হিমালয়ের গান্ধী


  • May 21, 2021
  • (0 Comments)
  • 917 Views

ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের পথিকৃৎ, আজীবন গান্ধীবাদী পদ্মবিভূষণ ডঃ সুন্দরলাল বহুগুনা চলে গেলেন কোভিডে। তাঁকে নিয়ে লিখলেন অমিতাভ আইচ

 

“বাস্তুতন্ত্রই প্রকৃত পক্ষে আমাদের সবচেয়ে স্থায়ী অর্থনীতি” বলেছিলেন তিনি, হিমালয়ের প্রকৃতি আর অরণ্যকে রক্ষা করার জন্য হেঁটেছেন হাজার হাজার মাইল। ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের পথিকৃৎ, আজীবন গান্ধীবাদী পদ্মবিভূষণ ডঃ সুন্দরলাল বহুগুনা চলে গেলেন। কোভিড মহামারী শত শত নামী অনামি খ্যাতনামা ও অখ্যাত ভারতবাসীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও নিয়ে গেল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলল ৯৪ বছর।

 

চিপকো আন্দোলন তাকে পরিচিতি দিয়েছিল হিমালয়ের গান্ধী নামে। অথচ তার নিজের কথায় এই আন্দোলন তার নিজের ছিল না, ছিল হিমালয়ের মেয়েদের। আর নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর স্ত্রীও। সেটাই স্বাভাবিক কারণ, সারা জীবন গ্রামে আশ্রম করে থেকে মানুষ ও প্রকৃতির সেবা করব — এই শর্তেই তো তিনি বিয়ে করেছিলেন নিজের স্ত্রীকে। গাছের সাথে শিকল দিয়ে তারা বেঁধে রাখতেন নিজেদের যাতে ঠিকাদাররা সেই গাছ সহজে কেটে না নিয়ে যেতে পারে। এইভাবেই প্রকৃতিকে জড়িয়ে (হিন্দিতে চিপকে) থাকতেন তাঁরা, মেয়েরা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতেন “চিপকো”। পাহাড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যেতো সেই জড়িয়ে যাওয়া মেয়ের দল, ঠিকাদারের সাধ্যকি গাছ কাটে! মহাত্মা তাঁকে শিখিয়েছিলেন, যদি আর কিছু না পারো হাঁটতে থাকো, দেখবে তোমার সাথে জুড়ে যাবে মানুষ। ঠিক তারা ঘর, মহল্লা, পাহাড়ের বাঁকে ছোট ছোট গ্রাম থেকে বেড়িয়ে আসবে একদিন আর হাঁটতে থাকবে তোমার সাথে। পাঁচ হাজার কিমি পাড়ি দিয়েছিলেন সুন্দরলাল হিমালয়ের পথে তার প্রাণ ও প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য। এই যাত্রায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। ইতিহাস সাক্ষী সে সাক্ষাৎকারের ফলেই হিমালয়ের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় পনেরো বছরের জন্য গাছ কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার।

 

কিন্তু উন্নয়নের রাজনীতি ও অর্থনীতি তো থামার নয়। বহুদিন ধরে ঝুলে থাকা তেহেরি বাঁধ করতেই হবে তাদের। কথা ছিল সোভিয়েতের পয়সায় তা  হবে। ততদিনে রাজনৈতিক বিপর্যয়ে  আচ্ছন্ন সোভিয়েত। আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন তাঁর, প্রিয় রাজনৈতিক ও বন্ধু ইন্দিরা। আর নতুন কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে তারাই এই প্রকল্পের ৮০ ভাগ অর্থ জোগাবে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সম্পূর্ণ জলের তলায় নিমজ্জিত হবে প্রাচীন তেহেরি শহর, সুন্দরলালের জন্মভূমি। উপযুক্ত পুনর্বাসনের দাবিতে এবং এই প্রকল্পের হিমালয়ের কোমল বাস্তুতন্ত্রের উপর যে ভয়ানক প্রভাব হতে পারে তার জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠেন সুন্দরলাল। এর পর ভারতের বড় বাঁধ বিরোধী আন্দোলন, নদী আন্দোলন ও তিনি সমার্থক। সত্যাগ্রহ শুরু করেন হিমালয়ের গান্ধী, একের পর এক আমরণ অনশন, কখন নরসিমা রাও আবার কখনও বা দেবগৌড়া বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনশন ভঙ্গ করাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, রাজনীতি ও সত্যাগ্রহের আঙিনা থেকে আদালতের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করে তেহেরি। ২০০১ সালে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে আর জলের তলায় তলিয়ে যেতে থাকে তেহেরি। এই বাঁধ উঠলে শুকিয়ে যাবে ভাগীরথী, বলেছিলেন সুন্দরলাল। বৈজ্ঞানিক তথ্য বলছে তেহেরি বাঁধ ভাগীরথী জলধারাকে আটকে দিয়ে তার মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে।

 

হিমালয়ের প্রকৃতি, মানুষ, মেয়েদের অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের জন্য আজীবন নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন সুন্দরলাল। পরবর্তী প্রজন্মের ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের সকল পথিকেরা তাঁকে পূর্বসূরি মানতেন, গুরুও। একবার কলকাতায় এসে বলেছিলেন ৮০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন এই বাংলার বন্দোপাধ্যায় তাই বাংলার সাথে আমার অন্য যোগাযোগ। সাদা দাড়িতে ঢাকা তাঁর চেহারা অবিকল হিমালয়ের কোনও ঋষিকে মনে করায়। তাঁর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল একটা যুগের। আজ তাঁর মৃত্যুতে চরম শোকাচ্ছন্ন ভারত। যে রাজনৈতিক শক্তি গোটা হিমালয় ও ভারত জুড়ে ধ্বংসের ডঙ্কা নিনাদ বাজিয়ে চলছে, নীতি প্রনয়ণে না মানলেও “বাস্তুতন্ত্রই আসলে অর্থনীতি” একথা উঠে আসছে আজ তাদের মুখেও। আর এখানেই তাঁর ছাপ রেখে গেলেন হিমালয়ের গান্ধী। তাঁর উত্তরসূরি এবং ভারতের মানুষের কাছে এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় বার্তা।

 

Share this
Leave a Comment