বুজিয়ে নয়, বহমান রেখেই চড়িয়াল খালের সংস্কারের দাবি উঠল


  • July 13, 2021
  • (0 Comments)
  • 1522 Views

বেলাগাম নগরোন্নয়ন চড়িয়াল খালের একাংশকে পরিণত করেছে এক নাগরিক আবর্জনায় ভরা নালায়। সেই খাল পুনরুদ্ধার দূরের কথা, নগরকর্তারা তাকে মুছে ফেলতে চাইছে। খালের একাংশের নীচে হবে টানেল আর খাল বুজিয়ে হবে রাস্তা। এমন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ভিন্নমত পরিবেশকর্মী, বিজ্ঞানী ও সচেতন নাগরিকরা। এই বাস্তুতন্ত্র বিরোধী অপউন্নয়ন নিয়ে কলম ধরলেন নদীকর্মী তাপস দাস

 

আদি গঙ্গার উত্তর পাড়ের গ্রাম রসা। রসা রোড, রসা পোস্ট অফিস ইত্যাদি নামের সাথে রসা নাম জুড়ে রেখেছে তার ইতিহাসকে। রসা গ্রাম এখন পূর্ণ শহর। শুধু শহর নয় রূপালি শহর, টলিউড। আদি গঙ্গার এক পাড়ে টলিউড অন্য পাড়ে পুটিয়ারি। সাবর্ণ চৌধুরীর বোন পুটু রানির যৌতুকে দেওয়া ভূসম্পত্তি এই পুটিয়ারি অঞ্চল। কুঁদঘাটে আদি গঙ্গা থেকে বেরিয়ে পুটিয়ারিকে পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ করে দক্ষিণ দিকে বয়ে গিয়েছে কেওড়া পুকুর খাল। সেই খাল জুলপিয়া হয়ে আরো দক্ষিণে গিয়ে মিশেছে গঙ্গায়। কেওড়াপুকুর খাল থেকে একটি সুতি খাল সোজাসুজি দক্ষিণে মিশেছে চার আলির খাল বা চড়িয়াল খালে। যদিও পুরোনো মানচিত্রে স্পষ্ট, এই খাল এবং ঠাকুরপুকুরের কাছ থেকে উৎপন্ন আর একটি খাল ‘বাঙাল নালা’ যা কালিঘাট-ফলতা রেল পথের নীচ থেকে এসে প্রায় সমান্তরাল ভাবে যুক্ত হয়েছিল কেওড়াপুকুর খালের সাথে। অন্য দিকে চড়িয়াল খাল জোকা-ঠাকুরপুকুর-মহিষগোট বিভিন্ন গ্রাম-জনপদ ছুঁয়ে মিশেছে মূল গঙ্গায়। পরবর্তী সময়ে গঙ্গার জল তল উঁচু হওয়ায় জল নিকাশি ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা যায় তখন আরো একটি খাল খনন করে পুজালির কাছে গঙ্গার সাথে মেশানো হয়। লকগেট তৈরি হয়। খাল এবং লকগেটের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জলসেচ বিভাগের। ষাটের দশকের শেষের দিকে সাউথ সুবার্বন অর্থাৎ বেহালা মিউনিসিপ্যালিটির উদ্যোগে জমি অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে জমির জল বয়ে যাওয়ার চরিত্রকে অনুধাবন করে পুরনো একটি জল বয়ে যাওয়ার পথে চড়িয়ালের সম্প্রসারিত একটি ধারা খনন হয়। কাজ শুরু হয় সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে। যা তার পরবর্তী সময়ে বার বার নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সংস্কার করা হয়েছে।

 

বর্তমানে খালটি কলকাতা কর্পোরেশনের ১২৪, ১২৩ নম্বর হয়ে ১২২ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। এর পোশাকি নাম চড়িয়াল এক্সটেনশন। জলের স্বাভাবিক বয়ে যাওয়ার বেশ পুরোনো মজা পথে এই খাল খনন হওয়ায় সহজে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বর্ষার জল গঙ্গা নদীতে বয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ১১৫, ১২২, ১২৩, ১২৪, ১৪৩, ১৪৪ নম্বর ওয়ার্ড তথা পূর্ব বেহালার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বর্ষার জলকে বয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হয়ে উঠেছিল এই খাল। সঙ্গে এক জীববৈচিত্রের আধার হয়ে ওঠে। ফলে এলাকার প্রান্তিক মানুষের বিকল্প জীবিকার সহযোগী হয়েছিল।

 

মহাত্মা গান্ধী রোড তৈরি হওয়ার পর ধীরে ধীরে বাঙাল নালা গুরুত্ব হারাতে হারাতে বর্তমানে দখলের শিকার। দিনে দিনে কলকাতাও বেড়ে উঠেছে, দক্ষিণবঙ্গের খাল-বিল ‘মানুষের’ কেবলমাত্র ‘মানুষের’ দখলে এসেছে। জলের স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে কংক্রিটের জঙ্গলে। চড়িয়াল খাল সেই কংক্রিটের আগ্রাসনের বাইরে থাকতে পারে না। কলকাতা পুরসভার অধীনস্থ ‘কলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম’-এক (কেইআইআইপি) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পে খালের কিছু অংশকে কংক্রিটের করা হয় এবং পূর্ব বেহালার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা তৈরির মধ্য দিয়ে বিশালাকার কয়েকটি জলাশয়ের মাধ্যমে নিকাশি জলকে পরিস্রুত করে মাছ চাষ করা হবে এবং পরিশেষে জলকে চড়িয়াল খালে ফেলা হবে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। জলাশয় তৈরি সহ প্রচুর নির্মাণ হয় ২০০৫-২০১০ সালের সময়কালে।

 

এই বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্র সংঘ ঘোষণা করেছে ২০২১ সাল থেকে আগামী এক দশক হবে বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের দশক। অথচ বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংস করে যে উন্নয়ন সে ধারণা সমানে চলছে। তেমন এক উন্নয়ন চলছে পূর্ব বেহালা বিধানসভা অঞ্চলে। কেইআইআইপি দুই প্রকল্পে সার্বজনীন প্রাকৃতিক সম্পত্তি (commons) ‘সম্প্রসারিত চড়িয়াল’ খালকে দেখা হচ্ছে শুধুমাত্র শহরের ময়লা বয়ে নিয়ে চলার নর্দমা রূপে।

 

যদিও আবাহাওয়া পরিবর্তন,পরিবেশ দূষণের একের পর এক রিপোর্ট সামনে আসার এই সময়,নদী-খাল-জলাশয় সামগ্রিক পরিবেশ প্রকৃতিকে দেখার প্রয়োজন ছিল সাধারণের প্রাকৃতিক সম্পত্তি বা সার্বজনীন (commons) আর সাধারণ জ্ঞান (common sense) এর দৃষ্টিতে। কোথাও কোথাও ১২ফুট থেকে ৪৫ ফুট চওড়া এই প্রসারিত প্রাকৃতিক পরিবেশকে সম্পূর্ণ বুজিয়ে ৩৫ ফুট নীচ থেকে ২৪০০মিমি পাইপের মধ্য দিয়ে নর্দমার জল বয়ে নিয়ে যাওয়ার আন্ডারগ্রাউন্ড সুয়ারেজ তৈরি করা হচ্ছে। সেই বর্জ্য জলকে পাম্প করে ফেলা হবে চড়িয়াল খালে। সঙ্গে মূল প্রকল্পে কোথাও উল্লেখ না থাকলেও এলাকায় বলা হচ্ছে রাস্তা তৈরি হবে সম্পূর্ণ খাল বুজিয়ে। প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্যকে অঞ্চলের মানুষের অন্তরালে রেখে চলছে বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসলীলা।

 

পরিবেশকর্মীদের মতে, গঙ্গানদীর সাথে সংযুক্ত চড়িয়াল খালের জীববৈচিত্র শেষ করে, খাল বুজিয়ে প্রযুক্তি আর অর্থ নির্ভর এই উন্নয়ন, দীর্ঘ স্থায়ী ও সহনশীল হতে পারে না। গঙ্গার জোয়ার-ভাটার জল বয়ে যাওয়া এই খালে এমন কাজ ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। ক্যানাল অ্যাক্ট ১৮৬৪ অনুসারে এ ধরনের কার্যক্রম খাল-দখলের সমতুল্য।

 

বিজ্ঞানের অগ্রগতির আমাদের দেখিয়েছে গঙ্গা নদীর নীচ দিয়ে মেট্রো রেলপথ হতে পারে, তবে নিশ্চয়ই ৩৫ ফুট নীচে সুয়ারেজের পাইপ লাইনের উপরে চড়িয়াল খালকে বহমান রাখা সম্ভব। বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের এই দশকে এমনি পরিকল্পনা গ্রহণ করা সময়ের দাবি। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার সিয়ল শহরে পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা উড়ালপুল‌ ভেঙে চিয়ংগেচিয়ং (Cheonggyechon) খালকে তার প্রবাহ পথ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা কি সেই কথা ভাবতে পারবে?

 

লেখক একজন পরিবেশ ও নদীকর্মী।

 

Share this
Leave a Comment