে স্থিতাবস্থার পক্ষেই জোরদার হয়।

 

বাদল সরকার নাটক নিয়ে পথে নামলেও তা ছিল প্রচারমূলক ধারার বাইরে। তাঁর নাটক তৃতীয় ধারার। যেখানে নাটক চেতনাকে সদা জাগিয়ে রাখা এক প্রশ্নময় পরিসর নির্মাতা। যে নাটক শহরের নিরাপত্তার বাইরে পা রাখলে ফিসফাস শুরু হয়। বাদলবাবু, গ্রাম-শহরের ব্যবধান সম্পর্ক ‘ভোমা’-তে চোখের সামনে ঘটে চলা সত্যের খোলামেলা স্বীকারোক্তি নাটকের চেহারায় তুলে আনেন। গ্রাম-শহরের ব্যবধানের সত্যকে পাশ কাটিয়ে, বিহার-বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নাটক নিয়ে গ্রাম পরিক্রমার বিষয়টি সফদার হাসমির তীযর্ক উক্তির নিশানা হয়ে ওঠে। তাই আবারও প্রশ্ন চলেই আসে শহরের শিক্ষিত মার্জিত দর্শক পরিধির বাইরে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক অংশের মানুষ নাটকের দর্শক হয়ে উঠলে সেই নাটকের মান অধোগতি সম্পন্ন হবে, এমন একটা গড়পড়তা মনোভাব বা ইঙ্গিত সফদার হাসমি, উৎপল দত্ত দু’জনার আলোচনাতেই বহন করছে। মজার বিষয় হল সফদার যেভাবে বিদ্ধ হচ্ছেন সেই একই কারণে তিনি আবার বিদ্ধ করছেন। সামন্ত সংস্কৃতি যেভাবে নিজেকে এক এবং অদ্বিতীয়ম ভেবে নিয়ে প্রশ্নহীন আত্মতুষ্টিতে ডুবে যায়, এ যেন তারই প্রতিধ্বনি। প্রসেনিয়ামের ইমারত অতিক্রম করে জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতিতে মতপ্রকাশের অধিকার তথা দাবি নিয়ে পথনাটক শ্রমিক মহল্লার অলিগলিতে পৌঁছে গেলেও মানসিকভাবে সামন্ত সংস্কৃতির ঘেরার আধিপত্য কোথায় যেন লুপ্তপ্রায় অঙ্গের সঙ্কেত হয়ে ক্ষীণ চেহারায় টিকে গেছে। ফলত পথ জুড়ে অমীমাংসিত শব্দবাণ পথনাটকের যাত্রাপথ ঘিরে ক্ষতের আর্বতে ঘোরাফেরা করছে।

 

বন্দোপাধ্যায় সত্য; পথনাটক উদ্ভব বিকাশ; সাফদার ৫০ জাগা জেগে থাকা জাগানো; পশ্চিমবঙ্গ লেখক শিল্পী সংঘ; কলকাতা ০৭; প্রথম প্রকাশ ১২ এপ্রিল ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৩

হাসমি সাফদার হল্লা বোল সাফদার হাসমি মানে জাগা, জেগে থাকা জাগানো গ্রুপ থিয়েটার ৪২ সাফদার জননাট্য মঞ্চ সংখ্যা ৮৯ 

দত্ত উৎপল(কথা বলেছেন দত্ত আশিস); পথের নাটকঃ নাটকের পথ; সাফদার জাগা জেগে থাকা জাগানোপশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ কলকাতা জেলা কমিটি কলকাতা ০৭ প্রথম প্রকাশ ১২ এপ্রিল ২০০৬ পৃষ্ঠা ১১৫

Erven Von Eugene An interview with Safder Hashmi 30 April & 4 May 1988; সাফদার ৫০ জাগা জেগে থাকা জাগানো; জেলা সম্পাদকমন্ডলী কর্তৃক সম্পাদিত পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ কলকাতা জেলা কমিটি কলকাতা ০৭ প্রথম প্রকাশ ১২ এপ্রিল ২০০৬ পৃষ্ঠা ১৪০

https://www.news9live.com/knowledge/mother-teresa-arrived-in-kolkata-on-this-day-in-1929-all-you-need-to-know-145003

Erven Von Eugene An interview with Safder Hashmi 30 April & 4 May 1988; সাফদার ৫০ জাগা জেগে থাকা জাগানো; জেলা সম্পাদকমন্ডলী কর্তৃক সম্পাদিত; পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ; কলকাতা জেলা কমিটি; কলকাতা ০৭, প্রথম প্রকাশ ১২ এপ্রিল ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৪0

৭ সরকার বাদল; থিয়েটারের ভাষা; রক্তকরবী; ১০/২বি রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট; কলকাতা ০৯

 আমাদের দেশের থিয়েটারের ক্রম অনুসারে প্রথম ধারা লোক নাটক দ্বিতীয় ধারা বৃটিশের হাত ধরে আমদানীকৃত প্রসেনিয়াম থিয়েটার।প্রথম ধারাটি গ্রাম সমাজকে কেন্দ্র করে। দ্বিতীয়টি প্রধানত শহর ভিত্তিক। লোকনাটক প্রসেনিয়াম থিয়েটার যেন জ্যামিতিক সূত্র অনুসারে থিয়েটারের এক সমান্তরাল দুটি ধারা। দুটি ধারা যারা পাশাপাশি অবিচ্ছেদ্য দূরত্বে একই সময়ে অবস্থান করছে। তৃতীয় ধারা কেবল ভিন্ন শৈলীর বিন্যাস নয়। তৃতীয় ধারা একটা দর্শন। যা মানুষের চেতনাকে উসকে দিয়ে নমনীয় বহনীয় স্বল্প ব্যয়ের ধারায় গড়ে ওঠা থিয়েটার 

 

দত্ত উৎপল(কথা বলেছেন দত্ত আশিস); পথের নাটকঃ নাটকের পথ; সাফদার জাগা জেগে থাকা জাগানোপশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ কলকাতা জেলা কমিটি কলকাতা ০৭ প্রথম প্রকাশ ১২ এপ্রিল ২০০৬ পৃষ্ঠা ১১৭

 

দত্ত উৎপল(কথা বলেছেন দত্ত আশিস); পথের নাটকঃ নাটকের পথ; সাফদার জাগা জেগে থাকা জাগানোপশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ কলকাতা জেলা কমিটি কলকাতা ০৭ প্রথম প্রকাশ ১২ এপ্রিল ২০০৬ পৃষ্ঠা ১২১

 

Share this
Recent Comments
1
  • comments
    By: Aniket Roy on December 8, 2022

    আমরা আমাদের থিয়েটার বিষয়ক থিয়েটার পত্রিকা “বাঁকড়ি” পত্রিকায় লিখাটি পুনর্মুদ্রিত করার অনুমতি চাইছি।

Leave a Comment