বনাধিকার আইন ও পশ্চিমবঙ্গ


  • December 17, 2021
  • (0 Comments)
  • 4278 Views

উত্তরবঙ্গের বক্সা টাইগার রিজার্ভ বা বাঘবনে অবশেষে বাঘ দেখা গিয়েছে। সংবাদমাধ্যম বলছে, ২৩ বছর পর দেখা দিলেন বাঘমামা। অথচ, এ জঙ্গল একদিন তার স্বাভাবিক আবাস ছিল। কেন এতকাল বাঘের দেখা মেলেনি তা নিয়ে নানা মুনির নানা তত্ত্ব রয়েছে। তার অন্যতম যে, বাণিজ্যিক লোভে এই বাঘবনের চরিত্রই বদল করে ফেলা হয়েছে। স্বাভাবিক অরণ্য নিধন করে গড়ে তোলা হয়েছে শাল-সেগুনের অরণ্য। কেটে বিক্রি করা হবে বলে। বড় বড়, বিস্তৃত ঘাসের জমি লোপাট হয়ে গিয়েছে যা বাঘের তো বটেই তার প্রধান আহার্য তৃণভোজী প্রাণীদের চারণভূমি। এর জন্য অবশ্য ভয়াবহ পাহাড়ি বন্যায় নেমে আসা বালি-পাথরও দায়ী। তো যে কথা বলার বাঘ দেখার খবরের সঙ্গে সঙ্গে বাঘবন ও রাজ্য বনদপ্তর, বনমন্ত্রীদের মুখে শোনা যাচ্ছে অন্তত ১৫টি বনগ্রাম উচ্ছেদের কথাও। যদিও তাঁরা উচ্ছেদ বলেন না। বলেন ‘স্থানান্তরকরণ’। বাঘবনে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়েছে জঙ্গল সাফারি। অর্থাৎ, এই শীতের পর্যটনের বাজারে কেড়ে নেওয়া হল বহু মানুষের রুটি-রুজি। বাঘ আছে বলেই, বন্যপ্রাণী আছে বলেই তো জঙ্গলে পর্যটকরা আসেন, সাফারি হয়। বন্ধ হবে কেন? শুধু কি তাই সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, পানিঝোরা, পাম্পু বস্তিতে গিয়ে বনকর্তারা গ্রাম সরানোর মানে উচ্ছেদের গল্প শোনাতে শুরু করেছেন। যা তাঁরা পারেন না। না, পারেন না। বনাধিকার আইন, ২০০৬ তাঁদের সেই ইচ্ছেমাফিক উচ্ছেদের ঔপনিবেশিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বনগ্রামবাসীরা গ্রাম ছাড়বেন কিনা, ছাড়লে কোন শর্তে ছাড়বেন তা স্থির করবে বনবাসীদের গ্রামসভা। এটাই আইন। 

 

এর মধ্যেই এসে গেল বনাধিকার আইন দিবস। ১৮ ডিসেম্বর। ২০০৬ সালেই এই দিন সংসদে এই ঐতিহাসিক বনাধিকার আইন পাশ হয়েছিল। ১৮ ডিসেম্বর বক্সার রাজাভাতখাওয়ায় ‘বনগ্রামবাসী দিবস’ পালন করছে উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চ। এই উপলক্ষ্যে বনাধিকার আইন কী ও কেন এবং এই আইন রূপায়ণে রাজ্য সরকারের ভূমিকা বিষয়ে লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ। আজ প্রথম কিস্তি। 

 

প্রাককথনঃ অরণ্যের অধিকারের লড়াই বনাম সরকারী পাট্টা

 

কিছুকাল আগে, উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকার চিলাপাতা বনাঞ্চলে, কোদাল বস্তি বনগ্রামের বাসিন্দারা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে গ্রাম-সংলগ্ন বনের ওপর তাঁদের অধিকারের কথা ঘোষণা করেন। সাইনবোর্ডের লেখা এবং ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত গ্রামবাসীদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই অধিকার “বনবাসী তফসিলি জনজাতি এবং অন্য পারম্পরিক বনবাসীদের বনাধিকার স্বীকার আইন, ২০০৬” (সংক্ষেপে, বনাধিকার আইন) অনুযায়ী তাঁদের প্রাপ্য। ঘটনাটি সংবাদমাধ্যম মারফত সাধারণ্যে পৌঁছায় এইভাবে যে গ্রামবাসীরা ‘সংরক্ষিত সরকারি’ জঙ্গল দখল করেছেন, এমনকি কোথাও এমন কথাও লেখা হয় যে দখল করা জঙ্গল গ্রামের লোক নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেবেন। এই অভিযোগ সমর্থিত হয় ওই এলাকার বনাধিকারিকদের বক্তব্যে, যাঁরা ঘটনাটিকে বেআইনি চক্রান্ত বলে আখ্যা দিয়ে হাসিমারা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন, বনবিভাগ এবং পুলিশের লোকজন গ্রামবাসীদের টাঙানো চারটি সাইনবোর্ডের মধ্যে দুটি খুলে নিয়ে যান। পরে হাসিমারা থানা সুত্রে জানা যায় ওগুলি নাকি ‘বাজেয়াপ্ত’ হয়েছে। এর পরের দিন, কোদাল বস্তি গ্রামসভার পক্ষ থেকে বনবিভাগের বিরুদ্ধে পালটা এক অভিযোগ দায়ের করা হয়।

 

কোদাল বস্তির ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক। এই রাজ্যের আর কোথাও বনবাসী মানুষ বনাধিকার আইন অনু্যায়ী অরণ্যের অধিকার প্রকাশ্যে ঘোষণা করার এরকম উদ্যোগ আগে নেননি, সম্ভবত গোটা দেশেও তুলনীয় কিছু ঘটেনি। উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলের বিভিন্ন বনখণ্ডে অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই বনগ্রামের বাসিন্দারা বনাধিকার আইনে লিখিত অধিকারগুলি দাবি করে আসছেন। বিশেষত কোচবিহার বন-এলাকার চিলাপাতা অরণ্যে, ১২টি গ্রামের গ্রামবাসীরা আলাদা আলাদা গ্রামসভা বানিয়ে, লিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করেন, অরণ্য সম্পদের উপর তাঁদের কর্তৃত্ব ঘোষণা করেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরকে ২০০৮-এর সেপ্টেম্বরে চিঠি লিখে তাঁরা যৌথভাবে জানান, গ্রামসভার সম্মতি ছাড়া এলাকার বনাঞ্চল থেকে কাঠ বা অন্য বনজ সম্পদ আহরণ বা বিক্রি করা যাবে না। বনবিভাগের নিত্যকার বন-সাফাই বা ক্লিয়ার ফেলিং-এর কাজও এর পর বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে, ২০০৮-এর এপ্রিলে, কার্সিয়াং বন এলাকার তাইপুতে সরকারি কাঠের ডিপোটি প্রায় তিন মাস বন্ধ রাখেন এলাকার বনগ্রামবাসীরা। প্রায় দু’মাস বন্ধ থাকে কোদাল বস্তির কাঠের ডিপোটিও।

 

পরপর এইসব ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগ যারপরনাই ক্ষুব্ধ, বিভিন্ন সভা ইত্যাদিতে এবং সংবাদমাধ্যমকে তাঁরা বারংবার জানাচ্ছেন, বনাধিকার আইনের প্রকৃত রূপায়নকারী তাঁরাই,নানান জায়গায় তাঁরা আদিবাসীদের ‘পাট্টা’ দিচ্ছেন, এবং কিছু কুচক্রী, সরল-গ্রামবাসীদের-বিভ্রান্ত-করনেওয়ালা ‘শক্তি’ যদি মধ্যিখান থেকে বাগড়া না দিত, কবে আরো অনেক ‘পাট্টা’ ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলা যেত। বনবিভাগের আমলারা এবং সরকারের বনমন্ত্রী ও অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ মন্ত্রী নিয়ম করে এই ‘শক্তি’দের গাল পাড়ছেন। যেহেতু বিষয়টি নিতান্তই ‘আইনি’, এবং যে কোনও আইন বিষয়ে সাধারণ মানুষ মাথা ঘামান কম,বনাধিকার আইন এবং তার প্রয়োগ নিয়ে প্রকৃতই নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

 

এ কারণে অবশ্য সরকারি পাট্টা বিলির অনুষ্ঠান বন্ধ হয়নি। জেলায় জেলায় ঘুরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পাট্টা বিলি করে যাচ্ছেন। ২০১০-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, পশ্চিমবঙ্গে বনাধিকার আইন মোতাবেক পাট্টা দেওয়া হয়েছে তফসিলি জনজাতিভুক্ত ২২,০০০ পরিবারকে। এই সময় পর্যন্ত সরকারি হিসাব অনু্যায়ী দাবিপত্র জমা পড়েছে মোট ১,৪২,৭৮৩। লক্ষ্যণীয়, ২০০৯-এর জুলাই-এ এই সংখ্যাটি ছিল ১২০০০০, পাট্টাপ্রাপকের সংখ্যা ছিল ৫০৪৯। এখনো পর্যন্ত কোনো অন্য পারম্পরিক বনবাসীকে পাট্টা দেওয়া হয়নি।

 

এই আইনের প্রতিপাদ্য কী? কীভাবেই বা এই আইনের প্রয়োগ করছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার? হইচই করে পাট্টা বিতরণের পিছনের গল্পটাই বা কী? নিজেদের অধিকার অর্জনের জন্য আইনটিকে কীভাবে ব্যবহার করবেন আদিবাসী-অরণ্যবাসী মানুষ?

 

বনাধিকার আইন, ২০০৬: আইনে যা বলা আছে 

 

প্রস্তাবনা
১৮ ডিসেম্বর,২০০৬ তারিখে ভারতের সংসদে ঐতিহাসিক “বনাধিকার আইন” পাশ হয়। “বনবাসী তফসিলি জনজাতি এবং অন্য পারম্পরিক বনবাসীদের বনাধিকার স্বীকার আইন, ২০০৬” নামের নতুন এই আইনটি নিয়মমাফিক বিজ্ঞাপিত হয় ২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর। অর্থাৎ ওই দিন থেকেই আইনটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। আইনের মূল ধারাগুলি খুঁটিয়ে দেখার আগে প্রস্তাবনা থেকে শুরু করা যাক।

 

আইনটির নাম থেকেই বোঝা যায় যে রাষ্ট্র ও সরকার মেনে নিচ্ছেন যে অরণ্যবাসী মানুষদের বিভিন্ন অধিকার আছে, এবং এই অধিকারগুলিকে স্বীকার করা প্রয়োজন। আইন চায় এই অধিকারগুলিকে স্বীকার করতে, এবং যাতে অরণ্যবাসী মানুষেরা এগুলি অর্জন করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে।

 

প্রস্তাবনায় আছে, “সমস্ত অরণ্যবাসী মানুষের স্বীকৃত অধিকারগুলির মধ্যে আছে, বনসম্পদের ও জীববৈচিত্রের যথাযথ দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের ও সংরক্ষণের, এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার, দায়িত্ব ও ক্ষমতা। এইভাবে, অরণ্যবাসী মানুষের জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করে, বন সংরক্ষণের সমগ্র প্রক্রিয়াটিকেই আরো শক্তিশালী করে তোলা যাবে।”

 

স্পষ্টত, আইন বলছে যে বনবাসীদের স্বীকৃত অধিকারের মধ্যে বন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণও থাকছে, এবং মানুষের অংশগ্রহনের ফলে সংরক্ষণের কাজ আরো ভালোভাবে চলবে। আইন বলছে মানুষের “দায়িত্ব” ও “কর্তৃত্বের ক্ষমতা”র কথা, যার অর্থই হলো বনবাসীরা এখন সংরক্ষণের কাজে, এবং নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।     

 

প্রস্তাবনায় স্বীকার করা হয়েছে, “যে সব বনবাসী মানুষের অস্তিত্ব বনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, যাঁদের ছাড়া বন এবং বনভূমির দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ সম্ভব নয়, নিজেদের আদি বাসভূমি ও বাসস্থানের অরণ্যে তাঁদের অধিকারগুলি ঔপনিবেশিক সময় থেকেই ঠিকমতো স্বীকার করা হয়নি। এমনকি স্বাধীন ভারতবর্ষেও এই অধিকারগুলি স্বীকৃতি পায় না, এবং এর ফলে বনবাসী মানুষদের প্রতি এক ঐতিহাসিক অন্যায় সঙ্ঘটিত হতে থাকে।”

 

বিষয়টি পরিষ্কার। আইন বলছে যে ঔপনিবেশিক সময় থেকে আজ পর্যন্ত, যাবতীয় সরকারগুলি অরণ্যবাসীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারগুলিকে নথিবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং এর ফলে যে শুধু এই মানুষেরাই বিপন্ন হয়েছেন তাই নয়, বিপন্ন হয়ে পড়েছে অরণ্যও। বনবাসী মানুষ যদি না ভালো থাকেন, বনও ভাল থাকতে পারে না।

 

প্রস্তাবনায় আরো বলা আছে, সরকারি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ফলে উচ্ছেদ হয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন এমন মানুষ-সহ অরণ্যবাসী সমস্ত মানুষের বাসভূমির নিরাপত্তার অভাব, এবং বনসম্পদের উপর তাঁদের অধিকারের সমস্যাগুলি দূর করা একান্তই  দরকার হয়ে পড়েছে।”

 

এ অবধি নিশ্চয় কোনো বিভ্রান্তি নেই। অতঃপর আইনের কিছু মূল ধারায় আসা যাক।

 

বনাধিকার আইন : বনজ সম্পদের উপর অধিকার

 

আইনের ২-এর(ক) ধারা অনুযায়ী, বনবাসী মানুষের ব্যবহৃত জঙ্গল এখন গ্রামসভার সাধারণ সম্পত্তি বা কমিউনিটি ফরেষ্ট রিসোর্স। এই জঙ্গল এবং অন্য যে কোনো জঙ্গলের জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, ঘাস, ফলমূল, ভেষজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য লতাপাতা সহ সব ধরণের অকাষ্ঠল বনজ সম্পদের বা এনটিএফপি (নন-টিম্বার ফরেষ্ট প্রোডিউস)-র মালিকানা (ধারা ৩-এর গ) গ্রামের মানুষের। এছাড়াও জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য সহ সব ধরনের জঙ্গলের এনটিএফপি সংগ্রহ, পশুচারণ ও মাছ ধরার অধিকার (৩-এর ‘ঘ’) পাচ্ছেন অরণ্যবাসী মানুষ। যদিও বনজ সম্পদ ব্যক্তিগত ভাবে সংগ্রহ করা যাবে, মাছ ধরা ও চারণের অধিকার সাধারণের, অর্থাৎ গ্রামসভার অনুমতিক্রমে চারণ করা এবং মাছ ধরা যেতে পারে। বনসম্পদের ‘মালিকানার’ বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার। যে কোনো গ্রামসভার আওতাভুক্ত বনাধিকারভোগীরা যদি যৌথ ও ব্যক্তিগতভাবে এই সম্পদের ‘মালিক’ হন, বনবিভাগ বা সরকারের সেখানে আদৌ কোনো হক থাকে না।

 

৩ এর (খ) উপধারায় বলা আছে, পুরোনো জমিদারি বা রাজকীয় জঙ্গলে নিস্তার বা অন্যান্য যে সব গোষ্ঠী-অধিকার ছিল, তা আবার এই আইন মারফত দাবি করা যাবে। যথা, পুরুলিয়ার মাঠা অঞ্চলে (এবং অন্যত্র) গ্রামবাসীদের অরণ্যের কাঠে লিখিত অধিকার ছিল। এছাড়াও, অরণ্যে তসর বা লাক্ষা চাষেরও অধিকার ছিল। সরকারি দস্তাবেজ এবং জমিদারি খতিয়ানে এ জাতীয় অজস্র অধিকারের উল্লেখ আছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নেহাত গা-জোয়ারি করেই, এই সব অধিকার শেষ করে দেওয়া হয়।

 

 

বনাধিকার আইন : বাস্তু, কৃষি ও গ্রামভূমির উপর অধিকার

 

যদিও বনবিভাগ এবং রাজ্য সরকারি মন্ত্রীরা বনবাসীদের ‘পাট্টা’ ইত্যাদি দিচ্ছেন, আইনে পাট্টা দেবার কথা কোথাও নেই। বলা হয়েছে (ধারা ৩-এর ক), ১৩ ডিসেম্বর, ২০০৫ অবধি বনাঞ্চলে বসবাস করতে আসা ও কৃষিকাজে লিপ্ত মানুষদের পরিবার পিছু ৪ হেক্টর পর্যন্ত জমি থাকতে পারে। এ কথা যে সব মানুষেরা বনভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস বা চাষাবাদ করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সরকার তাঁদের বসবাসের জমি এবং কৃষিজমির দখলাধিকার (possession) স্বীকার করে শংসাপত্র বা সার্টিফিকেট দেবেন, যেখানে জমির পরিমাণ উল্লেখিত থাকবে। এই দখলপত্র কোনোমতেই জমির ‘পাট্টা’ না। জমির মূল আইনি মালিক কার্যত বনবিভাগই থেকে যাচ্ছেন।

 

টুকরো-টুকরো বাস্তু বা কৃষিজমির ক্ষেত্রে দখলপত্র দেওয়া হবে। যেখানে গোটা গ্রাম বা বাজার বনভূমিতে বসে আছে, তার কী হবে? আইনানুযায়ী, বনগ্রাম, টঙিয়া বস্তি, এফডি হোল্ডিং সহ বনাঞ্চলে অবস্থিত সব ধরণের গ্রামের (যাবতীয় অনথিভুক্ত ও অসমীক্ষিত গ্রাম সহ, অর্থাৎ যে গ্রাম সম্পর্কে কোনো সরকারি তথ্য নেই, সে গ্রামও আইনের আওতায় আসবে) রাজস্ব গ্রামে রূপান্তর এখন একটি অধিকার। আইনমাফিক বিজ্ঞপ্তি জারি করে, রাজ্য সরকার স্বচ্ছন্দে পারেন বনভূমিতে অবস্থিত সব ক’টি গ্রামকে রাজস্ব গ্রামে পরিণত করতে। যতক্ষন না একটি বনবস্তিকে (বা বনভূমিতে স্থিত যে কোনো গ্রামকে) আইনের (৩জ/3h) অনু্যায়ী  রাজস্বগ্রামে পরিবর্তন করা হচ্ছে, এবং ওই বস্তির বনভূমিকে ‘খাস’ জমিতে পরিণত না করা হচ্ছে, ততক্ষণ সেই ভূমিতে মালিকানা অধিকার সহ কাউকে পাট্টা দেওয়া যায় না। বনবস্তিকে ‘খাস’ করে রাজস্বগ্রামে পরিণত না করে বিক্ষিপ্ত দখলপত্র বিলি করার অর্থ এই যে বনবস্তিগুলি যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকে, বস্তির খেলার মাঠ, রাস্তা, ধর্মীয় স্থান এমনকি বস্তিবাসীদের বসবাসের জায়গার উপরেও বনদপ্তরের কর্তৃত্ব থেকেই যায়।

 

বনাধিকার আইনঃ বন সংরক্ষণের এবং পরিচালনার অধিকার

 

প্রস্তাবনায় কী বলা হয়েছে আগেই দেখেছি। আইনে দুটি জায়গায় এবিষয়ে নির্দিষ্ট বিধান আছে। ৩-এর(ঝ) এবং ৫-এর ১, ২, ৩ ও ৪ ধারা অনু্যায়ী, গ্রামসভাকে এলাকার বনাঞ্চলের সম্পূর্ণ পরিচালন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৩-এর (ঝ) ধারা অনুযায়ী, গ্রামসভা এখন যে কোনো সাধারন বন বা কমিউনিটি ফরেষ্ট রিসোর্সকে রক্ষা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে পারবে। ৫-এর ১/২/৩/৪-এ বলা আছে গ্রামসভা এবং বনাধিকারভোগীরা যে কোনো বনকে উপযুক্তভাবে সংরক্ষণ (বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ) করার প্রয়োজনে যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। বনধ্বংস করতে পারে, বা গ্রামসভার সদস্যদের প্রাকৃতিক ও সাংষ্কৃতিক উত্তরাধিকারকে নষ্ট করতে পারে এমন যে কোনো কাজ ঠেকানোর ক্ষমতাও গ্রামসভাকে দেওয়া হয়েছে।

 

এখানে মনে করা ভাল, কোদাল বস্তি গ্রামসভা আইনের উপরোক্ত বিধান অনু্যায়ী সাইনবোর্ড টাঙিয়েছিলে। প্রয়োজন মনে করলে এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, গ্রামসভা এই কাজ (বা অন্য যে কোনো কাজ, যথা জঙ্গলে ঢোকার মুখে পাহারাদারি চৌকি বসানো, জঙ্গলে কাঠকাটা বন্ধ করা) আবার করতেই পারেন। আইনে কোথাও বলা নেই, এর জন্য গ্রামসভাকে সরকারের কী পুলিশের কাছ থেকে সম্মতি নিতে হবে। অতএব ঠিক কোন আইনে বনবিভাগ এবং পুলিশ এই কাজকে বেআইনি ঠাউরেছেন, তা তাঁরাই জানেন। যাঁরা সাইনবোর্ড খুলে এবং ‘বাজেয়াপ্ত’ করে আইন রূপায়ণের কাজে বাধা দিয়েছেন, বনাধিকার আইনের ৭ নং ধারা অনুযায়ী, কেন তাঁদের জরিমানা করা হবে না, তারও কোনো উত্তর নেই।

 

বনাধিকার আইন রূপায়ণ : গ্রামসভা কী এবং তা কী করবে   

 

বনাধিকার আইন অনু্যায়ী, এই আইন রূপায়ণের মূল দায়িত্ব গ্রামের মানুষের।

 

গ্রাম কী? 

বনাধিকার আইনের ২-এর (ত)-ধারার ৩ নং উপধারায় বলা আছে বনভূমিতে স্থিত যে কোনো গ্রামই ‘গ্রাম’, অর্থাৎ গ্রামের মানুষ যে এলাকাটিকে গ্রাম বলে মানেন তাই-ই গ্রাম, সরকার তাকে গ্রাম বলে মানুন না-মানুন। রাজ্য সরকারের আইনে গ্রামের অন্য কোনো ব্যাখ্যা থাকলে তা-ও গ্রাহ্য হবে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা একমাত্র ব্যাখ্যা হিসাবে ধরা যাবে না, গ্রামের মানুষের ধারণা অনু্যায়ী ‘গ্রাম’ নির্ধারিত হবে।

 

গ্রামসভা কী?

একটি গ্রামের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক বাসিন্দারা গ্রামসভা (বাসিন্দারা একসঙ্গে বসলেই গ্রামসভা) গঠন করবেন। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে সভায় অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতি থাকতে হবে।

 

গ্রামসভার দায়িত্ব

প্রত্যেক গ্রামসভা নিজের নিজের গ্রামে বনাধিকার আইনে উল্লেখিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তি অধিকার (যা ধারা ৩ অনু্যায়ী স্বীকার্য) তা গণ-শুনানির মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করবেন, এবং মানচিত্র সাক্ষ্যপ্রমাণাদি সহ প্রস্তাবাকারে তা সংশ্লিষ্ট মহকুমা শাসকের কাছে জমা করবেন। ব্যক্তি-অধিকারে থাকা বাস্তু ও কৃষিজমি এবং গোষ্ঠী-অধিকারে থাকা গ্রামের অন্যান্য ভূমি, যথা খেলার মাঠ, রাস্তা, বিদ্যালয়, ধর্মীয় স্থান এই সকল ক্ষেত্রেই মানচিত্র বানানো দরকার। সাধারণ বন বা কমিউনিটি ফরেস্ট রিসোর্স-এর ক্ষেত্রেও মানচিত্র লাগবে। মানচিত্র বানানোয় সরকার গ্রামসভাকে সাহায্য করবেন।

 

বনাধিকার কমিটি কী?

উপরোক্ত কাজ করার জন্য প্রত্যেক গ্রামসভা এক বনাধিকার কমিটি (Forest Rights Committee বা FRC) গঠন করবেন। আইনানুযায়ী, গ্রামসভার সদস্যদের মধ্য থেকে ১৫জনের বনাধিকার কমিটি নির্বাচিত হবে। এই কমিটি অধিকার-প্রস্তাব তৈরি করে গ্রামসভার কাছে জমা করবেন। প্রস্তাবের সঙ্গে যথাযথভাবে ভর্তি করা ব্যক্তি-অধিকারের জন্য নির্দিষ্ট দাবিপত্র ‘ক’ ও গোষ্ঠী-অধিকারের জন্য দাবীপত্র ‘খ’ থাকা দরকার।

 

দাবিপত্র কী? তা কীভাবে ভর্তি করতে হবে?

ধারা ৩-এ উল্লেখিত যাবতীয় অধিকারের স্বীকৃতির জন্য অধিকারভোগী আদিবাসী-অরণ্যবাসী মানুষদের নিজের নিজের গ্রামসভার এবং বনাধিকার কমিটির মাধ্যমে নির্দিষ্ট দাবীপত্র জমা দিতে হবে। বনাধিকার কমিটি এই দাবীপত্র ভর্তি করতে সাহায্য করবেন। প্রত্যেক ব্যক্তি ‘ক’ পত্র জমা দিয়ে নিজের কৃষিজমির ও বাস্তুজমির পরিমাণ এবং বনজ সম্পদের উপর কোনো দাবী থাকলে তা(ধরা যাক, বছরে কোনো অধিকারভোগী পরিবার জঙ্গল থেকে এক নির্দিষ্ট পরিমাণ সালপাতা, কেঁন্দুপাতা বা অন্যান্য ফল, বীজ ইত্যাদি সংগ্রহ করেন — সংগৃহীত জিনিসের নাম ও পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে) জানাবেন।

 

‘খ’ পত্রের মাধ্যমে একটি গ্রামের যাবতীয় গোষ্ঠী-অধিকারের দাবী করতে হবে। একটি গ্রামের জন্য একটিই গোষ্ঠী-দাবীপত্র জমা পড়বে। দরকার মতো অতিরিক্ত পাতা ব্যবহার করতে হবে। গোষ্ঠী-দাবীপত্রকে প্রথমে বনাধিকার কমিটি ও পরে গ্রামসভা অনুমোদন করবেন।

 

দাবীপত্রের সঙ্গে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে হবে।

 

সাক্ষ্যপ্রমাণ কী?

ব্যক্তি/গোষ্ঠী অধিকারের জন্য নানাবিধ সম্ভাব্য সাক্ষ্যপ্রমাণের কথা আইনের নিয়মাবলীর ১৩ ধারায় বলা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ভোটার পরিচয়পত্র, রেশন কার্ড, খাজনা দলিল বা অন্য যে কোনো সরকারি বা আধা-সরকারি দলিল বা দস্তাবেজ, যা থেকে বোঝা যায় দাবিদার কোন অঞ্চলের বাসিন্দা।

 

বিভিন্ন সরকাররি, আধা-সরকারি দলিল, মামলার কাগজপত্র, গবেষণাকর্ম ইত্যাদিও প্রমাণ হিসাবে গণ্য।

 

কোনো কাগজপত্র না থাকলে, জমিতে বসবাস বা জমি-ব্যবহারের অন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখাতে হবে, যথা জমিতে ঘরবাড়ি, সেচ ব্যবস্থা, কুয়ো, আল, সমাধিক্ষেত্র/শ্মশান,দেবস্থান ইত্যাদি।

 

গ্রামের কোনো বয়ষ্ক মানুষের মুখের কথা লিখে নিলে তাও প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য হবে।

 

অরণ্যের উপর গোষ্ঠী-অধিকারের প্রমাণ হিসাবে অরণ্য এলাকা ব্যবহারের যে কোনো প্রত্যক্ষ চিহ্ন গ্রাহ্য হবে, যথা নিয়মিতভাবে সংগৃহীত হয় এমন বনজ সম্পদ যেখানে আছে সে জাতীয় এলাকা (ধরা যাক, কোনো এলাকায় প্রচুর বন্য আলু বা অন্য যে কোনো ভেষজ উদ্ভিদ পাওয়া যায়)। এছাড়া, গোচারণক্ষেত্র বা মাছ ধরার জায়গা, দেবস্থান, সমাধিক্ষেত্র, সেচব্যবস্থা, বসতি কি চাষের চিহ্ন — এ সবই প্রমাণ হিসাবে গণ্য হবে।

 

মোট যে কোনো দু-ধরনের প্রমাণ দিতে হবে।

 

দাবীদার কারা হবেন? অধিকারভোগী কে?     

অরন্যে বসবাসকারী সমস্ত মানুষ বনাধিকারের দাবীদার হতে পারেন। জীবিকার প্রয়োজনে দিনের একটা নির্দিষ্ট অংশ যাঁদের বনের মধ্যে কাটাতে হয়, তাঁরাই “অরণ্যে বসবাসকারী” হিসাবে গণ্য হবেন। তফশিলী জনজাতিভুক্ত মানুষ, যাঁরা ২০০৫-এর ১৩ই আগষ্টের আগে অরণ্যে বসবাসের প্রয়োজনে এসেছেন, তাঁরা অধিকারভোগী হিসাবে গণ্য হবেন। তফশিলী জনজাতিভুক্ত নন এমন মানুষদের অরণ্য এলাকায় তিন পুরুষ বা ৭৫ বছর ধরে বসবাসের প্রমাণ দিতে হবে। লক্ষ্যণীয়, বলা হয়েছে “অরণ্য এলাকা”, যে জমি বা অরণ্যের দাবী করা হচ্ছে, নির্দিষ্টভাবে সেখানে বসবাসের কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ কোনো পরিবার যদি অরণ্যের যে কোনো অংশে ধারাবাহিকভাবে বসবাস করে আছেন, তাঁরা দাবী করতে পারবেন। গ্রামের বয়ষ্ক মানুষদের কথা এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসাবে গণ্য হবে।

 

গ্রামসভা-মহকুমা স্তরীয়-জেলা স্তরীয় কমিটি 

বনাধিকার কমিটির প্রস্তাব গ্রামসভা বিবেচনা করে অনুমোদন করলেই তা মহকুমা-স্তরীয় কমিটিতে পাঠানো যাবে। মহকুমা-স্তরীয় ও জেলা-স্তরীয় কমিটিতে (সেখানে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রতিনিধি ও পঞ্চায়েত রাজের প্রতিনিধিরা থাকবেন) গ্রামসভার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে এবং কোনো দাবির বিরুদ্ধে কারো কোনো নির্দিষ্ট বক্তব্য থাকলে, মহকুমা কমিটি তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রামসভার কাছে ফেরত পাঠাবেন। গ্রামসভা জমা দিয়েছেন এমন কোনো দাবি, গ্রামসভাকে না-জানিয়ে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা মহকুমা বা জেলা স্তরের কমিটির নেই। আইনের নিয়মাবলির ১১ ও ১২ নং ধারায় বিস্তারিত ভাবে গ্রামসভার দায়িত্ব এবং ক্ষমতার কথা বলা আছে।

 

লেখক উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চের অন্যতম কর্মী।

 

Share this
Leave a Comment