রাজ্যের ৬৪টি ইস্কুলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করল রাজ্যে সরকার


  • December 12, 2021
  • (0 Comments)
  • 2799 Views

অতিমারি ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের ভয়ার্ত আবহে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হল রাজ্যের ৬৪টি বিদ্যালয়কে। দেবব্রত গোস্বামীর প্রতিবেদন। 

 

বিলুপ্ত হয়ে গেল ৬৪টি বিদ্যালয়। যেন ডোডো পাখি। সরকারের এক ঘোষণায় জানিয়ে দেওয়া হল তা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলিও করা হয়েছে অন্য স্কুলে। কিন্তু কেন চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হল এই ইস্কুলগুলি? সরকারের তরফ থেকে তার কোনও ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত জনপরিসরে নেই।

 

বিলুপ্ত ঘোষিত ৬৪টি ইস্কুলের তালিকা

 

তবে, একটি কথা সাধারণ ভাবে বলা হচ্ছে যে, ইস্কুলগুলিতে ছাত্র-ছাত্রী ছিল না বললেই চলে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বসিয়ে বসিয়েই বেতন দিতে হচ্ছিল। প্রশ্ন উঠেছে, বিগত ১৮ মাস সব ইস্কুলই বন্ধ, এখনও কোনও ইস্কুলই সম্পূর্ণ খোলা হয়নি। তবে কীসের ভিত্তিতে রাজ্য শিক্ষা দপ্তর স্থির করল যে এই ৬৪টি ইস্কুল তুলে দেওয়া হবে? তবে কি এই সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়েছে? বিলুপ্ত ঘোষণার বহু আগেই ‘লাল তালিকাভুক্ত’ করা হয়ে গিয়েছিল? আর এই অতিমারি ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের ভয়ার্ত আবহের সুযোগে তা প্রায় একরকম গোপনেই বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হল?

 

গত ১ ডিসেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর এই বিদ্যালয়গুলির ১৪৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে অন্য বিদ্যালয়ে বদলির নির্দেশ দিয়েছেন মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলি। প্রশ্ন উঠেছে, এই বিদ্যালয়ের শিশুরা কোথায় গেল? তারা কি পাচারের শিকার কিংবা রাজ্যে বা ভিন রাজ্যে শিশু শ্রমিক হয়ে পরিবারের আর্থিক দায় মেটাচ্ছে? পাচারের খবর, পরিযায়ী হয়ে যাওয়া কিংবা বিপন্ন-বিয়ের শিকারের খবর ইতিমধ্যেই নানা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষা দপ্তর ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও।

 

এবিটিএ-র রাজ্য নেতা সুকুমার পাইন এ প্রসঙ্গে গ্রাউন্ডজিরোকে বলেন, “শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী আর পরিকাঠামো না থাকলে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হচ্ছে কেন? ইচ্ছে করে ইস্কুল বন্ধ করছে সরকার। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ বন্ধ। জঙ্গলমহলে একটি ইস্কুলে ছাত্র সংখ্যা ৪০০ কিন্তু, শিক্ষক মাত্র ৮ জন। সঠিকভাবে পঠনপাঠন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, অভিভাবকরা ওই ইস্কুলে  সন্তানদের পাঠাতে চাইছেন না। আবার ছাত্র-ছাত্রী কম বলে বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিটিইএ-র রাজ্য সভাপতি সুবোধ দত্ত বলেন, ”হিঙ্গলগঞ্জে ২১টি বিদ্যালয়, কিন্তু মাত্র একটিতে বিজ্ঞান বিভাগ আছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার জন্য হয় বাইরে যেতে হচ্ছে কিংবা হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট স্কুলে প্রচুর টাকা দিয়ে পড়তে হচ্ছে।“

 

আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, শহর ও শহর লাগোয়া বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক সংখ্যা প্রচুর। চুঁচুড়ায় ডাফ স্কুলে ছাত্র সংখ্যা ২০০ জন কিন্তু শিক্ষক সংখ্যা ৪৪ জন। তেমনই কলকাতার এক স্কুলে ২৭০ জন ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ৪৩ জন শিক্ষক ছিলেন। উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে আরও ৪ জন শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন বলে সুবোধবাবু জানান।

 

কেন বন্ধ হল ইস্কুল? উঠল ২১ দফা প্রশ্ন।

 

রাজ্যের শিক্ষানুরাগীদের মতে, “৬৪টি ইস্কুলকে ‘এক্সটিঙ্কট’ হিসাবে ঘোষিত হওয়ার তথ্য ‘ইস্কুলটি বন্ধ হল’ এ জাতীয় কোনও নৈর্ব্যক্তিক তথ্য নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে রাজ্যের সামগ্রিক বিদ্যালয় শিক্ষানীতি।“ স্বভাবত নীতি সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের প্রশ্ন:

 

২১ দফা প্রশ্ন

 

১। এই প্রায় দু-বছরে কোন বাস্তবতার ভিত্তিতে ৬৪টি সরকার পোষিত ইস্কুলকে পশ্চিমবঙ্গে ‘এক্সটিঙ্কট’ হিসাবে ঘোষণা করা সম্ভব হল? বিচারের মাপকাঠি ও ফ্যাক্টরগুলি কী?

২। সব পড়ুয়াদের আনাগোনাই তো বন্ধ ছিল। তাহলে এই প্রায় দু-বছরে কী এমন বাড়তি ছাত্রশূন্যতা মালুম পড়ল।

৩। মালুম যদি পড়েই থাকে, তবে অতিমারি পর্বের সেই স্কুলছুট সংক্রান্ত যুক্তিগ্রাহ্য তথ্য কোথায় পাওয়া যাবে?

৪। সেক্ষেত্রে ইস্কুল থেকে ঝরিয়ে দেওয়া পড়ুয়াদের জন্য সরকার কী কী বিশেষ পরিকল্পনা নিচ্ছে?

৫। স্কুলছুটদের ফের ভর্তি করার জন্য বিশেষ প্রয়াস বা কোনোরকম ‘কমিউনিটি বেসড’ কাজের বন্দোবস্ত করছে সরকার?

৬। শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯ সালের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্কুলছুটদের জন্য বিদ্যালয়ে ‘বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি’-র কী পরিস্থিতি? এই কর্মসূচির সহায়ক কারা হবেন? স্কুলের শিক্ষকরাই না কি অন্য ‘এডুকেশনাল ভলান্টিয়ার’? বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মডিউল তৈরি হয়েছে? প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে এই কর্মসূচির সহায়কদের প্রশিক্ষণ হয়েছে?

৭। বিদ্যালয়ে না-আসা ছাত্রদের জন্য ‘চাইল্ড ট্র্যাকিং’-এর কাজ হচ্ছে?

৮। বুথ ভিত্তিক ‘চাইল্ড রেজিস্টার’ কোথায়? সাম্প্রতিকতম তথ্য সংযোজিত হয়েছে?

৯। রাজ্যের প্রত্যেকটি ‘রেসিডেনশিয়াল পকেট’-এর ৬ থেকে ১৮ বছরের বাচাদের মোট সংখ্যা কত? তাদের মধ্যে ইস্কুলে যাচ্ছে ক’জন, ক’জনই-বা যাচ্ছে না?

১০। ‘এক্সটিঙ্কট’ ইস্কুলগুলি কোন কোন ‘রেসিডেনশিয়াল পকেট’-এর ‘ফিডার’ ইস্কুল?

১১। ৬৪টি ইস্কুলকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার কারণ কি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র ‘ক্লাস্টার স্কুল’-এর নীতিকে প্রণয়ন করা?

১২। তেমনটা হলে, শিশুর শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯ মাফিক , প্রাথমিকের বাচ্চাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার আর উচ্চ প্রাথমিকে ১.৫ কিলোমিটারের মধ্যে ইস্কুল থাকার বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্তের কী হবে?

১৩। ৬৪টি ইস্কুল বন্ধ হলে পড়ুয়াদের বাড়ি থেকে ইস্কুলের দূরত্ব কমানোর সিদ্ধান্তের কী হবে?

১৪। সেক্ষেত্রে যশপাল কমিটির প্রস্তাবিত ‘লার্নিং উইদাউট বারডেন’ নীতিকে কী চোখে দেখা হবে?

১৫। ৬৪টি ইস্কুল যদি অনেক আগে থেকেই পড়ুয়াশূন্যতায় ভুগতে থাকে তবে, ইস্কুলের ‘র‍্যাশনালাইজেশন’-এর জন্য ‘নিউ সেট আপ’ স্কুল সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে – প্রয়োজনীয় স্থানে কি ৬৪টি বা তার কিছু কমবেশি সংখ্যক ইস্কুল তৈরি হবে?

১৬। শিশুর শিক্ষার আইন ২০০৯-এর প্রস্তাব অনুযায়ী আবাসিক বিদ্যালয়, বিনামূল্যের পরিবহন ইত্যাদি পরিকল্পনাগুলি কি নেওয়া হবে?

১৭। রাজ্যে শিশুশ্রমিকের পরিস্থিতি কী?

১৮। যদি স্কুলছুট হয়ে থাকে তবে স্কুলছুটরা কি শিশুশ্রমিক হয়ে গেল?

১৯। শ্রমদপ্তর, ভবঘুরে বা বাস্তুহীন বিষয়ক দপ্তর, শিশু কল্যাণ দপ্তরগুলি শিশুশ্রমিক, পথশিশু, বাস্তুহীন শিশু প্রসঙ্গে কী রিপোর্ট দিচ্ছে? তাদের ইস্কুলের পড়াশোনা সংক্রান্ত পরিস্থিতি কী?

২০। হোস্টেল, আবাসিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা অতিমারি পর্বে কোথায় ছিল বা থাকছে কোথায়?

২১। অতিমারি পরিস্থতিতে শিশু বিষয়ক কমিশনের কী এসমস্ত বিষয়ে সুপারিশ-সহ কোনও রিপোর্ট রয়েছে?

 

সৌজন্য: উর্বা চৌধুরী।

 

শুধু এই ৬৪টি-ই নয় আরও বহু বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদ থেকে অভিভাবকরা। বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদ্যালয়গুলির ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়েও তাঁরা উদ্বিগ্ন। বলাগড়ের শিক্ষানুরাগী ও অভিভাবক সৈকত বাগচী বলেন, “জানি না, ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ কী! বিভিন্ন অজুহাতে স্কুল বন্ধ করে সাধারণ ঘরের সন্তানদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।“ জিরাটের শিক্ষক রামপ্রসাদ হালদারের বক্তব্য, “বাম জমানার শেষ দিকে যে সমস্ত স্কুলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো আর হয়তো চলবে না। কারণ, বিগত ১০ বছরে ওই বিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি হয়নি। আমাদের সহকর্মীরা অনিশ্চিত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। যে কোনও সময় বন্ধ হবে বিদ্যালয়গুলি।“

 

শিক্ষানুরাগী, শিক্ষকদের আরও অভিযোগ, পরিকাঠামোর উন্নতি না ঘটিয়ে, স্কুলে ছাত্র নেই এই অজুহাতে শতাধিক বিদ্যালয় বন্ধ করার উদ্দেশ্যে জোর করে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলি করা হচ্ছে। অভিযোগ, সরকারি বিদ্যালয়গুলি এভাবে রুগ্ন এবং চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার বেসরকারিকরণকেই উৎসাহ দিচ্ছে রাজ্য সরকার। এমনটা চললে শিক্ষা আর সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে না।

 

বন্ধ ইস্কুলের ১৪৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার বদলির নির্দেশ।

 

Admn Transfer
Share this
Leave a Comment