দেওচা-পাচামি প্রকল্প বন্ধের ডাক দিলেন রাজ্যের বিশিষ্টজনেরা


  • December 14, 2021
  • (5 Comments)
  • 2903 Views
  • দেওচা-পাচামিতে ওই অঞ্চলের কোনো গ্রামবাসীকে  কোনোভাবেই উচ্ছেদ করা চলবে না।   
  • জীবাশ্ম জ্বালানি আর নয়। আর নয় কার্বন।
  • খোলামুখ হোক বা বন্ধমুখ—পরিবেশ দূষণকারী কয়লাখনি চাই না। দেওচা-পাচামি প্রকল্প বন্ধ হোক। 

 

এমনই আট দফা দাবি তুললেন রাজ্যের বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, বিশিষ্ট নাগরিকরা। একইসঙ্গে তাঁদের অঙ্গীকার “…এই পৃথিবী, তার পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই পরিবেশ-সংবেদী জীবন যাপনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ” গ্রহণ করবেন তাঁরা। গ্রাউন্ডজিরো রাজ্যের বিশিষ্টজনদের এই আবেদনটি হুবহু প্রকাশ করল।

 

#দেওচা-পাচামি: পরিবেশ ও জীবন বিরোধী প্রকল্প বন্ধ হোক

#ReisistDeuchaPachamiCoalMineProjet

 

উন্নয়ন তথা বিকাশের অর্থ যদি হয় পরিবেশ দূষণ এবং হাজার হাজার মানুষের উচ্ছেদ, তাহলে প্রথম যে প্রশ্ন আসে তা হল, এই উন্নয়ন কার স্বার্থে? বীরভূম জেলার দেওচা-পাচামিতে আদিবাসী ও মূলবাসীদের জমি দখল করে রাজ্য সরকার কয়লা তুলতে চাইছে, বৃহৎ শিল্পের স্বপ্ন ফেরি করা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী দিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ চাকরির প্রতিশ্রুতি। আদতে তা স্থানীয় মানুষের কোন্ উপকারে লাগবে? সারা বিশ্ব যখন জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে পথে নেমেছে, তখন নতুন করে ‘মৃত্যুদূত’-কে আবাহন করা, কার স্বার্থে? দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, সরকার জনগণের জীবনের মানোন্নয়নের নাম করে যে সমস্ত প্রকল্প গ্রহণ করে, সেখানে জনগণ পায় শুধুমাত্র বাইরের খোসা। এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর আসল শাঁস খেয়ে পুষ্ট হয় বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠী। দেওচা-পাচামিও ব্যতিক্রম নয়। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের ৩৪০০ একর এলাকা জুড়ে এই কয়লা ব্লক। যার পরিমাণ বলা হচ্ছে ২.২ বিলিয়ন টন। প্রথমে ইস্টার্ন কোলফিল্ডকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু তারা কোনো উদ্যোগ নেয় না। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ-সহ ছয়টি রাজ্যকে এই ব্লকটি নেবার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। মূলত তা লাভজনক নয় বলেই। অবশেষে ২০১৮ তে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে এই খনি দেয়।

 

ইতিমধ্যেই বীরভূমের এই  অঞ্চল পাথর খাদানের দূষণে দূষিত। পাথর খাদান তাঁদের জীবনে কোনো আর্থিক উন্নতি ঘটায়নি। উপরন্তু ক্ষতি করেছে তাঁদের চাষবাস, তাঁদের সমাজ ও সংস্কৃতির। খনিজ ছাড় সুবিধা আইন, ১৯৬০ এবং খনিজ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আইন ১৯৮৮-র ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুসারে খাদান বুজিয়ে ফেলা সংক্রান্ত বিধি এখনও অবধি দেওচা-পাচামিতে মানা হয়নি। খনন-উত্তর জমি, জলের মান উন্নয়ন, বায়ুর মান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার উপরিভাগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত নির্দেশিকা পালন করা হয়নি। এখানে অতি গভীর খাদান ও অন্যদিকে বর্জ্য ও ধুলোর পাহাড়গুলো পড়ে আছে বহুদিন। সেখানকার রাস্তা মানেই চার পাঁচ ইঞ্চি পুরু ধুলোর চাদর, যা মানুষের শরীর ও প্রকৃতির ক্ষতি করে আসছে কয়েক দশক ধরে। চারদিকে সবুজহীন ধূসর প্রান্তর, এই সবুজহীনতা আর ধুলোও কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি বা গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিচ্ছন্নতার পরিপন্থী, যা এঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ‘এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক’ থেকে কয়লা উত্তোলনের আস্ফালন।

 

একটু তথ্য ও ইতিহাসে চোখ রাখা যাক! আমরা জানি, জলবায়ুর বর্তমান আপৎকালীন অবস্থার প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি, যা বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম হেতু। সেই শিল্পবিপ্লবের কাল থেকে কার্বন নিঃসরণের ৮০ শতাংশ উৎস হল কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস। কয়লা উত্তোলন সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ খনন, ধৌতিকরণ থেকে পরিবহণ, শিল্পে ব্যবহার অর্থাৎ কয়লার দহন ক্রিয়া — এসবই বায়ুমণ্ডলে বাড়ায় কার্বন-দূষণের মাত্রা, বাতাসে মেশায় বিষাক্ত গ্যাস। খোলামুখ বা মাটির নীচে খনন, সমস্ত ধরনের কয়লা খনিই দূষণের আধার। খোলামুখ কয়লা খনিতে লক্ষ লক্ষ বছরে সৃষ্টি হওয়া মাটির স্তর (টপ সয়েল) চিরতরে হারিয়ে বর্জ্য পাহাড়ে পরিণত হয়। শুধু ধস নয়, এর ফলে স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয় ব্যাপক। বর্ষার সময়ে সেই মাটির স্তূপ ধুয়ে গিয়ে ভরাট হয় ওই অঞ্চলের নদনদীর তলদেশ, ডেকে আনে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা। এ-বছর বর্ধমানে বন্যা-পরিস্থিতির অন্যতম কারণ আসানসোল অঞ্চলের খোলামুখ খনির পাশে জড়ো করা মাটির স্তূপ। ওই মাটির স্তূপ থেকে ভূগর্ভস্থ জল প্রবাহের ব্যাঘাত ঘটিয়ে  শুধু ওই এলাকার নয়, এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজ-বনজ উৎপাদন এবং নদী-পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করবে।

 

সরকারি ভাষ্যে বলা হচ্ছে:

 

  • দেওচা-পাচামিতে কয়লাখনি থেকে পাওয়া কয়লার জন্য কমবে রাজ্যে বিদ্যুতের দাম।’
  • দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে গড়ে উঠবে বহু শিল্প, যা রাজ্যে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি করবে।’
  • দেওচা-পাচামির অধিবাসী মানুষ যারা বাস্তুচ্যুত হবেন তাঁদের জন্য ঘোষিত হয়েছে সেরা প্যাকেজ।’
  • রাজ্যে বিদ্যুতের যোগান না থাকলে উন্নয়নটা হবে কী করে?’
  • খনির ফলে জঙ্গল হয়তো নিশ্চিহ্ন হবে, কিন্তু সরকার প্রচুর গাছ লাগিয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেবে।’

 

এবার এই বক্তব্যগুলো যুক্তি দিয়ে একটু খতিয়ে দেখা যাক :

 

১. দেওচা-পাচামিতে কয়লার স্তর রয়েছে ব্যাসল্ট পাথরের স্তরের অনেক নীচে। এই পুরু পাথরের স্তর কেটে এবং তা তুলে ফেলে তার নীচ থেকে কয়লা উত্তোলন বিপুল খরচ-সাপেক্ষ। এর ফলে এখানে উত্তোলন করা কয়লা দিয়ে তৈরি বিদ্যুতের দাম অনেকটা বাড়তে বাধ্য। সেই বাড়তি দামের চাপ নিতে হবে বিদ্যুৎ গ্রাহককেই। বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের নিজস্ব চালু খনিগুলিতে আগামী তিরিশ বছরের জন্য পর্যাপ্ত কয়লা আছে। সেগুলি থেকে কয়লা তোলার খরচ অনেক কম। এই মুহূর্তে রাজ্যের বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম  সেই কয়লা ব্যবহার করে এ রাজ্যের এনটিপিসি বা ডিভিসির বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির থেকেও কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিসিসিএল বা ইসিএল-এর কাছ থেকে যে কয়লা কেনা হয় তার দামও দেওচার থেকে অনেক সস্তা হবে।

 

২. কয়লা উত্তোলন কোনো শিল্প নয়। আর দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলনের বরাত মূলত পাবে বেসরকারি সংস্থা। সেই সংস্থা স্থানীয় বাসিন্দাদের এই কাজে নিয়োগ করবে না। কারণ, এই ধরনের কয়লা উত্তোলন মূলত পরিশ্রমসাধ্য কায়িকশ্রমের ওপর নির্ভরশীল যেমন, তেমনি পূর্ব অভিজ্ঞতার ওপরেও নির্ভরশীল। ওই অঞ্চলের মানুষের সেই অভিজ্ঞতা কতটুকু? বরাত পাওয়া সংস্থা নিজেদের পদ্ধতি অনুসারে নিয়োগ করবে কর্মীবাহিনী। ফলে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা খুবই কম।

 

৩. এই রাজ্যে বর্তমানে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। অনেক ক্ষেত্রে এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও বিদ্যুতের রপ্তানি করা হচ্ছে। বিদ্যুতের যথেষ্ট জোগান থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে এ-পর্যন্ত ক’টা শিল্পোদ্যোগ গড়ে উঠেছে এ-রাজ্যে? সুতরাং, দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হলেই রাজ্যে কর্মসংস্থানের বান ডাকবে বলে যাঁরা বলছেন, তাঁদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে!

 

৪. হাজার হাজার বছর ধরে চাষাবাদ এবং জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল ওই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ, বিশেষত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁদের উৎখাত করতে যে ‘সেরা প্যাকেজ’-এর ঘোষণা হয়েছে, এমন বহু প্যাকেজ অতীতেও প্রতিটি ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে আদিবাসী-উচ্ছেদের আগে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সব ‘উন্নয়ন’-এ কারা লাভবান হয়েছে আর কারা সর্বস্ব হারিয়েছেন তা ইতিহাস খুঁজলেই পাওয়া যাবে। সর্বত্রই লাভবান হয়েছে কর্পোরেট, রাজনীতির কারবারি আর মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ! ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে সব রকমভাবে বঞ্চিত হয়েছেন ভূমিপুত্র-কন্যারা।

 

৫. আগেই আমরা বলেছি রাজ্যে পর্যাপ্ত বিদ্যুতের জোগান থাকা সত্ত্বেও শিল্পের বান ডাকেনি! সুতরাং, রাজ্যের উন্নয়ন দেওচা-পাচামির কয়লার ওপর নির্ভর করে আছে এমন নয়! বরং, ফসিল পুড়িয়ে বাতাসে কার্বনের মাত্রা বাড়িয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের অপচয়ের সংস্কৃতিতে রাশ টানা হোক্। আর, পুনর্নবিকরণ যোগ্য অপ্রচলিত উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেওয়া হোক পুরো মাত্রায়।

 

৬.  প্রচুর গাছ লাগিয়ে পরিবেশের যে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা এক কথায় হাস্যকর! লক্ষাধিক বছর ধরে গড়ে ওঠা ওই অঞ্চলের বনজ সম্পদ, মৃত্তিকা, বন্যপ্রাণের যে ক্ষতি হবে তা শুধুমাত্র কিছু গাছ লাগিয়ে পূরণ করার কথা যাঁরা ভাবতে পারেন, তাঁদের ‘পরিবেশ-জ্ঞান’ অবাক করার মতো! প্রস্তাবিত এই কয়লাখনি আগামী বহুবছর ধরে যে পরিমাণ কার্বন উদগিরণ করবে, সেই কার্বন বিশ্ব উষ্ণায়নে যে ভূমিকা নেবে তার ক্ষতি কীভাবে পূরণ হবে?

 

ভারত-সহ কয়লা উৎপাদক দেশগুলির ওপর সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বিষাক্ত দূষক যা কয়লা থেকে নির্গত হয় তা হল, ভারী ধাতুর মধ্যে কঠিন বর্জ্য হিসাবে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, সীসা, পারদ এবং বায়ুমণ্ডলীয় কণার মধ্যে সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং গ্যাসীয় নির্গমনের মধ্যে ওজোন।  পিপলস কালেকটিভ ইন্ডিয়া একটি সমীক্ষা চালায় খোলামুখ কয়লাখনি এলাকায়। ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক ও গবেষকদের দল সমীক্ষা করেন কয়লা এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পের ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার প্রত্যন্ত চারটি গ্রামে। রামগড়েই আছে সেন্ট্রাল কোলফিল্ড এবং টাটা স্টিলের খোলামুখ কোলিয়ারি।

 

তাদের সর্বমোট ২৩৫৩টি সমীক্ষিত স্বাস্থ্যতথ্য থেকে জানা যাচ্ছে এখানের মানুষের প্রধান দশটি রোগের কথা। সেগুলি হল, ব্রঙ্কাইটিস (হাঁপানি সহ); সিওপিডি/ কার্ডিওভাসকুলার (নিশ্বাসের সমস্যা); যক্ষা; ত্বক(কালো/সাদা দাগ, চুলকানি, আলসার); চুল (পতন/হ্রাস, বিবর্ণ); চোখ (জল পড়া ও লাল); পা/পায়ের পাতা(ফাটা, আলসার); কোমরে ব্যথা, বাত ও পেটের অসুখ। এই এলাকার বায়ু, জল, মাটি আর পলি পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে মারাত্মক দূষণ, বিভিন্ন বিষাক্ত ভারী ধাতু। বায়ু দূষণ (পিএম ২.৫) যা ভারতীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকার সীমা অতিক্রম করেছে। বাতাসে যে পরিমাণ ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল ও সিলিকন পাওয়া গেছে তা স্বাস্থ্য নির্দেশিকার নির্দিষ্ট মাত্রার অতিরিক্ত। মাটিতে যে পরিমাণ ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডিয়াম পাওয়া গেছে, তা পরিবেশ রক্ষায় নির্দেশিত কানাডীয় মৃত্তিকা নির্দেশিকার মাত্রা অতিক্রম করেছে। বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ও নিকেল পাওয়া গেছে পলিতে, ফলে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে। অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেছে জলে, যা ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড নির্দেশিত মাত্রা ছাপিয়ে গেছে।

 

মানুষের জীবন আর কতটা দুর্বিষহ করলে থামবে রাষ্ট্র? জানতে চাইছেন ওই অঞ্চলের মানুষ। দেওচা-পাচামিতে যেন এক অঘোষিত কার্ফু জারি করা হয়েছে! কিছু ‘বিশিষ্টজন’ ওই অঞ্চলের মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব পেয়েছেন এই প্রকল্পের ‘সুফল’! তাঁদের গতিবিধি ওই অঞ্চলে অবাধ। অথচ সমীক্ষক দল হোক বা অন্যদের প্রবেশ ‘নিষিদ্ধ’! প্রতিবাদীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো এবং নানা রকম প্রলোভন আর হুমকি দেওয়ার খবর আমরা পাচ্ছি। নবান্ন থেকে ঘোষিত প্যাকেজ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘শ্রেষ্ঠতম প্যাকেজ’। এর সঙ্গে সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে আমরা দেখলাম সরকারের পক্ষে, ‘উন্নয়ন’-এর পক্ষে শাসকের জন্য সেই নিদান, দরকার হলে কড়া হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে! শাসক দলের মোটরসাইকেল মিছিল, নবান্নে শিল্পপতিদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। গ্রামবাসীদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ, প্রতিবাদীদের ওপর ‘ইউএপিএ’- ‘রাষ্ট্রদ্রোহ আইন’ চাপানো এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ‘সংঘর্ষ মৃত্যু’-ও হয়তো ওঁত পেতে আছে! এসব সত্ত্বেও ওই অঞ্চলের মানুষ প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছে প্রতিবাদ। ইতিমধ্যেই দেওচা-পাচামির প্রস্তাবিত কয়লাখনি রুখে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন ওই অঞ্চলের আদিবাসী সমাজের মানুষ। বছর দুয়েক আগে, ২০১৯-এর ১৯ ডিসেম্বর দেওচা-পাচামি কয়লা প্রকল্পের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল রাজ্যের মুখ্যসচিবের উপস্থিতিতে। সেই উদ্বোধন পরিকল্পনা বাতিল হয় হাজার হাজার আদিবাসী সমাজের মানুষের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে। ‘কয়লাঞ্চল বাঁচাও মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ’-র তথ্যানুসন্ধানী দলকে ওই অঞ্চলের মানুষ জানিয়েছেন, ছত্রিশটি গ্রামের আদিবাসী মানুষের মধ্যে সমন্বয় রেখেই তাঁরা প্রত্যেকে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। ইতিমধ্যেই আদিবাসী সমাজ গণ-কনভেনশন করে এই ধ্বংসাত্মক কয়লাখনি প্রকল্প রুখে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন।

 

অতীতে নর্মদা-বাঁধ, ডিভিসি বাঁধ এবং অন্যান্য বড় প্রকল্পে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন দেওয়ার নামে তাঁদের সমন্বিত জীবন ও সংস্কৃতিকে ধংস করে দেওয়া হয়েছে। অথচ তাঁদের জন্য স্বর্গ সৃষ্টি করার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। সেই সমস্ত গ্রামের মানুষেরা ছন্নছাড়া হয়ে গেছেন। শাসকের সমস্ত প্রতিশ্রুতি যে শুধু কথার কথা, তা ‘উন্নয়ন’-এর নামে প্রতিটি উচ্ছেদের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়ে গেছে।

 

আমাদেরও সময় এসেছে প্রতিবাদ করার। দেওচা-পাচামির প্রকল্প শুধু ওই অঞ্চলের মানুষের জন্যই বিপজ্জনক নয়, বিশ্ব উষ্ণায়নের এই সময়ে তা আমার আপনার প্রত্যেকের জন্যই, বিশেষ করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা প্রবলভাবে বিপজ্জনক! আমাদের সীমাহীন লোভের মাসুল যেন আমাদের সন্তানদের না গুনতে হয়, তার জন্যও আমরা চাই এই আত্মঘাতী প্রকল্প বন্ধ হোক্!

 

পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী, নদীকর্মী, অধিকার আন্দোলনকর্মী, সামাজিক আন্দোলনকর্মী, রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে এই প্রকল্প বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি।

 

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও তার প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি :

 

১. দেওচা-পাচামিতে ওই অঞ্চলের কোনো গ্রামবাসীকে  কোনোভাবেই উচ্ছেদ করা চলবে না।

২.  জীবাশ্ম জ্বালানি আর নয়। আর নয় কার্বন। খোলামুখ হোক বা বন্ধমুখ — পরিবেশ দূষণকারী কয়লাখনি চাই না। দেওচা-পাচামি প্রকল্প বন্ধ হোক।

৩.  মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করো, হুমকি বন্ধ করো।

৪.  মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ‘উন্নয়ন’ চাই না।

৫.   বর্তমানে চালু খনিখাদান নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে বন্ধ করার প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু করতে হবে।

৬.  পরিবশ-বান্ধব শক্তির ব্যবহারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। খতিয়ে দেখতে হবে সমস্ত সম্ভাবনা।

৭. প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয়ের সংস্কৃতি অবিলম্বে বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হোক্। বিদ্যুতের অকারণ অপচয় বন্ধ হোক্।

৮. স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পরিবেশ বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হোক্ সর্বস্তরে!

 

আমরা অঙ্গীকার করছি :

১. পরিবেশ ধ্বংসকারী এবং বিপুল সংখ্যক মূলবাসী ও আদিবাসী মানুষকে উৎখাত করে প্রস্তাবিত দেওচা-পাচামির কয়লাখনির বিরুদ্ধে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে থাকব।

 

২ . পরিবেশ ধ্বংসকারী এই ‘উন্নয়ন’-এ শুধু পুঁজিপতিদেরই বাড়বাড়ন্ত হয়নি, উচ্চ মধ্যবিত্তেরও হয়েছে। তাই তাঁদের অধিকাংশের দৃষ্টিতে আত্মঘাতী এই উন্নয়নই ‘প্রকৃত উন্নয়ন’। তাই তাঁরা প্রক্রিয়ার প্রতিরোধে শামিল হন না। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে যদি একই ভোগবাদী সমাজ আমরা বজায় রাখি তাহলে প্রকৃতির বিপর্যয়কে ভবিষ্যতে রোখা যাবে না।

 

আমাদের এই পৃথিবী, তার পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই পরিবেশ-সংবেদী জীবন যাপনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম।

 

  • সমর বাগচী, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক
  • সৌরীন ভট্টাচার্য, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-চিন্তক
  • অভ্র ঘোষ, বিশিষ্ট লেখক ও সমাজ-চিন্তক
  • শুভেন্দু দাশগুপ্ত, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ-চিন্তক
  • জয়া মিত্র, সাহিত্যিক ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী
  • গৌতম চৌধুরী, শিল্পী ও শিল্পকলার শিক্ষক
  • দেবাশিস সেনগুপ্ত, অধ্যাপক ও পরিসংখ্যানবিদ
  • মনোজ ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, আরএসপি
  • দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই (এমএল, লিবারেশন
  • অভিজিৎ মজুমদার, রাজ্য সম্পাদক, সিপিআই (এমএল), লিবারেশন
  • শঙ্কর দাস, পলিটব্যুরো সদস্য, সিপিআই (এমএল), রেড স্টার
  • অমিতাভ ভট্টাচার্য, শ্রমিক ও গণ আন্দোলনের সংগঠক
  • বিদ্যা দিনকরণ, পরিবেশ ও মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক,
  • পাসারুল আলম, এনএ পিএম
  • সুজাত ভদ্র, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক
  • অভিজিৎ দত্ত, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী
  • কিরীটি রায়, সম্পাদক, মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ
  • নিশা বিশ্বাস, মানবাধিকার ও নারী আন্দোলনের সংগঠক
  • রঞ্জিত শূর, মানবাধিকার সংগঠক
  • সঞ্জীব আচার্য, অধ্যাপক ও মানবাধিকার সংগঠক
  • আলতাফ আহমেদ,  মানবাধিকার সংগঠক
  • প্রদীপ দত্ত, লেখক ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক
  • বঙ্কিম দত্ত,  গণবিজ্ঞান আন্দোলনের সংগঠক
  • বিবর্তন ভট্টাচার্য, বিজ্ঞান আন্দোলনের সংগঠক
  • সৌমিত্র ঘোষ, পরিবেশ ও অধিকার আন্দোলনের সংগঠক
  • তাপস দাস, নদী রক্ষা ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক
  • কল্লোল রায়, নদী রক্ষা ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক
  • অংশুমান দাস, কৃষি ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক
  • অভ্র চক্রবর্তী, কৃষি ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক
  • তাপস বর্মন, পরিবেশ ও শান্তি আন্দোলনের সংগঠক
  • পলাশ সিংহ, পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক
  • পিনাকী আচার্যি, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী
  • অমিতাভ সেনগুপ্ত, জলঙ্গী নদী সমাজ
  • দেবাঞ্জন বাগচী, জলঙ্গী নদী সমাজ
  • স্বপন ভৌমিক, মাথাভাঙ্গা নদী বাঁচাও কমিটি
  • শ্যামল ব্যানার্জী, সভাপতি, গ্রিন নাগরিক
  • তাপস বিশ্বাস, পরিবেশ বান্ধব মঞ্চ, ব্যারাকপুর
  • পার্থসারথী, সমাজ-গবেষক
  • অভিনন্দন সিনহা, গবেষক, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট
  • সুসময় সামন্ত, বিজ্ঞান-গবেষক
  • রতন বসু মজুমদার, আহ্বায়ক, মুক্ত বাংলা
  • ডাঃ কুণাল দত্ত, চিকিৎসক
  • শ্যামল চক্রবর্তী, চিকিৎসক
  • ডাঃ সুমিত দাস, মনোচিকিৎসক
  • ডাঃ সোমনাথ মিত্র, শ্বাসজনিত রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
  • ডাঃ প্রদীপ্ত রায়, চিকিৎসক ও গবেষক, সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ
  • তুষার চক্রবর্তী, বিজ্ঞানী
  • ডাঃ মুনমুন কীর্তনীয়া, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য কর্মী
  • রবিন মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  • শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  • সোমা মারিক, অধ্যাপক ও নারী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী
  • তীর্থঙ্কর চন্দ, নাট্যকার
  • অশোক মজুমদার, নাট্যকর্মী
  • ঋতদীপ, নাট্যকর্মী
  • শুভঙ্কর দাসশর্মা, নাট্যকর্মী, ‘জনগণমন’
  • শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত, লেখক ও সমাজকর্মী
  • প্রমোদ গুপ্তা, সাধারণ নাগরিক
  • প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক, কালধ্বনি
  • দেবাশিস আইচ, সাংবাদিক
  • নন্দিনী ধর, বিকল্প গণমাধ্যম কর্মী
  • সজল রায়চৌধুরী, সম্পাদক, মাতৃভাষা
  • জিতেন নন্দী, সম্পাদক, মন্থন, সাময়িকী
  • মৃন্ময় সেনগুপ্ত, গণআন্দোলনের সংগঠক
  • সুশোভন ধর, গণআন্দোলনের সংগঠক
  • সুমিত চৌধুরী, গণআন্দোলনের সংগঠক
  • মলয় তেওয়ারি, গণআন্দোলনের সংগঠক
  • অমিতাভ চক্রবর্তী, গণআন্দোলনের সংগঠক
  • অপর্ণা ঘোষ,  গণআন্দোলনের সংগঠক
  • সমুদ্র সৈকত, গণআন্দোলনের সংগঠক
  • সৌরভ চক্রবর্তী, গণআন্দোলনের সংগঠক
  • সুমিত মৈত্র, সমাজকর্মী
  • \রত্না পাল, সমাজকর্মী
  • সন্তোষ কর্মকার, সমাজকর্মী
  • সঞ্জিৎ চ্যাটার্জী, সমাজকর্মী
  • অতনু ঘোষ, সমাজকর্মী
  • প্রসেনজিৎ পাল, সমাজকর্মী
  • রাজীব শেখ,  সমাজকর্মী
  • শুক্লা বসু, সমাজকর্মী
  • জগন্নাথ চ্যাটার্জী, সমাজকর্মী
  • শুভপ্রতিম রায়চৌধুরী, আমরা-এক সচেতন প্রয়াস
  • শমীন্দ্র সরকার, আমরা-এক সচেতন প্রয়াস
  • ফারুক, আমরা-এক সচেতন প্রয়াস
  • মোহিত রণদীপ, আমরা-এক সচেতন প্রয়াস

 

 

Share this
Recent Comments
5
  • comments
    By: Gautam Pal on December 15, 2021

    এখনই বন্ধ হোক পরিবেশ ধংসকারী এবং মানুষ বিরোধী এই খনন কাজ ।

  • দেওচা পাচামি প্রকল্প মানুষ, প্রাণী ও গাছপালার চূড়ান্ত স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে। এই প্রকল্প প্রাথমিকভাবে ও শেষ পর্যন্ত সবার জন্যে সবদিক দিয়ে ক্ষতিকর। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, এই প্রকল্প অবিলম্বে৷ বন্ধ করা হোক।

  • একটি প্রয়োজনীয় সময়োপযোগী প্রয়াস। পাশে আছি।

  • comments
    By: প্রবীর রায় on December 15, 2021

    শুধু মাত্র উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা ভালো প্যাকেজ দিয়ে দিয়ে কোনপ্রকার পরিবেশ দূষণকারী প্রকল্প অনুমোদন সার্বিকভাবে সকলের ক্ষতি। তাই এই প্রকল্প কোনভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

  • comments
    By: Jiban Chakraborty on December 15, 2021

    The propsed Open Cast Mining in Deocha- Pachami in the district of Birbhum besides affecting a large number of tribal people in terms loss of livelihood, shelter and inviting severe health hazards will be a regressive step in fulfilling India’s global commitment to reduce carbon footprint in a phased manner. More alarmingly, it will further widen the existing social stratification ,deepen the prevailing class-hiatus and lead to pauperisation of the marginalised and the working people. The mining block should , therefore, be left undisturbed in larger public interest.

Leave a Comment