গ্রাউন্ডজিরোর প্রতিবেদন
১৫ বছর পার হয়ে গেলেও বনাধিকার আইন ২০০৬, এ রাজ্যে কোথাও পূর্ণ মান্যতা দেওয়া হয়নি। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স ও পাহাড়ের কোথাও কোথাও এই আইন অনুযায়ী বিভিন্ন বনবস্তির বাসিন্দারা নিজেদের গ্রামসভা গঠন করলেও তার পূর্ণ স্বীকৃতি দেয়নি বনদপ্তর কিংবা রাজ্য সরকার। সারা রাজ্যের বনাঞ্চলে এই আইন চালু করা এবং প্রতিটি গ্রামে গ্রামসভা গঠনের দাবিতে ৮ অক্টোবর শুক্রবার পুরুলিয়ায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও অবস্থান করল আদিবাসীদের সংগঠন ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল, পুরুলিয়া জুয়ান মহল ও প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ।
বন-পাহাড়-নদীনালা ও জনজীবন ধ্বংসকারী সমস্ত উন্নয়নী প্রকল্প-সহ অযোধ্যার ঠুড়গা-বাঁদো-কাঁঠালজল প্রকল্প বাতিল ছিল আন্দোলনকারীদের এক অন্যতম প্রধান দাবি। প্রসঙ্গত, পুরুলিয়ার অযোধ্যায় ঠুড়গা পাম্প স্টোরেজের বিরুদ্ধে ২০১৮ সাল থেকেই আন্দোলন চলছে। হাইকোর্টে চলছে মামলা। বছর দুয়েক আগে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ আন্দোলনকারীদের পক্ষে রায় দিয়ে জানিয়ে দেয়, আইন মোতাবেক গ্রামসভা গঠন করে তাদের অনুমতি নিয়ে তবেই এই প্রকল্প করা যাবে। আবেদনকারীদের অভিযোগ ছিল যে বনাধিকার আইন অনুযায়ী গ্রামসভার অনুমতি নিতে হয়, আর গ্রামসভায় গ্রামের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ন্যূনতম অর্ধেক থাকতে হয়, অথচ ১৭টি গ্রামসভার মধ্যে মাত্র ২টি গ্রামসভা দেখানো হয়েছে, যার একটিতে সই মাত্র ২৪টি আর আরেকটিতে একটিও নয়। কিন্তু গ্রাম দুটিতে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা হাজারের ওপর। ফলে যা দেখানো হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করে রাজ্য সরকার। তার শুনানি শেষ হলেও এখন রায় প্রকাশের অপেক্ষা। এই আন্দোলনের একজন কর্মী সৌরভ প্রকৃতিবাদী বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্য এই মামলাটিকে বনাধিকার আইনের আওতা থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের আওতায় ফেলতে চাইছে। ব্যাখ্যা করে তিনি জানান, প্রকল্প ছাড় পাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত আইনকে যেভাবে লঘু করে দেখানো হয়েছে, তাতে বাস্তবে প্রাণ-প্রকৃতির বিপুল ক্ষতি হলেও পরিবেশ আইনের অঙ্কের হিসাবে সরকার বলতে চাইছে তা প্রকৃতি অসংবেদী নয়। তাঁর মতে, যেহেতু রিট পিটিশনটি বনাধিকার আইনকে ভিত্তি করেই করা হয় এবং বনাধিকার বিষয়টি যেভাবে গণমানসে ও চর্চায় ঢুকে পড়েছে তাতে সরকারের পক্ষে পার পাওয়া সহজ হবে না। শুক্রবারের জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে উপচে পড়া জনসমাবেশ বোধহয় এ কথাই প্রমাণ করছে।
এই সভা আটকাতে জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের যথেষ্ট তৎপরতাও লক্ষ্ করা গিয়েছে। ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর অযোধ্যা পাহাড়ে প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ এবং অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ‘জনচেতনা র্যালি’র সাতজন নেতৃত্ব স্থানীয় উদ্যোক্তা প্রকৃতি বাঁচাও মঞ্চের সুপেন হেমব্রম, আযোদিয়া ঘাট পারগানার শ্যামসুন্দর মান্ডি, আযোধিয়া পিড় পারগানার গুলান মুর্মু, ভূমিজ মুন্ডা কল্যাণ সমিতির কেদার সিং মুড়া, বাঘমুন্ডি মুলুক পারগানার নকুল বাস্কে, জুয়ান মহলের পুরুলিয়ায়া জেলা পারসেৎ রাজেন টুডু ও পুরুলিয়া সদর তল্লাট পারগানার রাজেশ্বর টুডুর বিরুদ্ধে ডিএম অ্যাক্টে মামলা দায়ের করা হয়।
শুক্রবার ভোরে কলকাতা থেকে পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া ‘অযোধিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলন’ স্ংহতি মঞ্চের আহ্বায়ক সৌরভ প্রকৃতিবাদী এবং দুই সদস্য সুরজিৎ চক্রবর্তী ও হিরণ্ময় চট্যোপাধ্যায়কে হুড়া থানার প্রায় ছ’ঘণ্টা আটক করে রাখে। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, এই কর্মসূচি আটকানোর জন্য পুলিশ ও প্রশাসন জেলার নানা স্থানে ব্যারিকেড করে রাখে এবং আন্দোলনকারীদের বাস-গাড়ির পথরোধ করে। এছাড়া নানা ছল,চাতুরি করে মিছিলের অংশগ্রহণকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে ছিল প্রশাসনিক হুমকিও। উদ্যোক্তাদের দাবী, প্রশাসনিক বাধা সত্ত্বেও পুরুলিয়া ছাড়াও, বাকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান থেকে প্রায় ৪০০০ আদিবাসী মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজেন টুডু বলেন, “আমরা আদিবাসীরা প্রকৃতির মতোই শান্ত। আবার রেগে গেলে প্রকৃতির মতোই অশান্ত হই। আমরা যাঁরা প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে নিজেরা বেঁচেবর্তে থাকি তারাই যেন আজ অপরাধী।” প্রশাসনকে সতর্ক করে তিনি বলেন, “প্রশাসন ও সরকার জেনে রাখুক, বিরসা-সিধো-কানুরা আজ নেই কিন্তু তাঁদের রক্ত আমাদের শরীরে বইছে।”
আন্দোলনকারীরা জানান, তাঁদের সাতদফা দাবির প্রেক্ষিতে পুরুলিয়া প্রশাসন স্বীকার করেছে বনাধিকার আইন প্রয়োগ না-করার ক্ষেত্রে ভুল স্বীকার করে ও ‘উদাসীনতা’ রয়েছে বলেও মেনে নেন। আগামী ১০ নভেম্বর প্রশাসন আদিবাসী দপ্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একই সঙ্গে পরিবেশ ও বনাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের কোনও ভাবে হেনস্থা করা হবে না বলেও জেলা প্রশাসন কথা দেয়। প্রকৃতি বাঁচাও মঞ্চের অন্যতম আহ্বায়ক, সুপেন হেমব্রম বলেন, “বনাধিকার আইন প্রশাসনের নিজের থেকে প্রয়োগ করার কথা। গ্রামসভা গঠনের কাজও তাদের কর্তব্য। অথচ আইন পাশ হওয়ার ১৫ বছর পরও এ বিষয়ে তারা উদাসীন।” তাঁর প্রশ্ন, আসলে এ উদাসীনতা নাকি পরিকল্পিত ছক? তিনি জানিয়ে দেন সমস্ত দাবি আদায় না-হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। পুরুলিয়ায় অযোধ্যা পাহাড় সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আদিবাসী জমি ও বনভূমি দখল করে লাগামহীন পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলনকারীদের সাতদফা দাবি সনদে বলা হয়েছে, আযোধিয়া বুরুতে অনেক দর্শনীয় স্থানের নাম বিকৃত করা হয়েছে, তা আদি নামে ফিরিয়ে দিতে হবে। ট্যুরিজমের নামে মোচ্ছব করে প্লাস্টিক ও পলিথিন থেকে পাহাড় ও বনকে রক্ষা করতে হবে। এছাড়া সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় কেন্দ্রস্থল ল-বির বাইসি-সুতানটান্ডি, মারাংবুরু পাহাড়কে সংরক্ষণ করতে হবে।
Good news