সুন্দরবন প্রসঙ্গ ও অসম্মানের ‘ভোমা’ সহাবস্থানে ভাগাভাগি


  • August 17, 2021
  • (0 Comments)
  • 1147 Views

বাদল সরকারের ‘ভোমা’ জীবন কাঠামোর কানায় কানায় ভরে থাকা কোনও নিটোল গল্পের সমাপাতন নয়। বরং ভোগবাদে আস্তিন ডোবানো সমাজ অর্থনীতি রাজনীতির খুঁতহীন হিসাব, জাতীয়-আন্তর্জাতিক আঞ্চলিকতাকে কীভাবে শোষন যাতায় পেষণ চালাচ্ছে এবং তার প্রতিটি দিক কীভাবে ভোমা–র গলার ফাঁস হয়ে উঠছে তা নাটকের বিষয় কাঠামো। ‘ভোমা’ ব্যক্তি মানুষের পরিচিতি নয়। ‘ভোমা’ সুন্দরবনের লবণ জলে ক্ষয়ে যাওয়া পুড়ে যাওয়া জীবন যৌবনের প্রতিনিধি। লিখেছেন কোয়েল সাহা। 

 

অতিমারি সঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পরিবেশের বেহাল অবস্থা যা সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে তাড়া করছে। ফি-বছর হাড় হিমকরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আমফান, ইয়াস, তাদের ভয়াবহ দাপট টের পাইয়ে দিচ্ছে। বিশ্বময় বিপুল দূষণের কারণেই প্রকৃতির ঘড়ি মিলিয়ে আসা ঝড়-ঝঞ্ঝা, গ্রীষ্ম-বর্ষা, কালবৈশাখীর যাতায়াত ম্লান হয়ে এসেছে। আবহাওয়ার গুনাগুণে বা চরিত্রে বদল ঘটে গিয়েছে। দুনিয়া জোড়া বিভিন্ন স্তরের দূষণ যার কারণ আর ফলাফল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ২০২০-র অতিমারির চেহারা থেকে ঝড় ঝঞ্ঝা প্রকৃতির রূপ ও চরিত্র বদলের অন্য এক অধ্যায় প্রতক্ষ করছি। বিপর্যস্ত পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে কলকাতা শহরের জীবন ও শহরের গতিকে সুরক্ষিত করার দায় ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ২০২১ সালে ইয়াসের পূর্বাভাস ঘোষণা থেকে সরকারি ভাবে বিপর্যয় মোকাবিলার, পাশাপাশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাত পাহাড়ায় থেকে রাজ্য বাসীর দুশ্চিন্তা লাঘব করার যাবতীয় প্রচেষ্টার ধারাবিবরণ টিভি পর্দায় আপডেট হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছি।

 

২০২১-এ ইয়াস তার বিপদ সংকেত নিয়ে শহরের জীবনে রেখাপাত করতে না পারলেও সমুদ্র উপকুলবর্তী সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবন ছাড়খার করে দিয়েছে। ঝড়ের দাপট আছড়ে পড়লে কোনো রকমে তাপ্পি দেওয়া বাঁধ অচিরেই ভেঙে পড়ে। গ্রাম ও জীবন বাঁচাতে তড়ি ঘড়ি সুন্দরবনের মানুষ তাদের নিজেদের শরীরকেই বাঁধের মতো টান করে দাঁড় করিয়ে দেন। উন্নয়নে চোখ ধাঁধানো দেশ প্রতক্ষ করল বিপদ সঙ্কুল পরিবেশে ২০২১এ মানুষের শরীর নির্মিত বাঁধ।

 

তৃতীয় ধারার থিয়েটারে এই শরীরের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যে শরীরের স্পষ্ট ব্যবহার আড়াল করার প্রবণতা তথা পর্দা, মেক আপ, কস্টিউম, আলোর ব্যবধান কে নস্যাৎ করে ভোগবাদ তথা আতিশয্যের দুনিয়ার বিপরীতে দর্শক-অভিনেতা একই তলে, কোনো রকম ব্যবধান না রাখার সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় তৃতীয় ধারার থিয়েটার। যে থিয়েটার প্রসঙ্গে বাদল সরকার দর্শনগত ব্যাখ্যা ‘থিয়েটারের ভাষা’ তে নথিভুক্ত চেহারায় প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে বাদল সরকার স্পষ্টতই জানিয়েছেন তৃতীয় ধারা প্রথম থিয়েটার তথা লোক নাটক ও আমদানি করা তথা ইংরেজের হাত ধরে আসা প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সমান্তরাল এক থিয়েটার। এই দুই ধারা থেকে নিদিষ্ট অঙ্কের দূরত্বে নিদিষ্ট দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৃতীয় থিয়েটার। যে থিয়েটারের অবস্থান জনিত দায় স্পষ্ট। তাই কাদের জন্য থিয়েটার কিসের জন্য থিয়েটার এই বিষয়টিও স্পষ্ট। ‘ভোমা’ সেই পরিচিতি যে মানুষ সামাজ অর্থনীতিতে থাকা তৃতীয় স্তরের। যে জীবনের সাথে জৌলুস-আড়ম্বর-বিনোদনের কোনও যোগাযোগ নেই। যে থিয়েটারে যাবতীয় বাহুল্য বর্জন করাটাই নীতিগত অবস্থান। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ‘ভোমা’ তৃতীয় ধারার প্রেক্ষাপটে খোলামেলা প্রকাশ। যে ঘটনা সমাজ-জীবন-প্রান্তিক অবস্থান নিয়ে একই ভাবে সত্য। যেখানে বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র শরীর। যা বিষয় হিসাবে প্রাচীন ইতিহাস তথা স্পার্টার যুগকে স্মরণ করায়। যে যুগ অবলীলায় এখনকার প্রেক্ষাপটের সাথে তুলনায় আসতে পারে।

 

সুন্দরবন প্রসঙ্গ ও অসম্মানের ভোমা সহাবস্থানের থাকা।

সুন্দরবন প্রসঙ্গ ও অসম্মানের ‘ভোমা’ সহাবস্থানে ভাগাভাগি।

 

বাদল সরকারের ‘ভোমা’ জীবন কাঠামোর কানায় কানায় ভরে থাকা কোনও নিটোল গল্পের সমাপাতন নয়। বরং ভোগবাদে আস্তিন ডোবানো সমাজ অর্থনীতি রাজনীতির খুঁতহীন হিসাব, জাতীয়-আন্তর্জাতিক আঞ্চলিকতাকে কীভাবে শোষন যাতায় পেষণ চালাচ্ছে এবং তার প্রতিটি দিক কীভাবে ভোমা–র গলার ফাঁস হয়ে উঠছে তা নাটকের বিষয় কাঠামো। ‘ভোমা’ ব্যক্তি মানুষের পরিচিতি নয়। ‘ভোমা’ সুন্দরবনের লবণ জলে ক্ষয়ে যাওয়া পুড়ে যাওয়া জীবন যৌবনের প্রতিনিধি। যাদের ব্যক্তি হয়ে গড়ে ওঠার কোনও সুযোগ নেই। অর্থাৎ ব্যক্তি বিকাশের একক সত্বার সে অর্থে বিকাশ হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ‘ভোমা’ সুন্দরবনের আধপেটা খেয়ে থাকা বাঘ কুমিরের সাথে লড়াই করা লোনা জলের জীবন। যেখানে সরকারের দাক্ষিণ্য কলকাতা শহরের বিত্ত টপকে সুন্দরবনে এসে আর পৌঁছায় না। তাই আজও জীবিকার সন্ধানে লোনা জলের গভীরে যেতে হয়। বাঘের সাথে পাঞ্জা কাষাকষি করতে হয়। হেরে গেলে মারা পড়তে হয়, শরীরের ভাষা থেমে যায়। বেঁচে থাকার মূলধন শরীর। তৃতীয় ধারা বাহুল্যবর্জন ও শরীরকে গুরুত্ব দেওয়ার নীতিগত অবস্থানের নিরিখে গড়ে ওঠা। সেই সাথে সমাজ জীবনের কোন অংশের মানুষকে গুরুত্ব দিতে চাইছে সেই প্রসঙ্গটিও স্পষ্ট। অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া অর্থনীতির গড়পড়তা হিসাবে যাকে বলে সামাজিক অবহেলা। যা সামাজিক অবস্থানের নিরিখে অনেকটা তৃতীয় শ্রেণির। প্রথম দ্বিতীয়কে টপকে যে তৃতীয়ের স্থান নির্ধারিত হয়। সমাজ ও জীবনে যে তৃতীয় কে টিকে থাকার জন্য অতিরিক্ত সংঘর্ষে যেতে হয়। যাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নির্মিত সুযোগ সুবিধা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিসাবের আওতার বাইরে।

 

অমফান কিংবা ইয়াস এর দাপুটে ঝড় ঝাপ্টা মিটলে পাতলা নীল ত্রিপলের নীচে ভাঙা বাঁধের উপর হাড়ি কলসি ছাগল বেলচা নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হয়। শহর থেকে মোটর গাড়ি বোঝাই সামান্য কিছু ত্রাণ পৌঁছায় শহর শহরতলির কিছু মানুষের হাত ধরে। রাষ্ট্র সেখানে নীরব। শান্ত সমাহিত যেন কোনও বিশেষ আড়ালে হারিয়ে যাওয়া। অনেকটা সরকার জনগণের খোলা মঞ্চের নাটক ঘটমান সত্য হিসাবে কাজ করে। যেন কলকাতা শহর ছাড়া সরকারের আর কোনও দায় নেই।

 

সুন্দরবনের জোয়ার ভাঁটা খাড়ি পেরিয়ে কাদামাখা শরীর নিয়ে ‘ভোমা’-দের ছুঁতে চেয়েছিলেন। পৌঁছে দিতে চেয়েছিলন শহরের না জানা না চেনা মানুষদের কাছে। যে ‘ভোমা’ চাষের জন্য লোনা জমিকে আবাদ তুল্য করে গড়ে তোলেন ঘাম রক্তের বিনিময়ে। সরকারি বদান্যতায় তারা দ্বিগুন দরে পাম্প মেশিন কিনতে বাধ্য হয়ে থাকেন। কারণ লোকাল কোম্পানি পাম্পসেট তৈরি করার জন্য সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে লোন পাননা। মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির কাছে লোকাল কোম্পানিকে শ্রম মেধা বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। চাষি জমিতে জল দেওয়ার জন্য সর্বস্ব পুঁজি বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধতকার যাঁতায় আটকা পড়েন। এরপর একটা বড় ঝড় এলে সব তছনছ। এক কথায় আবার শূন্য থেকে শুরু করা। লোনা জল ধানি জমিকে নষ্ট করে তাই নয়, শরীর জীবনের কানায় কানায় তখন লোনা জল ভরে ওঠে।

 

জীবন, বেঁচে থাকার তাগিদ নিয়ে ‘ভোমা’ শহর মুখো হন। আমরা দেখেছি ১৯৪৭-এর দেশ ভাগাভাগি এদেশ ও দেশের শিকড়হীন উদ্বাস্তু মানুষ। স্বাধীন ভারতে তার নাগরিক নিরুপায় ‘ভোমা’ বেঁচে থাকার কারণে নিজের দেশে উদ্বাস্তু হয়ে পড়়েন। জীবিকার সন্ধানে ‘ভোমা’র স্ত্রী-মেয়ে শহুরে বাবু বাড়ির এঁটো বাসন আর ঘর পরিস্কারের কাজে জুতে যান। বাবু আর দাসের সামন্ত সংস্কৃতি নারী শরীরকেও ভোগ দখল করতে চায়। অচিরেই বাবুর সন্তান তাকে ‘পেটে’ ধরতে হয়। শহরের সুথ স্বাচ্ছন্দ উন্নয়নের জ্বালানি হয়ে সুন্দরবনের লোনা জলে ক্ষয়ে যাওয়া ‘ভোমা’ শহরের প্রান্তে টিকে থাকা। শিকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে শহর জীবনে নিতান্ত অপাঙ্কতেয় পরিচয়ে পরিচিত হয়ে পড়েন ‘ভোমা’।

 

বিশ্বজোড়া উন্নয়নের বারুদ, পারমানবিক বোমার দাপট পরিবেশ ও প্রকৃতির সর্বস্তরে চলে বিষাক্ত দূষণের মারণ যজ্ঞ। যার ফলাফল প্রকৃতি ও জীবন থেকে উৎখাত। তবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত যারা হচ্ছেন তারা সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষ। উন্নয়ন সমাজের গুটি কতক মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য কে নিশ্চিত করছে বটে তবে উদ্বাস্তু হচ্ছেন ‘ভোমা’-রা। বাদল সরকারের দেখা সত্তরের সুন্দরবন ও ‘ভোমা’, আর আজকের সুন্দরবন ও ‘ভোমা’ যাদের বিষয়গত কোন তফাত নেই।

 

ঝড় কেটে যাবার পর শহর তার গতিময় জীবন নিয়ে অক্ষত থাকলেও পোড়া মুখ সুন্দরবন লোনাজল ঝড়ের দাপটে প্রকৃতির সাথে সাপ লুডোর খেলায় জেরবার। যারা ঘর হারিয়েছেন কোনো রকম ভাঙা বাঁধের উপর পলিথিন শিটের নীচে নতুন করে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজছেন সুন্দরবনের লোনা জলের আনাচে কানাচে।

 

জীবনের একটা অধ্যায় পার করে বাদল সরকার তাঁর সুন্দরবন অভিজ্ঞতা থেকে গ্রাম শহরের বিভেদের দেওয়াল যে কতটা শক্ত ও সুদূর তা পরখ করেছিলেন। সামাজিক রাজনৈতিক চাপান উতোর কীভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রামকে শহর মুখাপেক্ষী করে রাখতে চায়। তার ফলাফল ‘ভোমা’।

 

অস্থির সময়, জরুরি অবস্থায় দাঁড়িয়ে ‘ভোমা’। সুন্দরবনের রাঙ্গাবেলিয়ায় কাদামাটি মাখা লোনা জল ভেঙে শহরের প্রান্ত থেকে আসা বাদল সরকার সহ অন্যান্যরা সেখানে বেঁচে থাকার এক অসম লড়াই চাক্ষুষ করেন। প্রকৃতি ও শাসকের বদান্যতায় যাদের টিকে থাকা সাঁড়াশির সাথে তুলনায় আসতে পারে। যে উপলব্ধির ফলাফল তৃতীয় ধারার অনেকের যৌথ কর্মকাণ্ড ‘ভোমা’। বিষয় বস্তু এক্ষেত্রে কতটা বিপদজনক সে বিষয়কে মাথায় রেখে নাটকের আন্ডারগ্রাউন্ড শো হয়ঃ

বরং যখন আমরা ভোমা তৈরি করছি, তখনই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। আমরা তখন জানি ভোমা-র বিষয় বস্তুটা জরুরি অবস্থায় সহ্য হবেনা। ওই জরুরি অবস্থায় কার্জন পার্কে নিজে থেকেই শো বন্ধ করে দেয়। আমরা ঐ অবস্থাতেই একাডেমির সামনের মাঠে তিন রবিবার চালিয়েছি, তারপর পুলিশ সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বন্ধ করে দেয়। তখন আবার আমাদের ঘর খোঁজা শুরু হয়, ভোমা-র আন্ডারগ্রাউন্ড শো প্রজ্ঞানানন্দ ভবনে হয়, ভোমা ওখান থেকে তাড়ানোর পর আমরা থিওজফিকাল সোসাইটির হলটা পাই।[i]

 

১৯৬৮ পরবর্তী সত্তরের নকশালবাড়ি-র রাজনীতির সাথে সাপটে জুড়ে থাকা আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দ তখন আর শব্দের সীমানায় দাঁড়িয়ে নেই। তখন প্রশ্ন মানেই রাষ্ট্র বিরোধী সংস্কৃতির চেহারা। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক দেশে মতামত প্রকাশ করা মানেই প্রাণঘাতী। যাঁরা মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নাছোড় তারা অবধারিত ভাবেই আন্ডারগ্রাউন্ড কৌশলকে কাজে লাগালেন। সেক্ষেত্রে তৃতীয় ধারা তথা ‘ভোমা’ উল্লেখযোগ্য।

 

ঘোষিত জরুরি অবস্থা তৎকালীন সময়ে রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ভাষার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল তারই ফলশ্রুতি নাটকের আন্ডারগ্রাউন্ড চেহারা। আজ ২০২১, অঘোষিত জরুরি অবস্থায় রোজ সকালের শাক-সবজি ব্যাগ থেকে ঘরের একান্ত পরিবেশ সবেতেই আড়িপাতা চলছে। চুপি সারে সংবিধানের অর্জিত অধিকার রাতারাতি হাপিস হয়ে যাচ্ছে। শাষন যন্ত্রের নিষেধাজ্ঞার চোরা চাহনি ব্যক্তি জীবনের সমস্ত গতিবিধিকে যেন বন্দি করতে চাইছে। অধিকার খর্ব হতে থাকা মানুষ তার রোজের জীবনে ঘরের কোনে, পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় দেওয়ালে আটকে। তাই যে প্রশ্নটা সহজ ভাবেই এসে পড়ে তৃতীয় ধারা এ সময়ে কোন গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে? সমাজ জীবনের কোন প্রশ্নকে তৃতীয় ধারা আজ অধিকার বা হক প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে উচ্চারণ করতে চাইছেন?

 

প্রশ্নগুলো এসে পড়ে স্বাভাবিক নিয়মে কারণ একটা সময় তৃতীয় ধারার থিয়েটার কে শহর থেকে গ্রামে ডেকে নিয়ে যাওয়া হত। সে ডাক সহজ জিজ্ঞাসা, ‘আমাদের গ্রামে যাবেন?’

 

গ্রামে অর্থনৈতিক বিভাজন ছিল ফলত সব অংশের চাষিরা হয়তো সব সময় খবর ও পেতেন না নাটকের। গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা ছাত্ররাই এই নাটক তাদের গ্রামে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়ে থাকতেন। তৃতীয় ধারার দর্শক গড়পড়তা শিক্ষিত ও আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল শ্রেণির। নাটকের দর্শক নিদিষ্ট এই শ্রেণির সীমাবদ্ধ চেহারার ফ্রেমে আটকা পরলেও সুযোগ মতো প্রান্তিক ভূমিহীন চাষি কাজ করতে করতে অনায়াসে কাজ ফাঁকি করে নাটক দেখতে চলে আসতে পারতেন। অর্থাৎ সেই ফ্লেক্সেবিলিটি তৃতীয় ধারার তাত্ত্বিক পরিসরে ছিল।

 

বাদল সরকার অভ্যেসের চলনে অনুগত না থাকার কারণে যু্ক্তি-প্রশ্নে নতুন ভাবে দেখার সচেতন প্রয়োগের দিকে এগিয়েছিলেন। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সাথে থাকা, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পাশাপাশি প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ফ্রেমের বাইরে থিয়েটার নিয়ে ভাবনা চিন্তা ও তৃতীয় ধারা সম্পর্কে দর্শনগত অবস্থান, স্পষ্ট মতামতের মধ্যে দিয়ে তাঁর যুক্তি প্রশ্ন ও সচেতন প্রয়োগকে চিহ্নিত করেছে। যুক্তি ও প্রশ্ন বাদল সরকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট যা ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যেই লালিত হয়েছে। স্বচ্ছল শিক্ষিত গোড়া খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান হলেও প্রথাকে মান্যতা দিয়ে প্রশ্নহীন ভাবে কখনও জীবনে চলেননি:

স্কটিশে পড়বার সময়ে ফিজিক্স কেমেষ্ট্রি বায়োলজির সঙ্গে সংঘাতে অনেক দিনের ধর্ম বিশ্বাস কাবু হয়ে এসেছিল। এখানে প্রথম বছরেই সেটা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলো। বাড়ি গেলে রবিবার সকালে গির্জায় যেতাম আগের মতোই, কিন্তু এখন ‘সারমন’ শুনতাম খুঁটিয়ে সমালোচক হয়ে, এবং তাতে বিরোধটা আরো পাকিয়ে উঠলো।[ii]

 

বিরোধ পাকলেও তাঁর প্রশ্ন ও যুক্তি কখনও মাথা নত হয়নি। শহরের নিশ্চিত জীবন পরিসরে রাষ্ট্র শক্তির কড়া নজরদারি এড়িয়ে সুন্দরবন-ভোমা একাকার হয়ে যাওয়া জীবন সম্পর্ক লবণাক্ত শরীর বাঘের আঁচড় না খেতে পাওয়া এত সবের পরে, আবারও স্বপ্ন দেখে। জীবন-বেঁচে থাকার পক্ষে ‘ভোমা’। যার সাথে আমাদের পরিচয় করালেন। টান করা শরীরের প্রতিটি তন্ত্রী দিয়ে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের মতো সমস্ত প্রতিকূলতার ঢেউ টপকে স্বপ্ন উসকে দিতে চায়, যা এত সহজে শেষ হওয়ার নয়:

জানি, তাই আমার স্বপ্ন আছে। স্বপ্ন। ভোমা উঠছে। ভোমা উঠছে। মরচে ধরা কুড়ুল কুড়িয়ে নিচ্ছে হাতে, শান দিচ্ছে। চারি পাশে জঙ্গল। ভোমার চোখে জঙ্গল।

২০২১ সুন্দরবনের জঙ্গল এখন কমে আসছে। প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও ম্যানগ্রোভ সাফ করে বেআইনি ফিশারি, অনিয়ন্ত্রিত ভাবে গাছ কেটে ট্যুরিজিমের নামে যত্রতত্র ইমারত তৈরি শুধুমাত্র যে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের প্রেক্ষাপটকে ধ্বংসের কারণ হিসাবে মজবুত করেছে, তা কিন্তু নয়। ইকোসিস্টেম নষ্ট করার ভৌগোলিক সীমারেখা থাকতে পারে কিন্তু তার ফলাফলের কোন ভৌগোলিক সীমানেই। জাপানে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপের ফল কেবল জাপানের একার সংকট নয়, তামাম দুনিয়ার সংকট কে ডেকে নিয়ে আসে। তবে এই কারণে সমাজের প্রান্তিক অংশের মানুষের ক্ষতির সন্মুখীন হন সব চেয়ে বেশি একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ‘ভোমা’ প্রান্তিক অংশের মানুষ তারা জীবন দিয়ে সে ক্ষতির মুখোমুখি হন।

 

১৯৭৬ সালের সুন্দরবন তার অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজ-জীবন মিলে মিশে আজকের ২০২১-কে সাঁকোর মতো জুড়ে দিয়েছে। ভোগবাদ বনাম সর্বহারা উদ্বাস্তু জীবনের সমীকরণ একই সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে। বাদল বাবু চেতনাকে উসকে দেওয়া ‘ভোমা’ যেন এই প্রজন্ম এই সময়কে প্রশ্ন করছেন উন্নয়ন কতটা এগোলো? ব্যবধান কতটা? ইতিহাস আর বর্তমানের সমীকরণে ‘ভোমা’ একই যাঁতায় পাক খেয়ে চলেছে।

 

[i] রক্ষিত মলয় (সম্পাদিত); শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সাক্ষাৎকার সংগ্রহ; লালমাটি; প্রথম প্রকাশ; কলকাতা ২০১৯; পৃষ্ঠা ২৯৪

[ii] সরকার বাদল; পুরোনো কাসুন্দি; লেখনী; মে ২০০৬; কলকাতা ৭৮; পৃষ্ঠা ৭১

 

  • কোয়েল সাহা, গবেষক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ।

 

  • ছবি : GroundXero Archive।

 

Share this
Leave a Comment