হতাশার মধ্যেই অনিতা মন্ডল আর্জু হাসানরা ভোট দেবার লাইনে দাঁড়াবেন পৌরসভা নির্বাচনে


  • December 12, 2021
  • (0 Comments)
  • 860 Views

ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে কলকাতা পৌরসভা নির্বাচন। ইতিমধ্যেই প্রার্থী ঘোষণা হয়ে গেছে। প্রচার তুঙ্গে। ২০১৫-র পর, ছ’বছর বাদে, ১৯শে ডিসেম্বর হতে চলেছে কলকাতা পৌরসভার নির্বাচন। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আঁটঘাট বেঁধে প্রস্তুত প্রার্থীরা। ভোটের মরশুমের সাথে সাথে চলে এসেছে রাজনৈতিক আলোচনা, তর্ক বিতর্কের মরশুম-ও। এই ভোট প্রচার পর্বে, দল, প্রার্থী, এলাকার কাজ ধীরে ধীরে আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়া শুরু করেছে। শীতের হাওয়া শহরে প্রবেশ করবার আগেই ভোটের হাওয়া টের পেতে শুরু করেছে কলকাতা। জেনে নেওয়া যাক, শহরের সাধারণ মানুষজন এবারের নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন।

 

দক্ষিণ কলকাতার ১০০ নং ওয়ার্ডের ভোটার, গৃহপরিচারিকা অনিতা মন্ডল এবং তাঁর প্রতিবন্ধী স্বামী বাপি মন্ডলের সাথে কথা হলে, তাঁরা জানান, “ভোট তো চলেই এল, প্রার্থীরা এখনও ঘরের কাছে প্রচারে আসেনি তবে ওই রাস্তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।”

 

এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছে কী কী দাবি রাখছেন? কোন‌ কোন বিষয়গুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়? প্রশ্নটা শুনে, ছোট্ট খাটটার মধ্যে আরো খানিক আঁটোসাঁটো হয়ে বসে, ওঁরা একে অপরের মুখের দিকে চাইলেন। বাপিবাবু বলা শুরু করলেন, “পৌরসভা তো কাজ করেছে। আমরা অনেকদিনের লাল পার্টির ভোটার। কিন্তু সত্যি বলতে টিএমসি আসার পর রাস্তাঘাট, জল এগুলোর অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে… “বাপিবাবুর কথার রেশ ধরেই আলোচনায় যোগ দিলেন অনিতা মন্ডল, “সত্যি বলতে রাস্তাঘাট হচ্ছে সে ঠিক আছে, কিন্তু শিক্ষা, চাকরি এগুলোর দিকেই সরকারের বেশি করে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এই যে আমাদের ছেলে, এবার পাঁচশো বারো নম্বর নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে, কিন্তু যেই স্কুল থেকে পাশ করলে এখন সেখানেই ওকে ভর্তি নিচ্ছে না। কত পার্টির লোক ধরেছি। সিপিএম, টিএমসি, কেউ সাহায্য করেনি, আসলে কেউই আমাদের কোনদিনও সাহায্য করেনি। এবার তাই ঠিক করেছি ভোট-ই দেব না। এই যে আমার বর, জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী। আজ অবধি তার একটা প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট হয়নি। কেউ করে দেয়নি। কাকে ভোট দেব? তাও ছাড়লাম ওকে নয় দেয়নি, আমার ছেলেটার ভর্তিটুকু এরা করিয়ে দিতে পারত না?”

 

বাড়ি বাড়ি গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করেন অনিতা মন্ডল, প্রতিবন্ধী হওয়ার দরুন তাঁর স্বামী সেভাবে কোন কাজ করতে পারেন না। লকডাউনের পর বহু বাড়ির কাজ হারিয়েছেন অনিতা মন্ডল, “হঠাৎ করে জানিয়ে দিল আর আসতে হবে না। মাইনে পর্যন্ত দেয়নি। তখন খুব কষ্ট করে চলেছে, ওই পার্টি থেকে যে চাল, ডাল দেয় ওইসব দিয়ে। সেই সময় টিএমসি পার্টি কিছু সাহায্য করেছিল। ওই ২ টাকার চাল পেতে।”

 

দক্ষিণ কলকাতার একটা ফ্ল্যাটে কেয়ারটেকারের ঘরেই তারা দিন কাটান। আট ফুট বাই সাত ফুটের একটা ঘর। সেই ঘরেই থাকা, খাওয়া, রান্না। একটা খাটে কোনরকমে তিনজনের জায়গা করে নেওয়া। ঘরের ভিতরে রান্নার গ্যাস, স্টোভ। আরেক কোণে ছোট্ট একটু জায়গা করে রাখা ক্লাস টুয়েলভের কমার্সের ক’টা বই। এর মধ্যে দিয়েই কোনোরকমে বেঁচেবর্তে চালিয়ে যাচ্ছেন অনিতা মন্ডল ও তাঁর পরিবার। এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছে রাস্তাঘাট, জল, এই দাবির বাইরে তাঁরা শিক্ষা, চাকরি, গ্যাসের দাম কমানোর মতো দাবিগুলির দিকে রাজনৈতিক দলগুলিকে নজর দিতে অনুরোধ করেছেন।

 

এবারের নির্বাচনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সিপিএম, তৃণমূল এবং বিজেপি – প্রত্যেকটা দলের প্রার্থী তালিকায় মহিলাদের অংশগ্রহণ একটি লক্ষ্য করার মতো বিষয়। তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় প্রায় ৪২ শতাংশ আসন দেওয়া হয়েছে মহিলা প্রার্থীদের, অন্যদিকে সিপিএম ৭১ জন মহিলা প্রার্থীকে জায়গা করে দিয়েছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে অনিতা মন্ডল জানান যে, এটাকে তিনি একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন, তবে কাজ না শুরু হলে কোনো বক্তব্য রাখা সম্ভব নয়। অন্যদিকে কে. কে. দাস কলেজের বি.কমের ছাত্র আর্জু হাসানের বক্তব্য, এই পদক্ষেপ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর সাথে সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকেও সামনে এগিয়ে আনা জরুরি। তাঁর মতে, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছেই সংখ্যালঘুরা স্রেফ একটা ভোটব্যাংক হয়ে থেকে গেছে, তাই তাঁদের উন্নতির দিকেও এবার বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত।

 

১০১ নং ওয়ার্ডের ভোটার, আর্জুর মতে, “এবারের নির্বাচন মেয়র বেছে নেওয়ার নির্বাচন হলেও, ছাত্র যুবদের দাবি সবসময়ই শিক্ষা এবং চাকরির।” এবারের প্রার্থীদের কাছে তাঁর দাবি জানতে চাওয়ায় তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “সবার কাছে শিক্ষা এবং সবার হাতে কাজ চাই।”

 

অনিতা মন্ডল এবং আর্জু হাসানের বক্তব্য থেকে খানিক হলেও আঁচ করা যায় এবারের নির্বাচনে শহরবাসী কি ভাবছেন।

 

একের পর এক নির্বাচন পেরোতে দেখলেও, লাল থেকে সবুজ সমস্ত পার্টির দরজায় গিয়েও, অনিতা মন্ডলের স্বামীর হাতে আজও প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট এসে পৌঁছায়নি। এই গোলোকধাঁধায় পাক খেতে খেতেই, অনিতা মন্ডল জানান, “মানুষ হতাশ হয়ে গেছে”। এই হতাশার মধ্যে সংসদীয়  রাজনীতি সম্বন্ধে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও ভোট প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা সম্বন্ধে হাজার প্রশ্ন সত্ত্বেও , অনিতা মন্ডল, আর্জু হাসানরা হয়তো এবারেও ভোটের  লাইনে দাঁড়াবেন।

 

 প্রতিবেদক পীযূষ দত্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
Share this
Leave a Comment