অসাম্যের শিখর ছুঁয়েছে ভারত 


  • January 20, 2022
  • (0 Comments)
  • 1193 Views

ভারতের অর্থনীতি অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে ‘ঘুরে দাঁড়াচ্ছে’, অন্তত ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে। এমনই মনে করছে কেন্দ্রীয় সরকার। কোন ভারত? বিশ্বব্যাঙ্কের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,  সার্বিক ভাবে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্মণ দেখা গেলেও তার সুফল আটকে রয়েছে  সমাজের উঁচু তলায়। আর দেশের অর্ধেক মানুষ মন্দার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। অর্থাৎ, সেই ভারত যা রুটি-রুজির জন্য জীবন বাজি রেখে ঢুকে পড়ে বাঘের ডেরায়। ২০২০ সালে অতিমারিকালে সুন্দরবনে কাঁকড়া ও মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছেন ২৭ জন। যা এক রেকর্ড। কমে এলেও ২০২১-২০২২ সালেও যা অব্যাহত। অধিকাংশের  রুজিরোজগারের পথ যেখানে হয় বন্ধ, না হয় সংকুচিত,  বাজার যখন আগুন, শিক্ষা-চিকিৎসা নাগালের বাইরে ক্ষুধায় অপুষ্টিতে জেরবার সেই  বৈষম্যের বিশ্বে প্রতিনিয়ত ঘটছে অকাল মৃত্যু। প্রতি চার সেকেন্ডে এক জন, দিনে ২১০০০। বলছে অক্সফামের ইনইক্যুয়ালিটি  কিলস, ২০২২ রিপোর্টটি।  

 

একের পর এক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই করোনাকালের যাবতীয় সুফল কুক্ষিগত করেছে দেশের ধনকুবেররা। তাঁদের সম্পদ বেড়েছে রকেটের গতিতে, ততোধিক গতিতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে আম-ভারতের অর্থনীতি। এই প্রবল অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রটি আমরা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরব। বিশ্বব্যাঙ্ক, অক্সফাম ইন্ডিয়ার সমীক্ষা, অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশিত বিভিন্ন বণিকসভার রিপোর্ট, সম্পাদকীয় মন্তব্য থেকে সংগৃহীত তথ্য এই রিপোর্টে এক যোগে প্রকাশ করা হল। প্রথম ভাগে থাকছে ধনবৈষম্যের চিত্র। দ্বিতীয় ভাগে ভারতের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে বা আদৌ ঘুরে দাঁড়াবে কি না সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতামত।  

 

ধনবৈষম্য হত্যাকারী : অক্সফ্যাম রিপোর্ট 

  

  • গত ২১ মাসে (মার্চ ২০২০-নভেম্বর ২০২১) ভারতে বিলিয়ন ডলার ধনকুবেরের সংখ্যা ৩৯ শতাংশ বেড়ে (যাঁদের সম্পদ অন্তত ৭৪০০ কোটি টাকা) ১০২ থেকে ১৪২ হয়েছে। এই সময় দেশের ৮৪ শতাংশ পরিবারের রোজগার কমেছে।

 

  • ২০২১ সালে প্রথম ১০০ জন ধনীতমর সম্মিলিত সম্পদ রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়ে ২৩.১৪ লক্ষ কোটি টাকা (৩১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩.১৬ লক্ষ কোটি টাকা (৭৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

 

  • ২০২০ সালে ১০% ধনীতম ব্যক্তি জাতীয় সম্পদের ৪৫% দখল করেছে।

 

  • প্রথম ৯৮ জনের সম্পদ, অঙ্কের হিসেবে যা ৪৯ লক্ষ কোটি টাকা, দেশের দরিদ্রতম ৫৫.৫ কোটি জনের সম্পদের সমান।

 

  • ১০% মানুষের হাতে রয়েছে জাতীয় সম্পদের ৪৫%। দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে জাতীয় সম্পদের ৬%।

 

  • কোভিডে মহিলাদের দুই-তৃতীয়াংশ রোজগার কমেছে। মোট কাজ হারানোদের মধ্যে ২৮ শতাংশ মহিলা।

 

  • ২০২০ সালে ৪.৬ কোটিরও বেশি ভারতীয় অতি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। যা বিশ্বে নব-দরিদ্রের মোট সংখ্যার অর্ধেক।

 

  • ধনকুবেরদের সম্পদবৃদ্ধির ২০ শতাংশই ঘটেছে গৌতম আদানির। এক বছরে তাঁর মোট সম্পদ বেড়েছে আট গুণ। ২০২০ সালে আদানির সম্পদের পরিমাণ ডলারের অঙ্কে ৮৯০ কোটি। ২০২১-এ তা দাঁড়িয়েছে ৫০৫০ কোটি ডলার। তিনি ভারতের দ্বিতীয় ধনী, বিশ্বে ২৪তম। দেশের প্রথম ধনী মুকেশ আম্বানির সম্পদ ৩৬৮০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫৫০ কোটি ডলার।

 

  • বিশ্বের ছবিটাও অনেকটাই এই রকম। অক্সফামের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, অতিমারির আবহে ৯৯ শতাংশ মানুষেরই রোজগার কমেছে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নীচে তলিয়ে গিয়েছেন ১৬ কোটি মানুষ। অন্য দিকে, বিশ্বের প্রথম ১০ জন বিত্তশালীর মোট সম্পদ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৫ লক্ষ কোটি ডলার (১১১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি)। দৈনিক তাঁদের সম্পদ বেড়েছে ৯০০০ কোটি টাকা করে। শেষ দু’বছরে তাঁদের যা সম্পত্তি বেড়েছে তা গত ১৪ বছরেও বাড়েনি।

*সূত্র : ইনইক্যুয়ালিটি কিলস : ইন্ডিয়া সাপ্লিমেন্ট, অক্সফ্যাম। ১৭ জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের দাভোস অ্য়াজেন্ডা সামিটের প্রাক্কালে এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ জানুয়ারি ২০২২। গণশক্তি, ১৮ জানুয়ারি ২০২২।

 

ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২২, বিশ্বব্যাঙ্ক

 

  • ১৯৮০ সালে ভারতের স্বচ্ছলতম ১০ শতাংশের আয় ছিল জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশ। ১৯২১ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশে।

 

  • ১৯৮০ সালে দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের আয় ছিল জাতীয় আয়ের ২১ শতাংশ। ২০২১ সালে তা কমে দাড়িয়েছে ১৩ শতাংশে।

 

  • ২০২১ সালে স্বচ্ছলতম ১ শতাংশের আয় জাতীয় আয়ের ২২ শতাংশ।

 

  • ২০২১ সালে দরিদ্রতম অংশের মাথাপিছু বাৎসরিক গড় আয় ৫০ হাজার টাকা। স্বচ্ছলতম ১০ শতাংশের প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। উর্ধ্বতম ১ শতাংশের ৪৪ লক্ষ টাকার উপর।

*সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১

 

বেকারত্বের হার (অগস্ট-ডিসেম্বর, ২০২১। হার শতাংশে)

 

মাস দেশ শহর গ্রাম
অগস্ট ৮.৩২ ৯.৭৮ ৭.৬৪
সেপ্টেম্বর ৬.৮৬ ৮.৬২ ৬.০৬
অক্টোবর ৭.৭৫ ৭.৩৮ ৭.৯১
নভেম্বর ৭.০০ ৮.২১ ৬.৪৪
ডিসেম্বর ৭.৯১ ৯.৩০ ৭.২৮

 

  • উপদেষ্টা সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী,  অগস্টের পর উৎসবের মরশুমে বেকারত্বের হার সামান্য কমলেও ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে যায়। গ্রামে বেকারত্বের হার তুলনামূলক কম হওয়ার কারণ রবি চাষ এবং ১০০ দিনের কাজ-সহ অন্যান্য রোজগার প্রকল্প। কিন্তু করোনা ও লকডাউনের প্রভাব থেকে ছোট ও মাঝারি শিল্প এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিপদ এখনও কাটেনি। অর্থনীতি যেটুকু ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাতে বৃহৎ সংগঠিত ক্ষেত্রের অবদান বেশি। আর তা হয়েছে ছোট-মাঝারি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিনিময়ে। কাজের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। নতুন বছরের শুরুতে নতুন করে সংক্রমণ এবং নানা বিধিনিষেধের চাপে কাজের বাজার সংকুচিত হবে।

 

  • ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে দেশের বেকারত্বের হার ছিল ৬.০১%। কেন্দ্রীয় সরকার অসম্পূর্ণতার অজুহাত দিয়ে রিপোর্টটি জনসমক্ষে আনেনি। পরে অবশ্য রিপোর্টের সত্যতা স্বীকার করে।

*সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ জানুয়ারি ২০২২।

 

হোটেল শিল্পে কাজ হারিয়েছে ৫ কোটি*

 

  • অতিমারির প্রভাবে ইতিমধ্যেই ৩০% হোটেল-রেস্তরাঁ বন্ধ।
  • মোট ১.৪০ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
  • কাজ হারিয়েছেন পাঁচ কোটি কর্মী
  • তৃতীয় ঢেউয়ে বড় শহরে ব্যবসা ১০ শতাংশের নীচে।
  • করোনা-পূর্ব ব্যবসা ফিরতে পাঁচ বছর লাগবে।

 

অতিমারির প্রভাব :

 

সময় হোটেলে ঘরের চাহিদা রেস্তরাঁয় ভিড়
প্রাক-করোনা ৬৯-৮৯% ৮০-৯২%
প্রথম ঢেউ ১-৩% ০%
দ্বিতীয় ঢেউ  ১১-১৬% ১০-১৫%

 

  • যখনই ঘুরে দাঁড়ানোর কথা মনে হয়েছে্, এসেছে নতুন ধাক্কা। অথচ ব্যবসা বন্ধ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বইতেই হচ্ছে। মেটাতে হচ্ছে সরকারি ফি ও কর। এর আগে সরকারের ত্রাণ প্রকল্পে ঋণের সুবিধা নিয়ে এবং সংস্থাগুলি নিজেদের পুঁজি ঢেলে কোনওক্রমে সে সব চালু রেখেছে এবং যাবতীয় খরচ মেটানোর চেষ্টা করেছে। যারা পারেনি বন্ধ হয়েছে।

…বার বার ব্যবসা হোঁচট খাওয়ায়, বহু লোকের চাকরি যাওয়ায় কেউ এখন আর হোটেল-রেস্তরাঁয় কাজ করতে চাইছেন না। এর জেরে আগামী দিনে দক্ষ কর্মী পাওয়াই না কঠিন হয়ে দাড়ায়। গুরুবক্স সিং কোহলি, ভাইস প্রেসিডেন্ট, এফএইচআরএআই।

 

*সূত্র : ফেডারেশন অব হোটেল অ্যান্ড রেস্তরাঁ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (এফএইচআরএআই), আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ জানুয়ারি ২০২০।

 

ছবি : https://www.theindiaforum.in

 

Share this
Leave a Comment