যেভাবে মেয়েরা কার্ল মার্কসের কাছে ঋণী 


  • March 7, 2022
  • (0 Comments)
  • 2564 Views

আটই মার্চ নারীদিবস। যদিও, জনপ্রিয় আলাপচারিতায় এবং গণমাধ্যমের বয়ানবর্ষণে “শ্রমজীবী” শব্দটি আজ অবলুপ্তপ্রায়। গত দুসপ্তাহ ধরে তাই আমাদের সামাজিক গণমাধ্যমের টাইমলাইন নারী দিবস উপলক্ষ্যে পণ্যসামগ্রীর ছাড়ের বিজ্ঞাপনে ভরা। কয়েক বছর আগে, ইউনিলিভার নামক বহুজাতিকটি নারীদিবস উপলক্ষে বাজারে ছেড়েছিল কিছু বিজ্ঞাপণ। সেইসব বিজ্ঞাপণের প্রতিটির শিরোনামেই ছিল একটি অভিনব শব্দবন্ধ— “পন্ডস উইমেন্স ডে।” বহুজাতিকটির একটি আন্তর্জাতিক কসমেটিকস হল পন্ডস। তো, এই যে অবলোপনের প্রয়াস— “শ্রমজীবী” শব্দটির, “আন্তর্জাতিক” শব্দটির— তা তো শুধু দুটি শব্দের অবলোপনের বাস্তবতা নয়। এ আসলে আস্ত একটি ইতিহাস অবলোপনেরই খেলা। যে ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের পুঁজিবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাস। শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস এবং অবশ্যই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস। যার হাত ধরেই প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবসের প্রতিষ্ঠা।

সেই ইতিহাসকে সমস্ত জটিলতায় ব্যক্ত করার উদ্দেশ্য নয় আমাদের এই লেখাতে। এখানে বরং আমরা তুলে ধরলাম সেই ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি মানুষ— ক্লারা জেটকিন— তাঁর একটি ছোট্ট লেখার বঙ্গানুবাদ।

ক্লারা জেটকিন নামটির সাথে বাঙালি পাঠক অপরিচিত নন। জার্মান সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট, নারীবাদী ক্লারার সাথে বাঙালি পাঠকের— বিশেষত বাঙালি বামপন্থী পাঠকের—পরিচয় লেনিনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে। সেখানে আমরা শিখেছি লেনিনের পক্ষ নিতে, কিন্তু স্বীকৃতি দিতে শিখিনি ক্লারার স্বতন্ত্র চিন্তনপ্রক্রিয়াকে। তাই, ক্লারার সাথে বাঙালি পাঠকের পরিচয় হয়েছে বটে, কিন্তু পরিচয়পর্বেই দাঁড়িয়ে গেছে তাঁর সঙ্গে আমাদের সার্বিক আলাপচারিতা। সেই সার্বিক আলাপচারিতার দিকে আরও এক পা এগোতেই এই লেখাটি।

লেখাটির সময়কাল ১৯০৩। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস পালনের যে প্রস্তাবনাটি ক্লারা এনেছিলেন ডেনমার্কের কনফারেন্সে, ঠিক তার সাত বছর আগে। সেই বছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয় উইমেন্স ট্রেড ইউনিয়ন লিগ, যার অন্যতম রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, ধনিক শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণির মেয়েদের “ভগ্নিত্বের” (সিস্টারহুড) বন্ধনে আবদ্ধ করার। সেই শ্রেণিহীন ভগ্নিত্বের ধারণার বিরুদ্ধে তাঁর গোটা জীবন ধরেই সরব ছিলেন ক্লারা। তারই একটি ছোট্ট উদাহরণ নীচে দেওয়া হল। লেখাটি অনুবাদ করেছেন উর্মিমালা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

ক্লারা জেটকিন

 

এঙ্গেলস, যিনি বিগত চল্লিশ বছর ধরে মার্ক্সের সংগ্রাম ও কাজকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ভাবে জড়িত ছিলেন (১), তিনি লন্ডন থেকে তাঁদের উভয়েরই বন্ধু, নিউইয়র্কবাসী কমরেড সর্জেকে লেখেন, মানবজাতি একটি মস্তিষ্ককে হারিয়েছে এবং আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্কটিকেই খুইয়েছে (২)

 

এঙ্গেলসের মূল্যায়ন একেবারে অব্যর্থ 

এক জন বিজ্ঞানী হিসেবে, বিপ্লবী হিসেবে, শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতির বিকাশের পেছনে, বিশেষ, আজকের সর্বহারাদের প্রতি কার্ল মার্ক্সের সার্বিক অবদান আমাদের এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। কারণ তা করলে কেবল সোসালিষ্ট প্রেসে যা প্রকাশিত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তিই করতে হবে, পুনরাবৃত্তি করতে হবে মার্ক্সের চূড়ান্ত উর্বর, পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও ফলিত গবেষণাভিত্তিক লেখাপত্রের, এবং এর সঙ্গে বলতে হয় মানুষটির সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ ভাবে সর্বহারার প্রতি  নিয়োজিত সুবিপুল তাগড়াই ব্যক্তিত্বের কথা। তা না করে আমরা বলতে চাই, শ্রমিক শ্রেণিজাত,বা বলা ভালো সমগ্র নারী আন্দোলন কীভাবে তাঁর কাছে ঋণী।

 

নারীপ্রশ্নে মার্ক্স আলাদা ভাবে সরাসরি কোনো আলোচনা করেননি। তবুও তাঁর উদ্ভাবিত ধারণাই মেয়েদের অধিকার অজর্নের সংগ্রামে সবচাইতে অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তাঁর বস্তুবাদী ইতিহাসের ধারণা নারীর অধিকার বিষয়ে কোনো রেডিমেড ফর্মুলা হাজির করেনি, তৎসত্ত্বেও, এই তাত্ত্বিক কাঠামো আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : কারণ, তা থেকে আমরা প্রশ্নটিকে অন্বেষণ করবার ও বোঝবার উপযুক্ত সঠিক পদ্ধতির সন্ধান পেয়েছী। একমাত্র, তাঁর বস্তুবাদী ইতিহাসের ধারণাই আমাদের শেখায় নারী-প্রশ্নটিকে পৃথিবীর সর্বজনীন প্রবাহমান ঐতিহাসিক বিকাশের প্রেক্ষিতে, সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক ও তাদের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা এবং যৌক্তিকতার প্রেক্ষিতে খতিয়ে বুঝতে। তার দ্বারাই কেবলমাত্র আমরা তার চালক শক্তিগুলো ও তাদের উদ্দেশ্যকে বুঝতে এবং এই সমস্যার মীমাংসা করতে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো বুঝতে সক্ষম হব।

 

এই পুরাতন কুসংস্কার গুঁড়িয়ে গেছে যে ‘শাস্ত্রসম্মত বা ঈশ্বরের তৈরি বলে পরিবারে এবং সমাজে নারীদের অবস্থান চিরকাল অপরিবর্তনীয়’। মার্ক্স উদঘাটন করে দেখিয়েছেন, পরিবার ব্যবস্থাও অন্যসমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলির ন্যায় জোয়ার ভাঁটার মতো অবিরত ঘটে চলা প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও তার ফলে উদ্ভূত সম্পত্তির অধিকারজনিত সম্পর্কের সাথে সাথে রূপান্তরিত হতে থাকে। উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন এবং প্রচলিত অর্থনৈতিক ও সম্পত্তি ব্যবস্থার সাথে সংঘাতের ফলে অর্থনীতির উৎপাদনশীল শক্তির বিকাশ এই রূপান্তরে সাহায্য করে। আমূল পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে, মানুষের চিন্তা-চেতনায় বিপ্লব ঘটে এবং মানুষ প্রচেষ্টা করে পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ভিতের কাঠামোর সাথে সামাজিক উপরিকাঠামোর সামঞ্জস্য ঘটাবার। তাই প্রস্তরবৎ জমে যাওয়া সম্পত্তিগত এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের ধারণাগুলি অবশ্যই সরিয়ে দেওয়া উচিত। শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমেই এই সব পরিবর্তনগুলি সম্পন্ন হয়।

 

আমরা এঙ্গেলস লিখিত ‘পরিবারের উৎস, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং রাষ্ট্র’ নামক ভাস্বর গবেষণাকর্মটির ভূমিকা থেকে জানতে পারি যে, ওই বইটিতে অভিব্যক্ত তত্ত্ব এবং দৃষ্টিভঙ্গির অনেকাংশই মার্ক্সের অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে প্রাপ্ত, যা প্রত্যক্ষদর্শী এবং কার্যনির্বাহকের ভূমিকায় ছিলেন তাঁর অসাধারণ কর্তব্যনিষ্ঠ এবং বুদ্ধিমান এই বন্ধুটি।

 

এর কোনও কোনও অংশ অনুমান হিসাবে খারিজ করা হলেও (এবং সঙ্গত ভাবেই), একটি বিষয় নিশ্চিত : সার্বিকভাবে এই কাজটির মধ্যে সেই জটিল অবস্থার সম্বন্ধে অসংখ্য চমকপ্রদ সুস্পষ্ট তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে যা কিনা পরিবার এবং বিবাহের বর্তমান চেহারাটিকে যথাযথভাবে তুলে ধরেছে, এবং তার ওপর সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক ও সম্পত্তির সম্পর্কের প্রভাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে । এই রচনা আমাদের অতীতে নারীর অবস্থান সঠিকভাবে বিচার করতেই শুধু শেখায় না, বর্তমানে মহিলাদের সামাজিক, আইনি এবং সাংবিধানিক অবস্থানগুলিকে বুঝতে শেখায়।

 

অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে দাস ক্যাপিটাল গ্রন্থটি দেখায়, এক অপ্রতিরোধ্য ঐতিহাসিক শক্তি আজকের সমাজের ওপর অবিরাম ক্রিয়া করে চলেছে, নীচের থেকে উপরের স্তরের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি করছে, এবং তা মহিলাদের সম অধিকার নিয়ে আসতে চলেছে । পুঁজিবাদী উৎপাদনের বিকাশ এবং প্রকৃতি দক্ষতার সাথে পরীক্ষা করে, একেবারে যতটা সম্ভব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুঁটিনাটি বিষয় থেকে তার চলবার প্রকৃতি আবিষ্কার করে, যাকে আমরা অনেকেই  উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব বলে জানি , তিনি তাঁর নারী ও শিশুশ্রম সম্পর্কিত আলোচনায় চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করেছেন যে, পুঁজিবাদ মহিলাদের প্রাচীন ঘরোয়া কাজকর্মের ভিত্তিকে ভেঙে দিয়েছে , যার দ্বারা সেকেলে পারিবারিক ধাঁচটাই বিলীন হয়ে গেছে । এই জাতীয় বিকাশ  পরিবারের বাইরে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করেছে এবং এটি স্ত্রী, মা ও নাগরিক হিসাবে মহিলাদের সমতা পাবার ক্ষেত্রে একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেছে। তবে আরও যা স্পষ্টভাবে মার্কসের কাজ দ্বারা চিত্রিত হয়েছে তাহল : সর্বহারাই একমাত্র বিপ্লবী শ্রেণি যা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, একমাত্র তাঁরাই নারী-প্রশ্নের সম্পূর্ণ সমাধানের জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত তৈরি করতে সক্ষম এবং নিশ্চিতভাবেই সক্ষম। তাছাড়া ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলনরতা বুর্জোয়াদের পক্ষে শ্রমিকশ্রেণির মেয়েদের সামাজিক মুক্তি অর্জনের জন্য লড়াই করা কখনোই সম্ভব নয় এই জাতীয় মুক্তির বাস্তবতা কাম্যও নয় তাদের কাছে। বর্তমানের পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরে নিত্য নতুন যেসব দ্বন্দ্বের উদ্ভব হবে এবং ফলত নারী-পুরুষের সামাজিক ও আইনি সমতার দাবিতে যে লড়াইগুলি সংগঠিত হবে, সেখানে নতুন কোনো সমাধান দিতে তারা অক্ষম। মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ এবং তা থেকে উদগত সমস্ত অসামঞ্জস্য সম্পূর্ণ বিনষ্ট  না হওয়া পর্যন্ত এই সংঘাত সমাপ্ত  হবে না।

 

পরিবারের ভাঙন ও তার কারণসমূহ নিয়ে একদিকে যেমন আমরা বিশদে পাই মার্ক্স ও এঙ্গেলসের গবেষণা গ্রন্থ দাস কাপিটালে, অন্যদিকে তার একটি সারসংক্ষেপ তাঁরা হাজির করেন “কমিউনিস্ট ইস্তেহারে” :

 

কায়িক শ্রমে কারিগরি পটুতা ও শক্তিমত্তার প্রয়োজনীয়তা যত কমে যেতে থাকে, অর্থাৎ আধুনিক শিল্পের যত উন্নতি ঘটে, ততই পুরুষ শ্রমিকের জায়গা নিতে শুরু করে নারী শ্রমিক। সামাজিকভাবে আর শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে বয়স ও নারী-পুরুষ লিঙ্গ ভেদের  সুস্পষ্ট কোনও তফাৎ নেই। সকলেই তারা  কাজ করবার যন্ত্র, বয়স ও লিঙ্গ অনুসারে তাদের মাহিনা খাতে খরচ বাড়ে বা কমে …

বুর্জোয়ারা পরিবারের সংবেদনশীল আবেগের ভাবালুতার আবরণটাকে ছিঁড়ে ফেলে তাকে নিছক টাকা-পয়সার সম্পর্কে অবনমিত করেছে …

শ্রমিকশ্রেণির ক্ষেত্রে, পুরোনো সমাজের যে পরিকাঠামোগুলি, সেগুলি ক্রমাগত অবক্ষয়মুখী। ব্যক্তি শ্রমিকের হাতে কোনও সম্পত্তি নেই, তার নিজের স্ত্রী ও সন্তানের সাথে যে সম্পর্ক, তার সঙ্গে বুর্জোয়া পরিবারের সম্পর্কের সঙ্গে কোনও মিল নেই…

বর্তমান পরিবার অর্থাৎ বুর্জোয়া পারিবারিক ব্যবস্থাটা কোন ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ? পুঁজি ও ব্যক্তিগত মুনাফার ওপর। এই ব্যবস্থার পরিপূর্ণ বিকশিত চেহারাটি কেবল বুর্জোয়াদের মধ্যেই টিকে রয়েছে। কিন্তু এই অবস্থাটির পরিপূরক হল শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে পারিবারিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং প্রকাশ্য বেশ্যাবৃত্তি …

আধুনিক যন্ত্রশিল্পের প্রভাবে সর্বহারাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনসমূহ যতবেশি করে ছিন্ন হতে থাকে এবং তাঁদের সন্তানরা যত বেশি করে মামুলি কেনাবেচার বস্তু ও শ্রমের হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকে ততই পরিবার ও শিক্ষা বিষয়ে, বাপ-মায়ের সঙ্গে সন্তানের পবিত্র সম্পর্কের বিষয়ে বুর্জোয়াদের বাগাড়ম্বরের বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায় …

শুধু ভেঙে চলাটাই ঐতিহাসিক বিকাশের একমাত্র কাজ এ কথা মার্ক্স বলেননি, বরং তা আরও উন্নততর এবং আরও নিখুঁত পৃথিবী গঠন করবে তাঁর এই দৃঢ় বিজয়ী প্রত্যয় আমাদের পূর্ণ করে তোলে।

 

দাস ক্যাপিটাল-এ মার্ক্স লিখেছিলেন :

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরোনো পারিবারিক বন্ধনসমূহের ভাঙন যত ভয়ঙ্করই হোক না কেনও কেনো, তবুও  মহিলা থেকে ছেলে-মেয়ে, অল্পবয়স্ক সকলকে নির্বিশেষে পারিবারিক পরিধির বাইরে টেনে এনে আধুনিক যন্ত্রশিল্পে উৎপাদন প্রক্রিয়ার কাজে নিযুক্ত করে, মোটের ওপর তা পরিবার ব্যবস্থা ও নারী-পুরুষের সম্পর্ককে উন্নত  রূপ অর্জন করার অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে।

 

রাজনৈতিক উন্নাসিকতায় বলীয়ান হয়ে, ভবিষ্যৎ আদর্শের উপরে আরোপিত নোংরা সন্দেহের প্রত্যুত্তর দিয়েছেন মার্কস ও এঙ্গেলস বর্তমান পরিস্থিতির নির্মম চরিত্রাঙ্কন করে :

বুর্জোয়ারা নিজের স্ত্রীকে নিতান্ত একটি উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই দেখে। সে যখন শোনে উৎপাদন যন্ত্র সাধারণভাবে ব্যবহৃত হবার কথা উঠছে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই এ ছাড়া আর কোনও সিদ্ধান্তে সে আসতে পারে না যে, একইভাবে সকলের দ্বারা ব্যবহৃত হবার বিষয়টি নারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

 

তার মনে বিন্দুমাত্র ভাবনা জাগে না যে, আসল উদ্দেশ্য হল শুধুমাত্র উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে নারীর অস্তিত্বের বিলোপ ঘটানো।

 

তা ছাড়া কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রকাশ্যে এবং সরকারিভাবে এজমালি স্ত্রী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হবে এই মিথ্যা অভিযোগ এনে বুর্জোয়ারা যে মনগড়া ক্রোধ দেখান তার  থেকে বেশি হাস্যকর আর কিছু নেই। মেয়েদের সাধারণ সম্পত্তি করে তোলবার কোনও প্রয়োজন কমিউনিস্টদের নেই; কারণ প্রায় স্মরণাতীত কাল থেকেই এই প্রথা প্রচলিত রয়েছে।

 

সাধারণ বেশ্যাদের কথা বাদ দিলেও, বুর্জোয়ারা কেবল সর্বহারাদের স্ত্রী ও মেয়েদের যৌন দখলদারিত্ব পেয়েই সন্তুষ্ট থাকে না, একে অপরের স্ত্রীকে ফুঁসলে নেওয়াতে তারা পরম আনন্দ পায়।

 

বুর্জোয়া বিয়ে বাস্তবে আসলে সাধারণভাবে এজমালি স্ত্রী রাখার একটা ব্যবস্থামাত্র, এবং তাই বড় জোর কম্যুনিস্টদের সম্পর্কে সম্ভবত এই অভিযোগ করা যেতে পারে — ভণ্ডামির আড়ালে নারীদের ওপর যে এজমালি অধিকার লুকানো রয়েছে, তার পরিবর্তে একে তারা খোলাখুলি আইনগত ভাবে চিহ্নিত করতে চায়। তা ছাড়া এ কথা স্বতঃসিদ্ধ, বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থার উচ্ছেদের সঙ্গে, সেই ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত এজমালি স্ত্রী ব্যবস্থা লুপ্ত হবে, অর্থাৎ প্রকাশ্য ও ঘরোয়া উভয় ধরনের বেশ্যাবৃত্তিই দূর হবে।

 

তবে, এটুকুতেই মার্ক্সের কাছে নারী আন্দোলনের ঋণ শেষ নয়। এককভাবে প্রায়, মার্কস যেভাবে যে যন্ত্রণাক্লিষ্ট পথ দিয়ে হেঁটে মেয়েরা সামাজিক দাসত্ব থেকে মুক্তি ও ক্ষয়িষ্ণুতা থেকে একধরনের ঐকতানের দিকে এগিয়েছে, তার ওপর আলোকপাত করেছেন, তা ঠিক সেইভাবে তাঁর আগে কেউই করেনি। তাঁর গভীর ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যে যে ভাবে তিনি দেখিয়েছেন যে এই সমাজ শ্রেণি দ্বন্দ্বে জীর্ণ, তা আরেকটি বাস্তবতার দিকেও আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, দেখিয়েছে যে বিভিন্ন শ্রেণির নারীরা তাদের নিজ নিজ শ্রেণির স্বার্থদ্বারা চিহ্নিত ও পৃথক। ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার নিরিখে, এই যে ‘প্রেম গাথা’, যে বুর্জোয়া ও শ্রমিক মেয়েরা কোনও এক ধরনের অবিচ্ছেদ্য ‘ভগ্নীত্বে’র ফিতেয় বাঁধা, তা প্রায় সাবানের ফেনার বুদ্বুদের মতোই মিলিয়ে যায়।  মার্কস আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন সেই তরবারি, যার এক আঘাতে বুর্জোয়া ও শ্রমিক মেয়েদের আন্দোলনের মধ্যেকার লড়াইয়ের ঐক্যবদ্ধতার বুলি ছিন্ন হয়ে যায়। তার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য তাঁর চিন্তনপ্রক্রিয়ায় আমাদের এও শিখিয়েছেন যে, শ্রমজীবী মেয়েদের আন্দোলন এবং লড়াইয়ের নাড়ি অবিচ্ছেদ্য ভাবে বাঁধা পড়ে আছে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী ধারায় পরিচালিত শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে। এই ভাবেই, তিনি আমাদের আন্দোলনে এনেছেন রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, আড়ম্বর ও গভীর এক ধরনের মাহাত্ম্য।

 

মেয়েদের শ্রম, নারী শ্রমিকের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান এবং আইনি সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে দাস ক্যাপিটাল একটি মহা মূল্যবান আকর। স্বীকার করতে বাঁধা নেই, বইটি আমাদের প্রাত্যহিক লড়াই ও ভবিষ্যতের সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর যে মহৎ লক্ষ্য, এই দুইয়ের ক্ষেত্রেই কাজ করে এক ধরনের অপ্রতিরোধ্য আত্মিক অস্ত্র হয়ে। মার্কস শেখান আমাদের যে সমস্ত ছোট ছোট প্রাত্যহিক অস্ত্রশস্ত্র সহকারে নারী শ্রমিকরা লড়াই গড়ে তোলেন এবং নিজেদেরকে আরও আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন, সে সবের স্বীকৃতি দিতে হবে।  তার সঙ্গে সঙ্গে এও মনে করাতে করাতে যান— অপ্রতিরোধ্য বিপ্লব লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বিনা, নারীজাতির মুক্তি নেই। ওই লক্ষ্যটি বাদ দিলে নারী স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়ে উঠবে একটি শূন্য, নিস্পৃহ খোয়াব। তা বিনা আর কিছুই নয়। সর্বোপরি, তিনি আমাদেরকে দেন এমন এক প্রতীতি, যা আমাদের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মকে অর্থবহ করে তোলে। কাজেই, মার্কস আমাদের রক্ষাকর্তাও। তাঁর কাছে গিয়েই আমরা টিকিয়ে রাখি আমাদের রাজনীতির মূলগত বোধ ও আত্মিকতা, যা বহু সময়েই প্রতিদিনকার ব্যক্তি সঙ্কট, রুটিন , ছোট ছোট আশু লক্ষ্য ও সাফল্যের বুনটে ডুবে থেকেও, আমাদের তাকিয়ে থাকতে শেখায় ঐতিহাসিক দিগন্তের দিকে, যেখান থেকেই সূত্রপাত হবে নতুন দিনের। যেমনভাবেই তিনি বিপ্লবী চিন্তাধারার মহান শিক্ষক, সেইভাবেই, তিনি সেই বিপ্লবী আন্দোলনেরই অন্তর্গত গৌরবময় নারী আন্দোলনেরও পথ-প্রদর্শক। যাঁর গৌরবময় কর্মকাণ্ডে লড়াইয়ের উজ্জ্বল দায়িত্ব এসে বর্তায় শ্রমিক শ্রেণির নারী আন্দোলনের কাঁধের ওপরেই।

 

 

(১) ফ্রেডরিক এঙ্গেলস

 

(২) এই চিঠিটি লন্ডন থেকে ১৮৮৩ সালের ১৫ মার্চ ফ্রিড্রিচ অ্যাডল্ফ সর্জেকে পাঠানো হয়েছিল, যিনি ১৮৫২ সালে জার্মানি থেকে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী হয়েছিলেন।

 

রচনা : ১৯০৩, ১৪ মার্চ কার্ল মার্ক্সের বিশতম মৃত্যবার্ষিকীতে।

 

Share this
Leave a Comment