আলিয়ার পড়ুয়ারা আন্দোলনে, সরকার উদাসীন, হুঁস নেই বৃহত্তর সমাজের


  • January 17, 2022
  • (0 Comments)
  • 945 Views

২০১৯ এ প্রকাশিত এমএইচআরডির তথ্য বলছে, এ রাজ্যে ২১ শতাংশ মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী ড্রপআউট হয়। তাই এ পরিস্থিতিতেও যারা উচ্চশিক্ষা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তাঁদের শেষ আশ্রয় হয় আলিয়া। এটি স্পষ্ট যে, এই মুহূর্তে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী সমাজের কাছে এই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সরকারের এই লাগাতার অবহেলা, মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উস্কে দেয়। লিখলেন পীযূষ দত্ত।

 

ভোট, ভোট-হিংসা, হার-জিত, বিজয় মিছিল, এই সব কিছুর আড়ালে শেষ দুই মাসের বেশি সময় জুড়ে কলকাতায় আন্দোলন করছেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। দশ দফা দাবি নিয়ে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁদের মূল দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে, একটি জমি, ছাত্রদের মতে যা আলিয়ার জমি, যেট এমএমএ দফতর কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজকে দিয়ে দেওয়ার ‘চক্রান্ত’ করছে। এ ছাড়াও আন্দোলকারী ছাত্র সাজিদুরের বক্তব্য অনুযায়ী, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তালতলায় যে ক্যাম্পাস রয়েছে, সেখানে শিক্ষার পরিবেশ দিন দিন নষ্ট করা হচ্ছে, তাঁদের দাবি অবিলম্বে তালতলা ক্যাম্পাসের রক্ষাণাবেক্ষণের দিকে মাইনরিটি বোর্ডকে নজর দিতে হবে। এ ছাড়াও ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তব্য অনুযায়ী, বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা হস্টেলের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না।  এই দাবিগুলোর পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের আন্দোলনের মধ্যে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি, ক্যাম্পাসকে গুন্ডামির আখড়ায় পরিণত করা, মাইনরিটি বোর্ডের দুর্নীতির মতো একাধিক অভিযোগকে সামনে রেখে আন্দোলনে নেমেছেন।

 

এ রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ২৭ শতাংশ অর্থাৎ  প্রায় আড়াই কোটি হওয়ায়, তাঁরা উন্নত মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না-পেলেও, ভোটের আগে তাঁদের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে রাজনৈতিক দলগুলির উৎসাহের অভাব দেখা যায় না। এ বিষয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুর এক ছাত্রের মত, “মুসলিমরা বাংলায় থাকে, খায়, খাটে, তবু তাঁরা নিজের লোক নয়। শুধু ভোট এলে ভালোবাসা আর আটকে রাখা যায় না।” এই বক্তব্যের গভীরে প্রবেশ করলে এই কঠিন সত্যকে স্পর্শ করা যাবে।

 

স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড ও প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এর একটি সমীক্ষায় মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বিষয়ে যে ফলাফল সামনে আসে, তা ভয়াবহ। রিপোর্টে দেওয়া তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গে যেখানে সাক্ষরতার হার ৭৬.৩ শতাংশ সেখানে এমএলআর অর্থাৎ মুসলিম লিটারেসি রেট হচ্ছে, ৬৯.৫ শতাংশ। আরও দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে বঙ্গের মুসলিম প্রধান জেলা উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ। সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৫৬ শতাংশের কাছাকাছি হওয়াতেও, সাক্ষরতার হার ৫১.৬, ৫৮.১, ৬৩.২ শতাংশ। এবং এর কারণ হিসাবে উঠে আসছে একাধিক তথ্য। দেখা যাচ্ছে মুসলিম প্রধান ব্লকগুলিতে সব থেকে কম সংখ্যক স্কুল। যে ক’টা রয়েছে সেগুলিও বসতি অঞ্চল থেকে বেশ খানিকটা দূরে। স্কুলগুলির পর্যাপ্ত পরিকাঠামো না-থাকা, বিপুল পরিমাণ শিক্ষকের অভাব। এখানে আরও একটি বিষয় আলোচনা করা জরুরি, দেখা যাচ্ছে মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সাক্ষরতার হার আরও কম। যেখানে মুসলিম পুরুষদের সাক্ষরতার হার হচ্ছে ৭২.৫ শতাংশ, সেখানে মুসলিম মহিলাদের সাক্ষরতার হার ৬৪.৮ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে উঠে আসে একাধিক বিষয়, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ, গ্রাম এবং শহরতলি অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলিম পরিবারগুলির আর্থিক অবস্থা।

 

এই আলোচনা প্রসঙ্গে আমাদের আরেকবার নজর দিতে হবে স্ন্যাপ এবং প্রতীচীর ২০১৬-র রিপোর্টের দিকে। তাঁরা রাজ্যের ৯৭,০১৭টি মুসলিম ঘরকে ধরে সমীক্ষা করে। এর মধ্যে ৭৯,৯১৩টি গ্রামীণ ক্ষেত্রে এবং ১৭,১০৪টি শহরাঞ্চলে। সেই সমীক্ষা থেকে জানা যায়, রাজ্যের ৮০ শতাংশ মুসলিম ঘরের মাসিক আয় ৫০০০ বা তার থেকে কিছু কম। যা পাঁচ জনের পরিবারের জন্য দারিদ্র‍্যসীমার আয়ের স্তরের কাছাকাছি। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, পশ্চিমবঙ্গে ৩৮.৩ শতাংশ মুসলিম পরিবারের‌ মাসিক আয় ২৫০০ বা তার কিছু কম। অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মুসলিম পরিবারগুলির মধ্যে মাত্র ২৩.৫ শতাংশ পরিবারের কাছে চাষযোগ্য জমি রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য বাম আমলের বর্গা অপারেশনের পরেও কৃষির সাথে যুক্ত মুসলিম পরিবারগুলির চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়েনি।

 

২০১৫-১৬ তে অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন একটি রিপোর্ট পেশ করে, যেখানে তারা বলেন যে দেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কম। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি,খড়্গপুর, ওয়েস্ট বেঙ্গল  ইউনিভার্সিটি অব টিচার্স ট্রেনিং, এডুকেশন প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়—এ অত্যন্ত কম সংখ্যক মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের দেখা মিলছে। অন্যদিকে অ্যামিটির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-এও মাত্র ১,১৪০ জন মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীকে পাওয়া যায়। কিন্তু আবার সেই একই বছর আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বর্ধমানে ভর্তি হয় ৬,৬৫৬ জন মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী।

 

উপরে দেওয়া এই তথ্য আমাদের সামনে রাজ্যে উচ্চশিক্ষায় মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণের দুরবস্থার ছবি, মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি সরকারগুলির অবহেলার ছবি যেমন সামনে আনে সাথে সাথে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বও খানিক টের পাইয়ে দেয়। ২০১৫-১৬ রিপোর্টে যখন স্পষ্ট দেখা মিলছে যে, রাজ্যের পরিচিত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায় একপ্রকার নেই-ই, সেখানে একমাত্র আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বড় অংশের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক মহম্মদ রিয়াজ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিন্হিত করেন। তিনি বলেন, বাংলায় মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় অংশ গ্রাম থেকে আসে উচ্চশিক্ষা এগিয়ে নিয়ে যেতে। মূলত মালদা, মুর্শিদাবাদ‌ থেকে। তাঁর মতে, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় না-থাকলে এই সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর জন্য লেখাপড়া করা অসম্ভব হয়ে যেত। এরা প্রত্যেকেই মাদ্রাসা বোর্ডের ছাত্র এবং এদের সেই আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই যার ওপর ভর করে তারা বেসরকারি কলেজে যাবে। এখানে তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন, রাজ্যে একটা বড় অংশের মুসলিম ছাত্রকে দেখা যায় স্কুল-কলেজ ছেড়ে বিভিন্ন রাজ্যে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে যেতে। ২০১৯ এ প্রকাশিত এমএইচআরডির তথ্য বলছে, এ রাজ্যে ২১ শতাংশ মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী ড্রপআউট হয়। তাই এ পরিস্থিতিতেও যারা উচ্চশিক্ষা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তাঁদের শেষ আশ্রয় হয় আলিয়া।

 

অধ্যাপক রিয়াজের বক্তব্য থেকে এ বিষয় স্পষ্ট যে, এই মুহূর্তে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী সমাজের কাছে এই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সরকারের এই লাগাতার অবহেলা, মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উস্কে দেয়। আলিয়ার আন্দোলনরত ছাত্র সাজিদুর জানায়, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলন চালানোর পরেও কর্তৃপক্ষের দিক থেকে এবং মাইনরিটি বোর্ডের দিক থেকে কোনোরকম লিখিত আশ্বাস পায় না। উপরন্তু কলেজে তাঁদের উপর শাসক দল ঘনিষ্ঠ গুন্ডারা উইকেট হাতে চড়াও হয়। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। এই আন্দোলন, এক সুদীর্ঘ সময় জুড়ে চলা সত্ত্বেও মূলধারার সংবাদমাধ্যামগুলিকে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করতে দেখা যাচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমগুলির এই নীরবতা অনান্য পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলির আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখা যায় না, তবে এ ক্ষেত্রে তাদের এই ভূমিকা আরও কিছু জটিল সংশয়ের জন্ম দেয়। বৃহত্তর ছাত্র সমাজেও এর কোনও অনুরণন দেখা যাচ্ছে না।

 

আলিয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে চলা এই সমস্ত ঘটনা আগামী দিন নিয়ে মনে যেমন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনই এ রাজ্যে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা আরও খানিকটা বাড়িয়ে তোলে।

 

তথ্যসূত্র:
১) https://www.aliah.ac.in/history-of-aliah-university
২) https://www.populationu.com/in/west-bengal-population
৩) https://www.thehindu.com/news/cities/kolkata/bengal-governor-says-muslim-education-faces-tests-in-bengal/article8292959.ece
৪) Behind Under-representation of Muslims in higher education, A case study of West Bengal, Partha Sarathi Banerjee, Page 4.
৫) https://www.thehindu.com/news/national/enrolment-of-muslims-in-bengal-varsities-abysmally-low-says-survey/article19265509.ece

 

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

Share this
Leave a Comment