অভিযুক্তকে হাতকড়া পরাতে পারে না পুলিশ


  • March 4, 2022
  • (2 Comments)
  • 2306 Views

বিচারাধীন ব্যক্তিকে হাতকড়া পরানোর অর্থ আর কিছুই না, বিচার শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ- প্রশাসনই অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করছে। হাতকড়া পরানো বা কোমড়ে দড়ি জড়ানোর মাধ্যমে সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে, সমাজের কাছে হেয় করা এবং বিচ্ছিন্ন করার এ এক বর্বরোচিত পুলিশি প্রচেষ্টা। লিখেছেন পীযুষ দত্ত

 

 

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২। দিল্লি  দাঙ্গায় অভিযুক্ত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র উমর খালিদকে পেশ করা হল দিল্লির কোকারডামা আদালতে।  দেখা গেল, উমরের হাতে হাতকড়া পরানো। এখানে উল্লেখ করা জরুরি, জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ পাতিয়ালা আদালত পুলিশকে নির্দেশ দেয় উমর খালিদকে বিনা হাতকড়াতেই কোর্টে আনতে হবে। তবে কেন ফের হাতকড়া? কেন নির্দেশ অমান্য? কেন আদালত অবমাননা? এই প্রশ্নগুলি বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে তাদের এক বড় অংশের নীরবতাকেও আরও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

 

অভিযুক্তের হাতে হাতকড়া পরানো কিংবা কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে হাজির করার দৃশ্য দেশের মানুষ হামেশাই সংবাদমাধ্যমে দেখে থাকেন। বলা যায়, আদালতে এই ভাবে অভিযুক্তকে দেখতে তাঁরা এক প্রকার অভ্যস্ত। বা বলা ভালো তাঁদের অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে। তবে এই অভ্যাসের চাদরে যা আড়াল হয়ে যায় তা হল, এই হাতকড়া পরানো বা কোমরে দড়ি পরানোর সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্পর্কটি। উমরের হাতে হাতকড়া আমরা ভ্রু কুঁচকে দেখি, ক্ষুব্ধ হই। ঠিক তেমনই কিছুদিন আগে খোদ আমাদের রাজ্যে ন’জন ছাত্র-ছাত্রীকে আদালতে পেশ করার জন্য নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে আসে। আমরা যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রসঙ্গে ঘন ঘন উত্তরপ্রদেশের নাম শুনতে অভ্যস্ত, যেখানে উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটকের বিপরীতে বারংবার পশ্চিমবঙ্গের সুশাসনের উদাহরণ সামনে রাখা হয়, সেখানে এমন ঘটনা ঘটল এবং আমরা বিশেষ সাড়া শব্দও করলাম না।‌ এই সাড়া শব্দ না করবার পিছনে রয়েছে সংশয়। হাতকড়া পরানো বা কোমরে দড়ি পরানো আদৌ কি উচিত? আদৌ কি মানবাধিকার লঙ্ঘন?

 

সত্তর আশির দশকে সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে স্পষ্ট রায় দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট জানায় হাতকড়া পরিয়ে অভিযুক্তকে কোর্টে আনা কোনওভাবেই চলবে না।‌ অভিযুক্তের ‌হাতে হাতকড়া স্পষ্টতই মানবাধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন। আর যদি কোনও ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরে সেক্ষেত্রেও আদালতের অনুমতি ছাড়া হাতকড়া ব্যবহার করা যাবে না। উদাহরণ হিসাবে আমরা দুটো কেসের আলোচনা করতে পারি।

 

১৯৭৮ সালে, সুনীল বাতরা বনাম দিল্লি প্রশাসন মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট জানায় যে, সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনও ব্যক্তিকে তাঁর ব্যক্তি-স্বাধীনতার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। অর্থাৎ সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারাকে সূত্র ধরে, সুপ্রিম কোর্ট জানায়, যে এক জন বিচারাধীন বন্দির যে সামন্যতম চলাচলের স্বাধীনতা থাকে, এই হাতকড়া বা অন্য কোনও রকম ভাবে সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা চলবে না।

 

দ্বিতীয় উদাহরণ হিসাবে দেখতে পারি ১৯৮০-র প্রেমশঙ্কর শুকলা বনাম দিল্লি প্রশাসন মামলা। এ ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট হাতকড়া পরানোকে ‘পৈশাচিক’ এবং ‘অর্থহীন’ বলে দাগায়। পঞ্জাব পুলিশ ম্যানুয়ালের ২৬ নম্বর পরিচ্ছেদের ২৬.২১ ও ২৬.২২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, যে কোনও ‌বিচারাধীন বন্দি যার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রয়েছে, সেই বন্দিকে হাতকড়া পড়িয়ে আদালতে তোলা যাবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এই পঞ্জাব ম্যানুয়ালকে নিরর্থক বলে চিহ্নিত করে। এবং স্পষ্ট এই ওই ম্যানুয়ালের বক্তব্যকে নসাৎ করে দেয়।

 

ইতিমধ্যেই আমরা অল্প হলেও আন্দাজ করতে পেরেছি যে, এই হাতকড়া পরানো বা কোমড়ে দড়ি জড়ানোর মতো প্রথার বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দৃষ্টিভঙ্গিটি কী। যা একের পর এক রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে। বিচারাধীন ব্যক্তিকে হাতকড়া পরানোর অর্থ আর কিছুই না, বিচার শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ- প্রশাসনই অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করছে। হাতকড়া পরানো বা কোমড়ে দড়ি জড়ানোর মাধ্যমে সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে, সমাজের কাছে হেয় করা এবং বিচ্ছিন্ন করার এ এক বর্বরোচিত পুলিশি প্রচেষ্টা। কেবল বিচারাধীন বন্দির বিষয় নয়, এমন অনেক বন্দি আছে যারা আদালতে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরেও আদালত তাঁদের ক্ষেত্রে হাতকড়া ব্যবহারের নির্দেশ দেয় না। তবে পুলিশ-প্রশাসনকে সে সময়ও হাতকড়ার ব্যবহার করতে দেখা যায়। এই বন্দিদের বিচ্ছিন্ন করে মানষিক চাপসৃষ্টি এবং সামাজিক লজ্জাবোধ তৈরির চেষ্টা পুলিশ প্রশাসনের পুরোনো হাতিয়ার।

 

দেশের গণ্ডি ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নজর দিলেও দেখব, জাতিসঙ্ঘের নেলসন ম্যান্ডেলা রুলস, যা তারা ২০১৫-তে গ্রহণ করে, সেখানে বলা হচ্ছে, ধারা নম্বর ৪৭(১) অনুসারে, যে কোনও বন্দির ক্ষেত্রেই হাতকড়া বা এমন কিছুই ব্যবহার করা চলবে না, যা তাঁদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন করে। যদি প্রশাসন বোধ করে কোনও নির্দিষ্ট বন্দির পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আদালতের অনুমতি নিয়েই হাতকড়ার ব্যবহার করা যাবে।

 

তবে এ উপমহাদেশে প্রতিদিন এমন হাজারটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আমরা ঘটতে দেখি। উমর খালিদ বা খালিদ সাইফির ক্ষেত্রে সরাসরি আদালতের হাতকড়া ব্যবহার না করার নির্দেশ থাকলেও, পুলিশ যে তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি তা ওই ঘটনাই আমাদের শিখিয়ে দেয়। তবে বিষয়টা স্রেফ উমর খালিদ নয়, এমন ঘটনার শিকার দেশের অধিকাংশ বন্দিই। তবে যা চিন্তার তা হল, ঠিক কী ভাবে ভারত ধীরে ধীরে পুলিশি রাষ্ট্রের দিকে পা বাড়াচ্ছে। এবং তা এক সরকার বা এক আমলের গল্প নয়। যে দেশে মানুষের শেষ ভরসার কাঁধ সুপ্রিম কোর্ট, সেখানে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কীভাবে পুলিশ প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্রেফ খাতায় কলমে বন্দি করে, ফাইলের তাড়া জমাচ্ছে। কিন্তু তার প্রয়োগ হচ্ছে না। এবং এই বিষয়ে নাগরিকদের উদাসীনতার কারণ খুঁজতে গেলে দেখব, যে এ দেশের অধিকাংশ মানুষ এ কথা মনেই করেন না যে বন্দিদেরও মানবাধিকার থাকে। এখানে উল্লেখ করা জরুরি,  বন্দিদের এই অধিকার আদায় হয়েছে দীর্ঘদিনের সংগ্রামের হাত ধরে। এবং আজও বন্দিদের লড়াই চালাতে হয় তাঁদের অর্জিত অধিকার রক্ষা করতে। গোটা‌ বিশ্ব জুড়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বন্দিরা নিজেদের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে পেরেছিল। তবে এই ‘অভিযুক্ত মানেই দোষী’, এই ধারণা গড়ে ওঠার মূলে রয়েছে সমাজের নেতিবাচক ভূমিকা।

 

যে কোনও দেশের ইতিহাসে নজর দিলে দেখব, আদালতের দুর্বল হয়ে পড়ার পিছনে পুলিশের হাতে অতিরিক্ত ও অবাধ ক্ষমতা সঞ্চারের আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। উমর খালিদের বা বাংলার ন’জন ছাত্র-ছাত্রীর ঘটনা আমাদের সামনে ন্যায়ব্যবস্থার ভাঙন এবং পুলিশি রাষ্ট্রেরই ইঙ্গিত দেয়। যা আরও স্পষ্ট ভাষায় দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভাঙন বলা চলে। যেখানে আদালতের উপর থাকবে পুলিশ-প্রশাসন।

 

Share this
Recent Comments
2
  • comments
    By: Prasun Kr Dutta on March 4, 2022

    খুব সময়োপযোগী লেখা । বিষয়টি সমাজের সামনে তুলে ধরার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।।

  • comments
    By: Prasun Kr Dutta on March 4, 2022

    বিষয়টি একটি মানবিকতার প্রশ্ন! মানবিকতা লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে অনেক লেখনীর সাথে এটিও সংযোজিত হলো ।।

Leave a Comment