কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে ক্লাসে ফিরছেন বিশ্বভারতীর তিন বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী


  • September 8, 2021
  • (0 Comments)
  • 1119 Views

শিক্ষার্থীদের নাছোড় আন্দোলন, সমাজের সকল স্তরের মানুষের বিপুল সমর্থন ও আইনের লড়াই বিশ্বভারতীর অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত পড়ুয়াদের ক্লাসে ফেরাচ্ছে। নতুন রূপে আন্দোলনের অধিকার বজায় রাখার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্র আদর্শের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বর্তমান স্বৈরাচারীউপাচার্যের পদত্যাগ ঘটবে ও বিশ্ববিদ্যালয় ফ্যাসিজমমুক্ত হবে এমন আশায় বুক বাঁধছেন শিক্ষার্থীরা। সুদর্শনা চক্রবর্তী রিপোর্ট।

 

বিশ্বভারতীর উপাচার্যের বিরুদ্ধে আইনি  জয় পেলেন তিন বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁদের তিন বছরের জন্য বহিষ্কারের নির্দেশের বিরুদ্ধে অর্ন্তবর্তী স্থগিতাদেশ জারি করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। অবিলম্বে তাঁদের ক্লাসে যোগদান করতে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এই রায়ে উপাচার্যকে এক প্রকার সরাসরি ভর্ৎসনা করে তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থী বিরোধী নানা মন্তব্যের জন্য দেওয়া হয়েছে হুঁশিয়ারি। ৮ অগস্টের এই রায়ে যা বলা হয়েছে –

 

  • তিন জন পড়ুয়ার তিন বছরের জন্য বহিষ্কারের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ। আগামিকাল থেকেই ক্লাসে যোগদানের নির্দেশ।

 

  • অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সমস্ত রকম অবস্থান-বিক্ষোভ প্রত্যাহার করতে হবে।

 

  • তিন জন ছাত্রের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ও তার ভিত্তিতে দেওয়া শাস্তি একেবারেই উপযুক্ত নয়। লঘু পাপে গুরুদণ্ড।

 

  • তিন ছাত্র ও সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া অধ্যাপকদের মামলা দায়েরের নির্দেশ। দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তির আশ্বাস।

 

  • উপাচার্য যদি নিজেকে নিজেকে আইনের থেকে বড় ভাবেন তাহলে তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবে আদালত। বিভিন্ন মাধ্যমে কুমন্তব্য করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।

 

 

গত ২৭ অগস্ট থেকে উপাচার্যর বাড়ির সামনে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেন পড়ুয়ারা। তিন দিন আগে থেকে শুরু হয় অনশন আন্দোলন। বহিষ্কৃত এক পড়ুয়া ও বিশ্বভারতী ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশন-এর সদস্য এক অধ্যাপক রিলে অনশনে যোগ দেন। ‘ভাঙো অচলায়তন’ ডাক দিয়ে চলতে থাকে আন্দোলন। সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল হয়ে ওঠে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা পাশে এসে দাঁড়ান বিশ্বভারতীর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। অধ্যাপকেরা, সাধারণ মানুষ, পুরনো আশ্রমিক, ফ্যাসিস্ট বিরোধী নাগরিক মঞ্চ, ছাত্র-যুব সংগঠন, নানা শিল্প মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা, আলাপিনী সভার সদস্যরা মুখর হয়ে ওঠেন আন্দোলনের সংহতিতে। একইসঙ্গে চলছিল আইনি পথে লড়াইও। তারই পাশাপাশি আজ ছাত্রদের পক্ষে এই রায় ঘোষিত হল।

 

কী বলছেন বহিষ্কৃত তিন শিক্ষার্থী, যাঁদের অদম্য মানসিকতা এতটুকু টলে যায়নি এতদিনের লড়াইয়ের পরে।

 

বহিষ্কৃত হওয়া ছাত্র ফাল্গুনী পান বললেন, “এই রায় আমাদের এতদিনের আন্দোলন, এতদিনের লড়াইয়ের একটা প্রাথমিক জয়। কিন্তু আমাদের এই আন্দোলন ততদিন চলবে যতদিন না উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী পদত্যাগ করছেন এবং বিশ্বভারতী আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। কিন্তু এই রায়ই সবটা নয়। আমরা যে আবার ক্লাস করতে পারব এটা খুবই ভালো খবর। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত বিদ্যুৎ চক্রবর্তী রয়েছেন, ফ্যাসিজম আর আগ্রাসন রয়েছে আমাদের লড়াইটা চলবে। আমাদের এতজন শিক্ষক-শিক্ষিকা যাঁরা সাসপেন্ড হয়ে রয়েছেন তাঁদের বিষয়টা কিছু হয়নি, তাই এই রায়টাকেই আল্টিমেট ভেবে নিচ্ছি না।” আর এক বহিষ্কৃত ছাত্রী রূপা চক্রবর্তী জানালেন, “আমরা তো বরাবর এই মানসিকতা নিয়েই ছাত্র আন্দোলন করেই আসছি যে লড়াই চালিয়ে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে, কেউ তো হাতে তুলে দিয়ে যায় না। অবিরাম আন্দোলন করেছি, যার অংশ ছিল অনশনও। আদালতের রায় আমাদের পক্ষে গেছে, যা অনুযায়ী আমরা আবার পঠন-পাঠনে যোগ দিতে পারব। কিন্তু আমি একজন শেষ বর্ষের ছাত্রী, যার অলরেডি কোর্সের পরীক্ষা শেষ, রেজাল্ট আউট হয়ে গেছে বা হয়ে যাবে এরমধ্যে। তো আমাকে কীভাবে ক্লাস জয়েন করাবেন ওঁরা? এটা আমার একটা বড় প্রশ্ন। বিশেষভাবে ওঁদের ব্যবস্থা নিতে হবে – আমাদের ক্লাস নেওয়ার এবং আমার পরীক্ষা নেওয়ার এবং এ বছরের মধ্যেই যেন আমার ডিগ্রি শেষ হয়, আমার যেন ‘ইয়ার ল্যাপ্স’ না হয়। বিগত কয়েক মাস আমাকে যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ কিন্তু দিতেই হবে। এটা আমার একটা দাবি।”

 

কোর্ট যেভাবে উপাচার্যকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সে বিষয়ে রূপার বক্তব্য, “উনি তো কোর্ট আইন কিছুই মানেন না। অবমাননা করেন প্রতিবারই। কিন্তু এবারে ওঁর কাছে বড় ধাক্কা এটা। স্বৈরাচারী একজন উপাচার্য উনি, যাঁর এই পদে বসার কোনও যোগ্যতা নেই। উনি একজন সিরিয়াল মলেস্টার। ওঁর বিরুদ্ধে প্রচুর শ্লীলতাহানির অভিযোগ আছে, এবং সেগুলির তথ্য-প্রমাণ আছে। এরকম একজন নোংরা, চরিত্রহীন মানুষের এই পদে বসার কোনও অধিকার নেই, ওঁর পদত্যাগের দাবিও আমরা জানিয়েছি, সেইজন্য আমাদের আন্দোলন জারি থাকবে।”

 

সোমনাথ সৌ-এর বক্তব্য, “আমরা প্রাথমিকভাবেই জানতাম আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই বিশ্বাস করছিলাম যে আমরা জয়ী হয়ে ফিরব। প্রথম রায় আমাদের পক্ষে গেছে, পরবর্তীতেও রায় আমাদের পক্ষে থাকবে বলে আশা করছি। এবং আমরা পুরোপুরি জয়ী হব।” ক্লাসে যোগ দিচ্ছেন তো? “সেটা নির্ভর করছে বিশ্বভারতীর উপর। বিশ্বভারতী তো কোর্টের অর্ডার মানে না। মানে, এই উপাচার্যের আমলে মানা হচ্ছে না। কোর্টের অর্ডার ভায়োলেট করলে আমরা ক্লাস জয়েন করতে পারব না। আর জয়েন করার জন্য জানালে অবশ্যই করতে পারব,” বললেন তিনি।

 

কলকাতা হাইকোর্টের এই রায়ে অবশ্য উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সমস্ত রকম অবস্থান-বিক্ষোভ প্রত্যাহার করতে হবে’। ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য, আন্দোলনের একটি বড় হাতিয়ার অবস্থান-বিক্ষোভ। অস্বীকার করার উপায় নেই এই আইনি জয়ে ও নিজেদের ন্যায্য অধিকার, দাবি তো বটেই সেইসঙ্গে বর্তমান উপাচার্যর স্বৈরাচারী ও শিক্ষাবিরোধী আচরণ ও নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে তাঁদের অবস্থান-বিক্ষোভের বড় ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই হবে। কিন্তু তারজন্য আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের এরকম নির্দেশ দেওয়া কী ছাত্র রাজনীতির উপর কোনও প্রভাব ফেলবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ফাল্গুনী স্পষ্ট বললেন, “ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবে। এটা তাদের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের জায়গা। আমরা এক্ষুনি জানাতে পারছি না যে অবস্থানের জায়গা থেকে আমরা কী করব, কারণ এখনও আমাদের সবার মধ্যে আলোচনা হয়নি। সেটা একবার হলেই পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানাতে পারব।” রূপার মত, “আমাদের আন্দোলন জারি থাকবে। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী নিয়মাবলী মেনে আমাদের আন্দোলন মোড় নিতে পারে, অন্য রূপ পেতে পারে। আন্দোলন চলবেই।” সোমনাথ জানালেন, “আমরা এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের আইনজীবীদেরর সঙ্গে কথা বলে আইন মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেব।”

 

কলকাতা হাইকোর্টে শিক্ষার্থীদের পক্ষে আইনজীবী শামিম আহমেদ এই রায়ের বিষয়ে বললেন, নির্দেশ অনুযায়ী স্থগিতাদেশ যাতে স্থায়ী হয়, সাসপেন্ড হওয়া অধ্যাপকরা যাতে আইনি সহায়তা পান তারজন্য পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কাজ দ্রুত শুরু হবে। তিনি যোগ করলেন, “রবীন্দ্রনাথের যে প্রেরণা এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ যে দূষিত হচ্ছে সেটা আদালত উপলব্ধি করেছে। ছাত্ররা যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন সেই আন্দোলনের দাবি তাদের পূর্ণ হয়েছে। যে কারণে আন্দোলন করছিলেন সেই কারণ অপসারণ হয়েছে। আদালত বুঝিয়ে দিয়েছে উপাচার্য যদি আইনের গণ্ডির মধ্যে না থাকেন বা আদালতের নির্দেশ পালন না করেন তার পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নিতে হবে আদালত সেটা জানে।”

 

শিক্ষার্থীদের নাছোড় আন্দোলন, সমাজের সকল স্তরের মানুষের বিপুল সমর্থন ও আইনের লড়াই বিশ্বভারতীর অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত পড়ুয়াদের ক্লাসে ফেরাচ্ছে। নতুন রূপে আন্দোলনের অধিকার বজায় রাখার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্র আদর্শের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বর্তমান ‘স্বৈরাচারী’ উপাচার্যের পদত্যাগ ঘটবে ও বিশ্ববিদ্যালয় ‘ফ্যাসিজমমুক্ত’ হবে এমন আশায় বুক বাঁধছেন শিক্ষার্থীরা।

 

Share this
Leave a Comment