শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছে না তো? শিক্ষার অধিকার তালিবানি শাসনকালে অনিশ্চিত আবার ভারতের মতো বৃহৎ গণতন্ত্রেও অনিশ্চিত। বর্তমানে আফগানিস্তান কিংবা ভারত দুই দেশই ধর্ম প্রসঙ্গকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বিষয়টা শেষ পর্যন্ত শিক্ষার অধিকারকে মুছে ফেলার পথকে সুরক্ষিত করছে। কেবল পথটা আলাদা। লিখছেন কোয়েল সাহা।
নমিতা বয়স ২০। মা-বাবা ছোটকালেই গত হয়েছেন। কতটা ছোটকালে তা হিসাব কষে ঘটনার পরম্পরা সাজিয়েও মনে করতে পারে না। স্কুলমুখো হওয়ার সময়, সুযোগ কোনোটাই আসেনি তার জীবনে। ঘামে ভিজে এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ সামলে নমিতার গায়ে বেশ উগ্র মতো বোটকা গন্ধটা দিনের একটা বড় সময় ধরেই থেকে যেত। নমিতা ভাইকে চেয়ার টেবিলে বসিয়ে পড়াশুনোর বন্দোবস্ত করেছে, কালো অক্ষরের প্রতিটি শব্দ আর ভাইয়ের মধ্যেকার সমস্ত দূরত্ববিধি মুছে ফেলতে কোনও কসুর করেনি। কালো মোটা অক্ষরগুলো একটা স্বপ্নের চাবিকাঠি এ কথাটা বাপ-মা মরা মেয়েটা কী করে যেন বুঝে গিয়েছিল। সময়টা নব্বইয়ের দশকের প্রথম। যখন প্রযুক্তির দাপাদাপি ঘরেবাইরে কোনোখানেই সেভাবে এসে পৌঁছাতে পারেনি। এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ সামলে সন্ধের পর কিছুটা ফুরসত। নমিতাকে ডেকে পাঠানো হতো সাক্ষর করার তীব্র তাগিদে। অ থেকে এ অবধি পৌঁছাতেই ওর স্মৃতি জবাব দিয়ে দিত। বারবার ভুলে যাওয়ার আক্ষেপে বলে বসত, “আমাকে পড়াতে গেলে তোর মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে।” নমিতার এ বদ্ধ ধারণা ছিল। কায়িক শ্রম আর মাথার শ্রম সমান্তরাল দুই প্রতিবেশী যারা পাশাপাশি বসে চা হয়তো খেতে পারে কিন্তু বিদ্যার আদান-প্রদান সেখানে বন্ধ।
নমিতার ঘেমো শরীর-মন, যৌবনের নাগাল কোনো পুরুষের যত্নে ডালপালা মেলে ছিল। বহু দিন পর ঠিকানা খুঁজে ফোন নাম্বার মিলিয়ে ফোন করলে জানা গেল দুই ছেলে কলেজ পাশ করেছে। সেই সাথে তীব্র এক সুখ। বহু আকাঙ্ক্ষিত জয়, ম্যারাথন অপেক্ষার পর। একটু হেসে বলে ফেলল, করোনা ভাগ্যিস দু-চার বছর আগে এসে হাজির হয়নি। তাহলে ছেলেদের হয়তো স্বপ্নের চাবিকাঠি হারিয়ে যেত।
হিসাবের খাতা উল্টে অসময়ের করোনা যাদের ক্যালেন্ডারে ঢুকে পড়েছে তাদের স্বপ্ন-চাবির তবে কী হবে? নমিতার মতো মায়েরা তাদের খোকাদের খুকুদের কীভাবে কালো অক্ষরের বাহনটিকে আগলাবে? দুর্মূল্যের বাজারে পেটের দানা জোগানো যখন আয়ত্বের বাইরে সেখানে কালো অক্ষরের চাবিকাঠি কীভাবে খরিদ করবে? অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা। নমিতার কথাগুলো আরও একবার স্মরণ করলাম — তাইতো শিক্ষা এখন কিনতে হচ্ছে, বিক্রির মাল। শিক্ষার অধিকার কি তবে সবার জন্য নয়?
তাহলে শিক্ষা এখন কাদের জন্য? সহজ হিসাব যার পকেটে পয়সা তার জন্য। অধিকার স্লোগানটা গোলমেলে ধাঁধাঁর মতো হয়ে উঠছে। তাহলে আমার জন্য কী? আমি তো দেখছি আমার জন্য কেবল ভয় আমার জন্য কেবল সংশয়। যা আমার দেশের সরকার আমার জন্য বরাদ্দ করেছে। যে ভয়কে জোরদার করার জন্য অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন হয়েছে এনআরসি-র মধ্যে দিয়ে। যে জাতকে পায়ের তলার মাটি নিশ্চিত করতে সীতার মতো আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়, তার আবার শিক্ষা! অনেক খেদের থেকে এমন কথা মনে হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক?
করোনাকালে দেশ আমার পাকাপাকি দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। স্পষ্ট রং লাগল শ্রেণি বৈষম্যের। যে শ্রেণি বিভাজন অর্থনীতির ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। সেই ভাগাভাগিতে বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য তথা মৌলিক অধিকারের যাবতীয় রসদ ভ্যানিশ। এক শ্রেণি ডিজিটাল ইন্ডিয়া বা সাইনিং ইন্ডিয়ার স্পট লাইটের তলায় উজ্বল ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি আর অন্যদিকে অন্ধকার ভারতের প্রতিনিধি। এ দেশের অস্থিমজ্জার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসাম্যের প্রকট চেহারা। কেবল অতীতে শ্রেণিপ্রাচীর কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যবহার করা হত তা নয়, আজকের দিনেও সাইনিং ইন্ডিয়ার নেপথ্য। অন্ধকার ভারতবাসীর শিক্ষা সম্পর্কে ভারত রাষ্ট্রের উদাসীনতা জঁ দ্রজের সার্ভে রির্পোট থেকে আরও বেশি করে স্পষ্ট হচ্ছে। দলিত এবং আদিবাসী পরিবারের শিশুদের মাত্র ৫%, গ্রাম ভারতের ৮% এবং শহর ভারতের ২৩% ডিজিটাল দুনিয়ার অনলাইন শিক্ষার আওতায় আসতে পেরেছেন। পড়াশোনায় ইতি হয়েছে ৩৭% ছাত্রছাত্রীর। রামায়ণে সোজাসুজি খোলামেলা ভাবেই দেখা যায় বর্ণ বিভাজন অনুসারে উচ্চ শ্রেণির লেখাপড়ার অধিকার। বাকিরা কায়িক শ্রমে আটকে থাকা সেবাদাস। সরকারের ডাকে রামরাজ্য গড়ে তোলার প্রথম ধাপ সেই অনুসারে বেশ আশাব্যঞ্জক গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
২০২১-এ উন্নয়নের ঝাঁ-চকচকে দেশে গ্রাম শহরের ব্যবধান বেড়ে গেছে। শহরের মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার নামে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া একটি অংশ শহরের প্রান্তে টিকে আছেন। আর বাকি একটা অংশের মানুষ যারা লোকাল ট্রেনের উপর নির্ভর করে শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। করোনাকে সামনে রেখে লোকাল ট্রেন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি রাখার মধ্যে দিয়ে। বিচ্ছিন্নতার কোপে জীবিকাহীন হয়ে পড়া পরিবারকে সচল রাখার প্রয়োজনে, করোনাকালে স্কুল বন্ধ হয়ে ঘরে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের কাজে নেমে পড়তে হচ্ছে। যা স্কুল ছুট হওয়ার পিছনে অনেক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ।
অপুষ্টি: ২০১৪ সালে সরকারি স্কুলে মিড-ডে মিলের জন্য ধার্য্য ছিল ১৩,২১৫ কোটি টাকা। পরের বছর ২০১৫ সালে তা ৭৭৭৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশ অনুসারে সরকারি স্কুলের মিড-ডে মিল থেকে ছেঁটে দেওয়া হয় ডিমের বরাদ্দ। এক্ষেত্রে বলা জরুরি যে, ডিম মস্তিস্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী খাবার। যার থেকে ভিটামিন বি৬ (রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা গড়ে তোলে), বি১২ (স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজে সহায়তা করে), ফোলেট (নতুন রক্ত কোষ গঠনে সাহায্য করে।), ক্লোরিন (কোষের ভিতর এবং বাইরের তরলের ভারসাম্য রক্ষা করে)। শিশুর বিকাশে যা গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিগুণের রসদে ফাঁক হলে শারীরিক মানসিক গঠন পূর্ণ বিকাশে বাধা পায়। স্বাভাবিক শিক্ষাতে ছেদ নিয়ে আসে। ২০২১, ২৮ সেপ্টেম্বর মিড-ডে মিল নতুন নামে আত্ম প্রকাশ করল। ‘পি এম পোষণ’। বলার অপেক্ষা রাখে না, কর্পোরেট সংস্থাগুলি তাদের নতুন পণ্য যে ভাবে (সাবানের বিজ্ঞাপনে সপ্তাহ অন্তে যে ভাবে বিভিন্ন গুণাগুণ প্রকাশ করে) বাজারে এনে থাকে সেভাবেই। সেই একই পদক্ষেপে তথা কায়েমি স্বার্থ প্রদর্শন কেন্দ্র-রাজ্য প্রয়োগ করে চলেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্নটি এসে পড়ে কেন্দ্র–রাজ্যের চরিত্র নিয়েও। মহামারির দেড় বছরে চুপিসারে সরকারি কারসাজিতে স্কুলছুট একটি প্রজন্ম তৈরি হতে বাধ্য।
মেয়েটি জন্ম অন্ধ নয়। তবে চোখের জ্যোতি কিছু কম ছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এক চোখের মণি সাদা হয়ে গেল। জুট মিল মহল্লার আর পাঁচটা মেয়ের মতো সেও স্কুল যেত। ২০১৯ এর দাঙ্গায় কাঁকিনাড়ার ৬ নম্বর গলির নাগমা ও তার পরিবার সব হারিয়ে পথে এসে দাঁড়াল। এ মহল্লায়, বিহার দেশ থেকে ভাগ্যের খোঁজে আসা ছিন্ন মূল এই পরিবার গুলি মুছে যেতে শেখেনি। বরং কিছুটা জোরের সঙ্গেই আবারও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন। এর মধ্যে করোনার দাপট থাবা বসাল প্রতিদিনের রুজিতে। এক চিলতে ঘরে জনা সাতেকের সংসারে নাগমার স্কুলের বন্ধ দরজা খোলার আশা যখন ক্ষীণ হচ্ছে তখন পরিবারকে ভরসা যোগাল নিকা। বয়সে আঠারোর কম নাগমা। নিকার আড়াই মাস নাগাদ অসহ্য মাথা ব্যাথা নিয়ে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। আধপেটা খেয়ে থাকা পরিবারের কাছে মৃত্যু শোক বাহুল্য। শিক্ষা আনে চেতনা ফলত। মৃত্যুকে আল্লা তালা আর নাসিবের ঘেরার বাইরে ভেবে ওঠার মতো চেতনার রসদ এদেশে এরকম হাজারো মহল্লায় এখন আরও বেশি অনিশ্চিয়তায় ঘিরে ধরছে।
অন্যদিকে স্লোগান উঠছে ‘খেলা হবে’। সকালে সূর্য ওঠা থেকে কক্ষপথ বেয়ে সূর্যের ফিরে যাওয়ার মাঝে অদৃশ্য খেলায় আপনার আমার জীবন নিলামে উঠছে। দ্রৌপদী অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতির নগ্ন চেহারায় বেআব্রু হয়েছিলেন প্রকাশ্য সভায়। যে সভার খল-ছল দুই অবস্থাই আমরা প্রতক্ষ করেছিলাম। অবস্থান নিয়েছিলাম। এ সময়ে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও বেনে নামক কর্পোরেটের জটিল সমীকরণের অঙ্ক, কাঠামো দেখে অন্ধ ও বোবা হয়ে থাকার ফরমাস পালনে অভ্যস্থ জাত হয়ে উঠছি। তৈরি হচ্ছে মুনিব-দাস সংস্কৃতি। ফলোশ্রুতি বেকার প্রজন্মকে মূক ও বধির করার আয়োজনে ২ টাকা কেজির চাল। যে সংস্কৃতি গিলে নিতে চায় আত্মসম্মান।
শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছে না তো? শিক্ষার অধিকার তালিবানি শাসনকালে অনিশ্চিত আবার ভারতের মতো বৃহৎ গণতন্ত্রেও অনিশ্চিত। বর্তমানে আফগানিস্তান কিংবা ভারত দুই দেশই ধর্ম প্রসঙ্গকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বিষয়টা শেষ পর্যন্ত শিক্ষার অধিকারকে মুছে ফেলার পথকে সুরক্ষিত করছে। কেবল সুরক্ষিত করার পথটা আলাদা। ২০০৩ সালে পরিচালক সাদ্দিক বারমাক ‘ওসামা’ নামক ফিল্মে তালিবানি শাসন কালে গ্রাম আফগানিস্তান ও তার শিক্ষা ব্যবস্থার বিভীষিকাময় পরিবেশ পরিস্থিতির সূত্র তুলে ধরেন। আফগানিস্তানের গ্রাম শহরের ব্যবধান ও শিক্ষার দুরবস্থা গ্রাম ভারত ও তার শিক্ষা ব্যবস্থা তুলনামূলক আলোচনার সংকেত নিয়ে কালো মেঘের মতো যেন জাঁকিয়ে বসছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার তৃতীয় দুনিয়ার দেশ যেন এই ব্যবধান নামক ক্যানসার রোগে আক্রাম্ত। যে রোগের জীবানু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নতুন কৌশলের বহিঃপ্রকাশ নয়তো? ভোগের দুনিয়াকে সুরক্ষিত করার পন্থাকে নিশ্চত করতে হলে হাড় জিরজিরে অশিক্ষায় ডুবে থাকা ভৌগোলিক সীমানাটা অন্যতম শর্ত হিসাবে প্রতিদিন যেন প্রকট হচ্ছে।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.hindustantimes.com/editorials/the-future-is-at-stake-10163101677366.html
- https://www.anandabazar.com/editorial/essays/the-question-is-why-eggs-went-missing-from-the-students-mid-day-meal/cid/1305987
- কোয়েল সাহা, গবেষক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
- ছবি : সন্দিপ সাহা।