হাড়হিম যুগ


  • April 11, 2022
  • (0 Comments)
  • 901 Views

রাত ফুরোলেই উপনির্বাচন। জয়-পরাজয়ের চেয়ে বড় কথা বাঙালির ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যা ছিল প্রান্তীয়, বাঙালির রাজনীতিতে যা ছিল ঘৃণ্য, অপাঙক্তেয় — তা ক্রমে ক্রমে যে প্রাধান্য বিস্তার করেছে — তার মূলে রয়েছে রাজ্য জুড়ে এক আদর্শহীন একদলীয় রাজনীতির চরম উত্থান। এক মস্ত বড় শূন্যতা রাজ্যকে গ্রাস করেছে। লিখছেন দেবাশিস আইচ

 

 

এই রামনবমীর পিছনে ধর্ম নেই বরং ধর্মবিদ্বেষ রয়েছে। রয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাঁধানোর নোংরা ছক। এই রামনবমীতে কর্নাটকে হালাল বিতর্ক, দিল্লিতে মাংস বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা, রামনবমীর মিছিল থেকে রাজস্থানে দাঙ্গা এবং ৪০টি বাড়ি-দোকান পুড়িয়ে দেওয়াই আবারও মস্ত প্রমাণ যে, ‘প্রজানুরঞ্জক’ রামের সঙ্গে এই বিদ্বেষ-নবমীর কোনও সম্পর্ক নেই। এই সেই এস ওয়াজেদ আলি-র দেখা ‘ভারতবর্ষ’-র সেই ‘ট্র্যাডিশন’ নয়। এ নয় রামচরিতমানস। এ হল রামচরিতনাশ।

 

রামনবমী কোনওভাবেই বাংলার প্রধান সংস্কৃতি নয়। অশোক মিত্র সম্পাদিত ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ মেলা’, এই পাঁচ খণ্ডের সংকলনটি ষাটের দশকের প্রথম ভাগে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৫টি জেলার ২৬৪৯টি মেলা ও পূজার তালিকা সারণিতে রয়েছে। বিবরণী রয়েছে কিছু কম। রামনবমী মেলা ও পূজার কথা আছে বইকি। তবে সর্বসাকুল্যে ১৬টি।

 

২০২২-এ এসে সেই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষের সংস্কৃতি এ বাংলাতেও একরকম জাঁকিয়েই বসেছে। হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-এর শাখা সংগঠন ধর্মোন্মাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল তাদের ধর্মীয় একাধিপত্য স্থাপন করতেই এই হিংস্র-নবমীর উদ্যোক্তা। বিজেপি-র নেতা-নেত্রীরা প্রথম সারিতে কেননা এই পথেই তাঁরা রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শুধু কি তাই বাঙালির কালী মন্দিরে মহাসমারোহে এবার পালিত হল রামনবমী। যা ছিল এক ‘পুণ্য তিথি’-তে পূজা-পাঠ, তা হয়ে দাঁড়াল তাক লাগানো ধর্মপালা। সঙ্ঘী নেতৃত্ব আগেই দাবি করেছিলেন, কোনও কোনও কেন্দ্রীয় মিছিলে যোগ দেবেন বেলড় মঠ, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মহারাজরা। আরএসএস-এর অজগর আলিঙ্গনে তবে কি বাঁধা পড়ল ধর্মীয় বাঙালির কালীমন্দির, শীতলাতলা?

 

ধীরে ধীরে এই উগ্র হিন্দু সংস্কৃতিকে নিজের করে নিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন আর ঢাক গুড়গুড় নেই। নির্বাচনি ফায়দা তোলার জন্য কোভিড-পরবর্তী রামনবমী পালনে, আস্ফালনে, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে যুগপৎ ভক্তি ও ভীতি প্রদর্শনে রীতিমতো সমানে সমানে পাল্লা দিয়েছে তাঁর দলের নেতা, বিধায়ক, মহাবলী, বাহুবলী এবং যত ভোটকুড়ানির দল।

 

পাল্লা দিয়েছে বলাটা বোধহয় ভুল বলা হল। এবার তো রীতিমতো গলায় গলায়, সাথে সাথে, হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এও বাহ্য। জ্ঞানের-পাণ্ডিত্যের ভাটপাড়াকে যাঁরা সন্ত্রাস-দাঙ্গার ভাটপাড়ায় বদলে দিল তাঁদের নেতা সাবেক বিজেপি অধুনা তৃণমূল প্রিয়াঙ্ক পাণ্ডেকে দেখা গেল গদা ও তরবারি হাতে ‘সরকারি’ মিছিলের নেতৃত্ব দিতে। পিছনে লগে লগে আর এক মিছিল। যার নেতৃত্বে সাবেক তৃণমূল অধুনা বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং। বিগত এক রামনবমীর জুলুসে এই দু’জন ছিলেন বিপরীত মেরুতে। সেইদিন এই দুই মেরুর দুই বাহুবলীর এলাকায় ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এক ফুচকাওয়ালা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এই তো সেই অঞ্চল যেখানে ‘জয় শ্রীরাম’ আওয়াজে অতিষ্ঠ হয়ে রণরঙ্গিনী মূর্তিতে গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

 

এমনই এক রামনবমীতে আসানসোলের মুসলিম এলাকায় ঢুকে দাঙ্গা বাঁধিয়েছিল বজরং দল ও বিজেপি। এই  ঘৃণা-নবমী ‘সুষ্ঠুভাব’-এ পালনে কিছু কম ঔদার্য দেখায়নি আসানসোল পুরসভার তৎকালীন তৃণমূল চেয়ারম্যান জিতেন্দ্র তেওয়ারি। অতঃপর তৎকালীন বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র অকথ্য ‘হেটস্পিচ’। আসানসোল উপনির্বাচনের ভোটনবমীতে মহাসমারোহে পালিত হল রামনবমী। যুযুধান তৃণমূল ও বিজেপি প্রার্থীদের সামনে রেখে। বাবুল সুপ্রিয় দল বদলিয়ে এখন বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী। বাবুলের তাবৎ ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক উক্তিগুলোকে তিনি বোধহয় এখন ‘একটু কটু কথা’ মনে করে মার্জনা করে দিয়েছেন। কিন্তু, সারা দেশ জুড়ে যে ‘এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা’-র প্রবক্তারা মুসলমান সম্প্রদায়কে খাদের কিনারে ঠেলে এনেছে সেই সংখ্যালঘু মানুষদের জন্য কী বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী! যদি বলা যায়, আরএসএস ‘গুণগ্রাহী’ মুখ্যমন্ত্রী স্রেফ ক্ষমতার জন্য, একাধিপত্য বজায় রাখার জন্য হিন্দুত্ববাদী তাস মেলে ধরতেও আর পিছপা নন। আর নরম হিন্দুত্ব নয়, ভোটের প্রয়োজনে এবার কড়া হিন্দুত্ববাদী হতেও তাঁর আপত্তি নেই। তার জন্যই কি দ্বেষ-নবমীর এত আয়োজন? দুই প্রান্তে দুই সুবিধাবাদী বিজেপি দলত্যাগীকে বুকে টেনে নেওয়া? অবাঙালি হিন্দু ভোট টানতে উড়িয়ে আনা ‘বিহারি বাবু’-কে। রাত ফুরোলেই উপনির্বাচন। জয়-পরাজয়ের চেয়ে বড় কথা বাঙালির ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যা ছিল প্রান্তীয়, বাঙালির রাজনীতিতে যা ছিল ঘৃণ্য, অপাঙক্তেয়—তা ক্রমে ক্রমে যে প্রাধান্য বিস্তার করেছে—তার মূলে রয়েছে রাজ্য জুড়ে এক আদর্শহীন একদলীয় রাজনীতির চরম উত্থান। এক মস্ত বড় শূন্যতা রাজ্যকে গ্রাস করেছে। আর্থনীতিক, রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এই শূন্যস্থান তো আর অনির্দিষ্টকাল ধরে শূন্য থাকতে পারে না। প্রকৃতির নিয়ম মেনে ধারাবাহিক ভাবেই তা পূরিত হয়েই চলেছে। পৃরণ করছেন আনিস খান, পূরণ করছেন তুহিনা খাতুন, পূরণ করছেন বগটুইয়ের নারী ও কিশোরীরা। শূন্য দূরত্ব থেকে গুলি খেয়ে শূন্যতা পূরণ করছেন ঝালদা, পানিহাটির পুরপিতারা। মগরাহাটের দুই যুবক। হাঁসখালির নাবালিকা। এবং পুরণ করছে—শিলিগুড়ি থেকে পুরুলিয়া—বিজাতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতির হিংস্র উন্মাদনা।

 

এ নিছকই আইনশৃঙ্খলার অবনতি নয়। একটি জাতির সার্বিক অধঃপতন ঘটলে এমনই হয়। না হলে এত মর্মান্তিক মৃত্যুর পর কেউ বলতে পারেন, “একটা ইঁদুর মরেছে…!” এক অ-ছাত্র দুষ্কৃতীর হাতে উপাচার্যের চরম লাঞ্ছনার পর কেউ বলতে পারেন, “একটা কটু কথা বলেছে…!” এমন উক্তির পর যদি হাড় হিম হয়ে যায়, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসে শীতল স্রোত — তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সারা দেশের মতোই বাংলাতেও আজ হাড়হিম যুগ।

 

Share this
Leave a Comment