“কোমলগান্ধার”-এর জয়া বা জয়ার মতো মেয়েরা আমাদের বন্ধু, আমাদের কমরেড। তারা বাড়িতে, পরিবারে ঝামেলা করে রাজনীতি করতে আসে। তারা বিদ্রোহ করে, মিছিলে হাঁটে, সশব্দে স্লোগান দেয়। আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শ্রম দেয়। তারপর, একদিন হারিয়ে যায়। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটা হয়ে এসেছে। এই চিত্রটির মধ্যে যে একটি গভীর রাজনৈতিক সমস্যা আছে, তা সার্বিক ভাবে ভাবা হয়নি। মনে করা হয়েছে, এইটাই স্বাভাবিক। মনে করা হয়েছে, এটাই বাস্তব। সর্বোপরি এই যে বাস্তবতা, এটিকে মনে করা হয়েছে, মেয়েদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা। সার্বিক, যৌথ ব্যর্থতা নয়। লিখেছেন নন্দিনী ধর।
১.
ঋত্বিক ঘটকের ছবি “কোমলগান্ধার”-এর একটি পার্শ্বচরিত্র জয়া। চলচ্ছিত্রের পর্দায় তার রূপ দিয়েছিলেন অভিনেত্রী চিত্রা সেন। জয়া থিয়েটার করতে আসে একটি ব্যতিক্রমী, বামপন্থী দলে। সেই দলটি হতে পারে রূপক — ভারতীয় গণনাট্যে সংঘের, কিংবা খোদ কমিউনিস্ট পার্টির। কিংবা, হতে পারে নিছক একটি নাটকের দলই। এইরকম কতই না সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক যৌথতার কথা আমরা জানি! তো, মূল বিষয়টি হলো, তরুণী জয়া দলটির সদস্য। সে আসে নাটক করতে লুকিয়েচুরিয়ে। বাড়িতে মার খেতে খেতে। বাড়িতে মার খায়, তবুও নাটক করা ছাড়বে না সে। দলের বয়ো:জ্যেষ্ঠরা সহানুভুতিশীল। তাঁরা মমতা দিয়েই দেখেন মেয়েটির জীবনকে, সাংস্কৃতিক জীবনে তার অংশগ্রহণকে।
কিন্তু, ব্যস। ওই পর্যন্তই। এর থেকে বেশি জায়গা জয়া বা তার লড়াই ঋত্বিকের ছবিতে পায়নি। যেমন, এমন একটি দৃশ্যও ছবিটিতে নেই, যেখানে আমরা দেখতে পাই জয়া তার পরিবারের সাথে লড়াইরত। অর্থাৎ, জয়ার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ যে লড়াই, যে লড়াই ভিন্ন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হবে তার বাকি জীবনের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক লড়াইও, তাকে ঠেলে দেওয়া হলো দর্শকের দৃষ্টিমুখের বাইরে। ফলত, সেই লড়াই ছবিটির যে তত্ত্ববিশ্ব, সেখানে সম্পূর্ণ মান্যতা পেলো না। হয়ে রইলো নিছকই নৈমিত্তিক, আনুষাঙ্গিক ঘটনা হিসেবে। যার উল্লেখ, চকিতের জন্য হলেও, দর্শককে জয়ার প্রতি এক ধরনের ভাবালুতায় ভরিয়ে দেয়। এবং, পাশাপাশি, এও শেখায় যে জয়ার পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তা আসলে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক লড়াই, তার অঙ্গাঙ্গী অংশ হয়ে উঠবে না। থেকে যাবে মূল ঘটনাবলীর পটভূমির একটি পার্শ্বঘটনা হয়ে।
উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো এই যে, ঋত্বিক যে বিশেষ দৃশ্যমানতার বুনোটটি হাজির করলেন আমাদের সামনে, তা প্রকৃতপক্ষে বাংলার বাম আন্দোলনের অতীব প্রতিনিধিত্বমূলক আখ্যান। যেখানে, নারীপ্রশ্নটিকে উত্থাপান করা হয়, বহুসহময়েই নারীপ্রশ্ন আসে সামাজিক অনগ্রসরতার রূপক হয়ে, মেয়েটিকে স্থান দেওয়া হয় বৃহত্তর রাজনৈতিকতার সর্বজনীন ক্ষেত্রে, এবং তারপর, প্রশ্নটিকে ঠেলে দেওয়া হয় সেই রাজনৈতিকতার পরিধির বাইরে। অত:পর, নারীপ্রশ্ন বিষয়টি রয়ে যায় চর্চিত বামপন্থার মধ্যে একধরনের সেন্টিমেন্টালিটির আধার হয়ে। রাজনৈতিক প্রশ্ন বা কাট্যাগরি হিসেবে নয়। কাজেই, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, নারীপ্রশ্নটি বামপন্থী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে হয়ে ওঠে বি-রাজনীতিকৃত। এবং, এই যে বামপন্থার মধ্যে নারী প্রশ্নটির বি-রাজনীতিকরণ, তার আছে একটি ব্যবহারিক রাজনৈতিক সুবিধার দিকও।
যেমন ধরুন, জয়ার কথাই। যে মেয়েটি প্রতিনিয়ত পরিবারের সাথে লড়াই করে রাজনৈতিক থিয়েটার করতে আসে, তার মুখ দিয়ে একটিও রাজনৈতিক বক্তব্য শুনলাম না আমরা। শুনলাম না তার মুখে থিয়েটার নিয়ে কোনো জরুরি কথা। সে রয়ে গেলো কোরাসের একটি কণ্ঠস্বর হয়ে। সে রয়ে গেলো দলের সবার ছটপটে, অস্থিরমতি “ছোটবোন” হয়ে। যখন তার মধ্যে কোনো ধরনের মানবিক বৈষয়িকতা আমরা দর্শক হিসেবে প্রত্যক্ষ করলাম, তা হয়ে উঠলো রোমান্টিক চেতনা, যৌন বৈষয়িকতা। যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা বহু ক্ষেত্রে অভিহিত করেছেন “এজেন্সী” বলে। অর্থাৎ, কি দাঁড়ালো? ছবিটির প্রতীকী বিশ্বে কি দাঁড়ালো? বাম আন্দোলনের যে সার্বিক ক্ষেত্র, সেখানে মেয়েদের দেওয়া হলো একটিই মাত্র স্বাধিকারের জায়গা — প্রেমে পড়ার ও মনমতো জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার। এবং, সেই স্বাধিকারটি এলো তার রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরের বিনিময়ে, মূল্যে।
কাজেই, কি আশ্চর্য! যে মেয়েটি বাড়িতে মার খেয়ে, ঝামেলা করে রাজনৈতিক নাটক করতে আসে, সে কেমন চুপচাপ এই কখনো মিষ্টি ছোটবোন, কখনো স্বপ্নমেদুর প্রেমিকার ভূমিকা — এবং শুধুই সেই ভূমিকাগুলিতেই অবতীর্ণ হওয়া — বিষয়গুলিকে মেনেও নিলো। দলের মরদদের তুমুল বাওয়াল দিলো না। তার মানে দাঁড়ালো কি? একদিকে যেমন ঋত্বিক জয়ার বিদ্রোহকে দেখালেন তাঁর ছবিতে, আবার সেই বিদ্রোহের চতুর্দিকে টেনে দিলেন একটি লক্ষ্মণরেখাও। জয়ার হাত ধরে পিতৃতন্ত্রবিরোধী লড়াইয়ের আভাসের কথা এলো ঋত্বিকের ছবিতে। এবং, প্রায় পরবর্তী মুহূর্তেই সেই আগমনের যে ক্ষুরধার অস্তিত্ব, তা ভোঁতা করেও দেওয়া হলো। আমরা দর্শক হিসেবে জানলাম, একটি মেয়ে পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বামপন্থী ক্ষেত্রগুলিতে পদার্পণ করতে পারে। কিন্তু, সেই পদার্পণের সাথে সাথেই, সমস্ত বিদ্রোহ — বিশেষত, তা যদি হয় পিতৃতন্ত্র বিরোধী —তাকে রেখে আসতে হবে দোরগোড়ায়।
এই প্রতিস্থাপনের মধ্যে, ঐতিহাসিক ভাবে দেখতে গেলে, ব্যতিক্রমী কিছুই নেই। বরং, এটাই হলো, সর্বার্থে প্রতিনিধিত্বমূলক বাম লিঙ্গরাজনীতি। অন্যদিকে, এই জয়াকে আমরা চিনি। জয়া বা জয়ার মতো মেয়েরা আমাদের বন্ধু, আমাদের কমরেড। তারা বাড়িতে, পরিবারে ঝামেলা করে রাজনীতি করতে আসে। আমরা জানি সেসব কথা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা উসকেও দিই তাদের বিদ্রোহ। সাংগঠনিকভাবে তাদের বোঝাই, বাড়িতে ঝামেলা করতে হবে। বোঝাই, পরিবারের সাথে এই বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই প্রস্তুত করতে হবে নিজের রাজনৈতিক স্বকীয়তা, আত্মীয়তা। এবং, এর মধ্যে আছে বিদ্রোহ। গুরুতর, গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ। তারা বিদ্রোহ করে, মিছিলে হাঁটে, সশব্দে স্লোগান দেয়। আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শ্রম দেয়। তারপর, একদিন হারিয়ে যায়।
কেউ কেউ নিজেদের কমরেডকেই বিয়ে করে। সেই প্রেম ও বিবাহ কখনো কখনো তৈরী করে আরও আরও বিদ্রোহ বিদ্রোহভাব। এবং, পরবর্তী সময়ে, আরও আরও জটিলতা। বিশেষ করে, পুরুষটি যদি হোলটাইমার হয়। নিজেদের কমরেডকে যে মেয়েরা বিয়ে করে, বিশেষত: হোলটাইমারদের, তারা ঠিক হারায় না। তবে সংগঠন/রাজনীতিও করে না। অধিকাংশ সময়ে, অন্য সৃষ্টিশীল কাজেও দেখা যায় না তাদের। তাদের দেখা যায় কখনোসখনো — মিটিংমিছিলে ভীড় বাড়ানোর দলে। তাদের কেউ কেউ হয়ে থাকে যৌবনের রাজনীতি করার দিনগুলি সম্পর্কে গভীরভাবে নস্টালজিক। কেউবা অতীব তিক্ত। কখনো কখনো দুটোরই সহাবস্থান ঘটে থাকে একটি মানুষের মধ্যে। অবশ্য, এখন আর এই সামাজিক গণমাধ্যমের যুগে কেউ ঠিক হারায় না। বরং, যৌবনে রাজনীতি করা মেয়েরা ফেসবুকের পাতা ভরে সন্তানদের ছবি, নিজেদের রন্ধনপটীয়সীতার সচিত্র প্রমাণ ইত্যাদি দিয়ে হাততালি — থুড়ি, লাইক, লাভ — কুড়োয়। ব্যতিক্রম কি নেই? আছে। কিন্তু, এটাই মূলগত চরিত্র। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হয়ে এসেছে। এই চিত্রটির মধ্যে যে একটি গভীর রাজনৈতিক সমস্যা আছে, তা সার্বিক ভাবে ভাবা হয়নি। মনে করা হয়েছে, এইটাই স্বাভাবিক। মনে করা হয়েছে, এটাই বাস্তব। সর্বোপরি এই যে বাস্তবতা, এটিকে মনে করা হয়েছে, মেয়েদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা। সার্বিক, যৌথ ব্যর্থতা নয়।
এর মধ্যে রয়েছে আরও গভীর একটি বোধ — যা কখনোই এদেশের বামপন্থী তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভেতরে যথাযথভাবে আলোচিত বা বিনির্মিত হয়নি। তা হলো, পরিবারের সাথে মেয়েদের সম্পর্ক। ধরে নেওয়া হয়েছে, পরিবারই হবে মেয়েদের “স্বাভাবিক” জায়গা। প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে। তাই, ওই ঋত্বিকের ছবির জয়ার মতো, নিজের কমরেডের সাথে প্রেম — বহুক্ষেত্রেই বাড়ির অমতে — এবং তারপর তার সাথে বিবাহ, ও নিজের পরিবার গঠন, এর মধ্যেই চাপা পড়ে গেছে নারী ও লিঙ্গ প্রশ্ন।
২.
আসলে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রায় সূচনা মুহূর্ত থেকেই, পরিবার বিষয়টি ছায়ার মতো পেছনে সেটকে আছে। তাই তো হওয়ার কথা। “পরিবার” ও “পারিবারিকতা” বাদ দিয়ে কি-ই বা হয়? বিশেষ করে ভারতবর্ষে? বিশেষ করে ভারতীয় রাজনীতিতে? আরেকটু বিশদে বলি। যেমন ধরুন, আনিয়া লুম্বা তাঁর “রেভলিউশনারী ডিসায়ার্স” বইটিতে জানালেন, ওই বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে শুরু করে মোটামুটি ১৯৪৭ পর্যন্ত, মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে কমিউনিস্ট পার্টি বা পার্টি-সংলগ্ন যে গণসংগঠনগুলি, সেগুলি করতে আসার পেছনে কিছু বিশেষ কারণ ছিল। সেই বিশেষ কারণটি হলো, কমিউনিস্ট পার্টি বা তৎসন্নিগ্ধ যে গণসংগঠনগুলি, সেখানে সদস্য হতে গেলে মেয়েদের প্রয়োজন পড়তো না “অভিভাবক” দের সম্মতির। যার প্রয়োজন হতো কংগ্রেস সহ অন্যান্য মধ্যপন্থী ও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলিতে। কাজেই, প্রকৃত অর্থে, বাকি মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির তুলনায়, এক বিপুল অগ্রসরতার মধ্য দিয়েই কমিউনিস্ট পার্টি নারী তথা লিঙ্গ প্রশ্নে তার যাত্রা শুরু করে। এই অগ্রসরতার ছিল কিছু বিশেষ ভিত্তি।
এক, ব্যক্তি নারীকে কমিউনিস্ট পার্টি সংস্কৃতি দেখেছিলো প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে। পরিবারের ওপর নির্ভরশীল, নিজস্ব মতামতবিহীন একধরনের দ্বিতীয় শ্রেণীর জীব হিসেবে নয়। দুই, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে দেখার ফলে, ব্যক্তি নারীকে কমিউনিস্ট পার্টি দিয়েছিলো স্বাধীন, রাজনৈতিক একক হয়ে ওঠার সুযোগ। কাজেই, একভাবে দেখতে গেলে, “চয়েস” বা “ইচ্ছা/অভিমত” — এর রাজনীতি, মূলস্রোতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বহু আগে, তাকে ভারতীয় সমাজে মেয়েদের কাছে হাজির করে কমিউনিস্ট পার্টি। এবং, তা করে মেয়েদের রাজনৈতিক সংগঠন করার স্বাধীনতার প্রশ্নটির মধ্যে দিয়ে। তার সাথে, খুব স্পষ্ট করে না হলেও, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পার্টির হাত ধরে আসলো পরিবার, পরিবারের মধ্যে মেয়েদের অবস্থান ও ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্ত:সম্পর্কের প্রশ্নটি। এবং, একভাবে দেখতে গেলে পরিবারের যে নিয়ন্ত্রণ সাধারণভাবে একটি মেয়ের জীবনে অতিমাত্রায় কায়েম হয়ে তার প্রায় সমস্ত সিদ্ধান্তকেই আচ্ছন্ন করে দেয়, এবং যাকে আমরা সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের বৈশিষ্ট্য বলেই জানি, তার বিপরীতে একধরনের উদারনৈতিক ব্যক্তিস্বাধীনতার ভাবনা নিয়ে আসে কমিউনিস্ট পার্টি। খুব স্পষ্টভাবেই তবে, যে উদারনৈতিক ধারাবাহিকতায় প্রবাহিত হতে শুরু করেছে ঊনিশ শতক পরবর্তী মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েদের জীবন, যার মধ্যে আছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র আনীত সমাজশোধন, আধুনিক শিক্ষাজগত ও কিছুটা শোধিত বিবাহব্যবস্থা, সেই উদারনৈতিক আধুনিকতা ও সংস্কারের হাত ধরেই এলো কমিউনিস্ট পার্টি ও বাম সংস্কৃতিও।
ফলশ্রুতি হিসেবে, পার্টির চৌহদ্দি বা তার গণসংগঠনগুলির চৌহদ্দিতে আসা মেয়েদের কাছে তৈরী হলো একটি পৃথক ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের ধারণা। ঠিক এই শব্দে, এই ভাষায় তৈরী না হলেও, হলো। যে ব্যক্তিগততার ধারণার হাত ধরেই জয়ার বাড়িতে মার খাওয়ার গল্প ঋত্বিকের ছবিতে আসে। “ব্যক্তিগত” সেখানে জয়ার পরিবার, পারিবারিক জীবন। “সর্বজনীন” বলতে নাটকের দল। বকলমে কমিউনিস্ট পার্টি। একদিক থেকে দেখলে নাটকের দল/কমিউনিস্ট পার্টির জায়গায় থাকতেই পারতো মেয়েটির কর্মক্ষেত্র। এবং, একটু ভাবলেই যেটা দেখা যাবে, ঋত্বিকের সতীর্থ সত্যজিত রায়ের “মহানগর” ছবিটিতে এলো ঠিক এই দ্বন্দ্বটিই। বাড়ির বৌয়ের কর্মক্ষেত্রে পা দেওয়া, এবং তদজনিত পারিবারিক টানাপোড়েন। অদ্ভুতভাবে, ঋত্বিকের প্রায় কোনো ছবিতেই এলো না অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের মাধ্যমে বাঙালি মেয়ের স্বাধীন বৈষয়িকতা খোঁজার গল্প। কিংবা, যখন এলো “মেঘে ঢাকা তারা” ছবিটিতে, তখন মেয়েটির অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পেছনে যে শ্রম, তা হয়ে উঠলো মেয়েটির পরিবার, তথা দেশভাগজনিত সার্বিক দুর্দশার যূপকাষ্ঠে বলির রূপক হয়ে। যদিও, বাস্তবে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি ও তার গণসংগঠনগুলি, মেয়েদের — মধ্যবিত্ত মেয়েদের — অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিষয়টিকে গভীরভাবেই আজেন্ডা করেছে। বহুক্ষেত্রেই তার ফলশ্রুতি দাঁড়িয়েছে হোলটাইমার বর – চাকুরিরতা বৌ, যার অন্তর্নিহিত রাজনীতির ওপর বহুলাংশেই দাঁড়িয়েছে কমিউনিস্ট বিপ্লবীয়ানার অন্তরঙ্গ অর্থনীতি — যে বিষয়টির মূল্যায়ন ব্যতীত যে কোনো কমিউনিস্ট লিঙ্গ রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ আলোচনাই রয়ে যাবে অসম্পূর্ণ। তবে, এই লেখাটির বিষয় ঠিক তা নয়।
একদিক থেকে এই লেখাটি ভয়ঙ্করভাবে সীমিত। লেখাটি গড়ে উঠেছে মূলত শহুরে, মধ্যবিত্ত মেয়েদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে ঘিরে। যাঁরা ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে মূলত বাম-আন্দোলনের ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছেন। এছাড়াও, শ্রমজীবী মেয়েরা, গ্রামীণ বা মফস্বলের মেয়েরা, বা আন্ডারগ্রাউন্ড লড়াই করা মেয়েরা, তাঁদের অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করার কোনো দাবি এ লেখা করে না। অর্থাৎ, বাম আন্দোলনের ভেতরকার ক্ষেত্রগুলি বা সেখানকার মানুষরা, তাঁদের পরিচিতি বা পরিকাঠামোগত স্থিতির জায়গা থেকেও যে পৃথক পৃথক, সে সম্পর্কে এই লেখাটি ওয়াকিবহাল। এবং, সেই সব অভিজ্ঞতাগুলিকে একটি লেখায় ধরা যাবে বলেও এই প্রতিবেদকের মনে হয় না। যদিও, সেই সব পৃথক পৃথক অভিজ্ঞতাগুলির নথিভুক্তিকরণ ও বিশ্লেষণ, একইভাবে জরুরি।
এই লেখার প্রতিপাদ্য দুটি বিষয়। এক, উদারনৈতিক ভাবধারার বিকাশের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির — বিশেষত: ভারতবর্ষে — রয়েছে এক গভীর যোগাযোগ। বহুক্ষেত্রেই, একটু ঝাড়পোঁছ করে, উদারনৈতিক ভাবধারাই স্থান পেয়েছে প্রাত্যহিক কমিউনিস্ট রাজনৌতিক কর্মকান্ডে, চর্চায় ও চর্যায়। একথা বিশেষভাবে সত্য নারীপ্রশ্নে বা লিঙ্গপ্রশ্নে। তাই, একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে কমিউনিস্ট পার্টি বামপন্থী রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে সমাজসংস্কার, তা সাধারণভাবে উদারনৈতিকতার গন্ডি পেরোয়নি। দুই, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রটিকে নিয়ে ঠিক কি করা হবে, এটা কমিউনিস্ট রাজনীতিতে কোনোদিনই ঠিক নির্ধারণ করা যায়নি। সমাধান তো দূরের কথা। ঠিক উদারনৈতিক সর্বজনীন ক্ষেত্রসমূহের মতোই। যদিও, পরিবার বা পারিবারিকতাকে বাদ দিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি হয়নি এপর্যন্ত। যেমন পরিবার বিষয়টিকে বাদ দিয়ে চলে না উদারনৈতিক সর্বজনীনতাও।
কিন্তু, যেহেতু “ব্যক্তিগত” বিষয়টি নিয়ে ঠিক কি করা হবে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে, তা ঠিক জানা নেই কারোর, তাই “পরিবার” বিষয়টিও কমিউনিস্ট রাজনীতিতে এলো, অসমভাবে। একদিকে যেমন তৈরী করা হলো পরিবারের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ, বা ন্যূনতমভাবে দূরত্ব সৃষ্টির বাতাবরণ, অন্যদিকে তৈরী হলো ব্যাপক-পরিমাণে পরিবার বা পরিবারজাত মূল্যবোধের ওপর নির্ভরশীলতা। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে, অধিকাংশ জায়গাতেই সমাজে যা যা সাম্যবিহীনতা, বিকৃতি নিয়ে পরিবার বিষয়টি টিকে থাকে, সেসব সহই কমিউনিস্ট অন্তরঙ্গ সংস্কৃতি গড়ে উঠলো।
আসলে, একভাবে দেখতে গেলে, কমিউনিস্ট রাজনীতি — বিশেষত: তার প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে বলা যায় — একজন ব্যাক্তিমানুষকে, তার লিঙ্গ ব্যতিরেকেই, তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করার রাজনীতি। একজন “সাচ্চা কমিউনিস্ট”-এর ঠিক সেইভাবে “পারিবারিক” হওয়া হয়ে ওঠে না। খুব স্বাভাবিক কারণেই। তার জীবনযাত্রার প্রাত্যহিকতার যে পরিকাঠামোগত বুনোট, তার কারণেই। কাজেই, একজন কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটি সামাজিক সংঘাত। না, সে সংঘাত শ্রেণী সংঘাত নয়। যদিও, শ্রেণী বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতে পারে এই বাস্তবতার সাথে।
সেই সংঘাতটি একভাবে দেখতে গেলে, শ্রেণীর মতোই প্রায় ভিত্তিগত। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, কমিউনিস্ট রাজনীতি সমাজের যে ভিত্তিগত পারিবারিক দায়িত্ববোধের ধারণা, তার বিপরীতে একটি অন্যতর দায়িত্ববোধের নীলছককে হাজির করে। কাজেই, তিনি হতে পারেন দোর্দন্ডপ্রতাপশালী, অতি ম্যাচো কমিউনিস্ট নেতা। কিন্তু, সামাজিক অর্থে যেভাবে দায়িত্ববান, দায়িত্বশীল পারিবারিকতার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তিমানুষের আধ্যিপত্যকারী পৌরুষের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার যে পদ্ধতি ও ব্যবস্থা, তার থেকে একজন কমিউনিস্ট বঞ্চিত। এবং, অন্যভাবে বলতে গেলে, সেই মূলস্রোতের পারিবারিক দায়িত্ববোধের মধ্য দিয়ে যে সামাজিকভাবে আধিপত্যকারী পৌরুষের সংজ্ঞা তৈরী হয়, তাকে নাকচও করে থাকেন বইকি একজন ব্যক্তি কমিউনিস্ট। অন্তত খাতায় কলমে। এবং, সেখানেই সংঘাত। সমাজের সাথে। সমাজের আধিপত্যকারী দর্শনের প্রতিনিধিত্ব করা তার পরিবারের সাথেও।
তাই, কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসের গভীর লিঙ্গপাঠ যদি করতে হয়, তাহলে দেখা যাবে, কমিউনিস্ট পার্টি একভাবে সমাজের বুকে একটি অন্য পৌরুষ সৃষ্টির প্রচেষ্টার মধ্যে টিকে থেকেছে। সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে একাধিক গুণাবলী। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকতার ওপর দখল, সুবক্তা হতে পারার ক্ষমতা, সুসংগঠক হতে পারার ক্ষমতা, “শ্রেণীর” কাছে দায়বদ্ধতা, পার্টির প্রতি দায়বদ্ধতা, সমাজবদলের প্রক্রিয়ার প্রতি দায়বদ্ধতা। পারিবারিক দায়িত্ববোধ কমিউনিস্ট পৌরুষের ক্ষেত্রে মূল নির্ধারক হয়ে ওঠেনি। যদিও, একজন কমিউনিস্ট ঠিক সেই অর্থে সন্ন্যাসীও নন। তিনি যৌন জীব। ঐতিহাসিকভাবে কমিউনিস্ট তত্ত্বে বিবাহব্যবস্থাকে সমস্যায়িত করা হলেও, বিবাহই কমিউনিস্ট তথা বাং সংস্কৃতির মধ্যে যৌনতার প্রাতিষ্ঠানিক অভিব্যক্তির মূল আধার। অতএব, চর্চার ক্ষেত্রে যা দাঁড়িয়েছে তা হলো, একজন কমিউনিস্ট পুরুষ পারিবারিক দায়িত্ববোধ বড়ো একটা স্বীকার করেন না। কিন্তু, যেহেতু তিনি ঠিক ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী নন, পরিবার ও বিবাহই তার কাছে হয়ে ওঠে বিভিন্ন সময়ে মূল অবলম্বনের জায়গা। কাজেই, পরিবার বিষয়টিকে যথাযথভাবে রাজনৈতিক প্রশ্নচিহ্নের সামনে ফেলার ক্ষেত্রে, কমিউনিস্ট পার্টি ও সংস্কৃতির পক্ষে ঠিক সম্ভব হয় না।
বলা বাহুল্য, এর ফল কমিউনিস্ট সংস্কৃতির ক্ষেত্রগুলিতে যে মেয়েরা বিভিন্ন ভাবে পদার্পন করে থাকে, তাদের পক্ষে বিষয়টা হয়ে ওঠে জটিল। তারা অবশ্যম্ভাবীভাবেই পর্যবসিত হয় পুরুষ কমিউনিস্টদের অবলম্বনে। একক ভাবে রাজনৈতিক বৈষয়িকতার ধারকবাহক হয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। “কমিউনিস্ট” শব্দটি বললে, তাই আমাদের মানসচক্ষে এক বিশেষ ধরনের পুরুষদের চিত্রই ভেসে ওঠে। কমিউনিস্ট আত্মতা, বকলমে, প্রায় সর্বতভাবেই, আমাদের কাছে পুরুষ আত্মতা নিয়ে হাজির হয়।
৩.
মোটামুটি, কমিউনিস্ট রাজনীতিতে পা রাখার সাথে সাথেই শুরু হয় একজন ব্যক্তির এই নিজের পরিবার থেকে দূরূত্বসৃষ্টির ট্রেনিং। তাকে উৎসাহ দেওয়া হয় বাড়িতে ঝামেলা করে সংগঠনের সাথে আরও বেশি বেশি করে সম্পৃক্ত হতে। যে বা যারা সেটা সার্থকভাবে করে উঠতে পারে, তাদের বাহবা দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদাহরণও করে তোলা হয়। এবং, মিথ্যে বলবো না, তরুণ বয়সে এই যখনতখন বাড়ি থেকে বেরোনো, মাঝেমধ্যেই বাড়িতে না ফেরা, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পরিবারের মধ্যে যে একধরনের অনুরণন তোলা যায়, তাতে নিজের মধ্যেও বেশ বিদ্রোহ-বিদ্রোহ ভাব জাগে। নিজের মধ্যে তৈরী হয় “আলাদা” হওয়ার আত্মশ্লাঘা।
এবং, এই আত্মশ্লাঘা বিষয়টিকে সাংগঠনিক জীবনের আগাপাশতলা অঙ্গ করে তোলাতে সাধারণভাবে কতগুলো যৌথ কর্মসূচিও নেওয়া হয়। অবশ্যই, সেসব ঘটে থাকে অনানুষ্ঠিনকভাবে। অলিখিত চুক্তির মতন অনেকটা। কাজেই, একটা বড়ো সময় জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্গত যে গণ-সংগঠনগুলি, বা খোদ পার্টিরই, মিটিং হয় গভীর সন্ধ্যায় বা রাতে। সারা রাত ধরে। সদস্যরা বহু সময়েই কাটান বাড়ির বাইরে। বাড়িতে ফেরেন না একাধিক দিন।
কখনো কখনো তার প্রয়োজন থাকে বটে। বা, ঐতিহাসিকভাবে থেকেছে। কিন্তু, সত্তর-পরবর্তী যে নাগরিক প্রেক্ষাপটে বামপন্থার ভাঙাহাটে আমরা প্রায় সবাই রাজনীতি করেছি, সেখানে এই জাতীয় চর্যা নিজেদের ভেতরে উত্তেজনা জাগানো আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়। এইরকম একাধিক যুগপৎ উত্তেজনা ও আত্মশ্লাঘা-জাগানো আনুষ্ঠানিকতা আছে কমিউনিস্ট পার্টির জীবনে। তার সবকটিই প্রায় সমাজের যে মূলধারার পারিবারিক তথা সাংস্কৃতিক জীবন, তার থেকে ব্যক্তি কমিউনিস্টদের পৃথকীকরণের পন্থা। এবং, অনস্বীকার্যভাবে, এই সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা বহু ইতিবাচকতার নিদর্শনও তৈরী করেছে সমাজে।
যাই হোক, ফিরে আসি মূল প্রতিপাদ্যে। এই যে রাত্রিব্যাপী মিটিং, বহুদিনব্যাপী মিটিং, বাড়ি ফিরতে না পারা, যে কমিউনিস্ট চর্যা, তা একভাবে দেখতে গেলে, পার্টি ও পার্টিজাত গণসংগঠনগুলিতে, মেয়েদের অংশগ্রহণকে ব্যাহত করেছে। কারণ, সময় লিঙ্গায়িত। স্থানও। সময় লিঙ্গায়িত, তাই মেয়েদের তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হয়। সময় লিঙ্গায়িত, তাই মেয়েদের হোস্টেল, মেস, পেয়িং গেস্ট ইত্যাদি জায়গায় বাঁধাধরা সময় থাকে ফেরার। তা হতে পারে সন্ধ্যা ছটা, কিংবা রাত দশটা। যদিও দ্বিতীয়টি ঘটে থাকে খুবই কম ক্ষেত্রে। সময় লিঙ্গায়িত, তাই মেয়েদের বাইরে রাত কাটানো মানা। (মনে পড়ে মৃণাল সেনের “একদিন প্রতিদিন” ছবিটি?) স্থান লিঙ্গায়িত, তাই মেয়েদের শেখানো হয়, তার পারিবারিক গৃহ ব্যতীত, গোটা জগৎটিই বিপদকীর্ণ।
স্থান লিঙ্গায়িত, তাই মেয়েদের — বিশেষত মধ্যবিত্ত মেয়েদের — বারবার শুনতে হয়, “এই জায়গাটা ঠিক ভদ্রঘরের মেয়েদের যাওয়ার মতো নয়।” স্থান লিঙ্গায়িত, তাই আজও হাতে গোনা গুটিকয়েক বড়ো শহর বাদ দিলে, ভারতবর্ষের কোনো জনপদেই প্রায় মেয়েদের জন্য ব্যবহারযোগ্য সর্বজনীন প্রসাবগার নেই। স্থান লিঙ্গায়িত, তাই রাস্তায় চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কেবিন-জাতীয় রেস্টুরেন্ট থেকে কফিহাউজ — অর্থাৎ, যে যে জায়গাগুলি দেখা করা, আলোচনা করা বা মিটিং করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বামপন্থী সংস্কৃতিতে, তার কোনটিতেই মেয়েদের প্রবেশ খুব সহজে হয়নি। অর্থাৎ, খুব গোদাভাবে বলতে গেলে, বামপন্থী আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে, মেয়েদের এমন অনেক দায়ভার বহন করতে হয়েছে, যা শুধুই তাদের।
কাজেই, এই যে, যে সময়টিকে বলা হলো তাদের ঘরের ভিতরে থাকার সময়, সেই সময়টিকে নিজের মতন করে রাজনৈতিক সময় করে নিতে মেয়েদের লড়তে হলো অনেক বেশি। যে স্থানগুলোকে বলা হলো তাদের আয়ত্তের বাইরে, সেই “অস্থান-কুস্থান” গুলিকে নিজের বানাতে মেয়েদের লড়তে হলো অনেক বেশি। মানসিক শক্তি ক্ষয় করতে হলোও অনেক অনেক বেশি। এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই, ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেলো যে মধ্যবিত্ত মেয়েরা সাধারণত রাজনীতি করে একটি বিশেষ সময়কালে। তারুণ্যে, ছাত্রজীবনে। আরও বেশি করে দেখা গেলো যে যাদবপুর বা দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে, যেখানে মেয়েদের হোস্টেল বা ক্যাম্পাস জীবনে বিধিনিষেধ তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে মেয়েরা ছাত্রজীবনে রাজনীতি করে বেশি। অন্যদিকে, যে সমস্ত পরিবারে মেয়েদের জীবনে প্রতিদিনকার নিয়ন্ত্রণ কম, সেখান থেকেও মেয়েরা রাজনীতি করে তুলনামূলকভাবে বেশি। ছাত্রজীবন শেষ হলে রাজনীতি ছাড়েও ততোধিক দ্রুতগতিতে।
এবং, এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটাই সামাজিক বাস্তবতা। আশ্চর্যের বিষয় এইখানে যে যারা তাত্ত্বিক-রাজনৈতিকভাবে “বস্তুগত বিশ্লেষণ” “বস্তুগত বিশ্লেষণ” করে চিৎকার করলেন, তাঁরা এই লড়াই বা বাস্তবতাগুলিকে দেখতে পেলেন না। যাঁরা অল্পস্বল্প দেখতে পেলেন, তাঁরা তত্ত্বায়িত করলেন না। নাকি, চাইলেন না? তাই, তাঁদের হাত ধরে, ঐতিহাসিকভাবে এই যে বাস্তবিক জায়গাগুলিতে মেয়েদের বামপন্থী আন্দোলনে অংশগ্রহণ, বাস্তবিক কিছু বাধার মধ্য দিয়ে যাত্রা করা, তার কোনও তত্ত্বায়ন আমরা পেলাম না। ফলে বাম রাজনীতিতেও এসব কিছু এলো না। এবং, ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়, যাঁরা সারাজীবন নাকি পুঁজি ও রাষ্ট্রের মতো জটিল ও বিমূর্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে গেলেন, সেই জটিল ও বিমূর্ত বিষয়ের বিরূদ্ধে পাল্টা লড়াই গড়ে তুলতে চাইলেন, তাঁরা ঠিক তাঁদের নাকের ডগায় ঘটে চলা বাস্তবতা — যা কিনা সামাজিক জীব হলে চোখে পরে সর্বসময়ে, সর্বত্র, যা প্রভাবিত করে তাঁদের প্রত্যেকের কাছের মানুষের জীবন — তাই নিয়ে প্রায় কোনো তত্ত্বায়নই হাজির করতে পারলেন না। অতএব, পুঁজি ও রাষ্ট্রের সাথে পিতৃতন্ত্র বা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত জীবনের কোনো তত্ত্বায়ন ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রায় তৈরী হলোই না বলা চলে। কাজেই, জিজ্ঞাসা করতে সাধ যায়, কমিউনিস্ট রাজনীতির যে মূলগত প্রকল্প, তা কি আসলে শুধু পৌরুষের আস্ফালন? আগ্রাসী পৌরুষজাত যৌথ বৌদ্ধিক স্বমেহন?
কাজেই, এই পৌরুষজাত স্বমেহনের সংস্কৃতির ফলশ্রুতি দাঁড়ালো, একাধিক। নারী নেতৃত্ববিহীন কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ, নারী ক্যাডারের উপস্থিতি থাকলেও প্রায় নারী নেতৃত্ববিহীন বাম গণসংগঠনগুলি। নারী চিন্তকবিহীন বাম- সামাজিক পরিসর। আর, যে হাতে গোনা দু-একটি মেয়ে নেতৃত্ব দিতে পারলো, কিংবা চিন্তক হয়ে উঠতে পারলো, তারা ব্যতিক্রম। তারা ব্যতিক্রম, এবং এক বিশেষভাবে ব্যতিক্রম। তারা ব্যতিক্রম, কারণ তারা কনুইয়ের গুঁতো মেরে পুরুষদের সাথে গলাবাজি করতে পারে। পুরুষদের মধ্যে প্রায়-পুরুষ হয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ, কমিউনিস্ট সংস্কৃতিতে নেতৃত্বে বা নির্ধারক চিন্তক হিসেবে থাকতে পেরেছে বা জায়গা করে নিতে পেরেছে সেই মেয়েরাই, যারা হলো গিয়ে একধরনের “সম্মানীয় পুরুষ” অথবা “অনারারি ম্যান।” অবশ্য, সেই কনুইয়ের গুঁতো, কিংবা গলাবাজিতে যে নি:শর্ত অনুমোদন মিলেছে পুরুষ নেতৃত্বের, বিষয়টা এমনও ঠিক নয়। তবে, সে অন্য কথা।
কাজেই, খুব স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, কমিউনিস্ট ক্ষেত্রে টিকে থাকতে গেলে, একটি মেয়ের পৌরুষায়ন ঘটাতে হবে। কাজেই বিষয়টা অনেকটা এইরকম যে, কমিউনিস্ট পার্টির আধারে সমাজবদলের রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হলেও, পৌরুষের আধিপত্যকারী, আগ্রাসী রূপকে ভেঙে চুরমার করা ভিন্ন যে আসলে কোনো আমূল সমাজবদল সম্ভব নয়, এই আলোচনা কোনোদিন স্থান পেলো না। কাজেই, খুব স্বাভাবিকভাবে যেটা ঘটার কথা ছিল সমাজবদলের রাজনীতিতে, বিশেষত: কমিউনিস্ট পার্টিতে — অর্থাৎ, সাংগঠনিক ক্ষেত্রের বি-পৌরুষায়ন — বা, অন্যভাবে বললে, একধরনের সার্বিক-সর্বজনীন নারীত্বের দর্শনের প্রতিষ্ঠা — তা হলো না। কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে প্রতিষ্ঠিত হলো, আরও আরও বেশি পৌরুষের দর্শন, সংস্কৃতি। এবং, ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে, তার ফল হলোও সাংঘাতিক। এবং, সেই সাংঘাতিক রকমের নেতিবাচক ফলাফল শুধু লিঙ্গ রাজনীতি, বা মেয়েদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রইলো না। এই যে ক্রমাগত অতি-পৌরুষের পারফরম্যান্সের সংস্কৃতি তৈরী হলো পার্টির ভেতর, তার ভার বহন করতে হলো পুরুষ কমরেডদেরও। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্তব্ধ হলো তাঁদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, তাত্ত্বিক, মানবিক বৃদ্ধি। একধরনের চূড়ান্ত আগ্রাসী, ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবাদের রাজনীতির আধার হলো কমিউনিস্ট পার্টি। যদিও, এসবই ঘটলো যৌথতার কথা বলে, লড়াইয়ের কথা বলে, আন্দোলনের দোহাই দিয়ে, শ্রেণী-সংগ্রামের দোহাই দিয়ে।
যাই হোক, “অনারারি ম্যান” ব্যতীত যে মেয়েরা সাধারণভাবে, বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে এলো, এবং চলেও গেলো, তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটি হলো আরেকটু জটিল। পরিবারের থেকে বিযুক্তি তাদের ঠিক তেমনভাবে কোনোদিনই ঘটলো না, কারণ, খুব স্বাভাবিকভাবেই, মেয়েদের পরিবারের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। পরিবারের দায়ভারও তাদের ওপর বেশি। পারিবারিক ঘরোয়া শ্রম ও আবেগজাত শ্রমের দায়িত্বও নিতে হয় তাদের বেশি। এবং, খুব সহজ কথায় বললে, এটাকেই তো বলে পিতৃতন্ত্র।
অন্যদিকে, পিতৃতন্ত্র (বা, যেকোনো সার্বিক, পরিকাঠামোগত বৈষম্যব্যবস্থা) শুধুমাত্র দায়ভারকেন্দ্রিক বা শ্রমকেন্দ্রিক বিষয় নয়। তার সাথে জড়িয়ে থাকে একটি মানুষের অন্তরীণ জীবন, তার মনস্তত্ত্ব। কাজেই, বহুক্ষেত্রেই, পিতৃতন্ত্রের বিরূদ্ধে একটি মেয়ের বিদ্রোহ খুব সহজ হয় না। সহজ হয় না গৃহশ্রম বা পারিবারিক নিত্যনৈমিত্তিক দায়ভার এড়িয়ে রাজনৈতিক (বা সাংস্কৃতিক বা সামাজিক বা কখনো, স্রেফ চাকরি) কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা। ভেতরে চেপে বসে অপরাধবোধ। আমি কি তবে হয়ে গেলাম “খারাপ” মা বা স্ত্রী বা বৌমা বা কন্যা বা বোন? আমি কি তবে হয়ে গেলাম “দায়িত্বজ্ঞানহীন”?
এবং, ঠিক যে কারণে “কোমলগান্ধার” ছবিটিতে জয়ার পরিবারের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ বাদ পড়ে যায় ছবিটির মূল বুনোট থেকে, ঠিক সেই কারণেই এই যে মেয়েটির সামাজিক অবস্থান থেকে শুরু করে ভেতরকার অপরাধবোধ পর্যন্ত জটিল ধারাবাহিকতা, তার কোনটিই আসলে কোনোদিনই প্রায় চর্চিত হয় না বামপন্থী আন্দোলনের ক্ষেত্রে। যদিও, প্রাথমিকভাবে, মেয়েটিকে উৎসাহ দেওয়া হয় পরিবারের বিরূদ্ধে একধরনের বিদ্রোহে শামিল হতে। যেমন, জয়ার ক্ষেত্রেও, তার নাটকের দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের ছিল তার ও তার বিদ্রোহের প্রতি একধরনের সহমর্মিতা। কিন্তু, তার সাথে সাথে, কমিউনিস্ট সংস্কৃতি মেয়েটির সামনে হাজির করে তার নিজস্ব পোষ-মানানোর প্রক্রিয়া। ইতিহাসের একটি বড়ো সময় জুড়ে সেই পোষ মানানো, বা ডোমেস্টিকেশনের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল, মেয়েটিকে কমিউনিস্টের বৌ করে তোলার শিক্ষাপদ্ধতি। বা, বড়োজোর বাধ্য ক্যাডার করে তোলার প্রক্রিয়া। কিন্তু, আবার অবিবাহিত বাধ্য মহিলা ক্যাডারও যেহেতু সংগঠনের বুনোটে সমস্যা তৈরী করতে পারে — বিশেষত মেয়েদের সর্বজনীন উপস্থিতি ও বৈষয়িকতাকে যদি দেখা হয় সমাজের প্রচলিত যৌনতা মূল্যবোধ ও নৈতিকতা দিয়ে, এবং ঠিক যেটাই কমিউনিস্ট সংস্কৃতি করেছে এতো বছর ধরে — তাই বিবাহ বাদ দিয়ে কমিউনিস্ট সংস্কৃতিতে মেয়েদের উপস্থিতিকে দেখা গেলো না। কাজেই, হরেদরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভেতরে মেয়েদের শিক্ষানবিশীর প্রক্রিয়া আসলে হয়ে দাঁড়ালো “কমিউনিস্টের বৌ” হওয়ার প্রক্রিয়াই। একক, স্বনির্ভর কমিউনিস্ট হওয়ার শিক্ষাপদ্ধতি নয়। তাই, “কোমলগান্ধার” ছবিটিও শেষ হলো পর্দায় সবকটি মেয়ের বিবাহসম্ভাবনায়, বৈবাহিক জুটি বাঁধায়।
অতএব, যে পরিবার বা বিবাহ একটি মেয়ের কাছে দুনিয়ার সবচাইতে বড়ো শিকল হয়ে দেখা দেয়, সেই বিষয়ে মার্ক্সবাদী তত্ত্বের ভিতর বিমূর্ত স্তরে বহু বছর আগে তত্ত্বায়ন হাজির হলেও, কমিউনিস্ট বাস্তবিক রাজনীতিতে তার কোনো স্থান হলো না। বিবাহ ও পরিবারই হয়ে রইলো একটি মেয়ের সাংগঠনিক জীবনের ধ্রুবতারা। কাজেই, একটি মেয়েকে কমিউনিস্ট সংস্কৃতিতে “খারাপ মেয়ে” হবার উৎসাহ দেওয়া হয়, ঠিক তখনি, যখন সে তার বড়ো হয়ে ওঠা পরিবারের সাথে লড়াই করছে। ঠিক তখনি, যখন সেই পরিবারের সাথে লড়াই করে সে পার্টি-অনুমোদিত পারিবারিকতায় সংযুক্ত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়টি ঘটে যাওয়ার পরে, কেউ তাকে বলে না, “শোন, তুই একটু খারাপ মেয়ে হ। লাথ মার তোর পারিবারিক দায়িত্বে।” কেউ বলে না যে, “ওরে শোন, পৃথিবীতে বড়ো কিছু করতে হলে পরিবার নিয়ে বসে থাকলে চলে না।” যদিও, এই কথাগুলো হামেশাই বলা হয় একটি ছেলেকে। এই কথাগুলো আত্মস্থ করা (কিংবা বদহজম করাই) বহুক্ষেত্রে হয়ে ওঠে কমিউনিস্ট/বামপন্থী আন্দোলনের জায়গায় তার অন্যতম মূল শিক্ষানবিশী।
আসলে, এই যে মেয়েটিকে বলা হয় না, আর একটু খারাপ মেয়ে হতে, তার পেছনেও আছে কমিউনিস্ট পার্টি/বামক্ষেত্রের গভীর লিঙ্গ রাজনীতিবোধ। “খারাপ মেয়ে” টা তো “খারাপ” হয়ে উঠবে আন্দোলনের ক্ষেত্রেও — বাধ্য ক্যাডার, কোমল প্রেমিকা বা “ছোটবোন” হয়ে ঠিক থাকবে না! বলা যায় না, প্রশ্ন তুলতেও পারে পার্টি বা সংগঠনের ভিতরকার পিতৃতন্ত্র নিয়েও। এর পাশাপাশি আছে লম্বা ইতিহাস — পার্টি বা সংগঠনগুলির ভিতরকার শ্রমবিভাজন নিয়ে। যেখানে মিটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে চা বানিয়েছে মেয়েরা, রান্নাবান্নার আয়োজন করেছে। অর্থাৎ, গার্হস্থ্যকেন্দ্রিক যে শ্রম, তার দায়ভার মেয়েরা একটা বড়ো জায়গায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিলো পার্টির অভ্যন্তরেও। আমাদের সময়ে, সমস্ত দুর্বলতা সত্ত্বেও, তৃতীয়ধারার বাম-আন্দোলনের মধ্যে, খুব সীমিতভাবে হলেও, এই প্রশ্নগুলি উঠলো। বিশেষ করে ছাত্র-যুব আন্দোলনের অভ্যন্তরে। যদিও, ২০২১-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, পশ্চিমবাংলার সি.পি.এমের প্রাক-নির্বাচনী ব্রিগেডের ঠিক আগে, ব্রিগেডে মেয়েদের অংশগ্রহণ বোঝাতে তাদের রুটি বেলা, রান্না করার যে সারি সারি ছবি সামাজিক গণমাধ্যমে ছাড়া হলো, তা জনমানসে এই প্রশ্নটিকে পেছনে ঠেলে দিলো আরও কয়েক দশক।
৪.
যাই হোক, যেটা দাঁড়ালো যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, বাম আন্দোলনের ভেতরে, মেয়েরা রইলো একধরনের “সর্বজনীন গার্হস্থ্যতা”-র মুখ হয়ে। সেখানে, বিশেষ করে আজকের সময়ে, মেয়েরা আর হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই আর শুধু চা বানানো বা রান্নার কাজ সংগঠনে এসে করে না। কিন্তু, করে একধরনের ছকে বাঁধা কাজ, যার জন্য প্রয়োজন একঘেয়ে শ্রম করার ক্ষমতা ও যা চিন্তন-নির্ভর শ্রমের থেকে গুণগতভাবে আলাদা। তাই, মেয়েরা একটু বেশি পরিমাণেই বাম-সংস্কৃতির মধ্যে মিনিটস নেয় মিটিংয়ে, মেয়েরা একটু বেশি পরিমানেই কেরানিসুলভ যান্ত্রিক কাজ সংগঠনগুলির মধ্যে করে, মেয়েরা তাই সেক্রেটারি-মার্কা কাজও করে থাকে সংগঠনের মধ্যে বেশি। এই সবকটা কাজের মধ্যেই একধরনের গৃহশ্রমধর্মিতা আছে।
অবশ্য, বিক্ষিপ্তভাবে হলেও, যখনই মেয়েদের ভাষ্যে গার্হস্ত্যতা যে আসলে বহুবিধ শ্রমের সংযুক্তি, এবং তা আন্দোলনের মধ্যে তাদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, এই বাস্তবতা উঠে এলো, তখনই পুরুষ নেতৃত্ব, ও সাধারণভাবে পুরুষ কর্মীদের দিক থেকে দেখা গেলো একধরনের গভীর বিহ্বল, বিভ্রান্ত প্রতিক্রিয়া। যেমন ধরুন, কোনো একটি সংগঠনের এক তরুণী নারী-কর্মী। তিনি প্রতিদিনই তাঁর সন্তানটিকে নিয়ে আসেন মিটিঙে। বাচ্ছাটি ছোট। তিনচার বছর বয়স। লম্বা মিটিং চলাকালীন, স্বাভাবিকভাবেই বোর হয়ে গোলযোগ শুরু করে। এক বয়ষ্ক পুরুষ-কর্মী একদিন বাচ্ছাটির মাকে জিজ্ঞাসা করেন, “তুই ওকে রোজ নিয়ে আসিস কেন?” মেয়েটি উত্তর দেন, “তো ওকে কোথায় রেখে আসবো?” পুরুষ-কর্মীটি সগর্বে বলেন, “তা হলে তোকেও আসতে হবে না।” ঘরের সবাই হেসে ওঠে। মেয়েটি কুঁকড়ে বসে থাকেন। কিছুদিন পর থেকে তিনি আর সত্যিই আসেন না।
এই গল্পটি যিনি আমাকে বলেন, তিনি এক মধ্যবয়সী মানবাধিকার কর্মী। তিনি আমাকে গল্পটি বলেন ঠাট্টাচ্ছলে, হাসতে হাসতে। কিন্তু, শুনে আমার একদমই হাসি পায় না। বরং, ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়। সেকথা তাঁকে বলাতে, আমরা প্রচুর বিতর্ক করি। শেষে, ঝগড়া। তো, সেটা আমার জীবনে নতুন কিছু নয়। কিন্তু, এই ছোট্ট ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো, মাতৃত্ব যে দিনরাত এক করা এক গভীর শ্রম, সে সম্পর্কে এক ধরনের সম্পূর্ণ অজ্ঞতা। দ্বিতীয়ত, মাতৃত্ব বিষয়টি এক্ষেত্রে হয়ে উঠলো মেয়েটির একার দায়িত্ব। সেখানে তার সংগঠন, তার কমরেডদের কোনো দায়িত্ব নেই। তৃতীয়ত, মেয়েটিকে সংগঠনের মধ্যে কাজ করতে হবে পুরুষ কমরেডদের শর্তে। এবং, সেই পুরুষ কমরেডরা যা বলবে, তা হবে প্রায় পুঁজিচালিত, উদারনৈতিক কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতির যে মতাদর্শ, তার জেরক্স কপি।
অর্থাৎ, যে প্রশ্নটি আমি এখানে করতে চাইছি, তা হলো, কেন আমাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে হতে হবে শিশুবর্জিত? কেমন হয় যদি আমাদের সমস্ত অধিকার রাজনীতি, মায় বিপ্লবী রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে থাকে শিশুদের কলরোল? চতুর্থত, এই যে মেয়েটির কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী/কমরেডরা কোনোরকমেই কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করলেন না, আলোচনার মধ্যে আনলেন না তাঁর পারিবারিক পরিস্থিতিকে, তাতে যেটা স্পষ্ট হলো, তা হলো, আসলে মেয়েটির সামাজিক/রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠার বিষয়ে, তাঁরা কোনো কালেই খুব গভীরে ভাবেননি। খুব একটা সচেষ্টও এই বিষয়ে তাঁরা হয়ে উঠতে পারেননি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি কিছুটা আলাদা হলেও, স্পিরিটের দিক থেকে এক। একটি যুব সংগঠনের সারারাতব্যাপী মিটিং ঠিক হলে, একটি মেয়ে জানালো, সে থাকতে পারবে না। এক, রাতের বেলা তার বাড়িতে “ঘরের কাজ” থাকে। দ্বিতীয়ত, রাতের বেলা বাড়ির বাইরে থাকা তার বারণ। তার নেতা তাকে বলে, “আসতে পারবি না মানে? এই মিটিংটা তো অনেকদিন আগেই ঠিক হয়েছে।” আর এক নেতা বলে, “বাড়িতে এবার ঝামেলা শুরু কর।” মেয়েটা মৃদুস্বরে বলে, “ঝামেলা করলে আরোই বাড়ি থেকে বেরোতে দেবে না গো।” প্রথমজনের গলায় আবার বজ্রনির্ঘোষ — “তাহলে বাড়িতেই বসে থাক। সংগঠন, রাজনীতি কিছুই করতে হবে না তোকে।” লজ্জিত, অপরাধী মুখে বসে থাকে মেয়েটা। কিছুদিন বাদে যখন সে রাজনীতি ছেড়ে দেবে, তখন তার ভেতরে থাকবে গভীর গ্লানি — “আমি পারলাম না।” থাকবে গভীর লজ্জাবোধও।
এক্ষেত্রে অবশ্য ওই প্রাথমিক বিদ্রোহে উৎসাহদান তত্ত্ব মেনে, মেয়েটিকে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করা হলো, কিন্তু সেই বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে কোনোরকম আলোচনা করা হলো না। কি হবে এই মেয়েটির বিদ্রোহের পরে? কি হবে যদি মেয়েটির লাগাতার বিদ্রোহের ফলশ্রুতি হিসেবে তাকে পরিবার ত্যাগ করতে হয়? যে যে মাত্রায় স্থান ও সময় দুইটিই লিঙ্গায়িত, যে যে মাত্রায় এই লিঙ্গায়িত সময় ও স্থান, একটি মেয়ের জীবনকে অসুরক্ষিত করে তোলে, যে যে মাত্রায় একটি মেয়েকে তাড়া করে বেড়ায় যৌন নির্যাতনের ভয়, সেই সেই মাত্রায় তার পরিবারের পরিবর্তে কি হবে তার আশ্রয়?
এই ভাবনা যে তার বিদ্রোহের টুঁটি চেপে ধরে, এ নিয়েও কোনো সচেতনতা তার নেতৃত্বে মধ্যে দেখা গেলো না। ঐতিহাসিকভাবে যায় নি। আবারো বলি, ঋত্বিক ঘটক এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন জয়ার বিবাহের মধ্য দিয়ে। এক পরিবার থেকে আরেকটি পরিবারে স্থান হয়েছিল জয়ার। বাস্তবেও, পুনরাবৃত্তি করি, বহু সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার আশেপাশের ক্ষেত্রগুলি মেয়েদের পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সমস্যাটি মিটিয়েছে বিবাহের মধ্যে দিয়ে। এবং, ঠিক যেভাবে আগ্রাসী পৌরুষের সংস্কৃতিকে নির্মূল না করতে পারার কারণে, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির ভেতরকার অবস্থা হয়েছে সাংঘাতিক, বিবাহকে প্রশ্ন করতে না পারার ফলও হয়েছে সাংঘাতিক। বিশেষ করে নারী কর্মীদের জীবনে।
কিন্তু, যে মেয়েটি বিবাহের মধ্যে তার জীবন বা বিদ্রোহের সমাধান দেখতে চায় না, তার বেলা? আর এক ভাবে বিষয়টি দেখতে গেলে, সাধারণভাবে কমিউনিস্ট সংস্কৃতি পরিবার ব্যতীত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান সমাজের বুকে গড়ে তুলতে যে যে মাত্রায় ব্যর্থ হয়েছে, সেই সেই মাত্রায় একক মেয়েদের বিদ্রোহকেও তার স্থানিক কারণেই ধারণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, একক মেয়েদের স্থানিক স্বাধিকারের লড়াইটিকেও সমাজের বুকে রাখতে ঐতিহাসিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ ও তাদের আশেপাশের সংগঠনগুলি।
কাজেই, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বাধীনচেতা, একক মেয়েদের প্রায় কোনো স্থান নেই। ঐতিহাসিকভাবে থাকেনি।
৫.
এই যে দুটি ছোট ছোট ঘটনার কথা বলেছি এই লেখায়, এইরকম কতো ছোটখাটো ঘটনার বুনোটেই তো গড়ে ওঠে বাম আন্দোলনের প্রাত্যহিকতার ক্ষেত্র। এই দুটি গল্পেই যে জায়গাটায় এক ধরনের মতাদর্শগত মিল, তা হলো, যে এই দুটি জায়গাতেই মেয়েটির পরিবার-গার্হস্থ্যতা সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে দেখা হলো তার ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে। সেখানে ব্যর্থতার ভারও হলো তার একান্ত ব্যক্তিগত। এবং, এই যে গোটা পরিবারের সাথে তার লড়াই (বা না-লড়তে পারার বিষয়টিকে) করে দেওয়া হলো তার ব্যক্তিগত বিষয়, তাতে করে “পরিবার” বিষয়টিই বাদ পড়ে গেলো বামপন্থী/কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্র থেকে বাদ পড়ে গেলো উৎপাদনধারা (mode of production ) ও উৎপাদন-সম্পর্কের আলোচনা ও বিতর্ক থেকে পরিবার বিষয়টি। বহুক্ষেত্রেই, পরিবারই হয়ে দাঁড়ালো আন্দোলন-অর্থনীতি (মায়, বিপ্লবী অর্থনীতিরও) অন্যতম মূল, কিন্তু অনুচ্চারিত ভরকেন্দ্র। কাজেই, বহুক্ষেত্রেই, পারিবারিক মূল মূল সম্পর্কগুলির মতাদর্শগত পশ্চাদপদতাকে আমূল প্রশ্ন না করেই, পার্টির মধ্যে প্রতিস্থাপিত হলো পরিবার। যার ফল ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট রাজনীতির ক্ষেত্রে হলো অতীব সুদূরপ্রসারী। যার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এই প্রতিবেদনে সম্ভব নয়। কিন্তু, কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে যেটা বকলমে দাঁড়ালো যে যদিও “কমিউনিস্ট” পরিচিতিটি মূলত: একটি রাজনৈতিক পরিচিতি, ও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ, আসলে কমিউনিস্ট শব্দটির মধ্যে আছে মূলগতভাবে এক পৌরুষকল্পনা। এবং, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধুই পৌরুষকল্পনা।
যেমন ধরুন, সমাজতাত্ত্বিক মল্লারিকা সিংহ রায়কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে, এককালের প্রবাদপ্রতিম নকশাল কর্মী ও নেতা আজিজুল হক বললেন,
“there were very few women. It was difficult for women to join our movement. As we tuned the pitch of the struggle to such a high note that women could not match the scale. Our organization took such a character that it could accommodate only the foremost section of the activists. For strategic reasons we thought about inspiring women but of course it was difficult for women, who have been confined to domesticity for so long, to come and join us.
(খুবই কম মেয়ে ছিল সেইসময়ে। মেয়েদের পক্ষে আমাদের আন্দোলনে যোগ দেওয়া কঠিন ছিল। আমরা যে উচ্চ তারে লড়াইটা বেঁধেছিলাম, তাতে মেয়েরা তাল মেলাতে পারেনি। আমাদের সংগঠনের চরিত্র এমনি ছিল যে শুধুমাত্র অতীব অগ্রণী কর্মীদেরই ধারণ করা সম্ভব ছিল। কৌশলগত কারণে আমরা মেয়েদের অনুপ্রাণিত করার কথা ভেবেছিলাম বটে, কিন্তু মেয়েরা এতদিন ধরে যেভাবে বন্দি হয়ে আছে ঘরকন্নার মধ্যে, তাতে তাদের পক্ষে আমাদের সাথে যোগ দেওয়া খুব কঠিন ছিল।)
তো, এখানে আমরা কি দেখলাম? প্রথমত, মেয়েদের অবস্থান নিয়ে প্রভূত অজ্ঞানতা। পরিবার বা গার্হস্থ্যতা নিয়ে কোনধরনের গভীর রাজনীতিবোধ বা সমাজতাত্ত্বিক চোখের অভাব। দ্বিতীয়ত, যখন মেয়েদের আন্দোলনের নিয়ে আসার কথার উত্থাপন করা হলো, সেটাও হলো “কৌশলগত” কারণে। নারীমুক্তির প্রশ্নে নয়। অর্থাৎ, আবারো দাঁড়ালো এই যে, বিপ্লব থেকে কমিউনিস্ট ভাবধারা আসলে পৌরুষের বিচরণক্ষেত্র। বলা বাহুল্য, এইজাতীয় মতামতের আভাস ও উচ্চারণ বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের রাজনৈতিক সংগ্রহশালায় কোনো বিরল ঘটনা নয়। অবশ্য, এসবের দেখা মিলবে বেশি অলিখিত সংগ্রহশালায় — যার নাম আমাদের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। যা কিনা নথিভুক্ত করে রাখে সেইসব কথোপকথন, আলাপচারিতায় প্রকাশিত সত্য, যা কোনো দিন জায়গা পায়নি, পাবে না আমাদের নথিভুক্ত ইতিহাসে বা ডকুমেন্টে।
ঋত্বিকের ছবি “কোমলগান্ধার” শেষ হয় একধরনের প্রেমময় ভাবালুতা দিয়ে। জয়া-ঋষির প্রেমের সূচনা। সম্ভাব্য বিবাহ। কিন্তু, তারপর? মানে, ওই সিনেমার পর্দা থেকে, পরিবারের বিরুদ্ধে জয়ার লড়াইয়ের মতোই যা বাদ পড়ে গেলো, তা হলো, জয়া-ঋষির বিবাহিত জীবন। কিরকম হতো সেই জীবনটা? জয়া থিয়েটার ছেড়ে গৃহবধূ, অথবা রোজগার-সন্তানের দ্বৈত চাপে ন্যুব্জ স্কুল মাস্টারনি, ঋষির সন্তানদের মা? থিয়েটার বা রাজনীতির নাম শুনলে খিস্তি দিয়ে ভুত ভাগিয়ে দেয়? অতীব তিক্ত? নাকি, যৌবনের কিছুদিন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন করার নস্টাজিয়ায় আচ্ছন্ন? কিন্তু, বর্তমানে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কাজ করায় অপারগ? মানে, ঐতিহাসিকভাবে এমনটাই তো হয়েছে বাম-আন্দোলনগুলির বৃত্তে। এবং, আমরা সার্বিকভাবে ভয় পেয়েছি এই বাস্তবতাকে আমাদের শিল্পকর্মে তুলে ধরতে।
কিন্তু, আবার বামপন্থী আন্দোলন ও সাহিত্যের ইতিহাসের মধ্যেই আমরা দেখলাম একটি অন্য বাস্তবতা, যখন মেয়েরা কলম ধরলেন। তাই, সুলেখা স্যানালের “নবাঙ্কুর” উপন্যাসে, মূল চরিত্র ছবির কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার যাত্রাপথে পরিবারের সাথে যে বিবাদ, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ নথিবদ্ধকরণ আমরা দেখলাম উপন্যাসটিতে। অর্থাৎ, যে বিষয়টিকে ঋত্বিক ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ছবির মূল কেন্দ্র থেকে, সিনেমার পর্দা থেকে, তাকেই মুখ্য জায়গায় আনলেন সুলেখা স্যান্যাল তার উপন্যাসে। ফলত, “পরিবার” ও “গার্হস্থ্যতা” বিষয়টি রাজনৈতিক হয়ে উঠলো তাঁর লেখায়। তবে, তাতে করে, যেটা দাঁড়ালো তা হলো, মূলস্রোতের বাঙালি পাঠক, বা বামপন্থী লেখক-শিল্পী গোষ্ঠী, তাঁর লেখা ঠিক গলাধ:করণ করতে পারলো না। বিস্মৃত হলেন সুলেখা পাঠকের স্মৃতি থেকে। কিন্তু, তাঁর মতো বহু লেখিকা, যাঁরা মূলত কাজ করেছিলেন বামপন্থী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকেই, তাঁদের লেখায় বিধৃত হয়ে রইলো বামপন্থার অন্য এক ইতিহাস। সেই ইতিহাসে গার্হস্থ্যতা বা পরিবারের বিরুদ্ধে মেয়েদের লড়াই অর্জন করলো কেন্দ্রীয় স্থল। আগামীদিনে, যদি কোনো লড়াকু আন্দোলনক্ষেত্র আমাদের গড়ে তুলতে হয়, তবে সেসব লেখার পঠন ও মূল্যায়ন হয়ে উঠবে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ।
লেখক সাহিত্যের অধ্যাপক ও কবি।
Just Loved it! What a wonderful piece of writing. It seems that writer peeked into my mind and saw what I have observed !