গ্রামের সরকার, গ্রাম পঞ্চায়েত কোথায়?


  • June 7, 2021
  • (0 Comments)
  • 2209 Views

একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে, তৃণমূলস্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারকে, সম্পূর্ণ পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগটিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’, ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে আমলাতন্ত্রকে জনগণের মশিহা বানিয়ে তুলতে চাইলে, শেষ বিচারে গণতন্ত্রেরই অপূরণীয় ক্ষতি হয়। লিখছেন দেবাশিস আইচ

 

ইয়াসে বিপর্যস্ত কাঁথি-১ ব্লকের হরিপুর। মৎস্যখটি এলাকাটি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকার সর্বত্র একই ধ্বংসের ছবি। ১০ দিন পরেও হরিপুরে সরকারের দেখা মেলেনি। আনন্দবাজারকে বিডিও তুহিনকান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, “সেতু ভেঙে যাওয়ায় ওই গ্রামে পৌঁছতে সমস্যা হচ্ছে। তবে গ্রামের প্রতিনিধি কেউ ব্লক অফিসে এলে ত্রাণ দেওয়া হবে।” (আবাপ, ৫ জুন ২০২১।)

 

বিডিও-র দিকে আঙুল তুলে লাভ নেই। অতিমারি ও লকডাউন পরিস্থিতিতে বিডিওরা যেন নিধিরাম সর্দার। দপ্তরে কর্মী বাড়তি আবার তাবড় প্রকল্পের জিম্মাদারি তাঁর। অতিমারি ১.০ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। যে কাজ পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যরা করতে পারত, সে কাজ করতে হয়েছে বিডিও কিংবা পুলিশ প্রশাসনকে। নবান্নের নীতিও ছিল তাই। নবান্নই বলি কেন অতিমারিতে সারা দেশেই চলছে এমনই এক ধারা। এবারও সেই একই চিত্র।

 

ইয়াসে বিপর্যস্ত মানুষ ত্রাণশিবিরে যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ দু’বেলা খাবার, জলের বন্দোবস্ত করেছে জেলা প্রশাসন, পঞ্চায়েত। কিন্তু তার বাইরে সিংহভাগ জায়গায় গ্রামের সরকারের, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের খোঁজ মেলেনি। অন্যদিকে, ইয়াসের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ২৭ মে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দুয়ারে ত্রাণ’ কর্মসূচির ঘোষণা করেছিলেন। ৩ মে থেকে শুরু হয়েছে ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি। যা নিয়ন্ত্রণ করছেন সরকারি আধিকারিকরা। সরকার বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচি, কে কত ত্রাণ পেতে পারেন তার হিসেবনিকেশ। তথ্যের এই স্বচ্ছতা থাকলে উপভোক্তাদের সুবিধা,তাঁদের জোর বাড়ে, ঠকিয়ে নেওয়া সহজ হয় না। অন্যদিকে, মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে টাস্ক ফোর্স। আমপান-দুর্নীতিতে ‘কলঙ্কিত’ পঞ্চায়েতকে এই কর্মযজ্ঞ থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ক’দিন আগেই  পিএম টু ডিএম নীতির বিরোধিতা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সঙ্গত কারণেই করেছিলেন। এখানেও কি তেমনই সিএম টু ডিএম নীতির প্রবর্তন হলো না? সবচেয়ে বড় কথা কিছু পঞ্চায়েত প্রধান এবং দলীয় কর্মীর দুর্নীতির দায় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগটির উপর গিয়ে পড়ল। এমন ভাবে দেখতে গেলে তো আর বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া যায় না পূর্ত, সেচ কিংবা সুন্দরবন উন্নয়ন দপ্তরকে। দিঘা-শঙ্করপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটির দিকেও তো মুখ্যমন্ত্রী সর্বসমক্ষে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। কিন্তু, এঁরা ছাড় পেলেন আর পঞ্চায়েতি রাজ ‘চোর’ সাব্যস্ত হয়ে উন্নয়নের কর্মসূচি থেকেই নির্বাসিত হলো! এতো কাজির বিচার!

 

ফলশ্রুতি, পঞ্চায়েতের পর পঞ্চায়েত জুড়ে পানীয় জলের হাহাকার, খাবার, ওষুধ, পোশাকের হাহাকার, মৃত গৃহপালিত পশু পচাগলা শব, নোনাজলে মরা মাছে নরক গ্রামের পর গ্রাম। ১০ দিন পরেও দুয়ারে নেই সরকার। দুয়ারে সরকার বলতে তো পঞ্চায়েতকেই বোঝাত এতকাল। এ যাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রধানত সুন্দরবনের বিস্তৃত এলাকা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলীয় অঞ্চল। ২৮ মে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী জেলায় ১৪৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা ইয়াসের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭৪টি পঞ্চায়েত এলাকা এবং সাগর, পাথরপ্রতিমা, নামখানা, কুলতলি, গোসাবা ব্লক পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় ১৭০০টি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছিল। বিপজ্জনক ও ভাঙনপ্রবণ দ্বীপ ঘোড়ামারা, মৌসুনি থেকেও নদীতীরবর্তী হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবু, বাঁধভাঙা বন্যায় দুটি দ্বীপের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ চরম দুর্দশায় পড়েছেন। ইয়াসের প্রায় ৭২ ঘণ্টা পর স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবাধিকার, ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠন, ক্লাব উত্তরের সন্দেশখালি থেকে দক্ষিণের সমুদ্র তীরবর্তী ঘোড়ামারা, মৌসুনিতে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছতে থাকে। একই ভাবে কাঁথি, রামনগর, খেজুরির বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলেও শুরু হয় ত্রাণের কাজ। প্রায় এক ডজন ছোট সামাজিক সংস্থার মিলিত সংগঠন ‘ইয়াস রিলিফ নেটওয়ার্ক’ ৩০ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ৪,২৩৪টি পরিবারকে শুকনো খাবার থেকে শিশুদের জন্য গুঁড়ো দুধ, মায় দেশলাই-মোমবাতি, শাড়ি-জামাকাপড়ও পৌঁছে দিয়েছে। শুধুমাত্র কুলতলি ব্লকে ৭টি কমিউনিটি কিচেন চালু করা হয়েছে এপিডিআর, অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও গ্রামবাসীদের উদ্যোগে । এছাড়া প্রায় প্রতিটি ব্লকেই  স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্যে গ্রামবাসীরা একাধিক কমিউনিটি কিচেন গড়ে তুলেছেন। নেটওয়ার্কের সদস্য এবং রায়দীঘির বাসিন্দা অরিজিৎ চক্রবর্তী জানান, কোথাও কোথাও স্থানীয় পঞ্চায়েতের থেকেও উদ্যোগী হয়ে এমন গণরান্নাঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তেমন করে চাইলে স্বেচ্ছাসেবীদের রান্নাঘরের জন্য চাল মিলেছে পঞ্চায়েত, বিডিও অফিস থেকে। প্রত্যন্ত অনেক গ্রামে যেখানে বাইরের স্বেচ্ছাসেবীদের পৌঁছনোই সম্ভব নয়, সেখানে প্রাথমিক ভাবে স্থানীয় পঞ্চায়েতই দুর্গতদের সাহায্য করেছে। অন্যদিকে, কুলতলিতে ত্রাণ ও রান্নাঘরের দায়দায়িত্বে থাকা এপিডিআর-এর মিঠুন মণ্ডলের দাবি পঞ্চায়েত ও বিডিওর কাছ থেকে তাঁদের সাহায্য মেলেনি। মৎস্যজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি মেদিনীপুরের ঝর্না আচার্য জানিয়েছেন, দুর্যোগের সময় সরকারি ত্রাণশিবিরগুলিতে পঞ্চায়েত থেকে সব সাহায্যই করা হয়েছে, কিন্তু, দুর্গতরা ঘরে ফিরে আসার পর কোনও সাহায্যই মেলেনি। ত্রিপল যা পাওয়া গিয়েছে তা অপ্রতুল। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি “ঝাঁকে ঝাঁকে” এসে চলেছে শুকনো খাবার নিয়ে। আর তা দেখে হাত গুটিয়ে নিয়েছে পঞ্চায়েত। তাঁর মতে, শুকনো চিঁড়ের বদলে এখন বহু মানুষের কাছে জরুরি হলো ভাত। হাঁড়িকুঁড়ি, পোশাক, বালিশ-তোষক ভেসে গিয়েছে তার প্রয়োজন। প্রয়োজন মশারির। চাহিদা কিংবা পরিকল্পনার অভাবে অতি প্রয়োজনীয় বস্তু অমিল। তিনি জানান, কাঁথি পুরসভা থেকে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বটে তবে তা যথেষ্ট নয়। রান্না, স্নান, ও অন্যান্য প্রাত্যহিক কাজের জন্য জল নেই। গরু-ছাগলের খাবার নেই, জলও নেই। সবই নোনা জলে ডুবে আছে।

 

আর এখানেই প্রয়োজন ছিল পঞ্চায়েতের। কী করতে পারত পঞ্চায়েত? রান্নাকরা খাবার জোগাতে পারত। পোশাক দিতে পারত, পানীয় জল ও স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে পারত। এই যে ‘ঝাঁকে ঝাঁকে’ বিভিন্ন সংগঠনগুলি ত্রাণ নিয়ে আসছে তাদের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে পারত। দিকনির্দেশ করা, অতিদুর্গতদের চিহ্নিত করা এবং সেখানে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে আসা ত্রাণ পৌঁছতে সাহায্য করা, স্থানীয় বাজার থেকে ন্যায্যমূল্যে ত্রাণসামগ্রী কিনতে সাহায্য করা, কী প্রয়োজন আর কী প্রয়োজন নয় সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া, লঞ্চ, যন্ত্রচালিত নৌকার আগাম ব্যব্যস্থা রাখা — মাতব্বরি না করে এমন কাজে নেতৃত্ব দিতেই পারত পঞ্চায়েত। কীভাবে পারত পঞ্চায়েত?

 

বিশেষভাবে ‘সহায় প্রক্রিয়া ও কর্মসূচি’ নিয়ে এগিয়ে এলে গণ-রান্নাঘর থেকে পোশাক-আশাক, পানীয় জল থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা করা যেত। প্রয়োজন মনে করলে তার সঙ্গে জুড়ে নিতেই পারত স্বেচ্ছাসেবীদের। গ্রামের অতিদুঃস্থ বা সহায়-সম্বলহীন এবং কর্মক্ষমতাহীন পরিবারগুলির সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার, পোশাক, বাসস্থান, কাজের উপায়, ও অন্যান্য ন্যূনতম পরিষেবা সুনিশ্চিত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক উদ্যোগ হল সহায় প্রক্রিয়া ও কর্মসূচি। (সূত্র:গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান এবং উপ-প্রধানদের প্রশিক্ষণ উপলক্ষে পাঠোপকরণ, ২০১৫)। বিষয়টি বুঝতে আমরা পঞ্চায়েতের উপরোক্ত প্রশিক্ষণগ্রন্থ থেকে তিনটি ছক তুলে দিচ্ছি। যাতে একনজরে কিছু বোঝা যায়। আর কম পরিশ্রমে বোঝানোও যায়। ২৩টি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে কর্মসূচির খুঁটিনাটি লিপিবদ্ধ করা আছে ওই বইয়ে।

ছক ১

 

ছক ২

 

ছক ৩:

 

এখন যখন গ্রামের পর গ্রাম জলের নীচে, খাদ্যবস্ত্রহীন তখন পঞ্চায়েত কেন এমন কর্মসূচিকে সর্বজনীন রূপ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল না? এর জন্য তো ব্যবস্থাপত্র আছেই। শুধু সেই ব্যবস্থাটিকে এই গভীর সংকটকালে সর্বজনীন করে তোলা। আর তা করতে হলে, যা প্রয়োজন তা হলো উদ্ভাবনী শক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এবং হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তদের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখা।  পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগের এক প্রাক্তন শীর্ষ আধিকারিকের মতে,”বিপর্যস্ত এলাকায় এই কর্মসূচি চালু করাই যায়। একটি আদেশনামা দরকার শুধু। বেসরকারি উদ্যোগে যা হচ্ছে, সেটা তো ‘সহায়-ই’।” ‘টাস্ক ফোর্স’, মন্ত্রী, আমলারা তাঁদের স্ব স্ব শীর্ষস্থান আলো করে থাকুন, কিন্তু গত প্রায় দু’সপ্তাহের ঘটনাবলী প্রমাণ করে যে, সিংহভাগ বিপর্যস্ত মানুষের খাদ্যপানীয়টুকু জোগাড় করে উঠতে পারেনি কোনও সিএম টু ডিএম নীতি। সরকার পঞ্চায়েতের ছিদ্র না খুঁজে সাধারণ গরিব মানুষের বুঝটা নিজেদের বুঝে নিতে দিক। অন্যায় হলে তদন্ত করুক, শাস্তি দিক, দায়বদ্ধ করুক। এবং একই নীতি যেন প্রযোজ্য হয় নবান্নের সর্বস্তরে, প্রতিটি দপ্তরের ক্ষেত্রে। পঞ্চায়েত ও স্বাস্থ্যদপ্তরের এই প্রাক্তন প্রবীণ আমলা সারা দেশেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রীতিনীতির  অবমূল্যায়নে উদ্বিগ্ন। তাঁর মতে, “অভ্যুত্থান বা সরাসরি আঘাত গণতন্ত্রের উপর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হুমকির প্রতীক নয়। প্রকৃত ত্রাস হলো গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি যে অঙ্গীকার তার ক্রমিক ক্ষয়।”  একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে, তৃণমূলস্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারকে, সম্পূর্ণ পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগটিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’, ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে আমলাতন্ত্রকে জনগণের মশিহা বানিয়ে তুলতে চাইলে শেষ বিচারে গণতন্ত্রেরই অপূরণীয় ক্ষতি হয়।

 

Feature image courtesy : Raktim Mondol

 

Share this
Leave a Comment