উত্তরপ্রদেশের গ্রামের দলিত মহিলাদের অধিকারের জন্য লড়ছেন কল্পনা খারে


  • March 8, 2022
  • (0 Comments)
  • 1370 Views

উত্তরপ্রদেশের সামাজিক কাঠামোয় পিতৃতান্ত্রিকতার চেহারা যে কতটা প্রকট তা নতুন করে বলার কিছুই নেই। তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে নারীর অধিকারের লড়াইটাও কল্পনা খারে-এর মতো কোনও কোনও মহিলা দশকের পর দশক ধরে নিরন্তর চালিয়ে যান। নতুন প্রজন্মের তরুণ নারীরা জুড়ে যান পথ চলায়, প্রবীণ নারীরা তাঁদের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতায় পথ দেখাতে থাকেন। হাতে হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে রাজনীতি, সমাজ, পরিবারের বন্ধ দরজা ভেঙে মেয়েদের সম্মান, অধিকার আদায়ে পিছপা হন না তাঁরা। উত্তরপ্রদেশের পিছিয়ে থাকা জেলাগুলির মধ্যে এক জেলা মাহোবা – উত্তরপ্রদেশ আর মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে। মাহোবার সমাজে এখনও সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার ছায়া। এই মাহোবাতেই গত ৩১ বছর ধরে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে কল্পনা খারে-এর সংগঠন গ্রামোন্নতি সংস্থান। তরুণ প্রজন্মের নারী ও প্রতিবন্ধী নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও তাদের উপর চলা যৌনতা ও লিঙ্গিভিত্তিক হিংসার বিষয়টিকে সামনে রেখে বিশ্বের পাঁচটি দেশকে নিয়ে শুরু হওয়া ‘উওমেন গেইনিং গ্রাউন্ড’ প্রকল্পে উত্তরপ্রদেশ থেকে তৃণমূল স্তরে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন হিসাবে অংশ নিচ্ছেন কল্পনা খারে ও গ্রামোন্নতি সংস্থান। এই প্রকল্পের এক কর্মশালাতেই কল্পনার সঙ্গে আলাপচারিতায় গ্রাউন্ডজিরো-র সুদর্শনা চক্রবর্তী

 

 

প্র: আপনারা মূলত কোন্‌ ইস্যুগুলি নিয়ে কাজ করেন?

উঃ যদি আমাদের কাজের ক্ষেত্রটির কথা বলি তাহলে বলতেই হবে যে এই পুরো জেলাটাই ভয়ানক পিছিয়ে থাকা। মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম, এখনও পর্দা পথা চলে। ১৩শ শতাব্দী পর্যন্ত এখানে রাজতন্ত্র চলেছে। তারপর থেকে সামন্ততান্ত্রিকতা। তাও খাতায়-কলমে শেষ হয়েছে। কিন্তু মানুষের মানসিকতা এখনও বদলায়নি, তা এখনও মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় হল জাতপাত প্রথা। এখানে সমাজ এখনও উচ্চবর্গ আর নিম্নবর্গে ভাগ হয়ে রয়েছে। কোনও গ্রামে ঢুকলে সেখানে যেভাবে বসতির ব্যবস্থাপনা থাকে, আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন যে গ্রামে বসবাসের মধ্যেই প্রাথমিকভাবে উচ্চ ও নিম্নবর্গের বৈষম্য রয়েছে। আর্থিকভাবে দরিদ্র, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা আর জাতপাতের দিক থেকে দলিত, তপশিলী জাতি ও উপজাতির মানুষদের একদম আলাদা করে রাখা হয়। কিছু বছর আগে পর্যন্তও এরকম হতো যে কোনও নিম্নবর্গের মানুষকে যদি উচ্চবর্গের কারওর মজুরের কাজে ডাকতে হতো, তাহলে সেই মানুষটির বাড়ির দরজায় উচ্চবর্গের মানুষটির লাঠি রেখে আসা হত, সেই লাঠি চিনে কাজের জন্য যেতে হত। এখন এই প্রথা না থাকলেও মানসিকতা বদলায়নি। নিম্নবর্গের মজুর শ্রেণীর মানুষেরা এখনও নিজেদের দাবি জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে পারেন না। বন্ডেড লেবার (চুক্তিশ্রমিক), কম পারিশ্রমিকে কাজ করানো, কাজ শেষে পারিশ্রমিক দিতে দেরি করা বা না দেওয়া, প্রতিবাদ করলে মারধোর ইত্যাদি এখনও পুরোদস্তুর চলে। আবার নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যেও আরও প্রান্তিক হলেন মহিলারা। বন্ডেড লেবার (চুক্তিশ্রমিক) হিসাবে তারাও তো কাজ করেন এবং তাদের উপর শোষনের মাত্রা আরও বেশি।

 

প্র: এই যে পিছিয়ে পড়া জাতির কথা বলছেন, তাদের মধ্যে মহিলাদের প্রান্তিকতা আপনি কতটা, কোথায়, কীভাবে দেখছেন?

উঃ এই প্রান্তিকতা খুবই মারাত্মক। বিশেষ করে যদি বন্ডেড লেবার (চুক্তিশ্রমিক) প্রথার কথা বলি, তাহলে দেখব যে একটা গোটা পরিবার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সেক্ষেত্রে পরিবারের মহিলারা, এমনকি কিছু কাজ করতে পারে এমন বাচ্চারাও কাজে যায় পরিবারের সঙ্গে। এই মহিলাদের সঙ্গে মজদুর হিসাবে তো কাজ, টাকাপয়সা সংক্রান্ত শোষন চলেই। তাছাড়া তাদের শারীরিকভাবেও নিগ্রহ চলতে থাকে। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে যৌন সংসর্গ করা, শারীরিক হেনস্থা করা – এগুলি এখনও চলছে। কারণ এখানে এখনও জমিদারি প্রথা চলছে। কারওর হাতে অনেক জমি আর কারওর কোনও জমিই নেই। গরীব নিম্নবর্গের মানুষগুলোকে ধনী জমিদারদের দয়ায় বাঁচতে হয়। ফলে এই মহিলাদের ‘না’ বলার কোনও জায়গাই থাকে না। এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই – এত বছর ধরে আমরা একদম গ্রামের মহিলাদের নিয়ে কাজ করছি। ধরুন আমাদের কোনও আবাসিক কর্মশালা চলছে, রাতে আমরা সবাই গল্প করতে বসেছি। সেখানেই কোনও মহিলা খুব সহজ-সরলভাবে বলে ফেললেন, “আরে দিদি এই যে ঠাকুরদের বাড়িতে তো আমাদের সন্তান রয়েছে” বা “আমাদের বাড়িতে তো ঠাকুরদের বাড়ির বাচ্চা বড় হচ্ছে” – এই ধরনের কথা শুনলে আমরা ধীরে ধীরে কথাপ্রসঙ্গে তাদের কাছ থেকে বিষয়গুলো জানার, বোঝার চেষ্টা করি – তাদের শোষন, নিপীড়ন। জানতে পারি, সকালে উচ্চবর্গের মানুষদের বাড়িতে যে মহিলারা শ্রমিক হিসাবে কাজে যাচ্ছেন সেখানে তিনি শ্রমিক হিসাবে শোষিত হচ্ছেন আবার রাত্রিবেলা তাদের শরীরকেই ভোগ করছে সেই জমিদার।

 

প্র: এই যে যখন মহিলারা শ্রমিক হিসাবে কাজে যাচ্ছেন সেখানে পুরুষদের সঙ্গে তাদের কোনও বৈষম্য থাকে?

উঃ হ্যাঁ, বৈষম্যমূলক পারিশ্রমিক তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। যখন আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে যাই, তখন আমাদের বলা হয় – মেয়েরা কাজ করতে করতে বেশিবার বিশ্রামের জন্য বসেন, বাচ্চাদের কোলে তুলতে বিরতি নেন ইত্যাদি। বলুন তো, ছেলেরা দশবার করে বিড়ি খাওয়ার জন্য বিরতি নেন না? তাহলে পারিশ্রমিক দেওয়ার সময়ে মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্য করা হবে কেন?

 

প্র: মহিলাদের সাধারণত কী ধরনের কাজ দেওয়া হয়?

উঃ মহিলারা চাষের জমিতে কাজ করেন। তাদের বাড়ি তৈরির কাজে নিয়োগ করা হয়। জমিদারদের বাড়িতে গাই-গরু অনেক থাকে, সেইসব গৃহপালিত পশুদের দেখভালের কাজ করেন এই মহিলারা।

 

প্র: ৩১ বছর ধরে আপনি কাজ করছেন। কোনও পরিবর্তন কি চোখে পড়ছে? তরুণ প্রজন্মের মেয়েরা কী বদল আনছেন?

উঃ দেখুন সেভাবে দেখলে কিন্তু বেশ অনেকটাই বদল আগের থেকে হয়েছে। এখন তো বন্ডেড লেবার (চুক্তিশ্রম) আটকাতে আইনও রয়েছে। এখন মানুষ অনেকটা সংগঠিতও হচ্ছেন। আগে এরকম হত যে পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর মানুষদের হাতে খাওয়ার, সংসার চালানোর টাকা যদি না থাকত, তাহলে তারা জমিদার, উচ্চবর্গের মানুষদের বাড়িতে গিয়ে ধার চাইতেন। আর তারপরেই তাদের শোষন হত, কারণ এই টাকা তো তারা শোধ দিতে পারতেন না। ফলে তাদের দিয়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ কাজ করিয়ে নেওয়া হত। এখন এইটা বন্ধ হয়েছে। এখন তারা রোজগারের জন্য, ছেলেমেয়েদের বড় করার জন্য তারা এখন পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে অন্য রাজ্যে কাজের জন্য যাচ্ছেন। দিল্লি, পাঞ্জাব, সুরাটে যাচ্ছেন। এটা অন্য কথা যে এখানেও শোষনের মাত্রা প্রচুর। কিন্তু গ্রামের শোষনের থেকে তাদের একটু হলেও মুক্তি মিলেছে।

প্র: মহিলাদের মধ্যে কী বদল দেখছেন?

উঃ মহিলারা সংগঠিত হচ্ছেন, নিজেদের উপর ঘটা হিংসার কথা বুঝতে পারছেন। কাজের জন্য বেরোচ্ছেন, গ্রামের বাইরে যাচ্ছেন। আগে কাজের জন্য গ্রামের বাইরে তারা যেতেনই না।

 

প্র: শিক্ষার ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন দেখছেন?

উঃ তরুণ প্রজন্মের মেয়েরা পড়ছেন, সাইকেল চালাচ্ছেন, কাজের জন্য নিজেদের তৈরি করছেন।

 

প্র: পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এখনও ওখানে খুবই প্রবল। সেখানে এই মেয়েদের বাধা দেওয়া হয়নি? তাদের নিজেদের পরিবারের পুরুষেরা উচ্চবর্গের পুরুষেরা বাধা দেননি?

উ: হ্যাঁ, বাধা তাদের দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই মেয়েদের যে মা-বাবারা রয়েছেন বা আমরা যারা এত বছর ধরে কাজ করে চলেছি তারা এই মেয়েদের পাশে দাঁড়াচ্ছি। অন্য উপায়ও রয়েছে। যেমন – গ্রামে স্কুল খোলা, বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বিনামূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে, মিড ডে মিল দেওয়া। এরকম আগে অনেক হতো যে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতেন না মা-বাবা, অথচ দুপুরে খাওয়ার সময়ে তাদের হাতে পাত্র ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, “তোমার খাবার বানাইনি, যাও স্কুল থেকে তোমার ভাগের খাবারটা নিয়ে এসো।” তারপর আমরা স্কুলের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করি, তাদের বোঝাই যে আপনারা খাবার তো নিশ্চয়ই দেবেন, এ তো সরকারের দেওয়া কিন্তু অভিভাবকদেরও আপনাদেরই বোঝাতে হবে যে, খাবারের মতোই শিক্ষাও একইরকম জরুরি। আমরা গ্রুপ তৈরি করেছি, যারা সচেতন মানুষ তাদের নিজেদের সঙ্গে এনেছি। এখন মহিলারা অনেকটাই বুঝতে পারছেন। পঞ্চায়েতেও তারা অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছেন। যদি পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলিতদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকে, মহিলারাও নিজেদের আসন পাচ্ছেন। রাজনীতিতে অংশ নিতে পেরে তারা অনেকটাই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বুঝছেন। এখন তো হাতে হাতে স্মার্টফোন, সেখান থেকেও শিখছেন। কাজ করতে দিল্লি, মুম্বই গিয়ে যা শিখছেন, সেই পরিবর্তনের হাওয়া আনছেন নিজেদের গ্রামে। এখন আমাদের আর মহিলাদের বাড়ির বাইরে আনার জন্য পরিশ্রম করতে হয় না। সেটা তারা করছেন। এবার আমাদের তাদের পাশে থাকতে হবে নতুন চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের রশদ দেওয়ার জন্য।

 

প্র: আপনি কী মনে করেন যে উত্তরপ্রদেশে যে বিজেপি সরকারের শাসন চলেছে, মহিলাদের প্রতি তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা নারী অধিকার আন্দোলনে নতুন করে বাধা তৈরি করেছে?

উঃ হ্যাঁ, এখন অন্য রকমের অসুবিধা। আমরা মহিলাদের পরিবর্তন, তাদের অধিকারের জন্য কাজ করছিলাম। যেকোনও জাতিবর্গ, ধর্মের মানুষ হোন না কেন, তাদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার থাকতে হবে। আর নিজেদের কথা বলার অধিকার থাকতে হবে। এখন তো কেউ নিজেদের কথা বলতেই পারেন না এমন পরিস্থিতি। এমনকি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও নয়। আমরা ভেবেছিলাম যে সরকারের যে নীতি-সুযোগসুবিধা সেগুলি আমরা সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষদের কাছে নানাভাবে পৌছে দেওয়ার সেতু হিসাবেকাজ করব। কিন্তু এখন তো আমরা নিজেরাই চাপের মধ্যে রয়েছি। আমাদের নিজেদেরই কাজের পদ্ধতি বদলাতে হয়েছে। আমাদের বলা হয় এত অধিকারের কথা বলে আপনারা মানুষকে উসকাচ্ছেন, সমাজকে আসলে ভুল পথে চালাচ্ছেন। আমাদের বলা হয় ‘ঘর ভাঙানোর দল’।

 

প্র: ভারতীয় নারীদের একটা ছবি তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে…

উঃ একদম। তারা চুপ করে থাকবে, ঘোমটার নীচে থাকবে, মুখে মুখে জবাব দেবে না, যা বেঁচেবুচে থাকবে তাই খাবে – এই হল এদের ভাবনায় ভারতীয় নারী। কোনও নারী যদি সচেতন হন, তাদের যদি জানাবোঝা থাকে, তাহলেই তারা ঠিক, ভুলের তফাৎ বুঝতে পারেন, ভুলের বিরোধীতা করেন। তখনই লোকে বলে – এ বিগড়ে গেছে, খারাপ মেয়ে, ভালো মেয়ে নয়। এদের যে ভালো নারীর ধাঁচা তাতে এই মেয়েরা ফিট করে না। তাই তাদের উপর শোষন, অত্যাচার, তাদের কন্ঠরোধ নানা উপায়ে বাড়তেই থাকে, তাদের পরিবারকে উত্যক্ত করা, স্বামীদের বলা – “তুমি তোমার বউকে সামলাতে পারো না, আজকাল খুব তর্ক করে, অমুক জায়গায় দেখলাম মাথায় ঘোমটা ছিল না,” যাতে বর বাড়ি এসে বউকে মারে, অত্যাচার করে, দাবিয়ে রাখে। যদি সেই স্ত্রী না মানেন তাহলে পরিবারটাই ভেঙে যাবে।

 

প্র: এমন যদি চারটি বিষয় আপনাকে বেছে নিতে বলা হয় যা নিয়ে আপনি ভবিষ্যতে কাজ করবেন, সেগুলি কী?

উঃ মহিলাদের তাদের অধিকার পর্যন্ত পৌঁছাতে আমরা তাদের পাশে থাকব। তারা যেন নিজেদের উপর হওয়া হিংসাকে চিনতে শেখেন, যাতে আত্মসম্মানের সঙ্গে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারেন। যখন তাদের বিরুদ্ধে হওয়া শোষন বন্ধ হবে তখনই তারা একটা সম্মানের জীবন নিজেদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে বাঁচতে পারবেন। যতদিন পর্যন্ত তারা নিজেদের শর্তে নিজেদের সিদ্ধান্তে না বাঁচবেন ততদিন পর্যন্ত তাদের হয়ে অন্য কেউ ভাববেন না। তাই সবার আগে আমাদের নিজেদের উপর হওয়া হিংসা, বৈষম্যকে চিনতে শিখতে হবে। আমরা একবিংশ শতাব্দীর নারী। সবক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে গেছি। আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে এমন ভাবনা দূর করতে হবে যে আমরা দুর্বল, কারণ আমরা নারী। আমরা মানুষ। আমাদের সমান অধিকার আছে, আমাদের জন্য আইন আছে। আমাদের সেগুলি ব্যবহার করতে শিখতে হবে।

 

আমরা মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তা অত্যন্ত খারাপ হওয়ার কারণ তারা অবশিষ্ট খাবার যা থাকে তাই খান, ভোর চারটে থেকে উঠে কাজ করতে হয়, তাই কিছু না জুটলে খালি পেটে জল খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। সেখান থেকে আমরা লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করি। মেয়েরা বলেন, “আমরা কিছুর প্রতিবাদ কীভাবে করব? বিয়ে দেওয়ার সময় বলে দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়িই তোমার সব, বাঁচবে, মরবে সব ওখানে। আমার বাড়ি তাহলে কোথায়? মা-বাবার বাড়ি থেকে পালকি ওঠা আর শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরোবে মরদেহ – এটাই একটা মেয়ের গোটা জীবন। তাহলে কী করব আমরা? কোথাও যেতে পারব না আমরা। একটা ছোট্ট টিপ কেনার জন্যও পুরুষের কাছে হাত পাততে হয়। এবার তাদের মর্জি টাকা দেবে কি না।” এখান থেকেই মনে হয়েছিল যে মহিলাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে। যাতে শুধু নিজেদের পছন্দের জিনিস কেনার জন্যই নয়, স্বামী বাড়ি থেকে বের করে দিলে যাতে তারা বাস ভাড়া দিয়ে মায়ের বাড়িতে যেতে পারেন। কারণ এমনও শুনেছি যে সামান্য ঝগড়া হলেও বৃষ্টির মধ্যে স্ত্রীকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছে স্বামী। তিনি কারওর কাছে সাহায্য চাইতে পারেননি, কারণ তাহলেই তাকে দুশ্চরিত্রা বলা হবে। তাই সেই ঘর থেকে বের করে দেওয়া স্বামীর দরজার বাইরেই তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। সেখান থেকেই তাদের হ্যান্ডপাম্প মেকানিকের প্রশিক্ষণ দিই আমরা। সেলাই-ফোঁড়াই নয়, এমন কাজ যাতে তারা বাড়ির বাইরে বেরোন, পাঁচ জনের সঙ্গে মেলামেশা করতে শেখেন। এমন কাজের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি যাতে জেন্ডার স্টিরিওটাইপ ভাঙে। অনেক বাধা পেয়েছি, কিন্তু আমরা দমে যাইনি। কারণ আমরা প্রমাণ করার ছিল যে, মহিলাদের হাত শুধু চুড়ি পরার নয়, যেকোনও কাজ এই দুই হাত দিয়ে আমরা করতে পারি। তারপরের ধাপ ছিল যে শুধু নিজেরা রোজগার করা নয়, উপার্জিত অর্থ কোথায় কীভাবে খরচ করবেন সেই সিদ্ধান্তও মেয়েদের নিতে সচেতন করা। সেইক্ষেত্রেও আমরা মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছি। দেখা যেত বাড়ির শিশুকন্যাটি হয় পড়ে না, যদি বা পড়ে তাহলে গ্রামের সরকারি স্কুলে। তাও সেখানে যায় না, ছাগল চড়াতে যেতে হয় তাকে। যদি মায়েদের হাতে টাকা থাকে, তাহলে মায়েরা মেয়েদের এমনকি প্রাইভেট স্কুলেও পাঠাতে পারেন, নিজেদের মায়েরা অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে পারেন – এভাবেই সচেতন করেছি। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে শিখিয়েছি তাদের অনেক চ্যালেঞ্জের সামনে। এভাবেই লড়াই চলবে, আমরা থামব না। একে অন্যের হাত ধরে এগিয়ে যাব।

 

Share this
Leave a Comment